আয়ুর সোপানমার্গ বহু কষ্টে অতিক্রম করি
উন্মুক্ত মৃত্যুর প্রান্তে ঊর্ধ্বমুখে দাঁড়ায়েছি এসে;
সিন্ধুর ভাস্বর আঁখি খোঁজে মোরে নিম্নে নিরুদ্দেশে;
আমার আরতিদীপ মহাশুন্যে সাজায় শর্বরী॥
সম্মুখে নিখিল নাস্তি, পৃষ্ঠদেশে মৌল নীরবতা;
প্রশান্তি দক্ষিণে, বামে; জনহীন, অন্তর, বাহির।
তবু কার আবির্ভাবে কণ্টকিত আমার শরীর;
অবচেতনার তলে গুমরে কি জাতিস্মর কথা?
তবে কি বিরাট শূন্য শূন্য নয়, সাগরের প্রেত;
উদ্বেল বিক্ষোভ তার পরিণত বিদেহ ঈথারে?
তবে কি দুর্মর মর্ত্য ক্রন্দসীতে ক্রন্দন বিথারে;
শস্যের মিসরী শবে উপ্ত সম্ভাবনার সংকেত?
নির্লিপ্ত আলোর দ্বীপ নয় ওই দিব্য নীহারিকা,
কালের প্রপাতে মগ্ন বাসনার ভাসমান ফেনা?
অবচ্ছিন্ন তারারাশি, ওরা চিরদিনকার চেনা
পশুদের স্থুল সত্তা, লালসার মূর্ত বিভীষিকা?
নাই নাই মৌন নাই, সর্বব্যাপী বাঙ্ময় জগৎ;
নির্বাণ বুদ্ধির স্বপ্ন, মৃত্যুঞ্জয় জ্বলন্ত হৃদয়;
হয়তো মানুষ মরে, কিন্তু তার বৃত্তি বেঁচে রয়;
জন্ম হতে জন্মান্তরে সংক্রমিত প্রত্ন মনোরথ॥
কপোল কল্পনা ত্যাগ; নিরাসক্তি অসাধ্যসাধন;
অনন্তপ্রস্থান মিথ্যা; সত্য শুধু আত্মপরিক্রমা;
বিদ্রোহে স্বাতন্ত্র্য নাই; মুক্তি মানে নিরুপায় ক্ষমা;
সৃষ্টির রহস্য মাত্র আলিঙ্গন, পুনরালিঙ্গন॥
হৈমন্তী
বৈদেহী বিচিত্র আজি সংকুচিত শিশিরসন্ধ্যায়
প্রচারিল আচম্বিতে অধরার অহেতু আকূতি:
অস্তগামী সবিতার মেঘমুক্ত মাঙ্গলিক দ্যুতি
অনিত্যের দায়ভাগ রেখে গেল রজনীগন্ধায়॥
ধূমায়িত রিক্ত মাঠ, গিরিতট হেমন্তলোহিত,
তরুণতরুণীশূন্য বনবীথি চ্যুত পত্রে ঢাকা,
শৈবালিত স্তব্ধ হ্রদ,নিশাক্রান্ত বিষণ্ন বলাকা
ম্লান চেতনারে মোর অকস্মাৎ করেছে মোহিত॥
নীরব, নশ্বর যারা, অবজ্ঞেয়, অকিঞ্চন যত,
রুচির মায়ায় যেন বিকশিত তাদের মহিমা;
আমার সঙ্কীর্ণ আত্মা, লঙ্ঘি আজ দর্শনের সীমা,
ছুটেছে দক্ষিণাপথে যাযাবর বিহঙ্গের মতো॥
সহসা বিস্ময়মৌন উচ্চকণ্ঠ বিতর্ক, বিচার,
প্রাণের প্রত্যেক ছিদ্রে পরিপূর্ণ বাঁশরীর সুর:
জানি মুগ্ধ মুহূর্তের অবশেষ নৈরাশে নিষ্ঠুর;
তবু জীবনের জয় ভাষা মাগে অধরে আমার॥
যারা ছিল একদিন; কথা দিয়ে, চ’লে গেছে যারা;
যাদের আগমবার্তা মিছে ব’লে বুঝেছি নিশ্চয়;
স্বয়ম্ভূ সংগীতে আজ তাদের চপল পরিচয়
আকস্মিক দুরাশায় থেকে থেকে করিবে ইশারা॥
ফুটিবে গীতায় মোর দুঃস্থ হাসি, সুখের ক্রন্দন,
দৈনিক দীনতা-দুষ্ট বাঁচিবার উল্লাস কেবল,
নিমেষের আত্মবোধ, নিমেষের অধৈর্য অবল,
অখণ্ড নির্বাণ-ভরা রমণীর তড়িৎ চুম্বন॥
মোদের ক্ষণিক প্রেম স্থান পাবে ক্ষণিকের গানে,
স্থান পাবে, হে ক্ষণিকা, শ্লথনীবি যৌবন তোমার:
বক্ষের যুগল স্বর্গে ক্ষণতরে দিলে অধিকার;
আজি আর ফিরিব না শাশ্বতের নিষ্ফল সন্ধানে॥
অকৃতজ্ঞ
আমার মৃত্যুর দিনে কৌতূহলী প্রশ্ন করে যদি-
সাধিলাম কি সুকৃতি, হব যার প্রসাদে অমর?
মেনে নিও মুক্ত কণ্ঠে, নেই মোর পাপের অবধি;
সারা ইতিহাস খুঁজে মিলিবে না হেন স্বার্থপর॥
অজস্র ঐশ্বর্য মোরে অর্পিয়াছে সমুদার বিধি;
ভুঞ্জেছি নিষ্কুন্ঠ মনে সে-সকলই প্রাপ্য ভেবে আমি।
পেয়েছি অমিত সুধা আমন্থিয়া কালের বারিধি;
করেছি তা আত্মসাৎ, শুধু বিষ কণ্ঠে গেছে থামি॥
দেখেছি এ-মরচক্ষে নটরাজ মহাশূন্যে নাচে;
শুনেছি পার্থিব কানে সে-নক্ষত্রনুপূরের ধ্বনি।
তথাপি আমার বীণা বাজায়েছে বেসুর পিশাচে;
অধরার অনুনাদে সাড়া কভু দেয়নি ধমনী॥
ফাল্গুন অঙ্গনে মোর ছড়ায়েছে অশোক পলাশ।
দক্ষিণের বাতায়নে কৃষ্ণচূড়া হেনেছে বৈশাখ।
জাগায়ে মেদুর মেঘে চপলার চকিত বিলাস
বিকচ কদম্বকুঞ্জে আষাঢ় দিয়েছে মোরে ডাক॥
শেফালিরঞ্জিত হস্তে নবান্নের নৈবেদ্য এনেছে
অতিক্রমি কাশবন সিতাম্বর শ্যামল আশ্বিন।
কাননে ছড়ায়ে সোনা উদাসী অঘ্রান চ’লে গেছে
পৌষের পাথেয় দিতে সর্বহারা হয়েছে বিপিন॥
তথাপি অভাব মোর মিটে নাই মুহূর্তের তরে;
অপব্যয়ী প্রকৃতির অরক্ষিত দানসত্র থেকে
অপহরি মহাবিত্ত আনিয়াছি বৎসরে বৎসরে
অন্তর্ভৌম কোষাগারে মরুলুপ্ত সুড়ঙ্গের পথে॥
সে-উদার দৃষ্টান্তেও হয় নাই কার্পণ্য লজ্জিত,
সন্দেহের অবকাশ পায় নাই গৃধ্নুতা আমার।
ফিরেছি ধনীর দ্বারে অপলাপী চীবরে সজ্জিত,
বলেছি নাটকী স্বরে, বিশ্বে শুধু সত্য অবিচার॥
অন্তরঙ্গ সখাসম ফুলধনু আমার ইঙ্গিতে
ফুটায়েছে পারিজাত হিমরুক্ষ তুঙ্গ তপোবনে;
স্বয়ংবরা শৈলসুতা এসেছে কৌমার্য নিবেদিতে;
টুটেছে দুঃস্বপ্ন মোর ব্রহ্মান্ডের মঙ্গলাচরণে॥
তবু মোর নীল কণ্ঠে উঠে নাই কামোদ ঝংকারি;
অনভ্যস্ত রসনায় উৎসরিত হয়নি দীপক।
মোর প্রিয়সম্ভাষণে বিরহের আশঙ্কা সঞ্চারি,
অন্তরের দ্বার জুড়ে হেসেছে অশ্লীল বিদূষক॥
গোপন বৈভব আমি ব্যক্ত কভু করিনি প্রিয়ারে;
বুঝি নাই বিনিময়, বিনা বরে কুড়িয়েছি পূজা;
অভিব্যাপ্ত ক্ষুধা মম অবরোধে ঘিরেছে তাহারে;
পরিতৃপ্তি বিতরিতে পারেনি স্বয়ং দশভূজা॥
নিমেষ না যেতে তাই ফুরায়েছে প্রথম আবেশ;
উন্মীলিত বিলোচন জ্বলিয়াছে বিপ্রবলব্ধ লোভে,
অচিরাৎ সে-আগুন কামেরে করেছে ভস্মশেষ;
অপর্না সেজেছে চণ্ডী আত্মহিতে মোর উপদ্রবে॥
কেবলই চেয়েছি আমি, ক্ষতি কভু ছোঁয়নি আমারে;
কোনোদিন বজ্রাঘাতে সর্বস্বান্ত করেনি উর্বশী;
মোর তারাদীপাবলী মূলাধার অমার ফুৎকারে
কখনো যায়নি নিবে, ধ্বংসমূক হয়নি ক্রন্দসী॥
শিখিনি কদাচ আমি কাম্য যার নিশ্চিন্ত অমরা,
অনির্বাণ কুম্ভীপাকে হতে হয় তাহারে নিখাদ।
শুধুই জঞ্জালে তাই ভরিয়াছি প্রাণের পসরা;
গায়ত্রী জপেছি, কিন্তু শোনা গেছে নিরর্থ নিনাদ॥
আমার মৃত্যুর দিনে, তাই যদি অলস জিজ্ঞাসু
মাগে শবপরিচিতি, বিনা ভাষ্যে বোলো তারে, সখা,-
জগতের কোনো কাজে লাগেনি এ-অখ্যাত গতাসু,
যায়নি অনাথ ক’রে কোনো মৌন হৃদয়-অলকা॥
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন