আবুল হাসান

গল্প - অসহায় এলাকা

লেখক: আবুল হাসান
প্রকাশ - রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ধরণ: জীবনবাদী

পেনশন পাবার পর এই প্রথম তাঁর মনে হলো তিনি সত্যিই সব কাজ থেকে পেনশন পেয়ে গেছেন। তিনি সত্যি সত্যি অবসরপ্রাপ্ত! সংসারের কোথাও কোনো কাজে তিনি আর অপরিহার্য নন! ছেলেমেয়েগুলো আস্তে আস্তে তার চোখের সামনে বড় হয়ে গেছে। ওরাই এখন সবকিছু চালায়। আগে পেনশনের টাকা আনতে শহরে যেতেন; এখন তাও বন্ধ। মেজো ছেলে সংসার তদারক করে। ও-ই শহরে যায়। পেনশন উঠিয়ে নিয়ে আসে। মাস গেলে মাত্র একশটি তুচ্ছ টাকা! আগে বড় ছেলের দেয়া এক সেট পাজামা পাঞ্জাবী ন্যাপথলিন দেয়া পুরনো চামড়ার স্যুটকেস থেকে সযত্ন সতর্কতার সাথে বের করে, যখোন পেনশন উঠাবার জন্য শহরে যেতেন, তখোন মনে হতো, এখনোও তিনি অপরিহার্য। তাঁর দায়ভাগ কমেনি। স্ত্রী আমেনা তখোন ভোরবেলা উঠে ঘরদোর ঝাট দিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে বসতেন। সচরাচর হয় না, সেই দিনটিতে তাই হতো। সকাল বেলাই নতুন পাতিলে দুটো কাঁচাকলা সিদ্ধ বসিয়ে, উঠোনের মরিচ গাছ থেকে দুতিনটে মরিচ তুলে ভাত বেঁধে দিতেন–গরম ভাতের ফেনার সুগন্ধের মধ্যে মাসের সেই একটি দিন স্ত্রীর চিকন মায়াবী গলা শুনা যেতো। যুবতী থাকাকালীন যে মমতা এবং প্রেমের সাথে তিনি তাঁকে ভাত খেতে এসো বলে ডাকতেন–সেই রকম অবিকল কণ্ঠের নকল সুরটি তার কানে পৌঁছলে তিনি পুরনো দিনের সেই বসন্তভরা দিনে ফিরে যেতেন, ভাবতেন–আমি এখনো আছি। বেঁচে আছি। যে রকম বেঁচে থাকলে মানুষ সুখ-দুঃখের মধ্যে কাঁদতে পারে, হাসতে পারে সে রকম। কিন্তু গত এক বছর হলো স্ত্রীর সেই কণ্ঠের উদ্ধৃত্ত যুবতী স্বভাব কেন যেনো হারিয়ে গেছে। বরং ঘরের এক দিকের বারান্দায় টিন-টলির অভাবে যে থাকার জায়গা ক্রমশঃ কমে আসছে, তার একটা খনখনে অভিযোগ সকাল-দুপুর বিকেলে তিনি শুনতে পান। স্বভাবতঃই স্ত্রীর সামনে ভীরু তিনি। তাই প্রতিবাদ করেন না। বরং একটা অক্ষমতার দুঃখ তার ক্রমক্ষীণায়মাণ সংরক্ষিত দায়িত্বের উপর অন্ধকারের হাহাকার বুলিয়ে যায়। বুঝতে পারেন, যৌবনের আকাক্ষার অনেক জায়গায় তিনি পরাজিত। তার জয়ী হবার সময় বা সামর্থ আর কেউ ফিরিয়ে দেবে না।

বরং সন্তানরা তার একটু একটু বেঁচে থাকার অবসর হরণ করে নিচ্ছে। তার অপরিহার্য উপস্থিতিতে এখন তার নিজস্ব উত্তরাধিকারীদের অধিকার প্রবেশ ঘটেছে। তারাই এখন সবকিছুর মালিক।

এর জন্য অবশ্য তিনি একা একা গোপনে অযৌক্তিকভাবে ক্ষুণ্ণ হন। কিন্তু চাপা স্বভাবের এই পুরুষটির এখানেও পরাজয়ের আভাস ফুটে ওঠে। তিনি জোর গলায় চীৎকার করে তার সন্তানদের কাউকে অভিযোগ করে বলতে পারেন না যে, তিনি এখনো শক্ত সামর্থ্য। দরকার হলে নদীর তলা থেকে ডুব দিয়ে কাদা তুলে আনতে পারেন। যৌবনের সেই উষ্ণ অহঙ্কারে সঙ্গে এখনো পাল্লা দিয়ে তিনি চাই কি প্রমত্ত পদ্মায় ঝাঁপ দিয়ে আবার কুলে উঠে বাড়ী ফিরে আসতে পারেন। গভীর রাতের ঝড়ো হাওয়ায় একা বাড়ী ফিরে দরোজায় এখনো তিনি টোকা দিয়ে বলতে পারেন-আমেনা, দরোজা খোলো আমি এসেছি।

কিন্তু সেইসব সামর্থের কথা নিজের চাপা স্বভাবের তলায় পুরনো বাসের মধ্যে তুলে রাখা নতুন রুমালের মতো ঢাকা পড়ে যায়। এই সময় তার একমাত্র সঙ্গী নিজের কাছের নিজের দীর্ঘনিঃশ্বাস। যা একমাত্র তার নাসারন্ধ্রের অগ্রভাগ স্পর্শ করেই আবার নিজের ভিতর নিভে আসে।

স্বভাবতঃই এই কারণে তিনি নিজেকে সরল এবং নিজের কাছে অপরিহার্য করে রাখার জন্য সবার চোখের আড়ালে ঘরে সীমানার প্রান্তে রতি এক ফালি বাগানের ভেতর রাত না ফুরোতে ঢুকে পড়েন। এই গাছটির পাতা ঠিক করে দেন। ওই চারা গাছটির লতানো শরীরে জমে ওঠা দু’একটা পিঁপড়ে কি রাতের উড়ন্ত বাদুড়ের ফেলে যাওয়া বিষ্ঠার অংশ পরম মমতায় ঝেড়ে ফেলে দিয়ে পরে সকাল ফুটতে না ফুটতেই বাড়ীর উত্তর ভিটের এক ফালি জমিতে বুনে দেয়া শাকসজী ও ক্ষেতে মাটির কলস ভরা জল নিয়ে ঢোকেন। পাছে আবার কেউ দেখে ফেলে এই ভয়ে তাড়াতাড়ি নিষ্ঠাবান কৃষাণের মতো হাত উঁচু করে অঞ্জলীতে জল ঢেলে দিয়ে উঠন্তু শজির মূলে ঝারির জলের মতো পাতলা করে জল ছিটিয়ে অতি দ্রুত ঘরে ফিরে আসেন। আগে ধর্মের দিকে বড় একটা মনোযোগ ছিল না। এখন সময় কাটানোর তাগিদেই হোক অথবা নিজের বদ্ধমূল কিছু কিছু জীবনগত পাপক্ষয়ের ভ্রান্ত বাসনায় হোক ঘরের বারান্দার এক কোণে যত্নে টাঙ্গানো শীতলপাটির জায়নামাজটা বিছিয়ে চিরকালের উপাসনাকারীর মতো পৃথিবীর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানান। সুর করে এলাহান করে সুরা আবৃত্তিতে একদা শৈশবে তার পরিবার তথা তার পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে তাঁর বেশ সুনাম ছিল। বহুদিনের অনভ্যাসে সেই সুললিত ছন্দের সঙ্গীত থেকে এখনো কেন যেন তাঁকে বঞ্চিত করেনি। আগে কেউ ভোরে উঠতো না। কিন্তু এখন তার নামাজ আদায়ের কেতাদুরস্ত অভ্যাস এবং অভিনিরেশের মধ্য দিয়ে বাড়ীর অন্য আর সবাই সকাল বেলায় সূর্য দেখতে দেখতে বিছানা থেকে উঠে যে যার কাজে লেগে পড়ে। এই ভোরে ওঠার লিস্টে অবশ্য তার বড় ছেলেটি বাদ কেননা সে বাড়ীতে থাকে না। মেজো ছেলেটি ইন্টারমিডিয়েট পাসকরে কি এক অজ্ঞাত কারণে বাড়ীতেই রয়ে গেছে। তার একমাত্র মেয়ে, মার হারানো যৌবন নিজের শরীরে সঞ্চয় করে পরম কৃপণের মতো একটু একটু নারী হচ্ছে। তিনি অনুভব করেন তাঁর স্ত্রীর সকল সঙ্গোপন স্বভাবের ছায়া তাঁর ঐ একমাত্র মেয়ের মুখের ছায়ায়। এতে তার আনন্দই হয়। একটি নারীর হারানো সুষমা আর একটি নারীর নিভৃত স্বভাবের মধ্যে ফিরে আসছে, এই ব্যাপারটির মধ্যে চিরকালের কোন রহস্য লুকানো তিনি অবশ্য জানেন না। কিন্তু তার জন্য তার মন উদ্বিগ্ন হয় না। বরং এই অনুভূতি তাকে তার যৌবনের দিকে ফিরিয়ে দেয় তিনি মানশ্চক্ষে দেখতে পান, কোলকাতার চাকরি জীবনের প্রথম পাদে, শুকিয়া স্ট্রীটের একটি দু’কামরা অলা দালানের ভিতর একটি নিরাভরণ চৌকির ধবধবে সাদা চাদরের উপর গ্রামীণ সম্ভ্রান্ত বংশের যুবতী একটি কন্যাকে। যার শরীরে বিবাহের অলংকার ঝলমল করছে। যার উচ্চতা নাতিদীর্ঘ। পেলব শরীরের শনভঙ্গিটি সাদা চাদরে শুভ্রতার ভিতর একেবারেই যেন মানিয়ে গেছে। কানে একছড়া ওয়াসেল মোল্লার দোকানের হাল্কা দুল। লজ্জা মাখানো চিবুকে তার স্বর্ণাভা দুলে দুলে উঠতেই সারা ঘরে একটা অপার্থিব সূর্যাস্ত নেমে এসেছে। সেই যুবতীট তার স্ত্রী আমেনা। মধ্যরাতে যার প্রায়ই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখা অভ্যাস ছিল। যে যুবতী শরীওে সাংঘাতিক সন্ন্যাসভাবের জন্য একটা গোধূলির অলৌকিক স্থিরতায় প্রতিষ্ঠিত থাকতো। যার স্বভাবের মধ্যে যতটা না প্রগলভতা, তার চেয়ে ব্যর্থ প্রেমিকার বেদনা বোধের প্রশান্তি সর্বদা অনস্পর্শ দূরত্বের রহস্য অংকিত থাকতো। এবং যার ফলে বিবাহের প্রথম রাত থেকে তিনি একটু একটু তার স্ত্রীর নিজস্ব শুভ্রতার কাছে সাংঘাতিকভাবে সমর্পিত হয়েছিলেন।

পৌরুষের প্রবল ভোগজনোচিত জ্বরাবোধ তাই তাকে কখনো স্পর্শ না করলেও এবং বিবাহের পর থেকেই নিজের স্বভাবের কিছু কিছু উৎকেন্দ্রিক উগ্রতা থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত করতে পারলেও, সংসারের ভিতরের কোনো কোনো অংশের বৈরাগ্য তাকে যে বিষণ্ণতার মধ্যে বসিয়ে দিয়ে গেছিলো সেই বিষণ্ণতার বন্ধন থেকে অদ্যাবধি তিনি মুক্তিতো পানইনি বরং সংসারের আরো গভীরে তার এই বিষণ্ণ স্বভাবের শিকড় শাখা-প্রশাখা মেলে দিতেই ধীরে ধীরে তিনি তাঁর স্ত্রীর কাছে থেকে মনের দিক থেকে আলাদা হয়ে যেতে থাকেন। আজীবন অন্তর্মুখীন চারিত্রটি তার আরো অন্তর্মুখীন হয়ে পড়ায় তিনি একেবারেই চাপা স্বভাবের পুরুষেরা যেভাবে সংসারের ভিতর থেকে সন্ন্যাসবৃত্তি পালন করে ঠিক তেমন করেই সংসারের চাকা চালিয়ে যেতে থাকেন।

ফলে কোনো পার্থিব উন্নতি তার দ্বারা এ যাবৎ হয়নি। তার সহকর্মরা ইতিমধ্যেই অনেকেই কীর্তিমান পুরুষের খ্যাতিতে অধিষ্ঠিত। কেউ কেউ শহরে জায়গা জমি কিনে বর্তমানে রাজার হালে আছে। কেউ কেউ বাড়ীতে দালানকোষ্ঠা নির্মাণ করে, পূর্বপুরুষের জমিজমার খাতে আরো জমিজমার বৃদ্ধি ঘটিয়ে মোটামুটি সচ্ছল এবং ধনী।

শুধু তিনিই কিছু করতে পারেননি। এর জন্য স্ত্রী আমেনার অনেক দুর্বাক্য তাঁকে মাঝে মাঝে সহ্য করতে হয়। ফলে সংসারের ক্ষয়ক্ষতির হিসেব উঠলেই, ছেলেমেয়দের ভবিষ্যতের কথা উঠলেই, মেয়ের বয়সের উল্লেখ করে তার বিবাহের কথা উঠলেই তিনি তড়িঘড়ি সেখান থেকে উঠে পড়ে আমেনার দুঃখিত গলার অভিযোগ থেকে নিজেকে নিষ্কৃতি দিয়ে তবে বাঁচেন।

আর তাছাড়া ছেলেমেয়েরা সবাই এখন যার যার যৌবনের উত্তাপকে স্পর্শ করেছে। তাদের সামনে স্ত্রীর দুঃখিত অভিযোগ বড় কুৎসিত মনে হয়। যৌবনের বাসন্তী রাত্রিতে যে যুবতীটি এত সুষমাময়ী ছিল, নির্লোভাতুরা নিঃশর্ত ভাবে নেপথ্যচারিণী, সেই যুবতীটি, মাত্র তিনটি সন্তানের মাতা হওয়ার পর এ রকম ঘোর সংসারী হয়ে উঠবে, এটাও তার কাছে কি রকম যেন বেখাপ্পা লাগে। জীবনের কোনো অংকের সাথে নারীর এই লোভ-নির্লোভের অংক তিনি মেলাতে পারেন না। ফলে পরাজয়ের বেদনায় তিনি নিজেকে বড় হীন, অক্ষম ভাবতে শুরু করেন। এই ভাবনা তাঁকে ঘটনাস্থান থেকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করে।

এক সময় ছিল, স্ত্রী আমেনা তার পৃথক বিছানা সন্ধ্যেবেলা গড়ে রাখতেন। মশারী খাঁটিয়ে দিতেন। গ্রামের ঘন গাছগাছালির ছায়ায় রাত্রিকে আরো ঘন-গভীর করে তুলতে তিনি মাঝে মাঝে সেই পৃথক বিছানায় এসে তার শয্যাসঙ্গিণীও হতেন। অপরাহ্নের দুটি মানুষ-দুটি পুরুষ ও রমণীর পাশাপাশি এভাবে শুয়ে থাকার ভিতর তাদের দুপুর বেলার সেই দুটি যুবক-যুবতী মাঝে মাঝে যে সেজেগুজে রাত্রিকে রমণীয় করে তুলতো না, তাও নয়। মাঝে মাঝে এ রকমও ঘটেছে।

দক্ষিণের জানালার মৃদুমন্দ হাওয়ায় মশারীর ভিতর তাদের বিগত দিনগুলোর ভোগ উপভোগের স্মৃতি তখোন একটু একটু উষ্ণতায় তাদের সংসারের টানাপোড়েনের স্থিতিকে কোথায় হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। মনে হয়েছে তার সহকর্মীদের কীর্তিমান হাটে তিনি না যেতে পারলেও মধ্যিখানের একটি পথের পাশের এই নিরিবিলি সঙ্গসুখ থেকে তিনি তো বঞ্চিত হননি। ভাগ্যের প্রতি তখন তিনি আর কুপিত অবস্থা টের পাননি। ভেবেছেন, বেঁচে থাকার সব আয়ুর সীমার মধ্যে এই মুহূর্তের এই প্রাপ্তিই তার সবকিছু। বাড়ী, জমি, ধান সম্পত্তির সচ্ছলতা তার কাছে তুচ্ছ। দারিদ্র তার কিছু না।

কিন্তু ক্রমে দিন ফুরাতেই এখন টের পাচ্ছেন, সবাই তাকে ফাঁকি দিতে উদ্যত। স্ত্রী এখন পরম আরামে বাতের ব্যথায় কাতরে অন্য বিছানায় তার সদ্য যুবতী মেয়েটিকে সখীর মতো জড়িয়ে নিদ্রা যায়। মেজো ছেলে বাড়ীতে ঘুমোয় না মাঝে মাঝে। গ্রামের কিছু উঠতি বয়সের ছেলে ছোকরাদের দলপতি সেজে সে মাঝে মাঝে সমাজ সমিতি রক্ষা করার নামে গ্রামের গুরুজনদের বিরুদ্ধে সারারাত শলাপরামর্শ করে। একটি গোপন সংস্থার সাথে ইদানিং নাকি সে জড়িত হয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে কোথা থেকে চেনা-অচেনা কি সব ছেলেদের ঘরে ডেকে এনে রাত্রির আশ্রয় দেয়। তাদের হাতে ধারালো অস্ত্র-নতুন বন্দুকের নলের চকচকে সঙ্গীন দেখে তিনি কিছু বলেন না। মনে মনে শুধু দেশের রাজনীতিকে শাপ-শাপান্ত করেন। আবার অর্ধাহারে-অনাহারে উৎপীড়িত দেশবাসীর সকরুণ চেহারা মাঝে মাঝে যেন তার বার্ধক্যের পেশীতে যৌবনের সবল বিদ্যুৎ সঞ্চার করে তোলে। তিনি তাদের অস্ত্রের ধার নিজ হাতে স্পর্শ করে যেন তাদেরকে অলৌকিকভাবে দেশোদ্ধারের শপথ করান–যখন রাত্রি বাড়ে তখন তিনি উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। বাড়ীর পোষা কুকুর তার বিছানার পাশে শুয়ে থাকে। তিনি জেগে সেই কুকুরটির গায়ে হাত বুলিয়ে মমতায় তার সাথে এমন ভাবে কথা বলেন, যাতে কেউ টের না পায় যে তিনি জাগ্রত। কুকুরটি তার আদুরে চোখ বুজে আবার হাই তোলে। পাশ ফিরে শোয়। তিনি গলায় হাত বুলাতে বুলাতে, এক সময় কুকুরটি যখন ড্রিায় কাতর হয়ে পড়ে তখোন আবার বালিশে হেলান দিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকেন।

মাঝে মাঝে স্ত্রীর ঘুমঘোরে বাতের ব্যথার কাতরানি শুনে তিনি পার্টিশানের ওপার থেকে নদী পারের মানুষের মতো তন্দ্রাচ্ছন্ন গলায় বলে ওঠেন সান্ত্বনায়–আমেনা, ও আমেনা–কি, বাতের ব্যথাটা আবার বাড়লো নাকি? আমেনা শুনতে পান না। তিনি প্রত্যুত্তর না পেয়ে আবার পাশ ফিরে শুয়ে থাকেন তার রাত্রিতে ঘুম আর আসে না। এই রকম জাগরণ এবং তন্দ্রা তাকে প্রতি রাকে ক্লান্ত করে তোলে। তবুও ভোর হবার আগেই তার প্রকৃতি পরিচর্যার কাজে ছেদ পড়ে না। নামাজ আদায় করতে তিনি এখন রীতিমত উৎসাহী।

শুধু যা অভাব তা হলো কেউ তাকে আর আগের মতো অপরিহার্য ভেবে কোনোকিছু বায়না তোলে না। এমন কি যে বয়সে মেয়েরা বাবার কাছে সাধ সাধনার অলংকার দাবী করে সেই বয়সে সে তার মেয়েটিও যেন নিশ্চিন্তভাবে নির্বাক। পৃথিবীতে কোনো পার্থিব উপকরণ যেন এই মেয়েটির চাহিদায় আসতে ভয় পায়! শহর থেকে মাঝে মাঝে পত্রসহযোগে কিছু সস্নেহ উপদেশ, তাতেই যেন সে আপনাতে আপনি পূর্ণ এবং বিকশিত। এবং আশ্চর্যের বিষয়–যতদিন যাচ্ছে, এই কৃপণ প্রাপ্তির মধ্যে সে ততই সুষমামণ্ডিত হয়ে উঠছে। উর্বর মাটির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা দু’একটি চন্দ্রমল্লাকের গাছ যে কম শ্যামলিমা ধারণ করে সে রকম তার শরীরে শোভা, কোথাও কোনো বাহুল্য নেই। যতটুকু থাকলে চাঁদ জ্যোত্সাপ্রদায়ী, ঠিক ততটুকু থেকে সেও সুষমাময়ী।

মেয়ের এই অনৈশ্বর্যের ঐশ্বর্যে সে অবশ্য তৃপ্ত। বর্তমান বিবাহের বাজারে তার মেয়েটি যে একেবারে অপাংক্তেয় নয়–এটাও তাকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাসের মালিক করে তোলে। অন্ততঃ কালো-কুচ্ছিৎ মেয়ে সম্প্রদান করার পিছনে যে ব্যয় বাহুল্য, সেইটি যে হবে না, তর জন্য তিনি আনন্দিত।

মোটামুটি তার সংসারে দায় দায়িত্ব বলতে এই ৷ কিন্তু স্ত্রীটি যেহেতু ঐতিহাসিভাবে তাঁর কাছে আর কোনো দাবী নিয়ে আসে না এমনকি আগের মতো তার অক্ষমতার জন্যে তাকে তিরস্কারটি পর্যন্ত করে না–মুরগী প্রতিপালনের জন্য একটি খোয়াড়ের দরকার বহুদিন হলো তার স্ত্রী তার সামনে তার মেজো ছেলেকে এই আর্জি তুলে ধমক দিচ্ছে তিনি শুনতে পাচ্ছেন, অথচ একটিবারও তাকে এর জন্য কিচ্ছুটি বলছে না এবং রান্নাঘরের খড়ের আগুনে যে সে ভাত রাঁধতে গিয়ে যারপর নাই কষ্ট পাচ্ছে, কিছু কাঠের দরকার–তা-টি পর্যন্তও যখন মেজো ছেলের দায়িত্বে আমিনা ফেলে দিচ্ছে, তখন তিনি নিজেকে বড়ই অপাংক্তেয় মনে করেন। পোষা কুকুরটি এই সময় তার পায়ের কাছে ঘেঁষে এসে দাঁড়ায় তখন মনে হয় কুকুরটিও যদি তাকে কিছু বলতো। কিন্তু জীবজগতের ভাষা সবটা শেখার ক্ষমতা তো মানুষের নেই। এই অবস্থায় তিনি সংসারের আঙিনা থেকে সরে আসেন। আবার পূর্ববৎ নিজের অতীতে ফিরে যান–বিষণ্ণতা তাকে আচ্ছন্ন করে।

এবং তখোন তিনি জোরে অস্বাভাবিকভাবে পাগলের মতো চীৎকার করে-তারস্বরে সমস্ত আকাশ ফাটিয়ে বলে ওঠেন–আমেনা–আমি কি কিছু খাবো না? আমার ক্ষিদের দিকে দেখছি তোমরা একটুও তাকাও না। তোমাদের হলো কি? বেলা কম হলো নাকি। আমেনা, ও আমেনা, শুনছো।

আমেনার নিপ অবস্থার মধ্যে খোন মেজো ছেলেটা যখোন তার চোখের সামনে দিয়ে বাইরে যেতে উদ্যত হয় তখোন আরো জোরে চীৎকার, ওরা কারা? বলে দিচ্ছি আমার বাড়ীতে ওসব বিপ্লবীদের আড্ডা দেয়া চলবে না। বুঝেছ? আমি কাউকে গোল্লায় যাওয়ার জন্য বাড়ীতে জায়গা দেইনি। রাজনীতি টাজনীতি যাদের পয়সা আছে তারা করুক। আর কোনোদিন যেন না শুনি এ বাড়ীতে কেউ অস্ত্র নিয়ে কানাঘুষা করছে। শুনতে পেলে পিঠের ছাল বাকল শুদ্ধ আমি তুলে নেবো বলে রাখলাম। বুঝেছ? কি, কথা কানে গেল? কথাটা কি শুনতে পেয়েছ? এই যে বলি, ব্যাপারটার মাথামুণ্ড কি ভিতরে ঢুকলো না আবার… আর বলতে পারে না, বুকের ভিতর চিলিক দিয়ে একটা চিনচিনে ব্যথা তাকে থামিয়ে দেয়। তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে আবার বিছানায় গিয়ে সোজা শুয়ে পড়ে বড় ক্লান্তি অনুভব করেন। তাঁর মাথা ঘুরতে থাকে। ভিতর থেকে আমিনার কণ্ঠ সেই সময় তাকে প্রথমবারের মতো শাসনের অনুভূতি দিলে তিনি একটু নিশ্চিন্ত অনুভব করেন। তার মনে আবার নিরীহ শিশুর অভিমান জমে উঠতেই তিন মুখ বালিশে গুঁজে দিয়ে একটি অবদমিত পরাজয়ের কান্না বুকের ভিতর ঘুরিয়ে একেবারে নাভীর নীচে ঠেলে দেন। কারণ এই বয়সে তিনি জানেন, সব অশ্রু, রক্তের উদ্ধৃত অংশ ছাড়া আর কিছু নয়। তা চোখে নামলে চোখ বড় বিশ্রী দেখায়। মুখ কুৎসিত হয়ে ওঠে। মন কিছুতেই আর মানুষের মতো কোনো মমতায় সাড়া দিতে চায় না। স্ত্রীর শাসনের মধ্যে তিনি ফের অন্দরে প্রবেশ করে দেখতে পান, তার জন্য ভাতের থালায় খাদ্য শোভা পাচ্ছে। সরল শিশুর মতো তিনি ক্ষুধার্ত ভঙ্গীতে স্ত্রীর সামনে সেই ভাত খান আর গপ গল্প করে স্ত্রীর গত রাত্রির রান্নার প্রশংসা করেন এই বিশ্বাসে-হয়তো আমেনা তাকে তার স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেয়ার কথা বলবে। নিয়মিত খেতে বলবে। না খেলে এই বয়সে শরীর রক্ষা যে সত্যিই কঠিন, সেই কথাটিও মায়ের মতো তাকে শুনিয়ে দেবে। এ বয়স আসে, যখোন মানুষ স্ত্রীর ভিতরও নিজের হারানো মায়ের মাতৃত্বের ভঙ্গীটর জন্য লালায়িত হয়ে ওঠে সেই বয়সে তিনি তো পৌঁছে গেছেন–অগত্য আমিনার ভিতর যুগপৎ স্ত্রী এবং হারানো মায়ের অনুসন্ধানে তৎপর হয়ে তিনি যখোন ব্যর্থ হলেন কোন থালার শেষ ভাত গোগ্রাসে গিলে তিনি নিজেই কলস থেকে গেলাসে জল গড়িয়ে নিয়ে ঢক ঢক্‌ করে যতটুকু পারলেন, জল খেলেন। স্ত্রীকে শুনিয়ে বললেন, তিনি বাজারে যাচ্ছেন, আসতে রাত হবে। অগত্য দুপুরের ভাত যেনো তার জন্য না রাঁধা হয়। স্ত্রী কোনো কথা বললেন না–নির্বাক নিশূপ এই স্ত্রীলোকটির দিকে তখোন প্রবল ঘৃণায় তাকিয়ে তিনি সোজা বাড়ীর বাইরে চলে যান। বাজারে এসে মনে হলো তাঁর আপন গৃহাঙ্গনটিতে ধীরে ধীরে একটি প্রবেশ নিষেধ’ তার জন্য কেউ যেনো চকখড়িতে ইতিমধ্যেই লিখতে শুরু করে দিয়েছে।

বাজারে এসে তাই তিনি যেখানেই পারলেন নিজের কর্তৃত্ব ক্ষমতার বাহুল্য ঘটিয়ে এর ঝগড়া মিটিয়ে ওর দোকানের দেনাদারদের মধ্যে পুরনো মনোমালিণ্যের ছেদ ঘটিয়ে কিছুটা স্বস্তি পেলেন। একটি দোকানের চালার উপর এই সময় নদীর ওপারের কিংবা হয়তো ভীন্ গ্রামের কিছু সাদা কবুতর দেখতে পেয়ে নিজের অজ্ঞাতে হাত দিয়ে আয় আয় করে ডাকতে আরম্ভ করলেন। তার এই আচরণ বাজারে সমবেত তার জ্ঞাতি ভাই ভ্রাতাদের কাছে অপরিচিত। অকস্মাৎ এই পৌঢ় পুরুষটির প্রগলভতার কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে তারা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো। কেউ ভাবলো শেষ বয়সের এক ধরনের ছেলেমি–কেউ মনে মনে আঁচ করলো হয়তো বহুদিন পর গত রাতে তিনি স্ত্রীসঙ্গ উপভোগ করেছেন–প্রদীপের নিভে যাওয়ার আগে যে রকম হঠাৎ শিখা উদীপ্ত হয় হয়তো গত রাতে হঠাৎ উদ্দীপ্ত যৌবনের উপভোগকালীন আনন্দের রেশ তাঁর এই কবুতর ডাকার মধ্যে ছড়িয়ে আছে।

কবুতরগুলো তার হাতের তালিতে ছত্রখান হয়ে পাখসাটে আকাশের নীলিমা স্পর্শ করতেই কি জানি কেন তিনিও যেন আজ হঠাৎ তাঁর যৌবনের কিছু উদ্ধৃত বাসনায় নিজেকে নিজের পড়ন্ত পৌরুষ ফিরিয়ে দিয়ে ভাবলেন, “আজ রাতে হবে”।

এজন্য তাঁর চিরকালের অভ্যাসমতো দোকান থেকে কিছু তালমিছরী কিনলেন। কিছু গুয়ামৌরী। একটি সুন্দর দেশলাই প্রজাপতি মার্কা। বহুদিন সিগ্রেট খান না। হঠাৎ মনে হলো বাকীতে এক প্যাকেট ভালো সিগ্রেট কিনবেন। কিনলেও তাই। মফস্বলে ক্কচিৎ কদাচিৎ ক্যাপস্টান আসে। তার ভাগ্য ভালো এক দোকানে তিন ঐ ব্রান্ডের একটি প্যাকেট পেয়ে গেলেন। বাজারের এল, এম, এফ ডাক্তারটি শহর থেকে এই ব্রান্ড কিনিয়ে আনেন। ভাগ্যিস তিনি আজ এখানে নেই। নিজেই শহরে গেছেন। সুতরাং দোকানের থেকে প্যাকেটটি পেতে তার বেগ পেতে হলো না। সঙ্গে সঙ্গে কিছু হাল্কা অঙ্গরাগ–যৌবন বয়সে এমন কি মধ্যবর্তী বয়স পর্যন্ত স্ত্রীর রাত্রির সহচর্যের জন্য তিনি যা যা ব্যবহার করতেন অথবা যা যা তার অভ্যাস ছিল, সব তিনি জোগাড় করার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। বহুদিন পর তাঁর এই বিলাসী দ্রব্য সগ্রহের ঘটা দেখে কেউ কিছু বুঝে উঠতে পরলো না। তবে অনেকে মনে করলো হয়তো তাঁর যুবতী মেয়েটির বিবাহের কোনো সম্বন্ধ এসেছে তাদের জন্য হয়তোবা এই বিলাস দ্রব্য যা হোক, মোটামুটি যা পেলেন, তাই হাতে করে নিয়ে তিনি যখোন বাড়ীতে উপস্থিত তখোন অপরাহ্ন। ঘরের দরোজায় টোকা দিতে তার মেয়েটি বেরিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মা কোথায়। ঘুমুচ্ছে’ শুনে তিনি অস্ফুট কণ্ঠে সায় দিলেন : ঘুমোক।

তিনিও রাত জাগরণে জন্য কোনো কিছু খেলেন না। ঘুমিয়ে গেলেন। ঘুম ভাঙ্গতেই সন্ধ্যে। হ্যারিকেনের মৃদু আলোয় অবশেষে তিনি জেগে আমিনার সেই নাতিদীর্ঘ শরীরের ছায়া দেখতে পেলেন ঘরের বারান্দায়। ‘শোনো’ স্বামীর মৃদুকণ্ঠে আমিনার কোথায় যেনো একটা দুঃখ জমে উঠলো। বহুদিন কাছে বসেন না। বহুদিন ভুলেও জিজ্ঞেস করেন না। কেমন আছো শরর পড়ে গেলে পুরষ স্বভাবতঃ স্ত্রীলোকের চাইতে অসহায় হয়ে যায়। এই প্রথম তিনি তার স্বামীর পড়ন্ত বয়সের সেই অসহায়তা দেখে মৃদু ধীর গলায় প্রত্যুত্তর করলেন–বলো।

কিন্তু চাপা স্বভাবের ভদ্র লোকটি এবারও তাঁর উদ্দেশ্য স্ত্রীর কাছে বলতে পারলেন–বিছানায় এক প্রান্তে রাখা বিলাস দ্রব্য দেখিয়ে তিনি স্ত্রীকে অতীতের স্মরণযোগ্য রাত্রি বেলার কথা মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু আমিনা যেনো কিছুই বুঝলো না বারান্দার দোলানো পর্দার এক প্রান্তে তার শেষ যৌবনের রেশ লাগা হাতের দ্রুত সঞ্চালন আরো দ্রুত হতে লাগলো। তার চোখ কেঁপে উঠলো মেঘ থেকে জেগে ওঠা জ্যোৎস্না রাতের দূরাভাবিত দুটি তারকার মতো তিনি বুঝতে পারলেন আমিনার সেই শরীরের সৌরভের কোথায় যেনো সংসারের বহু বিস্ফোরণ লেগে একটা চরম ভ্যাপসা গন্ধের জন্ম হয়েছে–যা কাছে গেলে এবং একেবারে স্পর্শের মধ্যে আনলে আরো তীব্রভাবে তাঁকে জ্বালাবে।

ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারলেন তারা দু’জনেই নিঃশেষিত। ফুরিয়ে গেছেন। তার চোখে এই প্রথম এক বিন্দু জল দেখা গেল। আমিনা সেখানে আর দাঁড়ালেন না। পিছনের সংগৃহীত বিলাদ্রব্যের মধ্যে আমিনার অপসৃয়মাণ ছায়া দেখে তার মনে হলো আসলে তার স্ত্রী তার চাইতেও ক্লান্ত। তার চাইতেও একা। এই নেপথ্যাচারিণীর জন্য হঠাৎ কোথায় যেন তিনি দুঃখ অনুভব করলেন। সংসারের সমস্ত জয়-পরাজয়ের রহস্যের তিনি কোনো কুলকিনারা করে উঠতে পারলেন না।

সংসারের এই জয়-পরাজয়ের রহস্যের দুর্বোধ্যতা তাকে আরো কিছুটা অপাংক্তেয় করে তুলতে লাগলো যেনো। তদুপরি তার স্ত্রীর এই সঙ্গোপন সহনশীলতা এবং একাকিত্বের খবর, এতদিন যে তিনি জানতে পারেননি তার জন্যও নিজের কাছে নিজে কম ধাক্কা খেলেন না। ফলে শরীর এবং মনের একটি দ্রুতসংহার এই মুহূর্তে তিনি টের পেলেন। কয়েক মাস আগে পৃষ্ঠনের সাংঘাতিক যন্ত্রণায় পাগলের মতো মাঠঘাট ছুটে বেড়িয়েছেন। ঘুমোতে পারেননি, খেতে পারেননি। সেই যন্ত্রণার কবল থেকে এখনো তিনি মুক্ত নন। যন্ত্রণা কাতরতা আর জীবনব্যাপী পরাজয়ের মধ্যে অকস্মাৎ এই সন্ধ্যে বেলার শেষ মুহূর্তের অন্ধকারে তীব্র-তীক্ষ্ণভাবে কে যেনো সেই পৃষ্ঠব্রনের ক্ষতচিহ্নের ভিতর বসে সোজা তার হৃদপিণ্ডের পশম ধরে টান দিতে লাগলো। ফলে শেষবারের মতো তাঁর সংগৃহীত সম্ভোগ দ্রব্যাদির মধ্যে ঘরের ভিতরে হ্যারিকেনের লাল কেরোসিনের অল্প-প্রাণ আলোর শিখা এই একটি প্রবল বাতাস পেয়ে উঠতেই তিনি বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলেন। মেঘ থেকে বিদ্যুৎ বেরিয়ে আসার মত তার সমস্ত শিরাতন্ত্রী পুড়ে একটি দমবন্ধ নিঃশ্বাসের সে কি তীব্র উদগমনের প্রচেষ্টা। ধীরে ধীরে এতদিনের সাধের জমানো সংসার তার চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে এলো। তিনি জোরে তার মেয়েকে ডাক দিতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার মুখ নিঃসৃত ‘রানু’ শব্দটি খুব আস্তে বেরিয়ে বেশীদূর আর অগ্রসর হতে পারলো না। কেবল পোষা কুকুরটি মনিবের এতদিনের চেনা গলার দুর্বলস্বরে ছুটে এসে দেখলো, তার প্রিয়জন বাম কাত হয়ে খালি পাটির তক্তপোষের উপর শুয়ে আছে। মাথার বালিশ পড়ে গেছে। ভিতর থেকে হ্যারিকেনের অল্প-প্রাণ আলোর শিখায় বৃদ্ধ লোকটিকে মনে হচ্ছে অগোছালো ঘুমে কাতর। কিন্তু কুকুরটি কেন যেনো সবকিছু বুঝতে পেরে আস্তে তার তক্তপোষে ওঠে উবু হয়ে মনিবের ঠাণ্ডা নিস্তাপ শরীরের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চোখে জল।

এখন পর্যন্ত লেখাটি পড়া হয়েছে ১৮ বার
যদি লেখাটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন