একটা দিনের স্মৃতি
একটা দিনের স্মৃতি
মানব মন্ডল

গল্প - একটা দিনের স্মৃতি

মানব মন্ডল
শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫ জীবনবাদী, ভালোবাসা

“তোমার স্টুডেন্ট আজকেও, কী  মার খাওয়ার মতো কাজ করেছে না-কি?”

ছাত্রের মা’য়ের সম্মানে স্নেহা স্কেলটা টেবিলের উপর রেখে দিলেও,  সত্যটা চেপে না দিয়ে  কেয়া নীলিমা দেবীকে জানায়।

“ আন্টি। আমি  আজ ওর ব্যাপারে কথা বলবো ভাবছিলাম আপনার সঙ্গে । ভালো হলো যে আপনি চলে এলেন। রাহুলকে গতকাল হোমওয়ার্ক করতে দিয়ে গিয়েছিলাম। ও কোন হোমওয়ার্কের। গত  তিন ধরে ওকে পড়াচ্ছি আমি। আমি যা বুঝেছি তা হলো, ও পড়াশোনা নিয়ে চরম উদাসীনপড়াশোনার প্রতি ওর এই উদাসীনতার প্রভাবটা ওর রেজাল্টে পড়তে পারে বলে আমার ধারণা। ওর নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি না থাকলে আপনি পৃথিবীর সবথেকে চমৎকার শিক্ষকটা এনে দিলেও ওর পড়াশোনায় কোনো উন্নতি আসবে না।”

নিজের ব্যাপারে গৃহশিক্ষিকার এরকম মন্তব্যে ন মুখটা আরো কালো হয়ে যাওয়ার কথা রাহুলের। মা ছেলের ব্যাপারে  গুণগান কটমট করে ছেলের দিকে তাকলো। কিন্তু রাহুল বেশ ভাব লেশ হীন। 
নীলমা দেবী বলেন “তোকে আমি এখন কিচ্ছু বলবো না। আজ তোর বাবা। উনি তোর হিসাবটা বুঝে নিবেন। ”
কঠিন মানুষ  ওর বাবা। পুলিশ উচ্চ কর্মকর্তা। ওনা নাম নিয়ে নীলিমা দেবী ছুড়ে দেওয়া হুমকিটা রাহুল  চোখে ভয়ে ঝিলিক আনলেও , তেমন প্রভাব ফেললো না দেখে আরো রেগে গেলো কেয়া।

“বছরের ছয়  মাস শেষ হওয়ার পরে, আমি ওকে পড়ানো শুরু করেছি । সামনে ওর ফাইনাল পরীক্ষা। তবুও আমি শুরু থেকে ওর বই ধরেছি যেনো সিলেবাসের একটা কিছু মিস না হয়। আমি ওকে ঘড়ি ধরে পড়াই না। কিন্তু শিক্ষক হিসেবে আমি ওর জন্য যতটুকু এফোর্ট দিচ্ছি, স্টুডেন্ট হিসেবে ও আমার ততটুকু এফোর্টকে মূল্যায়ন করছে না। এরকম চলতে থাকলে বোর্ডে  পরীক্ষা ও ভালো ফল করবে বলে। আমার মনে হয়, আপনারা ওকে আরেকটু স্ট্রিক্টলি ট্রিট করে একটা রুটিনের মধ্যে চলার জন্য বাধ্য করা উচিত। আমার এতটুকু বলা জরুরী মনে হলো বলে বললাম। বাকিটা আপনি যা ভালো মনে করেন।”

নীলিমা দেবী বোধহয় ছেলের সম্পর্কে সম্পূর্ণ অভিযোগটা স্বামীর অপেক্ষায় তুলে রেখে কেয়া কে বললো।

“তুমি চিন্তা করো না। ওর বাবা কে।আসলে আজ এ-ই ব্যাপারে কথা বলবো আমি। উনিই ওর একটা বিহিত করবেন। তোমাকে আমি আসলে অন্য একটা কথা বলতে এসেছি। আজকে দুপুরের লাঞ্চটা তুমি আমাদের সঙ্গে করবে আসলে আমার, সুদীপ অনেকদিন পর বাড়ি ফিরলো তো! সে-ই উপলক্ষে সামান্য আয়োজন করেছি। ও বললো তোমাকে ”

‘সুদীপের ’ না শুনে কেয়ার মুখ আরো কঠিন হয়ে গেলো।“দুঃখিত, আন্টি। আমার রাহুলকে পড়িয়ে আরেকটা স্টুডেন্ট পড়াতে যেতে হবে। আজ সম্ভব নয়।”

নীলিমা তবুও কিছুটা জোর খাটিয়ে বললো,

“তাহলে আজ রাহুলকেকে পড়ানোর প্রয়োজন নেই। একেবারে লাঞ্চ করে নেই আমরা, চলো। তারপর না-হয় গেলে তুমি!”

কেয়া মনের অনাগ্রহটুকু বহাল রেখেই সামান্য মিথ্যা মিশিয়ে বলে,

“আপনি ব্যস্ত হবেন না, আন্টি। আমি ওকে পড়াতে আসার আগে ক্যান্টিন থেকে লাঞ্চ করে নিয়েছিলাম। এখন কিছু খাওয়া সম্ভব না। পেটে সামান্যতম জায়গা নেই। অন্য কোনোদিন হবে আমি তো কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি নি”

এরপর আর জোর করার মতো কিছু থাকে না। নীলমা বেগম ছেলেকে কড়া করে চোখ পাকিয়ে চলে যান। রাহুল বেচারা মিসের সামনে চেয়ার টেনে বসে কিছুটা ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো করে বলে,

“মিস, আসলে গতকাল সন্ধ্যায় কাকা বাড়িতে আসায় আমি হোমওয়ার্ক করার সময় পাই নি।”

কেয়া বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে কড়া গলায় প্রশ্ন করে,

“তোমার হাত পা বেঁধে রেখেছিল নাকি তোমার কাকা?”

রাহুল নিজের নখ খুঁটতে খুঁটতে জবাব দেয়,

“না। আসলে কাকা অনেকদিন পর এসেছে তো! আর অনেক কিছু এনেছে। আপানার জন্য তো এনাছে। সে-ই উপলক্ষে মা অনেককিছু রান্না করেছিল। এখন এতোকিছু খেয়ে আমার পেট ফুলে ঢোল হয়ে ছিল। খেয়েদেয়ে কি আর এনার্জি থাকে, বলুন? তাই ফুলো পেট নিয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”

এরকম বাচ্চামো কথাবার্তায় কেয়া বিরক্ত হয়। তার ওপর “আপনার জন্য ও এনেছে “কথা টায় আর বিরক্তিকর কেয়ার কাছে। রাহুলকেকে একটা উপপাদ্য করতে দিয়ে সে বিজ্ঞান বইটা খুলে একটা অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ লাইনগুলো হাইলাইটার দিয়ে উজ্জ্বল করে দাগাতে থাকে। ডিসি বাপের ছেলের অদ্ভুৎ সব সমস্যা! সে নাকি রিডিং পড়ার সময় বুঝতে পারে না এমসিকিউর জন্য কোন লাইনগুলো গুরুত্বপূর্ণ। তাই স্নেহার প্রতিদিন এই ছেলের বই দাগিয়ে দিতে হয়। মনে মনে এরকম নবাবজাদা ধরনের সমস্যা দেখে সে বেজায় বিরক্ত।

এরকম আলালের ঘরের দুলালদের প্রতি স্নেহার মনে সবসময়ই বিতৃষ্ণা কাজ করে। এই দুলালদের নাখরার শেষ নেই। এই যেমন রাহুলদের এইমাত্র বলা কথাটা – খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে সে নাকি পড়ার এনার্জি পায় নি। এই কথাটা কেয়ার কাছে খুবই লেম বলে মনে হয়েছে। মানুষ শরীরে শক্তি জোগাতে খায়। আর এই বড়লোকেরা না-কি খেয়েদেয়ে শরীরে শক্তি খুঁজে পায় না! কেয়ার ৎইচ্ছে করে এই শ্রেণীর মানুষদের ঘাড় ধরে একটু ফুটপাতের ধারে নিয়ে যেতে। ফুটপাত জুড়ে কতো ভুখা শিশু খাবারের অভাবে কষ্ট পায়, তা যদি এই ধনীরা বুঝতো। কথা ভাবতে আবার কেয়ার উজ্জ্বল এর কথা মনে পড়লো। রিকশা ওয়ালা কাকু সম্বোধন না করা জন্য ঘন্টা খানেক ধরে মুখ ঝামটা শুনিয়ে ছিলো ওকে ঊজ্জ্বল। শ্রমজীবী মানুষদের যত সম্মান করে ততটাই ও ঘৃনা করে বড় লোকদের।

টানা দুই-আরাই ঘন্টা সময় নিয়ে রাহুলকে পড়ানো শেষ করে কেয়া ওদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ই লক্ষ্য করে উঠোনের একপাশে থাকা একটা ঝকঝকে বিএম বাইককে। তার মনে পড়ে যায় কোনো এক সুদীপের আগমনের খবরটা। সুদীপের কখনো এই ব্যাপারে আগ্রহও দেখায় নি সে। নবাবঃ জাদা ঘুমাছে  হয়তো। সে এ বাড়িতে দিদি মুনির চাকরি করে। তার কাজ শুধুমাত্র পড়ানো এবং নিজের মাইনেটা বুঝে নেওয়া দিয়ে। ভ্যাপসা গরমে ত্যক্ত হয়ে কেয়া নিজের কুচকে রাখা মুখ নিয়েই বাইকটাকে পাশ কেটে বেরিয়ে যায়। কে ওকে পিছনে থেকে ডাকছে শুনে তাড়াতাড়ি একটা চলন্ত অটোরিক্সা উঠে পরে।

ঘড়ির কাঁটা রাত সাড়ে এগারোটা ছুঁই ছুঁই।  ব্যস্ত রাস্তাটা  গুঞ্জন  থেকে  গেছে।জানালার ফাঁক গলে ঘরে ঢুকছে দূরে কুকুরের ডাকে শব্দ। মাথার উপরের ফ্যানটা বিদঘুটে শব্দ তুলে ঘুরলেও সে-ই বাতাসে স্বস্তি মিলছে না। তিন বেডরুমের ছোট্ট ফ্ল্যাটের ডাইনিং টেবিলে গরম ভাতের ধোঁয়া উঠছে। টেবিলে একদম হিসাব করে পরিমিত পরিমাণে রান্না করা খাবার সাজানো। আলু ভর্তা, ডিম ভুনা এবং টোম্যাটো দিয়ে রান্না করা পাতলা ডাল।

কেয়া বাড়ি ফিরেছে এক ঘণ্টা হলো। ক্লাস শেষ করে পরপর তিনটা স্টুডেন্টকে পড়াতে হয় তাকে। তার মাঝে  ন্যাশনাল লাইব্রেরি গিয়ে নিজের পড়া শোলতাতে হয়। সকলকে পড়িয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রতিদিনই দেরি হয়ে যায়। ঘাম, ক্লান্তি এবং ধুলোবালি মুছে ফেলতে বাসায় ঢুকেই সরাসরি গামছা, কাপড় নিয়ে বাথরুমে করতে ঢুকেছিল সে।

স্নান সেড়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে প্লেট নিয়ে একে একে ভাত, আলুর ভর্তা বেড়ে নিয়ে স্নেহা নিজের রুমে ফিরে এসে পড়ার টেবিলটায় খেতে বসে। এই বাসার ডাইনিং টেবিলে চারটা চেয়ার রয়েছে। সে-ই চারটা চেয়ারে পর্যায়ক্রমে স্নেহার বাবা , উনার স্ত্রী কলেজ পড়ুয়া ছোট ভাই  এবং স্কুল পড়ুয়া ছোট বোন বসে। স্নেহা সেখানে কখনো বাড়তি চেয়ার নিয়ে গিয়ে নিজের স্থান করে নেওয়ার চেষ্টা করে না। নিজেকে যতটা পারে সকলের দৃষ্টির আড়ালে রেখে চলে সে।

ভাতের প্রথম গ্রাসটা মুখে তুলতেই কেয়ার কানে ভেসে আসে ডাইনিং টেবিল মা গুঞ্জন,

“আলুর কেজি দাম পঞ্চাশশ টাকায় গিয়ে ঠেকসে।  ডিমের একশ টাকা ডজন। কী হিসাব করে চলতে হয়, এইডা যদি সবাই বুঝতো! বাপের ঘাড়ে বইস্যা খায় বইল্যা বাজার সদাইয়ের হিসাব তো জানে না! আয়েশ কইরা বইস্যা গিললে এতো হুশ থাকে না-কি? নীলিমা দিদিভাই ফোন কইরা কইলো। নবাব জাদীর ওনাদের বাড়িতে জল পর্যন্ত স্পর্শ করে নাই। এতোই দেমাক”

ওর মায়ের মুখে,বাজারের দরদাম নিয়ে বিলাপ চলতেই থাকে।এটা কিছু না , কেউ তার কথার মাঝে ফোড়ন কাটে না। অবশ্য কেউ ফোড়ন কাটার প্রয়োজনটুকুও বোধ করে না। কারণ উনার বলা কথাগুলো তাদের কারো উদ্দেশ্যেই না। যার উদ্দেশ্যে এতো হিসাবের রেষারেষি চলছে সে ভাতের একটা দানা দ্বিতীয় বার একটা আর মুখে তুললো না। নীরবে প্লেট নিয়ে উঠে যায় ডাইনিং টেবিলে। আছোঁয়া ডিমটা তুলে রাখে কড়াইয়ে, অক্ষত ভর্তাটুকু তুলে রাখে বাটিতে, এখনো না মাখা ভাতটুকু সুন্দর করে তুলে রাখে হাড়িতে। বাদবাকি যতটুকু এঁটো হয়েছে তা ময়লার ঝুলিতে ফেলে প্লেট এবং নিজের হাতটা ধুয়ে নেয়।

টেবিলে বসে থাকা চারজন সদস্যই নীরবে দেখে সম্পূর্ণ দৃশ্যটা। কেয়া মুখে কুলুপ এঁটে রুমে গিয়ে ঠাস করে দরজাটা আটকে দেয়। ডাইনিং রুমটা ফের সরব হয়ে উঠে। বাড়িওয়ালা কারো বাপ না থেকে শুরু করে নানাধরণের মন্তব্য ছোঁড়া হয় কেয়ার উদ্দেশ্যে। সে-সকল মন্তব্য গায়ে না মেখে আলোটা নিভিয়ে বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে কেয়া। আজ দুপুরে ক্যান্টিনে বসে বিস্কুট চা খেয়েছে। সন্ধ্যায় ওর স্টুডেন্ট অতিনের বাড়িতে একপিস সিঙ্গারা খেয়েছিল সে, অতিনের দিদিকে ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে এসেছিলো বেঁচে যাওয়া সিঙ্গারাটা খেতে দিয়েছে ওকে ওরা।
আজ কলেজ খাওয়ার সময় পাশের টেবিলে বসা দুটো মেয়ের কথা তার কানে এসেছিল। আদরের দুলালী মেয়েটাকে নাকি তার মা-বাবা কখনো খালি পেটে ঘুমোতে দেয় না। হাজার রাগ করে থাকলেও মা নাকি মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দিয়ে তারপর ঘুমানোর অনুমতি দেয় মেয়েটাকে। এ-ই ব্যাপারটা নিয়ে মেয়েটার সে কী দুঃখ! সে নাকি শান্তিতে একটু দুঃখবিলাসও করতে পারে না। অন্য মেয়েটা তাঁর কেয়া রিং  বয়ফ্রেন্ড গল্প বলতে ব্যাস্ত ছিলো
বলতে বলতেই যদিও তার জানুর ফোন চলে আসে।
ঘটনাটা মনে পড়তেই চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে শুয়ে থাকা কেয়া গা জ্বলে উঠে। হুট করেই তার ইচ্ছে হচ্ছে ওই মেয়েটাকে খুঁজে বের করে দুই গালে ঠাসঠাস করে দু চারটা চটকানা মেরে এই ঢংয়ের দুঃখ ছুটিয়ে দিতে। ওই মূর্খ মেয়েটা কখনোই বুঝবে না যেটা তার দুঃখের কারণ, সেটাই কত মানুষের রাত জাগা হাহাকারের একটা অধ্যায়। কেয়া সারা দিন আজ ফোন দেখেনি। যদিও স্টুডেন্ট দের মা বাবা আর সুদীপের হাজার গন্ডা মেসজ ছাড়া ওর ফোনে কি থাকবে ওর ফোনে। তবুও ও ফোন টা দেখে। যদি উজ্জ্বলএর একটা মিস কল থাকে। উজ্জ্বলের সাথে ওর কত স্মৃতি আছে। উজ্জ্বল এর কি একবার মনে পড়ে না ওর কথা। ভাবতে ওর চোখে জল আসে। চোখের জল মুছে ও ঘুমতে চেষ্টা করে। কাল সকালে উঠতে হবে। আবার আরেকটি দিন কাটাতে হবে। দিন গুলো কাটাচ্ছে বছর কেটে যাচ্ছে কিন্তু কেয়ার জীবনে আর স্মৃতি তৈরি হচ্ছে না। যে পুরনো স্মৃতি মুছে নতুন স্মৃতি জায়গা করে নেবে ওর জীবনে।

, ,

পরে পড়বো
৪৮
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন