প্রিয়তার অতল ছায়
বৃষ্টি পড়ছিল অঝোরে। ঢাকার ব্যস্ততার মাঝেও কফিশপটা ছিল যেন এক চিলতে নির্জনতা। জানালার পাশে বসে থাকা মানুষটা ছিল অরিত্র। চোখে তার ক্লান্তি, কফিতে হাত ছুঁয়ে আছে, কিন্তু চুমুক পড়ছে না। হঠাৎ দরজা খোলে প্রবেশ করে এক পরিচিত ছায়া— সায়ন্তিকা।
দুজনেই কয়েক মুহূর্ত চুপ। তারপর এক অলিখিত অভ্যাসে দুটো চেয়ারে বসে পড়ে।
সায়ন্তিকা:
“এত বছর পরেও তোমার চোখে সেই পুরনো বিষণ্ণতা… ভালো আছো অরিত্র?”
অরিত্র:
“ভালো থাকার চেষ্টায় আছি।
তুমি কেমন?”
সায়ন্তিকা (হেসে):
“ভালো… যতটা একা মানুষ ভালো থাকতে পারে।
তোমার স্ত্রী? কেমন আছেন তিনি?”
অরিত্র (একটু থেমে):
“ভালো। সংসার সুন্দরভাবে সামলান। ছেলেটাও বড় হয়েছে।”
সায়ন্তিকা:
“তোমার মুখে সেই আলো নেই অরিত্র।
একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
অরিত্র:
“জানো, তোমার প্রশ্ন করাটা এখনো আগের মতোই সুন্দর।”
সায়ন্তিকা (হালকা হাসে):
“তবুও জিজ্ঞেস করছি—
তোমার স্ত্রী কি তোমার প্রিয় নারী?”
সেই প্রশ্নে যেন চারপাশের শব্দ থেমে গেল। বৃষ্টির শব্দ দূরে সরে গেল।
অরিত্র নিচু গলায় বলল—
“স্ত্রী কখনো প্রিয় নারী হতে পারে না।”
সায়ন্তিকার চোখে বিস্ময় আর কষ্ট।
সায়ন্তিকা:
“কী বললে?”
অরিত্র:
“স্ত্রী হয় অভ্যাস… দায়িত্ব…
তাকে সম্মান করি, কৃতজ্ঞতাও আছে।
কিন্তু প্রিয়তা তো অন্য কিছু…
সেটা শুধু তোমার সাথেই অনুভব করেছিলাম।”
সায়ন্তিকা (চোখে জল):
“আমি যদি তোমার স্ত্রী হতাম?”
অরিত্র:
“তবে হয়তো তুমিও একদিন প্রিয়তা হারিয়ে ফেলতে।”
—
রাতের নিস্তব্ধ আলো
রাত। অরিত্রর ঘর। আলো ম্লান। বিছানার পাশে বসে আছে মেঘলা—অরিত্রর স্ত্রী। তার মুখে চুপচাপ অভিমান।
মেঘলা:
“আজ তোমার চোখে অনেক কিছু লুকানো…
তুমি কি সায়ন্তিকার সঙ্গে দেখা করেছিলে?”
অরিত্র (অবাক হয়ে):
“তুমি জানলে কিভাবে?”
মেঘলা
“তোমার চোখের ভাষা পড়তে শিখেছি আমি।
আমি একসময় তোমার প্রিয় নারী ছিলাম, তাই না?”
অরিত্র (নিরুত্তর)
মেঘলা:
“আজ আর আমি সেই প্রিয় নেই, কেবল তোমার স্ত্রী।
দায়িত্বের ছায়ায় প্রিয়তা হারিয়ে গেছে… আমি বুঝি।”
অরিত্র চুপচাপ বসে। মনে হয়, এই স্তব্ধতা চিরন্তন হবে।
হঠাৎ, সে মেঘলার হাত ধরে।
অরিত্র:
“আমরা যদি আজ থেকে নতুন করে শুরু করি?
স্ত্রী নয়, প্রিয় হয়ে।
তুমি কি পারবে আবার আমার সেই মেঘলা হতে, যাকে আমি একদিন হারিয়ে ফেলেছিলাম?”
মেঘলা
“আমি আজও তোমার প্রিয় হতে চাই,
তবে এবার শুধু প্রেমে নয়—প্রজ্ঞায়, বন্ধুত্বে, জীবনে…”
—
ভোরের আলো জানালার কাচ ছুঁয়ে গেছে। মেঘলা রান্নাঘরে গান গাইছে—অনেক দিন পর।
অরিত্র কফির কাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকে দরজার পাশে। তার মুখে এক ধরণের প্রশান্তি।
ভয় হয় না এখন, কারণ সে বুঝেছে—
স্ত্রী কখনো কখনো শুধু স্ত্রী নয়।
যদি ভালোবাসা হারিয়ে না যায়,
তবে স্ত্রী-ও প্রিয় হতে পারে।
আর প্রিয় নারী তো তখনই, যখন সে ছায়া হয়ে পাশে থাকে।

মন্তব্য করতে ক্লিক করুন