ছেলেটার নাম ছিল আদনান।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত—নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে। বিশাল সবুজ ক্যাম্পাস, ঝিলপাড়, পাতাঝরা রাস্তা, আর দোল খাওয়া কাশবন।এই পরিবেশের মধ্যেই গড়ে উঠেছিল তার সৃষ্টিশীল মন। সে কবিতা লিখত, নাটক করত, আর লিখত অসংখ্য চিঠি। সবই সাদিয়া নামের একটি মেয়ের জন্য।
সাদিয়া ছিল এক অন্যরকম মেয়ে—গভীর মায়া ভরা চোখ, মৃদু হাসি, আর একরাশ স্বপ্ন নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়ত। দু’জনের প্রথম দেখা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে আয়োজিত ‘বসন্ত উৎসব’-এ। সাদিয়ার পরনে ছিল হলুদ শাড়ি, কপালে ছোট্ট একটা কলো টিপ। সেই দৃশ্যটা আদনানের মনে গেঁথে ছিল আজীবনের মতো।
বন্ধুত্ব শুরু, তারপর কিছুটা দ্বিধা, আর শেষে প্রেম। তারা হাঁটত ঝিলের পাড় ধরে, ক্যাফেটেরিয়ায় বসে চা খেত, আর কাশবনের ভেতর হারিয়ে যেত নিজেদের কথায়। ভালোবাসাটা ছিল খুব সাধারণ, অথচ গভীর।
কিন্তু সকল সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয় না সবসময়।
সাদিয়ার পরিবার তার জন্য এক প্রবাসী ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করল। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও সাদিয়া পরিবারকে রাজি করাতে পারল না। আদনান ভেঙে পড়েছিল, কিন্তু কিছুটা বিশ্বাস নিয়ে অপেক্ষায় ছিল।
বিয়ের আগের দিন, আদনান বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যমঞ্চের পেছনে পুরনো কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে বসে তার জীবনের শেষ চিঠিটা লিখল।
“সাদিয়া,
কাল তোমার বিয়ে। তুমি হয়তো এখন মেহেন্দির ঘ্রাণে ঘেরা, সাজঘরে বসে আছো। জানি, আমি তোমার জীবনের গল্প থেকে এক অপ্রকাশিত অধ্যায় হয়ে থাকব।
আমি আর কিছু চাই না, কেবল জানাতে চাই-তুমি যেদিন কাশবনে হেঁটেছিলে আমার সঙ্গে, সেদিন আমি মনে মনে চেয়েছিলাম সময় থেমে যাক।
যদি কোনোদিন ঝিলপাড়ে বসে হঠাৎ আমার কথা মনে পড়ে-জেনে নিও, আমি তখনও তোমারই কথা লিখছি কবিতায়।
ভালো থেকো।
-আদনান”*
চিঠিটা পোস্ট করেনি সে। মুড়ে রাখল নিজের কবিতার খাতার ভাঁজে, আর রেখে এল নাট্যমঞ্চের পাশের বেঞ্চের নিচে।
কয়েক বছর পর…
সাদিয়া ফিরেছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, একটা সাহিত্য অনুষ্ঠানে। তার ছেলেটা তখন ছোট, দৌড়ে বেড়াচ্ছে ক্যাম্পাসে। সে হাঁটছিল ঝিলের পাড় ধরে, কাশবনের পাশে এসে দাঁড়াল।
হঠাৎ একটা হাওয়া বয়ে এল-ঠিক সেই পুরনো দিনের মতো। কোথাও যেন একটা অদেখা চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে। দূরে নাট্যমঞ্চটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে, কিছুটা বিবর্ণ, কিছুটা স্মৃতিময়।
সাদিয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। হঠাৎ করেই ই মনে হল-“আদনান কি এখনো কবিতা লিখে? এখনো কি অপেক্ষা করে কারও চিঠির জন্য?”
সেদিন ঝিলের পাশে দাঁড়িয়ে সে বুঝেছিল-সব সম্পর্কের শেষ হয় না বিয়ে বা বিচ্ছেদে। কিছু সম্পর্কের শেষ চিঠি কেবল হৃদয়ের গভীরে চিরকাল নিঃশব্দে কেঁদে যায় অতি নীরবে।

মন্তব্য করতে ক্লিক করুন