ছেঁড়া ছই
ছেঁড়া ছই
মানব মন্ডল

গল্প - ছেঁড়া ছই

মানব মন্ডল
বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫ জীবনবাদী, ভালোবাসা

নৌকার ছইয়ে বসে বৃষ্টি উপভোগ করার আনন্দই আলাদা, তার ওপর পাশে ছিলো শ্রাবন্তী। নৌকায় ভীড় পাতলা ছিলো। এখন পুরো ফাঁকা হয়ে গেলো। হঠাৎ  ও আমার কাধে মাথা রাখলো। মাঝি ভাই দেখে হাসলো। ও আমার হাতে আর শক্ত করে চেপে আমার দিকে তাকলো। ওর চোখে একটা পরম নির্ভরতা দেখতে পেলাম। মনে মনে খুব ভালো লাগলো। সুখ আলাদা।
মনে মনে বললাম “তুমি যদি হও মাঝি, আমি সারাজীবন নৌকা হয়ে থাকতে রাজি। দুলে দুলে দু’জনেই ভালোবাসার জীবনের নদীতে ভেসে যাবো আজীবন।নৌকা যেমন মাঝির ওপর নির্ভরশীল, তেমনি জীবনও নির্ভর করে সঠিক দিকনির্দেশনার ওপর।”
ও দুই বছরের মধ্যেই আমার জীবন পাল্টে দিয়েছে।আমি জীবন নিয়ে উদাসীন ছিলাম। হিপ্পি ক্যালারে বিশ্বাসী ছিলাম। পঞ্চাশের দশকে ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় আমেরিকায় রক্ষণশীলতা ও দমনপীড়ন বৃদ্ধি পেয়েছিল। সাহিত্যের ওপর চলছিল কাটাছেঁড়া বা সেন্সরশিপ। শিল্প-সংস্কৃতির অন্যান্য মাধ্যমও কাটছাটের প্রকোপে আহত হয়েছে। ফলে ভোক্তাবাদ বা কনজিউমারিজম বেড়েছে দিনের পর দিন। বলে ষাট সত্তর দশকে তৈরি হয়েছিল এক নতুন প্রজন্মের।

ষাট ও সত্তরের দশকে মার্কিন তরুণ প্রজন্মকেই মূলত হিপ্পি বলা হয়তো। এই তরুণ প্রজন্মের চোখে  বিপ্লবের স্বপ্ন, ছিল সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাছিল। হিপ্পি আন্দোলন শুধু মার্কিন দেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি ছড়িয়ে পড়েছিল দেশ থেকে দেশান্তরে। আর সেসব দেশেও সৃষ্টি হয়েছিল বিদ্রোহ মনো-ভাবাপন্ন এক নবতর স্বাপ্নিক আন্দোলন। হিপ্পি আন্দোলনে কোন লিখিত ইশতেহার বা কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল না শুধু ছিল পরিবর্তনের জন্য হাহাকার। হিপ্পি সৃষ্টি হওয়ার মূল কারণ; কর্পোরেট ভোগবাদ, আমেরিকার ভিয়েতনাম যুদ্ধ, এর আগে দুইটি বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ সবকিছু পরিহার করে পরি-ভ্রমণশীল একটি সহজ জীবনধারার এক তীব্র আকুতি।

যুদ্ধ ও সহিংসতার বিপরীতে তারা “ভালোবাসা তৈরি করো, যুদ্ধ নয়” স্লোগানকে সমর্থন করত।
হিপ্পিরা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং নিজের পছন্দ অনুযায়ী জীবনযাপনকে উৎসাহিত করত। তাদের মধ্যে যৌন মুক্তি, সম্প্রদায়ের মাধ্যমে জীবনযাপন এবং অপ্রচলিত জীবনধারা দেখা যেত। এরা সমাজের প্রথাগত নিয়মকানুনের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল।
১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এবং ১৯৭০ এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই আন্দোলন চরম শিখরে ছিল। হিপ্পি ট্রেইল নামে একটি পথ ছিল, যেখানে ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক তরুণ-তরুণী ভারত, নেপাল ও অন্যান্য এশীয় দেশগুলোতে ভ্রমণে আসতো এবং জীবন ও নিজের সম্পর্কে নতুন কিছু শিখত।

১৯৬২ সালেল টিমোথি লেয়ারি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে হ্যালুসিনেশনের বৈজ্ঞানিক দিক নিয়ে অধ্যয়ন আরম্ভ করেন। ১৯৬৪ সালে আমেরিকান হিপ্পিরা শোনে দ্যা বিটলস ও দ্যা রোলিং স্টোনের গান। মাদক ও সংগীতের ব্যাপক প্রভাব পড়ে হিপ্পিদের জীবনযাত্রায়। রক, ব্লুজ, ফোক সংগীতেও বড় ধরনের বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলে। অনেকগুলো হিপ্পি ব্যান্ড সংগীত দল গড়ে উঠেছিল সেই সময়।দ্যা ডোরস, দ্যা গ্রেটফুল ডেড, দ্যা ভেলভেট আন্ডারগ্রাউন্ড।  অনেক আন্ডারগ্রাউন্ড সংগীত দল জন্ম নেয় সেই সময়। বিশেষ করে সাইকেডেলিক সংগীত ও আধ্যাত্মিকতা হিপ্পিদের আন্দোলিত করে।

এরা একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিল Haight Independent Proprietors (HIP)। মূল ধারার ব্যবসায়ীরা হিপ্পিদের ব্যবসায় গ্রহণ করে নি বিকল্প হিসেবে হিপ্পি এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। হেডশপ প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে হিপের অবদান। এই হিপকেই সাংবাদিকরা ‘হিপ্পি’ বলে চিহ্নিত করেন। কিন্তু ১৯৬৫ সালে সানফ্রান্সিসকোর নতুন ও অপ্রথাগত জীবনধারায় অভ্যস্ত শিশু-কিশোরদের হিপ্পি বলে অভিহিত করা হয়। ‘‘A New Haven forBeatniks’’ নামের একটি সাংবাদিক গদ্যে প্রথম হিপ্পি জনগোষ্ঠী অর্থে ব্যবহার করা হয় Hippies।রাজনৈতিকভাবে হিপ্পিরা জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বিশ্বাস করত আমেরিকানিজম ত্রুটিপূর্ণ। তারা হতে চেয়েছে বৈশ্বিক। নিজেদের চিন্তা, কাজ ও অভিজ্ঞতাকে গ্লোবালি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে।

আমি জীবনটাওদের মতো ভবঘুরে করে নিয়েছিলাম।  আমি দেখেছিলাম ভারত বর্ষ মতো দেশে বাম পন্থী আন্দোলন সবচেয়ে বড় বাধা হলো জাতীয়তাবাদ কারণ দেশটা ভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তি তে। তাই একটা তিক্ত স্মৃতি আছে এখনো আমাদের মধ্যে। আমার মনে মধ্যে একটা শব্দ লুকিয়ে থাকা সব সময়, ও হিন্দু আমি মুসলিম।

ও সব পরিবর্তন করে দিলো। দুই বছর মধ্যে আমি
পৃথিবীর বদলের স্বপ্ন ভুলে  নিজেকে বদলাতে শুরু করলাম। আমার পরিবার ওকে মেনে নিয়েছেন। আমাদের বিয়ে তখন সামনেই। আমরা ওর বন্ধু বিয়ে বাড়িতে গেলাম। ওরা আমাদের একটা আলদা ঘরে শুয়তে  দিয়ে ছিলো। ওর নরম বুক মুখ ডুবিয়ে শুয়ে আছি। হঠাৎ অনুভব করলাম  ও চোখ মুচ্ছে। এমন আবেগ ঘন মুহুর্তে কাটানোর পর ওর চোখ জল কেন প্রশ্ন করাতে । ও বললো। “আমাদের বিয়েতে আমার কন্যা দান কে করবে।!!” 

আমার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর ছিলো। সংবাদিক চাকরি করি। মুখ্যাজী বাড়িতে হাজির হলাম সেই পরিচয় নিয়ে।  জমিদার বাড়ি গুলোর ওপর লেখা লেখি করবো বলে। ওর বাবা সাথে আলাপ হলো খুব সহজেই। সব ভাইয়েরা চাকরি বাকরি করলেও। উনি এখনো চাকরি যোগ দেয় নি। পুরহিত আর জোতির্বিদ হিসাবে কর্ম জীবন বেছে নিয়েছেন। আশে পাশের  জমিদার বাড়ির কুল পুরহিত  এখন উনিই সেই সুত্রে লেখা লেখি  সাহায্য প্রতিশুতি দিলেন উনি। আমি পুরো পরিবারের সাথে আলাপ সেরে নিলাম।
সুযোগ বুঝে ওকে নিয়ে হাজির হলাম মুখ্যাজী বাড়িতে। সবাই খুব খুশি। ও নিজেই ভুলে গেছিলো ওটা যে ওদের বাড়ি।  আজ ওকে আবার তৃতীয় বার ওকে নিয়ে আসলাম ওর বাড়িতে। ওর বাবা কন্যা দান করবে না বলে দিয়েছেন। ওর ছোট কাকা করবে কন্যা দান। আমাদের বিয়েতে। এ বাড়ি থেকে বিয়েটা আমাদের হবে  বলে ওরা বলছে। কিন্তু ওর মা দিদা এ বাড়ি থেকে বিয়ে দিতে চাইছেন না। সেটা নিয়ে আলোচনা করতে এসেছি আমরা ওর কাকাদের সাথে। কারণ ওর বাবা যদি ওর মাকে একবার বলে তাহলে ফিরে আসবে উনি এ বাড়িতে।
পারিবারিক জিটল আলোচনা শেষে। ওর কাকা বললো উনারা সব কিছু দেখে নেবে আমাদের কিছু  ভাবতে হবে না। ভাই বোনদের সাথে খুনসুটি, আমার কাছে একটু আদর ভালবাসা পেয়ে ও খুব খুশি খুশি ছিলো। হঠাৎ উস খুসকো মুখ নিয়ে হাজির হলো যেনো ঝড়ে বিধস্ত নৌকা ও। আমাকে নিয়ে বেড়িয়ে এলো বাড়ি থেকে।
কোন নৌকা ছাড়বে না বলছিলো।  বৃষ্টি শুরু হয়েছে যে খুব। ও চারগুণ ভাড়া দিতে রাজি হলো।
একজন মাঝি রাজী হলো ও মুখ্যাজী বাড়ির মেয়ে বলে। ও চোখ লজ্জা ভয়কে তোক্কা না করে আমাকে জরিয়ে বসে থাকলো নৌকায়। ছই তোলায় যদিও অন্ধকারটা অনেক ঘন। কিন্তু অনুভব করলাম ও কাঁদছে। ছই এর বাইরে যে অনেক জোরে ঝড় চলছে সেটা যেমন বুঝতে পারলাম।
জানতে পারলাম ওর বাবা কাউকে বলছিলেন। “২২ বছর আগে এই মেয়ের জন্য আমি রমাকে ত্যাগ করছিলাম। আজ ওর মেয়ে আবার প্রমাণ করে দিলো। ও মেয়ে আমার না। আমার মেয়ে হলে, ও মুখ্যাজী বাড়ি মেয়ে হলছ কোন দিন একটা অব্রাহ্মণ ছেলেকে বিয়ে করতে পারতো না। ওটা রক্তের দোষ। ”
ছইয়ে অন্ধকারে আমি হারিয়ে ফেলাম এক হবার স্বপ্ন। জীবন হলো জলের নৌকা! কখনো সুখের পাল তুলে, কখনো কষ্টের স্রোতে ভাসে। কখনো ছুটে যায় ভালোবাসার টানে, কখনো থেমে যায় অজানা অভিমানে।ভালোবাসা কেবল নিজের ভালো থাকার নাম নয়, বরং অন্যকে ভালো রাখার এক অনন্য সাধনা। যে হৃদয় অন্যের হাসিকে নিজের আনন্দ মনে করে, যে চোখ অন্যের স্বপ্নকে নিজের আলোতে ভরিয়ে দেয়, সেই ভালোবাসাই হয় নির্মল, নিঃস্বার্থ ও পূর্ণতার।

ভালো থাকার চেষ্টা মানুষকে একা করে দেয়, কিন্তু ভালো রাখার চেষ্টা মানুষকে এক অপূর্ব বন্ধনে বেঁধে ফেলে। সেখানে থাকে না কোনো হিসেব, থাকে শুধু মমতার স্পর্শ, যত্নের উষ্ণতা আর নিঃশব্দ এক শান্তির ঢেউ।

অন্যকে ভালো রাখার আনন্দে নিজেও ভালো থাকা যায়, আর সেই সুখ হয় গভীর—যেন এক অন্তর্নিহিত আলো, যা বাইরে ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীটাকেও আলোকিত করে। আমাদের বিচ্ছেদ যখন অনেক গুলো মানুষের সুখের থাকার কারণ হবে তখন নিজের সুখের কথা ভাবি কি করে।

,,,,,

পরে পড়বো
৩৭
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন