রাতের ঢাকা যেন নিঃশব্দ এক মৃত্যুপুরী। স্ট্রিট লাইটের ফিকে আলোয় ছায়ার মতো হেঁটে যায় এক লোক—মলিন পোশাক, ঝুলে পড়া কাঁধ, চোখে এক অনির্বচনীয় বিষাদের ছাপ। তার নাম তৌফিক।
এক সময় সে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের উজ্জ্বল নক্ষত্র। শিক্ষকরা বলতেন—”এই ছেলেটা একদিন দেশের গর্ব হবে।” অথচ আজ সে নিজেই জানে না, কোন মুখে আয়নায় তাকাবে।
তৌফিকের জীবনের পতন শুরু হয় এক রাজনীতিক সন্ধ্যার পর থেকে। হলে নতুন একটা রাজনৈতিক সংগঠনের মিটিং ছিল। বন্ধু ইমন বলেছিল— “দেশ গড়তে হলে রাজনীতিতে আসতেই হবে। তৌফিক মুগ্ধ হয়েছিল, ভাবতে পারেনি সেই পথই তাকে টেনে নিয়ে যাবে এক গভীর অন্ধকারে।
প্রথমে পোস্টার লাগানো, পরে মিছিল, তারপর হাতের মুঠোয় লাঠি। একদিন রাতে প্রতিপক্ষ গ্রুপের সঙ্গে সংঘর্ষ। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি, কারা যেন ইট ছুঁড়ে মারে। এক ছাত্র মারা যায়। পুলিশ তৌফিককে সন্দেহ করে ধরে।
“আমি মারিনি!” — চিৎকার করেছিল তৌফিক, কিন্তু কে শোনে কার কথা?
জেলখানার লোহার গেট তার জন্য খুলে গেল। ভেতরে পাঁচ বছর—না বিচার, না সহানুভূতি। মা এক চিঠিতে লিখেছিল, “তুই আমাদের কলঙ্ক, আর ফোন করিস না।” সে চিঠি এখনো তৌফিকের বালিশের নিচে ভাঁজ করে রাখা।
জেল থেকে বেরিয়ে সে বুঝল, সমাজ তাকে ক্ষমা করে নাই। কেউ তাকে চাকরি দিল না, বন্ধুরা মুখ ফিরিয়ে নিল। তৌফিক একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছিল তার পুরোনো ক্লাসরুম, ভেতরে চলছে ক্লাস। সে হেসেছিল—একটা নিঃশব্দ কান্নার হাসি
এখন সে থাকে ফুটপাতে। রাত হলে এক কোণে শুয়ে পড়ে, দিনভর কাগজ কুড়ায়। তবু কখনো কখনো চুপিচুপি বইয়ের দোকানে গিয়ে পুরোনো ইংরেজি কবিতার বই খুলে পড়ে। হৃদয়ের ভাঙা কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলে—
“I have promises to keep,
And miles to go before I sleep…”
এক সন্ধ্যায় পল্টনের এক চায়ের দোকানে বসে ছিল তৌফিক। পাশে বসা কিছু তরুণ তর্জনী উঁচিয়ে বলছিল—“আমরাই গড়ব নতুন বাংলাদেশ!” তৌফিক চুপচাপ শুনছিল। হঠাৎ সে এগিয়ে এসে বলল, “একটা কথা বলবো, ভাই?”
তারা বিস্ময়ে তাকালো।
তৌফিকের গলা কাঁপছিল, চোখ ভিজে উঠেছিল। “তোমাদের জীবন শুরু, আর আমারটা শেষ… শুধু একটা কথা মনে রেখো—ভুল রাস্তা বেছে নিলে জীবনটা একবারেই ধ্বংস হয়ে যায়। আমি জীবিত থাকলেও, আমি আর বেঁচে নেই। আমি কেবল একটি… অভিশপ্ত জীবন।
তারা চুপ হয়ে গেল। একটি ছেলে ধীরে ধীরে চায়ের কাপ এগিয়ে দিল তৌফিকের দিকে।
তৌফিক বহুদিন পর সেই চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মনে মনে বলল—
“হয়তো আমার গল্প একদিন কাউকে পথ দেখাবে। তবেই হয়তো আমার অভিশপ্ত জীবনের একটু মানে থাকবে।”
অভিশপ্ত জীবন


০
০
সেভ বা রিয়েক্ট করার জন্য লগইন করে নিন!
১২৫
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন