কাল মধুমাস
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
বার বার ফিরে আসা নয় |
পারাপার
নয় |
শুধু যাওয়া |
এখন কথাটা হল,
কখন কী ভাবে
যাবে---
আকাশের কেমন আবহাওয়া |
মনে রেখো,
এ নদীতে একবার
শুধুই একবার
একটি মাত্র খেপ |
তা নিয়ে আক্ষেপ
করবার
পাত্রই আমি নই |
একবার
একবারই সই |
কথাটা, কী ভাবে
যাবে----
ক্ষণে ক্ষণে
মরতে মরতে ?
না কি বেঁচে
নেচে নেচে
ঢেউয়ের মাথায় ?
হালে পানি, পালে হাওয়া
না লাগে লাগুক---
কী আনন্দ, কী সুখ
যায় দিন, যায় ||
২
যদিও আবাল্য চোখে দেখে আসছি কম
ইদানীং ডান কানে
ইস্ ,
একমাত্র শুনছি না---
দ্রোণাচার্য তুচ্ছজ্ঞানে
নেন নি ভাগ্যিস
বাল্যে বুড়ো-আঙুল দক্ষিণা |
পারলে তাই দেখাতে ভুলি না
যখন যেখানে যাকে
দেখানো দরকার |
যৌবন বিদায় নিয়ে
এতক্ষণে পৌঁছে গেছে যেখানে যাবার |
মিষ্টি হেসে
হাত নেড়ে তাকে বলেছিলেম, বিদায়!
মেয়েলি ঈর্ষায়
প্রৌঢ়ত্বও করছে যাব-যাব |
এবার তাই ঠিক করেছি, যাবার সময়
দুহাতে লাল-নীল দুটো রুমাল ওড়াব |
তারপর টুকটুক করে বাড়ি ফিরব শনৈঃ শনৈঃ
সময় তো জানই---
নয় ব্যাকরণের অব্যয় |
যখন যে পদে থাকে
সেইমতো আকার |
সময়ের সঙ্গে আমরা সম্বন্ধ পাতাই
ছোট, বড়, গোল, চৌকো নানান মাপের |
সময়টা এক নয়—
এর ওর তার |
তোমার সময় দিয়ে তাই
বৃথা চেষ্টা আমাকে মাপবার |
তুমি বসে কাজ করো |
আমি উঠি |
যাই
গিয়ে দেখে আসি
কোথায় আকাশটা খুব বড় |
দেখে আসি পড়ো-পড়ো
কোথায় কখন কোন্ খুঁটি |
যাই
গিয়ে দেখে আসি
কী বীজ বুনছে মাঠে চাষী |
তুমি কাজ করো |
আমি কিন্তু
যখনকার কাজ ঠিক তখন না করে---
দাঁড়াব রাস্তার মোড়ে ;
যেখানে বিস্তর লোক একেবারে পৃথক কারণে
এক স্থানে এক কালে জড়ো |
সেখানে আমিই একা অহেতুক ;
ভেবে দেখব মনে মনে
জীবনের এ আবার কোন এক রহস্যকৌতুক !
খুব জোর বৃষ্টি আসছে ;
আকাশ মিশকালো |
আলো জ্বালো ;
জানলা-দরজা দাও বন্ধ করে |
বন্দ শার্সিটার গায়ে
বুনে নাও এই বেলা
খালি হাতে
যত ইচ্ছে আকাশকুসুম |
আমি যাই |
আজ বছরের এই প্রথম মরশুম
গায়ে এসে বিঁধবে যেন বর্শার ফলক
আকাশটা দুখানা করবে
বিদ্যুৎ ঝলক |
নেব না বর্ষাতি কিংবা ছাতা |
আমার স্বভাব নয়, তাই
বাঁচাই না মাথা
----রোদে না, জলে না |
যাই
কিছুক্ষণ গিয়ে বসি
যে-পুকুরে মাছগুলো
জলের গভীরে দিচ্ছে ঘাই |
ফাৎনায় বেঁধানো থাকবে চোখ
পাশে বসে থাকবে হয়তো বুড়োমতো লোক---
পরক্ষণে মনে হবে, আরে রাম রাম
লোকটা তো আমারই বয়সী |
ঘেঁষটে ঘেঁষটে যাচ্ছে ট্রাম |
আমাদের গলি দিয়ে যাওয়া এক
বিকলাঙ্গ ভিখিরির মতো
দুর্বিষহ মর্মন্ত্তদ কর্কশ আওয়াজ |
বিকেলে মিছিল থাকলে আজ
ছোকরাদের সঙ্গে যাব পাল্লা দিয়ে হেঁটে
সারিবদ্ধ দুটো হাত দোলাতে দোলাতে |
পরদিন পড়ে নেব, এই যুক্তি এঁটে---
সভায় যা বলা হবে না-শুনে সাক্ষাতে
দল বেঁধে দোকানে চা খাব |
আর যদি সেইসঙ্গে ভাগ্যে যায় জুটে
তবে বাড়ি-গাড়িও হাঁকাব |
ততদিন ঘুরে ঘুরে এ-ফুটে ও-ফুটে
এর ওর তার সঙ্গে
জমাব আলাপ |
হেসে বলব : কী খবর ? কেমন আছেন ?
হাতে খুঁজব হাতের উত্তাপ |
কে হে লোকটা ? এক হাতে বোঁটাসুদ্ধ চুন,
অন্য হাতে কোঁচা ?
যেতে যেতে দিয়ে গেল খোঁচা ?
‘কী মশাই, লিখছেন না কেন ?
লিখুন ! লিখুন !’
লোকটার বরাত ভালো ;
চলে গেল |
নইলে ও নির্ঘাৎ হত খুন ||
৩
চলেছে রাত্রের ট্রেন
বাইরে নিকষ অন্ধকার |
জানালা টপকে ছুটে আসে উল্টোমুখে
আলোয় কিম্ভূতকিমাকার
মূর্তি সব |
সারা কামরা নিস্তব্ধ নিঝুম |
জেগে একা বসে আছে শিশু---
চোখে নেই ঘুম |
সমানে চলেছে বাইরে
পৈশাচিক কী এক উত্সব |
ডাকলে কেউ উঠবে না সে জানে----
দাদা দিদি কাকা বাবা সব পিপুফিশু |
সে জানে না কোথায় চলেছে
মনে সে যা নিয়েছিল এঁচে
মিলছে না কিছুই |
এই অন্ধকার তার ছিল না হিসেবে
স্বপ্নে তার ছিল না স্তব্ধতা |
এই ভয়ংকর ভয়
ডেকে তুলে কাকেই বা দেবে |
শেষ রাত আন্দাজ
হঠাৎ সবাইকে ডেকে তুলে দিল
শূন্যতা ভরাট করা
গুম গুম আওয়াজ |
মা বললেন : দ্যাখ্ দ্যাখ, পদ্মা ঐ দূরে---
সাড়া ব্রিজ এই |
আমরা জয় মা কালী বলে
দিলাম সজোরে পয়সা ছুঁড়ে
যে তিমির
সেই তিমিরেই |
তারপর সেই শিশু আবার ঘুমুল |
স্বপ্নে দেখল : ছাদের যেখানে চাঁদ থাকে
তার পাশে ফণিমনসার টবটাতে
বসে আছে ফের সেই হুলো |
মাকে যেই সে ডাকতে যাবে
মা তার আগেই
ডেকে তাকে ট্রাঙ্কটা খুললেন ---
ট্রাঙ্ক থেকে কী বেরুল বলো |
দুটো তুবড়ি আর দুটো লাল-নীল দেশলাই |
তখন অনেক রাত,
পাড়াসুদ্ধু বাড়িসুদ্ধু ঘুমোচ্ছে সবাই |
তারপর কী যে মজা হল ||
৪
সেও এক ব্রিজ-ই
ওপরে টমটম যায় গুড়-গুড় গুড়-গুড়,
নীচে চাও যদি---
হিজিবিজি হিজিবিজি
নদী নৌকো নদী নৌকো নদী |
নাম নওগাঁ ;
অজ মফস্বলে এক নগণ্য শহর |
বৃষ্টিপাত বেশ ক-ইঞ্চি বেশি,
নেহাত নগণ্য নয়
সেখানকার শীতের বহর |
দু-পাশের রেনট্রি গাছে ছায়ায় ছায়ায়
দিগন্তের কোন্ অন্তরালে
জানতাম না কোথায় রাস্তা যায়--
কোন্ সে দুবলহাটি, দিঘাপতিয়াই বা কোথায় ?
রান্নাঘরে জানলা দিয়ে দেখা যেত দূরের রাস্তায়
গলায় দুলিয়ে ঘন্টা হাতি,
দুল্ কি চালে কখনও বা উট |
দৈনিক সকালে ঠিক কাঁটায় কাঁটায়
রানারের ছুট |
বাইরে বোতামফুল বেল জুঁই, ব্যস্—
ভেতরের ছোট্ট উঠোনে
তুলসীমঞ্চ কাঠগোলাপ হাস্নাহানা দোপাটি টগর
করবী মোরগঝুঁটি ফুল ; তিনটে হাঁস ;
পেঁয়াজ, উচ্ছের মাচা ; লক্ষ্মীগাই থাকত এক কোণে---
দুধ দিলে ডিম পাড়লে যা হত রগড় |
শীতকালে সার্কাস আসত ;
ইস্কুলের মাঠে পড়ত তাঁবু |
কী মুশকিলে পড়তেন যে হারাধনবাবু---
কাছে হবে মনে ক’রে
ছোট্ট তিনফুট উঁচু ঢিবিটায় উঠে তিনি রোজ
আকাশের তারা দেখে দেখে
খাতা ভরে কী সব টুকতেন |
সেই ঢিবি একদিন সার্কাসের তাঁবু দিত ঢেকে |
কুড়কুড় কুড়কুড় ক’রে বাজনার বোলে
ঘোড়ার গাড়িটা যেত লাল নীল সবুজ হলুদ
কত কী সুখের পায়রা ওড়াতে ওড়াতে |
আমরা এইটুকুটুকু আধভাঙা খুদ
স্বেচ্ছায় দিতাম ধরা তাদের কবলে |
সারাদিন আমাদের মহানন্দে খুঁটে খুঁটে খেত----
শেষের সপ্তাহে রোজ অদ্য-শেষ-রজনী বুঝিয়ে
সারাটা শহর কানা করে দিয়ে
জানি না কোথায় উড়ে যেত |
পাশের বাড়িতে থাকত আমার যে-বন্ধু, তার এক ছিলেন পিসিমা---
তিনি এলে ঘরে বসত মা-মাসিদের আসর
ঝুলিতে গল্পের তাঁর ছিল নাকো সীমা পরিসীমা
জিভে তাঁর কিছুই বাধত না |
কোন্ এক জেলার কোন্ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব
কবে কোন্ ট্রেনের কামরায়—
রসসিক্ত হয়ে উঠত বক্তার রসনা
---- মেমকে আদর করে বসালেন কোলে |
ছোটদের শুনতে নেই--- কী হল তারপর
শুনেছি | কারণ, তাতে বিস্কুট ছিল ব’লে |
কামরায় আর যারা ছিল কচর মচর
খেতে লাগল সাহেবের টিন থেকে দামি দামি বিলিতি বিস্কুট
ছোটদের দুর্বোধ্য ছিল
মধ্যে মধ্যে থাকত যা ব্যাসকূট |
বলতে বলতে হঠাৎ তিনি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে
চিত্পাত হলেন তক্তপোশের ওপর
মা কালী করতেন তাঁকে ভর |
না থেমে গড়গড় করে যা বলতেন তিনি
শুনে সারা গায়ে দিত কাঁটা—
নরকের যত সব ডাকিনী প্রেতিনী
তাঁকে দিচ্ছে সাজা,
বেঁধাচ্ছে গরম লোহা, উপ্ ড়ে নিচ্ছে চোখ
তেলের কড়াইতে করছে ভাজা---
তাঁর বর্ণনার কাছে
এখনকার পাপবিদ্ধ কবিতা কিছু না |
মনে মনে ওঁর জন্যে ঠাকুরকে ডাকতাম :
হে ঠাকুর, কেন ওঁকে শান্তি দাও না ? কেন ওঁকে কর না করুণা !
সকালে শীতের ভোরে তারের বেড়ায়
ঝুলে ঝুলে থাকত যেন নাকের নোলক |
বিকেল বেলায়
সূর্য ডুবে গেলে করত কী মন কেমন |
ছিল একটা খেলনার ঢোলক
ছেলেমেয়ে একসঙ্গে খেলতাম চত্বরে |
কখনও কখনও খুব নরম হাত ধরে
কোনো কিছু না ভেবেই হয়তো বলতাম :
তোর এই আয়মন নাম,
নামের মানেটা কী রে ? আয় মন, আয় মন, নাকি ?
বাঃ, কী সুন্দর গন্ধ,
হাতে বুঝি মেহেদির রং ?
চড়কের আগে আসত সং---
কাছের গ্রামের এক বহুরূপী ; বছরে একবার |
মেসবাড়িতে তার চেয়েও আসত লোক হরেক রকম |
এক আসত শীল্ডে খেলতে নানা জায়গাকার
নামী নামী অনেক প্লেয়ার |
তাদের পা টিপতে গিয়ে আমাদের নিক্ লে যেত দম |
এক এসেছিল শিল্প-প্রদর্শনী নিয়ে
সরকারের লোক এক ; তারই টেবিলে
কাঁচের কাগজচাপা দেখে
জীবনে প্রথম সেই কী-যে হয়েছিলাম স্তম্ভিত !
এজন্যে নয় যে, সেটা কাঁচ |
আসলে কাগজচাপা বসে ছিল দিব্যি সেই কাঁচের মধ্যে গিলে
শ্যামপত্রশোভাসমন্বিত
সম্পূর্ণ একটি গাছ |
আর এসেছিল
বন্যার্ত অঞ্চল থেকে হাতি চড়ে
এক জমিদার, তার দলবলসহ |
সন্ধেবেলা তার ঘরে
বইত রোজ ফুর্তির ফোয়ারা |
দরজায় পর্দা থাকত,
কালোয়াতি গানের গমক,
ঘুঙুরের বোল আর অদৃশ্য ঠমক
উপ্ চে পড়ত মাঝে মাঝে বাইরের মাঠে |
বন্যা নেমে যাওয়ার ঠিক মুখে---
গিন্নি-মা উঠলেন খাটে
সিঁদুর-চন্দনে রাজরাজেশ্বরী সেজে
কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল আহাম্মক ঝিটাই---
মা, তোমার গৌরবর্ণ নীল হল কিসে !
‘কিসে’ শুনতে লোকে নাকি শুনেছিল ‘বিষে’---
সেই দোষে ঝি হল ছাঁটাই |
ব্যাপারটা সকলেরই নাকি জানা
কিছুই জানি নি আমরা কী বৃত্তান্ত---
ছোটদের জানবারও কথা না |
খেতালচাষীরা আসত পাট্টা নিতে ;
তখন সামনের মাঠে পা ফেলা যেত না |
ঘটি নিয়ে ঘুরে ঘুরে জল দিতাম আমি আর দাদা |
শুধু শুকনো ঐটুকু পানিতে
কী করে যে মিলে যায় খোদাতালার এত দোয়া |
--- সেটা ছিল ধাঁধা |
কিছুতে নিতাম না হাতে গুঁজে দিলে কেউ লজেঞ্চুস |
আবগারি-দারোগা হয়ে বাবার যে নামডাক এক—
দাদা বলত, কী জন্যে বল্ তো ?
কারণ, নেনে না বাবা ঘুষ |
জল দিয়ে লজেঞ্চুস
এক রকম ঘুষ |
কাঁথিতে কোথাও কোনো সমুদ্রের ধারে
নুন তৈরি করতে গিয়ে পুলিশের বুটের কাঁটায়
ঝাঁঝরা হয়েছিল যার পিঠ---
সে এল স্ট্রেচারে |
সমস্ত শহর ক্ষুব্ধ ; ফেটে পড়ছি রাগে
আমরা সবাই |
মাঝে মাঝে হাঁক উঠছে : জোর্ সে বলো, ভাই---
বন্দে মাতরম্ |
সারাটা শহর করছে থমথম |
গুপ্তকক্ষে বসে বসে নিজের অস্থিতে
বজ্র যেন বানাচ্ছে দধীচি |
এমন সময়
হে ধরণী দ্বিধা হও, আমি যাই পাতাল তলিয়ে---
ভিড়ের ভেতর থেকে ও কে বলল : ছি, ছি,
তোর বাপ সরকারি চাকুরে !
সন্ধেবেলা একদিন বাপু রে,
মহকুমা হাকিমের কুঠিতে কী ভিড়---
রেডিও শোনাবে এস্-ডি-ওর জামাই |
সকলেই আমন্ত্রিত :
এসেছে সবাই |
মাস্টার, মুনসেফ, ব্যাঙ্ক ম্যানেজার, উকিল, মোক্তার
সিভিল সার্জেন, সোডাকলের মালিক,
থানার দারোগা, সাব-রেজিস্ট্রার, পশুর ডাক্তার---
সবাই এলেন |
একে এস্ –ডি-ওর জামাই
তদুপরি শোনাবে রেডিও |
সুতরাং সবাই হাজির
শহরের মশামাছিটিও |
এদিকে সময় যায় বয়ে |
তার-আলো আলো-তার, এ-কল, সে-কল
এ ছুঁই, তা ছুঁই---
গলদ্ ঘর্ম এস্ –ডি-ওর জামাই বেচারি :
হয় নাকো কিছুতে কিছুই |
শেষকালে শব্দ এল অবিকল
--- হ্যাঁ, হ্যাঁ, একেবারে অবিকল---
কী কাণ্ড, সামনে ডাকছে একগাদা কুকুর-বেড়াল |
এস্-ডি-ওর থোঁতা মুখ ভোঁতা হতে দেখে
একদল কী খুশী !
এস্-ডি-ওর বরাবরে উকিলরা দিল
সরকারকে দুয়ো |
আরেকজন বলল, ঐ জামাতাটি ভুষি |
শেষের দলটি বলল, এ থেকেই বোঝা যায়
রেডিও ব্যাপারটাই ভুয়ো |
বাঁ-দিকে মার্জিন-টানা বালির কাগজ,
গঁদের আঠার শিশি, চাবি আর তালা
লাল-হলদে সুতোর বাণ্ডিল,
শিলমোহর, গালা
---এই নিয়ে ছিল
বাবার টেবিল |
আর ছিল পেন্সিল কাটার একটা ছুড়ি
একদিন ইস্কুল থেকে ফিরে দেখি
হৈ হৈ ব্যাপার |
পেন্সিল কাটার সেই ছুড়ি হাতে, এ কী---
উঠোনে দাঁড়িয়ে মেজো খুড়ি |
বাবার মতলব ছিল নাকি
নিজের গলায় বসাবার |
খাটো করে গলা
‘ওতে কি পেন্সিল ছাড়া’ যেই বলা
আর যায় কোথা !
প্রচণ্ড ধমক অমনি : বড্ড হচ্ছ পাকা |
দিদির শাশুড়ি নাকি লিখেছেন যা তা
দেনাপাওনা এখনও ঢের বাকি |
অথচ দেনার দায়ে
বাবার বিকিয়ে আছে মাথা |
এদিকে চালের দাম উঠেছে আট টাকা |
লোকে বলছে
লাগল বলে আবার লড়াই ||
৫
লিখি নি, ভাগ্যিস !
মা বলতেন : শুনে নে, লিখিস্ ---
পালকি এসে পৌঁছুল দেউড়িতে
সে পেয়েছে শিবতুল্য বর
বুকের ভেতরে করে আনা
আশা তার মেলে দেবে ডানা---
আলো এল, ঘোমটাও সরাল
কে যেন ককিয়ে উঠল : কালো !
দাঁতে দাঁতে কড়মড় কড়মড় |
সেই থেকে সে রাক্ষসপুরীতে |
ভাগ্যিস, লিখি নি |
নইলে শিব গড়তে গিয়ে
হয়ে যেত নিশ্চয় বাঁদর |
মাকে মনে পড়ে |
মা আমাকে বলতেন বাঁদর |
কিন্তু তবু যখনই বৃষ্টিতে ঝড়ে
. চমকাত বিদ্যুৎ
পাশে এসে মা বলতেন হেঁকে
. জয়মণি ! স্থির হও |
যে-মন্ত্রে ঘেঁষে না কাছে ভূত
সে-মন্ত্র তো মার কাছেই শেখা |
আজ তাই শ্মশানে মশানে
কৃষ্ণপক্ষে ভয়ংকর যে-কোনো জায়গায়
যেতে পারি একা |
জলে কিংবা ঝড়ে
এখনও মেঘের দিকে যখনই তাকাই
মনে পড়ে মাকে |
কেন মনে পড়ে ?
মা ছিলেন মেঘবর্ণ |
শুধুই কি তাই ?
৬
দুয়ে আর দুয়ে আপনি ঠিক বলছেন চার ?
দেখুন, আমার একটা কুষ্ঠির দরকার |
ভবষ্যৎটা একটু ভালো করে
জেনে নিতে চাই |
যা যা জানি বলে যাচ্ছি
আপনি তো গণক---
ফাঁকগুলো নিজগুণে ভরে
বানিয়ে দিন না একটা ছক !
প্রথম যুদ্ধের ঠিক পরে |
কত সাল
সেইটাই তো জানি না |
বার বুধ |
ভুলি নি, কারণ---
মা বলতেন : বুধবারে নখ কাটা
আমার বারণ !
রাশিটা বিচারাধীন |
আপনি রায় দিলে
তবেই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে রাশি |
দিদি বলেছিলেন একবার---
যতদূর মনে পড়ছে মীন |
হতেও বা পারে
যে রকম মাছ ভালোবাসি !
মাঘের সংক্রান্তি তিথি |
অকাট্য নির্ভুল |
আরেকটু বলি |
তারপর ইতি |
কী করে জানি না---
আমার মনের মধ্যে জন্মগত ছবি একটা আছে,
একেবারে শীতের শেষদিন |
পাতা নেই গাছে |
দুটি ঠোঁট শব্দ তুলে অন্য দুটি ঠোঁটে
বলে ওঠে :
‘মনে নেই ? কাল মধুমাস’ !
বলেছিল আর কেউ, আমার মা নন |
বললাম তো কারণ---
মা তখন আমাকে নিয়ে যন্ত্রণায় নীল |
পারাপার
নয় |
শুধু যাওয়া |
এখন কথাটা হল,
কখন কী ভাবে
যাবে---
আকাশের কেমন আবহাওয়া |
মনে রেখো,
এ নদীতে একবার
শুধুই একবার
একটি মাত্র খেপ |
তা নিয়ে আক্ষেপ
করবার
পাত্রই আমি নই |
একবার
একবারই সই |
কথাটা, কী ভাবে
যাবে----
ক্ষণে ক্ষণে
মরতে মরতে ?
না কি বেঁচে
নেচে নেচে
ঢেউয়ের মাথায় ?
হালে পানি, পালে হাওয়া
না লাগে লাগুক---
কী আনন্দ, কী সুখ
যায় দিন, যায় ||
২
যদিও আবাল্য চোখে দেখে আসছি কম
ইদানীং ডান কানে
ইস্ ,
একমাত্র শুনছি না---
দ্রোণাচার্য তুচ্ছজ্ঞানে
নেন নি ভাগ্যিস
বাল্যে বুড়ো-আঙুল দক্ষিণা |
পারলে তাই দেখাতে ভুলি না
যখন যেখানে যাকে
দেখানো দরকার |
যৌবন বিদায় নিয়ে
এতক্ষণে পৌঁছে গেছে যেখানে যাবার |
মিষ্টি হেসে
হাত নেড়ে তাকে বলেছিলেম, বিদায়!
মেয়েলি ঈর্ষায়
প্রৌঢ়ত্বও করছে যাব-যাব |
এবার তাই ঠিক করেছি, যাবার সময়
দুহাতে লাল-নীল দুটো রুমাল ওড়াব |
তারপর টুকটুক করে বাড়ি ফিরব শনৈঃ শনৈঃ
সময় তো জানই---
নয় ব্যাকরণের অব্যয় |
যখন যে পদে থাকে
সেইমতো আকার |
সময়ের সঙ্গে আমরা সম্বন্ধ পাতাই
ছোট, বড়, গোল, চৌকো নানান মাপের |
সময়টা এক নয়—
এর ওর তার |
তোমার সময় দিয়ে তাই
বৃথা চেষ্টা আমাকে মাপবার |
তুমি বসে কাজ করো |
আমি উঠি |
যাই
গিয়ে দেখে আসি
কোথায় আকাশটা খুব বড় |
দেখে আসি পড়ো-পড়ো
কোথায় কখন কোন্ খুঁটি |
যাই
গিয়ে দেখে আসি
কী বীজ বুনছে মাঠে চাষী |
তুমি কাজ করো |
আমি কিন্তু
যখনকার কাজ ঠিক তখন না করে---
দাঁড়াব রাস্তার মোড়ে ;
যেখানে বিস্তর লোক একেবারে পৃথক কারণে
এক স্থানে এক কালে জড়ো |
সেখানে আমিই একা অহেতুক ;
ভেবে দেখব মনে মনে
জীবনের এ আবার কোন এক রহস্যকৌতুক !
খুব জোর বৃষ্টি আসছে ;
আকাশ মিশকালো |
আলো জ্বালো ;
জানলা-দরজা দাও বন্ধ করে |
বন্দ শার্সিটার গায়ে
বুনে নাও এই বেলা
খালি হাতে
যত ইচ্ছে আকাশকুসুম |
আমি যাই |
আজ বছরের এই প্রথম মরশুম
গায়ে এসে বিঁধবে যেন বর্শার ফলক
আকাশটা দুখানা করবে
বিদ্যুৎ ঝলক |
নেব না বর্ষাতি কিংবা ছাতা |
আমার স্বভাব নয়, তাই
বাঁচাই না মাথা
----রোদে না, জলে না |
যাই
কিছুক্ষণ গিয়ে বসি
যে-পুকুরে মাছগুলো
জলের গভীরে দিচ্ছে ঘাই |
ফাৎনায় বেঁধানো থাকবে চোখ
পাশে বসে থাকবে হয়তো বুড়োমতো লোক---
পরক্ষণে মনে হবে, আরে রাম রাম
লোকটা তো আমারই বয়সী |
ঘেঁষটে ঘেঁষটে যাচ্ছে ট্রাম |
আমাদের গলি দিয়ে যাওয়া এক
বিকলাঙ্গ ভিখিরির মতো
দুর্বিষহ মর্মন্ত্তদ কর্কশ আওয়াজ |
বিকেলে মিছিল থাকলে আজ
ছোকরাদের সঙ্গে যাব পাল্লা দিয়ে হেঁটে
সারিবদ্ধ দুটো হাত দোলাতে দোলাতে |
পরদিন পড়ে নেব, এই যুক্তি এঁটে---
সভায় যা বলা হবে না-শুনে সাক্ষাতে
দল বেঁধে দোকানে চা খাব |
আর যদি সেইসঙ্গে ভাগ্যে যায় জুটে
তবে বাড়ি-গাড়িও হাঁকাব |
ততদিন ঘুরে ঘুরে এ-ফুটে ও-ফুটে
এর ওর তার সঙ্গে
জমাব আলাপ |
হেসে বলব : কী খবর ? কেমন আছেন ?
হাতে খুঁজব হাতের উত্তাপ |
কে হে লোকটা ? এক হাতে বোঁটাসুদ্ধ চুন,
অন্য হাতে কোঁচা ?
যেতে যেতে দিয়ে গেল খোঁচা ?
‘কী মশাই, লিখছেন না কেন ?
লিখুন ! লিখুন !’
লোকটার বরাত ভালো ;
চলে গেল |
নইলে ও নির্ঘাৎ হত খুন ||
৩
চলেছে রাত্রের ট্রেন
বাইরে নিকষ অন্ধকার |
জানালা টপকে ছুটে আসে উল্টোমুখে
আলোয় কিম্ভূতকিমাকার
মূর্তি সব |
সারা কামরা নিস্তব্ধ নিঝুম |
জেগে একা বসে আছে শিশু---
চোখে নেই ঘুম |
সমানে চলেছে বাইরে
পৈশাচিক কী এক উত্সব |
ডাকলে কেউ উঠবে না সে জানে----
দাদা দিদি কাকা বাবা সব পিপুফিশু |
সে জানে না কোথায় চলেছে
মনে সে যা নিয়েছিল এঁচে
মিলছে না কিছুই |
এই অন্ধকার তার ছিল না হিসেবে
স্বপ্নে তার ছিল না স্তব্ধতা |
এই ভয়ংকর ভয়
ডেকে তুলে কাকেই বা দেবে |
শেষ রাত আন্দাজ
হঠাৎ সবাইকে ডেকে তুলে দিল
শূন্যতা ভরাট করা
গুম গুম আওয়াজ |
মা বললেন : দ্যাখ্ দ্যাখ, পদ্মা ঐ দূরে---
সাড়া ব্রিজ এই |
আমরা জয় মা কালী বলে
দিলাম সজোরে পয়সা ছুঁড়ে
যে তিমির
সেই তিমিরেই |
তারপর সেই শিশু আবার ঘুমুল |
স্বপ্নে দেখল : ছাদের যেখানে চাঁদ থাকে
তার পাশে ফণিমনসার টবটাতে
বসে আছে ফের সেই হুলো |
মাকে যেই সে ডাকতে যাবে
মা তার আগেই
ডেকে তাকে ট্রাঙ্কটা খুললেন ---
ট্রাঙ্ক থেকে কী বেরুল বলো |
দুটো তুবড়ি আর দুটো লাল-নীল দেশলাই |
তখন অনেক রাত,
পাড়াসুদ্ধু বাড়িসুদ্ধু ঘুমোচ্ছে সবাই |
তারপর কী যে মজা হল ||
৪
সেও এক ব্রিজ-ই
ওপরে টমটম যায় গুড়-গুড় গুড়-গুড়,
নীচে চাও যদি---
হিজিবিজি হিজিবিজি
নদী নৌকো নদী নৌকো নদী |
নাম নওগাঁ ;
অজ মফস্বলে এক নগণ্য শহর |
বৃষ্টিপাত বেশ ক-ইঞ্চি বেশি,
নেহাত নগণ্য নয়
সেখানকার শীতের বহর |
দু-পাশের রেনট্রি গাছে ছায়ায় ছায়ায়
দিগন্তের কোন্ অন্তরালে
জানতাম না কোথায় রাস্তা যায়--
কোন্ সে দুবলহাটি, দিঘাপতিয়াই বা কোথায় ?
রান্নাঘরে জানলা দিয়ে দেখা যেত দূরের রাস্তায়
গলায় দুলিয়ে ঘন্টা হাতি,
দুল্ কি চালে কখনও বা উট |
দৈনিক সকালে ঠিক কাঁটায় কাঁটায়
রানারের ছুট |
বাইরে বোতামফুল বেল জুঁই, ব্যস্—
ভেতরের ছোট্ট উঠোনে
তুলসীমঞ্চ কাঠগোলাপ হাস্নাহানা দোপাটি টগর
করবী মোরগঝুঁটি ফুল ; তিনটে হাঁস ;
পেঁয়াজ, উচ্ছের মাচা ; লক্ষ্মীগাই থাকত এক কোণে---
দুধ দিলে ডিম পাড়লে যা হত রগড় |
শীতকালে সার্কাস আসত ;
ইস্কুলের মাঠে পড়ত তাঁবু |
কী মুশকিলে পড়তেন যে হারাধনবাবু---
কাছে হবে মনে ক’রে
ছোট্ট তিনফুট উঁচু ঢিবিটায় উঠে তিনি রোজ
আকাশের তারা দেখে দেখে
খাতা ভরে কী সব টুকতেন |
সেই ঢিবি একদিন সার্কাসের তাঁবু দিত ঢেকে |
কুড়কুড় কুড়কুড় ক’রে বাজনার বোলে
ঘোড়ার গাড়িটা যেত লাল নীল সবুজ হলুদ
কত কী সুখের পায়রা ওড়াতে ওড়াতে |
আমরা এইটুকুটুকু আধভাঙা খুদ
স্বেচ্ছায় দিতাম ধরা তাদের কবলে |
সারাদিন আমাদের মহানন্দে খুঁটে খুঁটে খেত----
শেষের সপ্তাহে রোজ অদ্য-শেষ-রজনী বুঝিয়ে
সারাটা শহর কানা করে দিয়ে
জানি না কোথায় উড়ে যেত |
পাশের বাড়িতে থাকত আমার যে-বন্ধু, তার এক ছিলেন পিসিমা---
তিনি এলে ঘরে বসত মা-মাসিদের আসর
ঝুলিতে গল্পের তাঁর ছিল নাকো সীমা পরিসীমা
জিভে তাঁর কিছুই বাধত না |
কোন্ এক জেলার কোন্ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব
কবে কোন্ ট্রেনের কামরায়—
রসসিক্ত হয়ে উঠত বক্তার রসনা
---- মেমকে আদর করে বসালেন কোলে |
ছোটদের শুনতে নেই--- কী হল তারপর
শুনেছি | কারণ, তাতে বিস্কুট ছিল ব’লে |
কামরায় আর যারা ছিল কচর মচর
খেতে লাগল সাহেবের টিন থেকে দামি দামি বিলিতি বিস্কুট
ছোটদের দুর্বোধ্য ছিল
মধ্যে মধ্যে থাকত যা ব্যাসকূট |
বলতে বলতে হঠাৎ তিনি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে
চিত্পাত হলেন তক্তপোশের ওপর
মা কালী করতেন তাঁকে ভর |
না থেমে গড়গড় করে যা বলতেন তিনি
শুনে সারা গায়ে দিত কাঁটা—
নরকের যত সব ডাকিনী প্রেতিনী
তাঁকে দিচ্ছে সাজা,
বেঁধাচ্ছে গরম লোহা, উপ্ ড়ে নিচ্ছে চোখ
তেলের কড়াইতে করছে ভাজা---
তাঁর বর্ণনার কাছে
এখনকার পাপবিদ্ধ কবিতা কিছু না |
মনে মনে ওঁর জন্যে ঠাকুরকে ডাকতাম :
হে ঠাকুর, কেন ওঁকে শান্তি দাও না ? কেন ওঁকে কর না করুণা !
সকালে শীতের ভোরে তারের বেড়ায়
ঝুলে ঝুলে থাকত যেন নাকের নোলক |
বিকেল বেলায়
সূর্য ডুবে গেলে করত কী মন কেমন |
ছিল একটা খেলনার ঢোলক
ছেলেমেয়ে একসঙ্গে খেলতাম চত্বরে |
কখনও কখনও খুব নরম হাত ধরে
কোনো কিছু না ভেবেই হয়তো বলতাম :
তোর এই আয়মন নাম,
নামের মানেটা কী রে ? আয় মন, আয় মন, নাকি ?
বাঃ, কী সুন্দর গন্ধ,
হাতে বুঝি মেহেদির রং ?
চড়কের আগে আসত সং---
কাছের গ্রামের এক বহুরূপী ; বছরে একবার |
মেসবাড়িতে তার চেয়েও আসত লোক হরেক রকম |
এক আসত শীল্ডে খেলতে নানা জায়গাকার
নামী নামী অনেক প্লেয়ার |
তাদের পা টিপতে গিয়ে আমাদের নিক্ লে যেত দম |
এক এসেছিল শিল্প-প্রদর্শনী নিয়ে
সরকারের লোক এক ; তারই টেবিলে
কাঁচের কাগজচাপা দেখে
জীবনে প্রথম সেই কী-যে হয়েছিলাম স্তম্ভিত !
এজন্যে নয় যে, সেটা কাঁচ |
আসলে কাগজচাপা বসে ছিল দিব্যি সেই কাঁচের মধ্যে গিলে
শ্যামপত্রশোভাসমন্বিত
সম্পূর্ণ একটি গাছ |
আর এসেছিল
বন্যার্ত অঞ্চল থেকে হাতি চড়ে
এক জমিদার, তার দলবলসহ |
সন্ধেবেলা তার ঘরে
বইত রোজ ফুর্তির ফোয়ারা |
দরজায় পর্দা থাকত,
কালোয়াতি গানের গমক,
ঘুঙুরের বোল আর অদৃশ্য ঠমক
উপ্ চে পড়ত মাঝে মাঝে বাইরের মাঠে |
বন্যা নেমে যাওয়ার ঠিক মুখে---
গিন্নি-মা উঠলেন খাটে
সিঁদুর-চন্দনে রাজরাজেশ্বরী সেজে
কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল আহাম্মক ঝিটাই---
মা, তোমার গৌরবর্ণ নীল হল কিসে !
‘কিসে’ শুনতে লোকে নাকি শুনেছিল ‘বিষে’---
সেই দোষে ঝি হল ছাঁটাই |
ব্যাপারটা সকলেরই নাকি জানা
কিছুই জানি নি আমরা কী বৃত্তান্ত---
ছোটদের জানবারও কথা না |
খেতালচাষীরা আসত পাট্টা নিতে ;
তখন সামনের মাঠে পা ফেলা যেত না |
ঘটি নিয়ে ঘুরে ঘুরে জল দিতাম আমি আর দাদা |
শুধু শুকনো ঐটুকু পানিতে
কী করে যে মিলে যায় খোদাতালার এত দোয়া |
--- সেটা ছিল ধাঁধা |
কিছুতে নিতাম না হাতে গুঁজে দিলে কেউ লজেঞ্চুস |
আবগারি-দারোগা হয়ে বাবার যে নামডাক এক—
দাদা বলত, কী জন্যে বল্ তো ?
কারণ, নেনে না বাবা ঘুষ |
জল দিয়ে লজেঞ্চুস
এক রকম ঘুষ |
কাঁথিতে কোথাও কোনো সমুদ্রের ধারে
নুন তৈরি করতে গিয়ে পুলিশের বুটের কাঁটায়
ঝাঁঝরা হয়েছিল যার পিঠ---
সে এল স্ট্রেচারে |
সমস্ত শহর ক্ষুব্ধ ; ফেটে পড়ছি রাগে
আমরা সবাই |
মাঝে মাঝে হাঁক উঠছে : জোর্ সে বলো, ভাই---
বন্দে মাতরম্ |
সারাটা শহর করছে থমথম |
গুপ্তকক্ষে বসে বসে নিজের অস্থিতে
বজ্র যেন বানাচ্ছে দধীচি |
এমন সময়
হে ধরণী দ্বিধা হও, আমি যাই পাতাল তলিয়ে---
ভিড়ের ভেতর থেকে ও কে বলল : ছি, ছি,
তোর বাপ সরকারি চাকুরে !
সন্ধেবেলা একদিন বাপু রে,
মহকুমা হাকিমের কুঠিতে কী ভিড়---
রেডিও শোনাবে এস্-ডি-ওর জামাই |
সকলেই আমন্ত্রিত :
এসেছে সবাই |
মাস্টার, মুনসেফ, ব্যাঙ্ক ম্যানেজার, উকিল, মোক্তার
সিভিল সার্জেন, সোডাকলের মালিক,
থানার দারোগা, সাব-রেজিস্ট্রার, পশুর ডাক্তার---
সবাই এলেন |
একে এস্ –ডি-ওর জামাই
তদুপরি শোনাবে রেডিও |
সুতরাং সবাই হাজির
শহরের মশামাছিটিও |
এদিকে সময় যায় বয়ে |
তার-আলো আলো-তার, এ-কল, সে-কল
এ ছুঁই, তা ছুঁই---
গলদ্ ঘর্ম এস্ –ডি-ওর জামাই বেচারি :
হয় নাকো কিছুতে কিছুই |
শেষকালে শব্দ এল অবিকল
--- হ্যাঁ, হ্যাঁ, একেবারে অবিকল---
কী কাণ্ড, সামনে ডাকছে একগাদা কুকুর-বেড়াল |
এস্-ডি-ওর থোঁতা মুখ ভোঁতা হতে দেখে
একদল কী খুশী !
এস্-ডি-ওর বরাবরে উকিলরা দিল
সরকারকে দুয়ো |
আরেকজন বলল, ঐ জামাতাটি ভুষি |
শেষের দলটি বলল, এ থেকেই বোঝা যায়
রেডিও ব্যাপারটাই ভুয়ো |
বাঁ-দিকে মার্জিন-টানা বালির কাগজ,
গঁদের আঠার শিশি, চাবি আর তালা
লাল-হলদে সুতোর বাণ্ডিল,
শিলমোহর, গালা
---এই নিয়ে ছিল
বাবার টেবিল |
আর ছিল পেন্সিল কাটার একটা ছুড়ি
একদিন ইস্কুল থেকে ফিরে দেখি
হৈ হৈ ব্যাপার |
পেন্সিল কাটার সেই ছুড়ি হাতে, এ কী---
উঠোনে দাঁড়িয়ে মেজো খুড়ি |
বাবার মতলব ছিল নাকি
নিজের গলায় বসাবার |
খাটো করে গলা
‘ওতে কি পেন্সিল ছাড়া’ যেই বলা
আর যায় কোথা !
প্রচণ্ড ধমক অমনি : বড্ড হচ্ছ পাকা |
দিদির শাশুড়ি নাকি লিখেছেন যা তা
দেনাপাওনা এখনও ঢের বাকি |
অথচ দেনার দায়ে
বাবার বিকিয়ে আছে মাথা |
এদিকে চালের দাম উঠেছে আট টাকা |
লোকে বলছে
লাগল বলে আবার লড়াই ||
৫
লিখি নি, ভাগ্যিস !
মা বলতেন : শুনে নে, লিখিস্ ---
পালকি এসে পৌঁছুল দেউড়িতে
সে পেয়েছে শিবতুল্য বর
বুকের ভেতরে করে আনা
আশা তার মেলে দেবে ডানা---
আলো এল, ঘোমটাও সরাল
কে যেন ককিয়ে উঠল : কালো !
দাঁতে দাঁতে কড়মড় কড়মড় |
সেই থেকে সে রাক্ষসপুরীতে |
ভাগ্যিস, লিখি নি |
নইলে শিব গড়তে গিয়ে
হয়ে যেত নিশ্চয় বাঁদর |
মাকে মনে পড়ে |
মা আমাকে বলতেন বাঁদর |
কিন্তু তবু যখনই বৃষ্টিতে ঝড়ে
. চমকাত বিদ্যুৎ
পাশে এসে মা বলতেন হেঁকে
. জয়মণি ! স্থির হও |
যে-মন্ত্রে ঘেঁষে না কাছে ভূত
সে-মন্ত্র তো মার কাছেই শেখা |
আজ তাই শ্মশানে মশানে
কৃষ্ণপক্ষে ভয়ংকর যে-কোনো জায়গায়
যেতে পারি একা |
জলে কিংবা ঝড়ে
এখনও মেঘের দিকে যখনই তাকাই
মনে পড়ে মাকে |
কেন মনে পড়ে ?
মা ছিলেন মেঘবর্ণ |
শুধুই কি তাই ?
৬
দুয়ে আর দুয়ে আপনি ঠিক বলছেন চার ?
দেখুন, আমার একটা কুষ্ঠির দরকার |
ভবষ্যৎটা একটু ভালো করে
জেনে নিতে চাই |
যা যা জানি বলে যাচ্ছি
আপনি তো গণক---
ফাঁকগুলো নিজগুণে ভরে
বানিয়ে দিন না একটা ছক !
প্রথম যুদ্ধের ঠিক পরে |
কত সাল
সেইটাই তো জানি না |
বার বুধ |
ভুলি নি, কারণ---
মা বলতেন : বুধবারে নখ কাটা
আমার বারণ !
রাশিটা বিচারাধীন |
আপনি রায় দিলে
তবেই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে রাশি |
দিদি বলেছিলেন একবার---
যতদূর মনে পড়ছে মীন |
হতেও বা পারে
যে রকম মাছ ভালোবাসি !
মাঘের সংক্রান্তি তিথি |
অকাট্য নির্ভুল |
আরেকটু বলি |
তারপর ইতি |
কী করে জানি না---
আমার মনের মধ্যে জন্মগত ছবি একটা আছে,
একেবারে শীতের শেষদিন |
পাতা নেই গাছে |
দুটি ঠোঁট শব্দ তুলে অন্য দুটি ঠোঁটে
বলে ওঠে :
‘মনে নেই ? কাল মধুমাস’ !
বলেছিল আর কেউ, আমার মা নন |
বললাম তো কারণ---
মা তখন আমাকে নিয়ে যন্ত্রণায় নীল |
এখন পর্যন্ত কবিতাটি পড়া হয়েছে ২৯১ বার
যদি কবিতাটা সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন