সত্য কুম্ভকার

গল্প - কাঁচের ঝাড়লন্ঠন

সত্য কুম্ভকার
বুধবার, ২০ আগস্ট ২০২৫ রহস্য

​পুরোনো বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে সুগতর পায়ের নিচে পুরোনো কাঠ মচমচ করে উঠল। এই বাড়িটা তার দিদিমার, যেটাকে তিনি এক অদ্ভুত শর্তের কারণে বিক্রি করতে পারছিলেন না। শর্তটা ছিল খুব সরল, অথচ অদ্ভুত—বাড়ির ড্রয়িংরুমের মাঝখানে ঝোলানো প্রকাণ্ড কাঁচের ঝাড়লণ্ঠনটি অক্ষত অবস্থায় বিক্রি করতে হবে।
​এই ঝাড়লণ্ঠন কোনো সাধারণ জিনিস ছিল না। তার দিদিমা বলতেন, ‘এর ভেতর অনেক কিছু আটকে আছে, সুগত।’ সুগত তখন এসব কথা গুরুত্ব দিত না। ঝাড়লণ্ঠনটার প্রতিটি কাঁচের ফলকে যেন হাজারটা জোনাকি আলো জ্বলে। কিন্তু সে আলোয় কেমন যেন এক বিষণ্ণতা।
​একদিন রাতে সুগত যখন ঝাড়লণ্ঠনের দিকে তাকিয়ে ছিল, তখন সে দেখতে পেল, প্রতিটি কাঁচের টুকরোর ভেতরে এক একটা ছোট্ট জগৎ। একটিতে দেখা যাচ্ছে এক দম্পতি হাতে হাত ধরে হাসছে, আরেকটিতে এক শিশু ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, আবার অন্যটিতে এক বৃদ্ধা একা বসে সেলাই করছেন। এরা সবাই একই সময়ে, একই ফ্রেমে বন্দী।
​সুগত বুঝতে পারল, তার দিদিমার কথার মানে কী। এই ঝাড়লণ্ঠন আসলে সময়ের কারিগর। যে মানুষগুলো তাদের জীবনের সবচেয়ে সুখের বা দুঃখের মুহূর্তে ঝাড়লণ্ঠনের নিচে দাঁড়িয়েছে, তাদের সেই মুহূর্তগুলো কাঁচের টুকরোর ভেতরে চিরকালের জন্য আটকে গেছে। এক ধরনের আত্মারা এতে বন্দী।
​কিন্তু এর পেছনে একটা রহস্য ছিল। কিছু কিছু কাঁচের টুকরো ছিল কালো, অস্বচ্ছ। সুগত যতবারই সেগুলোর দিকে মনোযোগ দিয়েছিল, তার মাথা ধরে আসছিল। সে বুঝতে পারছিল না এই কালো কাঁচগুলো কীসের প্রতীক।
​রাতে সুগত স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নে দেখল তার দিদিমা কাঁদছেন আর বলছেন, ‘আমি চাইনি, সুগত… আমি চাইনি…’
​পরের দিন সকালে সুগত তার মায়ের পুরোনো ডায়েরি খুঁজে বের করল। সেখানেই সে পেল আসল রহস্য। তার দিদিমার এক ছোট বোন ছিল, যে খুব অল্প বয়সে আত্মহত্যা করেছিল। সে ঝাড়লণ্ঠনের ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে গলায় দড়ি দিয়েছিল। ডায়েরিটা শেষ হয় এই লাইনে, “ঝাড়লণ্ঠনটা ওর আত্মার অন্ধকারটুকু আটকে রেখেছে। কিন্তু দিদিমা এখনো ভয় পায় যে এই অন্ধকার একদিন সব আলোকে গ্রাস করবে।”
​সুগত ডায়েরিটা বন্ধ করে ঝাড়লণ্ঠনটির দিকে তাকাল। সেই কালো কাঁচগুলো এখন যেন আরও গাঢ় আর কালো দেখাচ্ছে। এক অদৃশ্য ভয়ের ঢেউ তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল।
​ঝাড়লণ্ঠনটির দিকে তাকিয়ে সুগতর মনে হলো, শুধু দিদিমা নন, সে নিজেও এখন এই রহস্যের শিকার। সেই রাতে ঝাড়লণ্ঠনের দিকে তাকাতেই তার মনে হলো, একসময় তার নিজের মুখও ওই কাঁচের টুকরোগুলোর মধ্যে ধরা পড়বে। সে কি হাসছে? নাকি কাঁদছে? আর তার সেই মুহূর্তটি কি কালো কাঁচের অংশে মিশে যাবে?

২৬
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন