রিপোর্ট ১৯৭১

আসাদ চৌধুরী আসাদ চৌধুরী

প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল
বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম
আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।
এ-সব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে
বৃক্ষের আড়ালে স’রে যায়-
বেড়ার ফোঁকড় দিয়ে নিজের রন্ধনে
তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন দেখে
শুধু মুখ টিপে হাসে।
প্রথম পোয়াতী লজ্জায় অনন্ত হ’য়ে
কোঁচরে ভরেন অনুজের সংগৃহীত কাঁচা আম, পেয়ারা, চালিতা-
সূর্য্যকেও পর্দা করে এ-সব রমণী।
অথচ যোহরা ছিলো নির্মম শিকার
সকৃতজ্ঞ লম্পটেরা
সঙ্গীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গেছে-
আমি তার সুরকার- তার রক্তে স্বরলিপি লিখি।
মরিয়ম, যীশুর জননী নয় অবুঝ কিশোরী
গরীবের চৌমুহনী বেথেলহেম নয়
মগরেবের নামাজের শেষে মায়ে-ঝিয়ে
খোদার কালামে শান্তি খুঁজেছিলো,
অস্ফুট গোলাপ-কলি লহুতে রঞ্জিত হ’লে
কার কী বা আসে যায়।
বিপন্ন বিস্ময়ে কোরানের বাঁকা-বাঁকা পবিত্র হরফ
বোবা হ’য়ে চেয়ে দ্যাখে লম্পটেরক্ষুধা,
মায়ের স্নেহার্ত দেহ ঢেকে রাখে পশুদের পাপ।
পোষা বেড়ালের বাচ্চা চেয়ে-চেয়ে নিবিড় আদর
সারারাত কেঁদেছিলো তাহাদের লাশের ওপর।
এদেশে যে ঈশ্বর আছেন তিনি নাকি
অন্ধ আর বোবা
এই ব’লে তিন কোটি মহিলারা বেচারাকে গালাগালি করে।
জনাব ফ্রয়েড,
এমন কি খোয়াবেও প্রেমিকারা আসে না সহজ পায়ে চপল চরণে।
জনাব ফ্রয়েড, মহিলারা
কামুকের, প্রেমিকের, শৃঙ্গারের সংজ্ঞা ভুলে গ্যাছে।
রকেটের প্রেমে পড়ে ঝ’রে গ্যাছে
ভিক্টোরিয়া পার্কের গীর্জার ঘড়ি,
মুসল্লীর সেজদায় আনত মাথা
নিরপেক্ষ বুলেটের অন্তিম আজানে স্থবির হয়েছে।
বুদ্ধের ক্ষমার মূর্তি ভাঁড়ের মতন
ভ্যাবাচেকা খেয়ে প’ড়ে আছে, তাঁর
মাথার ওপরে
এক ডজন শকুন মৈত্রী মৈত্রী ক’রে
হয়তো বা উঠেছিলো কেঁদে।
র‍্যাঁবো, পাউন্ড চোরের মতন
পা-টিপে পা-টিপে জ্যোতির্ময়
স্যারের কেলাস থেকে চ’লে গ্যালো।
কাচের গ্লাসের মতো ভেঙে গ্যালো ছাত্রাবাস।
পৃথিবীর সব চিন্তা কাগজের চেয়েও দ্রুত পুড়ে গ্যালো,
বারুদের গন্ধে ধন্য গ্রন্থাগার ব্যান্ডেজে সুন্দর।
জনাব উথান্ট,
জাতিসংঘ ভবনের মেরামত অনিবার্য আজ।
আমাকে দেবেন, গুরু, দয়া ক’রে তার ঠিকাদারী?
বিশ্বাস করুন রক্তমাখা ইটের যোগান
পৃথিবীর সর্বনিম্ন হারে একমাত্র আমি দিতে পারি
যদি চান শিশুর গলিত খুলি, দেওয়ালে দেওয়ালে শিশুদের রক্তের আল্পনা
প্লিজ, আমাকে কন্ট্রাক্ট দিন।
দশ লক্ষ মৃতদেহ থেকে
দুর্গন্ধের দুর্বোধ্য জবান শিখে রিপোর্ট লিখেছি- পড়, পাঠ কর।
কুড়ি লক্ষ আহতের আর্তনাদ থেকে
ঘৃণাকে জেনেছি- পড়, পাঠ কর।
চল্লিশ হাজার ধর্ষিতা নারীর কাছে
জুলুমের সবক নিয়েছি- পড়, পাঠ কর।
দুঃখের স্মৃতিতে ডোবা আশি লক্ষ শরণার্থী
শিখিয়েছে দীর্ঘশ্বাসে কতোটুকু ক্রোধ লেখা থাকে।
কোলকাতার কবির মতো কে পারে শোনাতে
‘আমি তোর জন্ম সহোদর?’
অনাহুত বিবেকের ভ্রাম্যমান স্থায়ী প্রতিনিধি হ’য়ে
ক্লান্তিহীন, বিশ্রামবিহীন আমি ছুটে যাই শান্তির সভায়
কখনো দিল্লীতে, মস্কো, লন্ডন, প্যারীর
জনাকীর্ণ সমাবেশে আমি খুঁজি একজন রাসেলের মুখ,
প্রেমের লিপিকা পড়ি জেনেভার জুরীদের কাছে-
পৃথিবীর ইতিহাস থেকে কলঙ্কিত পৃষ্ঠাগুলো রেখে
চ’লে আসি ক্যনাডার বিশাল মিছিলে শ্লোগান শোনাতে।
মানুষের জয় হোক, নিপীড়িত জনগণ জয়ী হোক অন্তিম সমরে।
অসত্যের অন্যায়ের পরাজয়ে খুশি হোক বিশ্বের বিবেক,
পলাতক শান্তি যেন ফিরে আসে আহত বাংলার ঘরে ঘরে।
এখন পর্যন্ত কবিতাটি পড়া হয়েছে ১১৪ বার
যদি কবিতাটা সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন