শহরের ব্যস্ততম একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে সদ্য চাকরি পেয়েছে স্নিগ্ধা।
প্রথম দিন সকাল থেকেই ভয় আর কৌতূহলের মিশ্রণ। নতুন জায়গা, নতুন মানুষ—কেমন হবে, কেউ জানে না।
লিফট থেকে নেমে যখন অফিস ফ্লোরে ঢুকল, চারপাশে কাঁচের দেয়াল, ব্যস্ত মানুষ, কীবোর্ডের টুংটাং শব্দ।
একটু দিশাহারা হয়ে ডেস্ক খুঁজছিল সে। হঠাৎ পাশ থেকে এক শান্ত কণ্ঠ—
— “এই দিকে আসুন, আপনার সিটটা এখানে। আমি রাহুল, আপনার টিমমেট।”
চোখ তুলে তাকাতেই সে দেখল এক অচেনা হাসি। স্নিগ্ধ চোখদুটো যেন আলাদা করে আলো ছড়াচ্ছে।
স্নিগ্ধা হালকা সংকোচ নিয়ে বসে পড়ল।
দিন গড়াতে গড়াতে অফিসের প্রজেক্ট, মিটিং আর কফি-ব্রেকে রাহুল আর স্নিগ্ধার আলাপ বাড়তে লাগল।
সাধারণ সহকর্মী হয়েও অদৃশ্য এক টান তৈরি হচ্ছিল।
লাঞ্চে একসাথে বসা, প্রজেক্টের ডেডলাইনে রাত জেগে কাজ করা, মাঝেমধ্যে চোখে চোখ পড়ে হেসে ফেলা—
সবকিছু যেন নিঃশব্দে জমে উঠছিল অন্য কিছুর ইঙ্গিতে।
একদিন সন্ধ্যায় ডেডলাইন শেষ করে সবাই চলে গেল। অফিস ফাঁকা, শুধু দুজন বসে আছে জানালার পাশে।
শহরের আলো ঝলমল করছে কাঁচের দেয়াল ভেদ করে।
রাহুল হঠাৎ কিছু না বলে চুপচাপ তাকিয়ে রইল স্নিগ্ধার দিকে।
সেই চোখে ছিল অদ্ভুত কোমলতা, এক অদৃশ্য স্বীকারোক্তি।
কোনো শব্দ উচ্চারণ হলো না, কিন্তু স্নিগ্ধার বুক ধক করে উঠল।
মনে হলো— সেই নীরব চোখ বলছে,
“ভালোবাসি।”
সেদিন থেকেই স্নিগ্ধার পৃথিবী বদলে গেল।
অফিসের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত তার কাছে হয়ে উঠল অদ্ভুত উজ্জ্বল—কারণ সেখানে রাহুল আছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাহুল আর স্নিগ্ধার সম্পর্ক শুধু অফিসের সীমার ভেতরে থাকল না।
লাঞ্চ ব্রেকের আড্ডা, কফি মেশিনের সামনে ছোটখাটো খুনসুটি, কিংবা মিটিং শেষ হলে একসাথে বাসে ফেরা—
সবকিছুই যেন নিঃশব্দে তাদের কাছে বিশেষ হয়ে উঠছিল।
কিন্তু সেই বিশেষত্বেই শুরু হলো অদ্ভুত টানাপোড়েন।
একদিন বড় একটি প্রজেক্টের প্রেজেন্টেশন ছিল। টিম লিড হিসেবে রাহুল ব্যস্ত ছিল, আর স্নিগ্ধা প্রেজেন্টেশনের ফাইল তৈরি করছিল।
মিটিং চলাকালীন রাহুল সবার সামনে স্নিগ্ধাকে হালকা একটা ভুলের জন্য ধমক দিয়ে ফেলল—
— “এই গ্রাফটা ঠিকভাবে অ্যানালাইসিস করতে বলেছিলাম, তুমি মনোযোগ দাওনি।”
সবার সামনে এই কথায় স্নিগ্ধার বুক কেঁপে উঠল।
চোখে জল চলে এসেছিল, তবু মুখ ঢেকে রেখেছিল ফাইলের আড়ালে।
মিটিং শেষে সে চুপচাপ নিজের ডেস্কে ফিরে এলো।
রাহুল তখন এগিয়ে এসে বলল—
— “এত সিরিয়াস হও কেন? অফিসে এসব ছোটখাটো ভুল নিয়ে আমি তো কিছু মনে করি না।”
স্নিগ্ধা কাঁপা গলায় বলল—
— “তুমি মনে না করলেও আমি করি। তুমি তো আমার কাছে শুধু অফিসের বস নও, তার থেকেও অনেক বেশি।”
রাহুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার বাইরে তাকাল।
— “কিন্তু অফিসের বাইরে সম্পর্ক মানে আরও দায়িত্ব, আরও বোঝাপড়া। তুমি কি সেটা করতে পারবে?”
স্নিগ্ধা অবাক হয়ে তাকাল—
— “তাহলে এতদিনের সবকিছু? তোমার চোখের সেই নীরব ভাষা? তোমার কাছে কি সবটাই অফিসের খেলা ছিল?”
রাহুল কিছু বলল না। শুধু নিঃশব্দে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল।
সেদিন থেকে তাদের মাঝে অদ্ভুত দূরত্ব তৈরি হলো।
একসাথে কাজ করতে হলেও কথা কমে গেল, চোখের মিলন এড়িয়ে যেতে লাগল দুজনেই।
কাজের অজুহাতে ধীরে ধীরে জমতে লাগল অভিমান, অভিযোগ আর অবহেলার পাহাড়।
রাহুল হয়তো ভেবেছিল, এভাবে ধীরে ধীরে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা সহজ হবে।
কিন্তু স্নিগ্ধার কাছে এটি ছিল ভয়াবহ দুঃখের রায়—
যেন ভালোবাসার আদালতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি ঘোষণা করা হয়েছে।
তার বুকের ভেতর কেবল একটিই কথা বাজছিল—
“তুমি আমাকে অপ্রেমের দায়ে অভিযুক্ত করলে, অথচ আমি তো শুধু তোমাকেই ভালোবেসে গিয়েছি।”
অফিসের প্রতিদিনের ব্যস্ততা চলতেই থাকে—ডেডলাইন, মিটিং, নতুন প্রজেক্ট।
বাইরে সবকিছু স্বাভাবিক দেখালেও ভেতরে স্নিগ্ধার পৃথিবী ভেঙে গেছে।
রাহুল এখনো সহকর্মী, এখনো একই টিমে কাজ করে, কিন্তু তার চোখে সেই আলো নেই, সেই কোমলতা নেই।
একদিন কাজের শেষে সবাই বেরিয়ে গেলে ফাঁকা অফিসে স্নিগ্ধা একা বসেছিল।
কম্পিউটারের স্ক্রিনে খোলা ফাইল, কিন্তু চোখ ফাঁকা তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ পিছন থেকে রাহুল এসে দাঁড়াল।
— “এত দেরি করছ কেন? বাসায় যাবে না?”
স্নিগ্ধা শান্ত কণ্ঠে বলল—
— “কাজ শেষ করতে হবে। আর বাসায় গিয়ে বা কী করব?”
রাহুল কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল।
দুজনের মাঝখানে এক অদৃশ্য দেয়াল যেন দাঁড়িয়ে রইল।
সেদিন রাতে স্নিগ্ধা নিজের ডায়েরিতে লিখল—
> “অবহেলা, অবজ্ঞা, অভিমান, অভিযোগ—
সব বুকে নিয়েই তোমাকেই বাঁচিয়ে রেখেছি।
তুমি মুখ ফিরিয়ে নিলে, আমি ফিরাইনি বুক।
তুমি ফিরিয়ে দিয়েও বুকের কাছে আকাশসমান ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছি।”
পরদিন আবার নতুন সকাল। অফিসে ঢুকেই স্নিগ্ধা স্বাভাবিক মুখ করে ডেস্কে বসল।
সহকর্মীরা কিছুই টের পায়নি, কেউ জানত না তার বুকের ভেতরে কেমন ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু স্নিগ্ধা জানত—
রাহুলের অবহেলা সত্ত্বেও, তার অভিযোগ সত্ত্বেও, সে-ই স্নিগ্ধার ভেতরে বেঁচে আছে।
তার মনে হলো, ভালোবাসার আদালতে সে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে।
রায় ঘোষিত— “যাবজ্জীবন কারাবাস।”
তবুও স্নিগ্ধা সেই শাস্তি মেনে নিল মাথা পেতে।
কারণ সে জানে, যতই রক্তাক্ত হোক বুক, যতই আঘাত আসুক, সে শুধু রাহুলকেই ভালোবেসে যাবে।
ভালোবাসা তার কাছে মুক্তি নয়—শুধু চিরস্থায়ী বন্দিত্ব।
সময় গড়াল। অফিসের প্রজেক্টগুলো শেষ হলো, নতুন কাজ শুরু হলো, মানুষ বদলালো—
কিন্তু স্নিগ্ধার ভেতরে রাহুলের প্রতি ভালোবাসা থামল না।
যদিও এখন তারা কেবল সহকর্মী।
রাহুল ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল।
কাজের জন্য প্রয়োজন ছাড়া আর তেমন কোনো কথা হতো না।
স্নিগ্ধা বুঝে গেল—
এই সম্পর্কের জায়গা আর নেই, কিন্তু তার ভেতরের ভালোবাসা এখনও বেঁচে আছে।
একদিন বিকেলে সবাই বাড়ি চলে যাওয়ার পর স্নিগ্ধা একা ছিল অফিসে।
টেবিলে ছড়ানো ফাইল, পাশে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ।
সে নিজের ডায়েরি খুলে লিখতে শুরু করল—
> “তুমি আমাকে অভিযুক্ত করেছ, শাস্তি দিয়েছ যাবজ্জীবন কারাবাসের,
তবু আমি ভেঙে পড়িনি।
কারণ এই বন্দিত্বই আমার মুক্তি।
ভালোবাসা আসলে কোনো শৃঙ্খল নয়,
এ এক নিঃশব্দ শক্তি, যা আমাকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে।”
কলম থামিয়ে সে জানালার বাইরে তাকাল।
শহরের আলো, দূরে গাড়ির হর্ন, মানুষের ভিড়—
সবকিছুর মাঝেও তার বুক ভরে উঠল অদ্ভুত এক শান্তিতে।
সে বুঝল—রাহুল হয়তো আর তার নয়, কিন্তু এই যাবজ্জীবন কারাবাস তার ভেতরে এক অদৃশ্য শক্তি তৈরি করেছে।
এটাই তাকে প্রতিদিন কাজে ফিরিয়ে আনে, মানুষকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাতে শেখায়, নিজের দায়িত্ব পালন করতে অনুপ্রাণিত করে।
মুখে ধীরে ধীরে এক শান্ত হাসি ফুটে উঠল।
এ হাসি কারও জন্য নয়, অভিযোগেরও নয়—
এ হাসি তার নিজের জন্য, তার টিকে থাকার শক্তির জন্য।
অফিসের ফাঁকা ফ্লোরে স্নিগ্ধার ঠোঁটে সেই হাসি যেন আলো ছড়িয়ে দিল।
মনে হলো— যাবজ্জীবন কারাবাসে থেকেও সে আসলে মুক্ত।
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন