ঘরের বাহিরে মেঘ
ঘরের বাহিরে মেঘ
নেশান্তপ্রতীক আশরাফ

গল্প - ঘরের বাহিরে মেঘ

নেশান্তপ্রতীক আশরাফ
শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫ জীবনবাদী, ভালোবাসা

প্রথম অনুচ্ছেদ

নতুন চাকরিতে সদ্য যোগ দিয়েছি।
একটা ছোটখাটো প্রাইভেট কোম্পানি।
বেতনের অঙ্কটা বড় কিছু নয়—তবে নিজের দৈনন্দিন খরচ চালানোর মতো যথেষ্ট।
হ্যাঁ, ঠিক এই জায়গাটায় তোমাদের একটা কথা বলা উচিত—
আমি ইফাদ।

ভার্সিটি শেষ করার পর কী করবো, কী হবো—এসব ভেবে রাতের পর রাত জেগে কাটাতাম।
পকেট খরচের জন্য বাসার দিকে হাত বাড়াতে লজ্জা লাগত খুব।
সেই লজ্জার হাত ধরেই একদিন এই চাকরিতে পা রাখি।

তবে গল্পটা আসলে সেদিন রাতের।
চাকরির প্রথম সপ্তাহের শেষে, কাজ শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম।
রাত প্রায় আটটা বাজে।
আকাশ হালকা ভিজে গেছে বৈশাখী বৃষ্টিতে।
আমি বাইকে করে ফিরছিলাম।
তাড়াহুড়ো করে গলির মোড়ে এক চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ালাম।

দোকানদার মামা চা বানাচ্ছিলেন,
আমাকে দেখে বললেন, “ইফাদ, বাড়ির দিকেই যাচ্ছো মনে হয়?”
আমি হেসে বললাম, “জ্বি, মামা। কিছু লাগবে?”

মামা কিছুটা সংকোচে বললেন, “না রে বাবা, তেমন কিছু না।
তবে যদি বাড়ি যাবার পথে একটু আমাদের বাসায় গিয়ে বলে দিস, যেন চায়ের জন্য পানি গরম করে দেয়। পানি ফুরিয়ে গেছে।”

আমি মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি দিলাম, “ঠিক আছে, বলে আসব।”

চায়ের দোকানের পাশেই মামার বাড়ি।
বৃষ্টি তখন থেমে গেছে,
রাতের নরম হাওয়ায় ভিজে গলির বাতিগুলো আরও নির্জন হয়ে উঠেছে।
তবে হঠাৎ কেন জানি বুকের ভিতরটা অস্থির লাগছিল।

আমি সাধারণত কারও বাসায় যাই না, বিশেষ করে যেখানে মেয়েরা থাকে।
আর মামার যে দুই মেয়ে, আগেও একবার দেখেছিলাম—
আমার বয়সীই হবে বা একটু কম।
তাদের সামনে গেলে কেন জানি বুক কেঁপে উঠে,
যেন নিজেরই কণ্ঠস্বর হারিয়ে ফেলি।

এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে ভুগতে দাঁড়িয়ে পড়লাম তাদের বাড়ির সামনে।
এখন মনে হলো আসল বিপদে পড়েছি।
একা, আশেপাশে কাউকে দেখা যায় না।
শেষমেশ সাহস সঞ্চয় করে কলিং বেল টিপে দিলাম।

ভিতর থেকে একটি কণ্ঠ ভেসে এলো—
“আসছি, অনুগ্রহ করে একটু অপেক্ষা করুন।”

আমি থমকে গেলাম।
এ যুগে এমন ভদ্র ভাষা—!
কণ্ঠটা এতটাই মিষ্টি, মন উতলা হয়ে উঠলো তাকে দেখার জন্য।

চাইলেই চিৎকার করে বলে দিতে পারতাম, “মামা বলেছে পানি গরম করতে।”
কিন্তু মনটা চাইল মেয়েটাকে একটু দেখতেই।

দরজাটা খুললো হালকা শব্দে।
মেয়েটি মুখে ওড়না তুলেছে,
কিন্তু চোখজোড়া—
সেই চোখের দিকে তাকিয়ে আমার নিঃশ্বাস কেমন আটকে গেলো।
নিরীহ, গভীর, সরল অথচ মায়ায় ভরা।
মনে হচ্ছিল চোখের ভাষাতেই সে বলে দিলো হাজারটা কথা।

আমি কাঁপা কণ্ঠে বললাম,
“মামা বলেছেন চায়ের পানি গরম করতে।”

বলেই আমি হাঁটা ধরতে যাব,
ঠিক তখনই মেয়েটি আমাকে পিছন থেকে ডাকলো,
“এই… ইফাদ ভাই… এক মিনিট শুনবেন?”

আমি থেমে গিয়ে অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম,
“আপনি… আপনি আমার নাম জানলেন কীভাবে?”

সে হেসে বললো,
“আরে ভাইয়া, আপনি কী করে ভাবলেন আমি আপনাকে চিনবো না!
আপনার পাশের বাড়িতেই তো আমরা থাকি।
আর মনে নেই?
কয়েক বছর আগে আপনি আমাকে ঈদের সালামি দিয়েছিলেন—
আপনাদের বাসায় গিয়েছিলাম সেদিন।”

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।
সত্যি, মনে পড়ে না।
সালামি তো দিয়েছিলাম ঠিকই,
কিন্তু কে ছিল সে?

এরই মাঝে সে বললো,
“আম্মু ডাকছে, একটু ভিতরে আসবেন?”

আমি কিছু না ভেবেই ঢুকে পড়লাম ঘরের ভিতর।
ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসলাম।
চোখে পড়লো— সারমিন আন্টি।

আন্টির একটা স্বভাব আমি চিনি—
কথায় কথায় উপদেশ দেওয়া আর খুঁতখুঁতে মন্তব্য!
আমার রেজাল্ট বের হবার সময়টায় প্রায়ই বাসায় চলে আসতেন,
সমালোচনার তালিকা হাতে।

আন্টি বললেন,
“ইফাদ বাবা, পানি ফিল্টারটা তো দোকানে দিয়ে আসো।
তোমার চাচা তো দোকানে একা, আর বাড়িতে তো কেউ নেই—সব মেয়ে। বুঝতেই পারছো!”

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম,
“আচ্ছা আন্টি, দিয়ে আসি।”

কিছুক্ষণ পর আন্টি মুখে এমন এক প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন,
যেটা শুনে ঘাম ছুটে গেলো—
“ইফাদ, শুনলাম নতুন চাকরি পেয়েছো! বেতন কত রে?”

বুঝে গেলাম—সমালোচনার কামান গরম হচ্ছে।
তাই একটু মিথ্যে বলেই দিলাম,
“হুম আন্টি, ৪০ হাজারের মতো। এমন কিছু না।”

আসলে সত্যিটা হলো, বেতন মাত্র ২০ হাজার।
কিন্তু সমালোচনা এড়াতে সত্য গোপন করতে হলো।

আন্টি চেঁচিয়ে উঠলেন,
“এই জোসনা! পানি গরম হলো না এখনো?”

জোসনা!
হঠাৎ করে নামটা শুনে থমকে গেলাম।
আচ্ছা… ও কি সেই মেয়েটি?
যাকে অনেক বছর আগে ঈদের দিনে জোর করে সালামি দিয়েছিলাম!

মনে পড়ে গেলো, ছোট্ট একটা মেয়েকে একদিন আন্টির সঙ্গে আমাদের বাসায় আসতে দেখেছিলাম।
মায়াবী চেহারা, মিষ্টি হাসি।
তখন আমি আম্মুকে মজা করে বলেছিলাম,
“মা, ঐ মেয়েটাকে আমার বউ করে আনো না!”
আম্মু শুধু হেসে গিয়েছিলেন।

এতদিন পরে সেই মেয়েটি—এই জোসনা?

সে এসে বললো,
“ভাইয়া, এই নেন পানি। আর একটু কষ্ট করতে হবে আপনাকে।
আবার যেতে হবে দোকানে… হয়তো কিছুটা রাগও থাকতে পারে মনে।”

আমি হেসে বললাম,
“আরে না, সমস্যা হবে না। কিচ্ছু না।”

পানি ফিল্টারটা নিয়ে আবার দোকানে গিয়ে দিয়ে এলাম।
তারপর ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম।
শুয়ে পড়লাম বিছানায়—
কিন্তু চোখে ঘুম নেই।
আজকের সন্ধ্যাটা যে মনে কেমন এক দোলা দিয়ে গেলো…

পরে দিন—
খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচিতে। নিচে নেমে দেখি, আমাদের পাড়ার শান্তশিষ্ট একটা ছেলে তার প্রেমিকাকে নিয়ে পালিয়ে গেছে।
চোখে ঘুম আর মনে বিস্ময় নিয়ে যখন ঘরে ফিরলাম, তখনই আম্মু শুরু করলেন তাঁর চিরচেনা ‘প্রকল্প’—

—“ইফাদ, তুই তো এখন চাকরিজীবী, এবার তোর জন্য একটা মেয়ে দেখে ফেলি।”

আমি হেসে বললাম, “মা, বিয়ে করলে সারমিন আন্টির মেয়ে জোসনাকেই করবো।”

সেদিন শুধু কথার ছলে বলা, কিন্তু কে জানতো সেই কথাটাই হঠাৎ এত বড় রূপ নেবে!

পরদিন অফিসে ছিলাম, হুট করে আম্মুর ফোন।

—“ইফাদ, আজ মাগরিবের পরে বাসায় চলে আয়। জরুরি কথা আছে।”

আশ্চর্য! আম্মু তো এমন কখনো করেন না।

ঘটনা বুঝে উঠার আগেই সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখি বাসায় অতিথি—আমার ফুফু, ভাবি, আত্মীয়স্বজন!
আমি অবাক!

—“মা, কী হয়েছে? বাসায় এত লোক কেন?”

আম্মু হেসে বললেন, “তুই তো বলেছিলি তোর জোসনাকে পছন্দ, তাই আজই দেখতে যাচ্ছি।”

আমার চোখ কপালে!

—“মা! আমি তো এমনি বলছিলাম! ওকে তো বহুদিন দেখিইনি!”

—“এসব আমি জানি না! তুই শুধু পাঞ্জাবিটা পরে আয়।”

আমি হতবাক! মনে মনে ভাবলাম—এভাবে যদি ভুলে বিয়েই হয়ে যায়!

আমরা গেলাম জোসনাদের বাসায়। ছোট বোন সাদিয়া দরজা খুলে দিল। ভেতরে ঢুকে দেখি বেশ আয়োজন চলছে। কথাবার্তা শুরু।

আমার ভেতরে তখন প্রচণ্ড এক ঝড়—আমি বিয়ে করতে প্রস্তুত না। হঠাৎ বলে উঠলাম—

—“আমি জোসনার সাথে একটু কথা বলতে চাই।”

ঘরের সবাই এক মুহূর্ত থেমে গেল। তারপর জোসনার বাবা বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুক।”

জোসনা আমাকে একটা ঘরে ডেকে নিল।
চোখ নিচু করে বললো—

—“জ্বি ভাইয়া, কী বলতে চান?”

আমি গলা পরিষ্কার করে বললাম—

—“তুমি আমাকে তো চিনো, তাই না?”

জোসনা মুচকি হাসলো, “গতকালও জিজ্ঞেস করেছেন ভাইয়া!”

আমি বিড়বিড় করে বললাম, “আসলে… নিচে গিয়ে বলে দাও তুমি আমাকে পছন্দ করোনি।”

সে অবাক, “কেন ভাইয়া? কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে নাকি?”

আমি ঘেমে একাকার! “না না, গার্লফ্রেন্ড কিছু না… আসলে… আমার বেতন ২০ হাজার, কিন্তু বলেছিলাম ৪০… আর আমি এখনো নিজেকে সামলাতে পারি না…”

জোসনা হালকা হেসে বলল, “আপনি যতদিন না পারেন যত্ন নিতে, ততদিন আমি আপনার যত্ন নেবো। আর ভাইয়া, আমার বাবা তো চায়ের দোকানি, আমরা তো চলি।”

আমি থমকে গেলাম। এমন সংযত, সরল আর গভীর একটা উত্তর… যেন হৃদয়কে ছুঁয়ে গেল।

আমি নিচে নেমে গিয়ে আন্টিকে বললাম—

—“আন্টি, আমি মিথ্যা বলেছিলাম। আমার বেতন ২০ হাজার। যদি আপনাদের সমস্যা না হয়…”

ঘরে নিস্তব্ধতা।
জোসনা মুখ কালো করে চেয়ে রইল।
কয়েক মুহূর্ত পর আন্টি বললেন—

—“তোমার মতো সৎ ছেলে পাওয়া আজকের দিনে বড় কঠিন। আমরা রাজি।”

সব ঠিক হয়ে গেল।
তবে জোসনার চোখে তাকালে এখনো তলিয়ে যাই, যেন এক গভীর দরিয়ায়।

বাড়ি ফেরার পথে আপু হাতে ধরিয়ে দিলো এক টুকরো কাগজ। বলল, “এটা জোসনার পার্সোনাল নম্বর!”
বাড়ি পৌঁছাতেই সবার দৃষ্টিতে ছিল একরাশ অবিশ্বাস। যেন আমি কিছু চুরি করে পালাবো!
হঠাৎ আপু জিজ্ঞেস করল,

— “কী রে ইফাদ! আজ তুই কী শুরু করলি? তোর জন্যেই তো বিয়েটা ভেঙে যাচ্ছিল!”

আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম,
— “আপু, আমি মিথ্যে বিয়ে করতে চাই না। বিয়ের পর যদি মেয়েটার পরিবার জানতে পারে আমার প্রকৃত বেতন, সেটা ওর সঙ্গে অন্যায় হবে না?”

আপু এক গাল হেসে বলল,
— “তাহলে আন্টিকে মিথ্যে বললি কেন? যাই হোক, তোর পছন্দই তো মানতে হবে। জোসনা শুধু নামেই নয়, রূপেও একেবারে জ্যোৎস্নার মতো।”

আমি বললাম,
— “তুই তো জানিস, আন্টিকে একবার কিছু বললেই সমালোচনায় ভরে ফেলে চারদিক। তাই একটু ঢেকে বলেছিলাম। জানতাম না এত দূর গড়াবে।”

আপু কণ্ঠে রহস্য জড়িয়ে বলল,
— “তোর জন্য একটা জিনিস এনেছি, তবে টাকা দিতে হবে আগে।”

আমি হেসে বললাম,
— “কি জিনিস বলো, আপু? টাকা দেবো।”
সে বলল,
— “৫০০ টাকা দে আগে। আগেরবারের মতো কাজ হাসিল করে টাকা না দিলে এবার কিন্তু হবে না।”

অবশেষে ৫০০ টাকা হাতে দিয়েই পেলাম জোসনার ব্যক্তিগত নাম্বার। মনে মনে ভেবে নিলাম, আজই কথা বলতেই হবে।

রাতের খাবারের পর সাহস করে কল দিলাম। প্রথমবার ধরল না। দ্বিতীয়বার ধরতেই অপর প্রান্তে এক স্তব্ধতা।
— “আসসালামু আলাইকুম,” আমি বললাম।
— “আপনি কে?”— তার কণ্ঠে একরাশ বিস্ময়।
— “আমি ইফাদ, চিনতে পারলেন না?”
— “নাম্বার পেলেন কোথা থেকে?”
— “পেয়ে গেছি। সমস্যা কিছু?”
— “না, কিন্তু আজ আপনি যা করেছেন, তা ঠিক হয়নি।”

আমি থমকে গিয়ে বললাম,
— “আমি আবার কী করলাম?”
— “সবাইয়ের সামনে আপনি আমার সম্পর্কে যা বললেন, তা মেনে নেওয়া সহজ ছিল না। আমি তো বেতন কম শুনেও কিছু বলিনি। আম্মুকেও বলেছিলাম ঠিক আছে।”

— “আচ্ছা, সরি,” আমি মাথা নিচু করে বললাম।

জোসনা আবার বলল,
— “ভাইয়া, আমি তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাই না। কিন্তু পরিবার চাপ দিচ্ছে।”
আমি বললাম,
— “তুমি যদি চাপে বিয়ে করো, সেটা কি ঠিক হবে? আমি তো তোমাকে পছন্দ করতাম অনেক আগে থেকেই। তুমি ভাবো, আমি তোমাকে চিনতাম না? যেদিন তোমায় সালামি দিয়েছিলাম, সেদিন থেকেই তোমার খোঁজ রাখতাম।”

জোসনা থেমে কিছুটা আবেগ নিয়ে বলল,
— “আমি জানতাম, আপনি বাড়ির আশপাশেই থাকেন। আমিও জানালার পাশ থেকে দেখতাম, আপনি কখন ভার্সিটিতে যাচ্ছেন। সত্যি বলতে, ঐ দিন থেকেই আপনাকে ভালো লেগেছে। কিন্তু পরিবার চাপে পড়ে সরাসরি বলতে পারিনি।”

সেই রাতটা কাটলো ভালোবাসার এক আবেশে। বলতে পারিনি, “ভালোবাসি”—এই কথাটা। ভেবেছিলাম, পরে একদিন বলব।

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি মেসেজ:
— “আজকে একটু দেখা করতে বলছে আম্মু।”

তারপরই অফিস থেকে কল এলো।
— “ইফাদ ভাই, আপনার প্রমোশন হয়েছে।”

আমি বিস্ময়ে বললাম,
— “কি! মাত্র দুই মাস হলো জয়েন করলাম।”
— “আপনার পরিশ্রমই আপনাকে এই জায়গায় এনেছে। আপনি এখন সহকারী ম্যানেজার। বেতন ৭৫ হাজার, সঙ্গে ট্যুর, গাড়ি ও আরও সুবিধা।”

মনে মনে ভাবলাম, জীবন বুঝি এবার একটু আলোকিত হলো। কাল রাতে এনগেজমেন্ট, আজ প্রমোশন। প্রথম সুখবরটা তাকেই দেবো।

হঠাৎ এক অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ এলো:
— “আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। পার্কে চলে আসেন।”

আমি ভাবলাম, নিশ্চয়ই জোসনা। কিন্তু অচেনা নম্বর কেন?

তবুও প্রস্তুতি নিলাম। খালি হাতে কী করে যাই! বন্ধুকে ফোন দিলাম।

— “আসাদ ভাই, শুন, একটা দরকার আছে।”
— “বলো কী হলো?”
— “জোসনার সাথে আমার এনগেজমেন্ট হয়েছে। সে হয়তো আমাকে দেখা করতে বলেছে।”
— “তাই নাকি! অভিনন্দন! তবে ভাই, যদি সে হয়, তাহলে তো বাসায় ডাকত, পার্কে কেন?”

আমি বললাম,
— “ভাই কিছু বুঝতে পারছি না। আজই প্রমোশন হয়েছে, আগে তাকেই জানাবো বলে যাচ্ছি।”

আসাদ বলল,
— “ওকে, চকলেট আর একটা তাজা লাল গোলাপ নিয়ে আসছি।”

১৫ মিনিট পর সে এসে বলল,
— “নে ভাই, রাতে দেখা হবে।”

গোলাপ হাতে পার্কে পৌঁছলাম। কিন্তু গিয়ে দেখি, সেখানে জোসনা নয়, এক অচেনা মেয়ে বসে আছে…

আমি হঠাৎ থমকে গেলাম। যাকে ভেবেছিলাম সে— জোসনা, সে তো নয়।
নাম্বারে টেক্সট করলাম, দেখলাম মেয়ে উত্তর দিচ্ছে!
আমি অবাক হয়ে পড়লাম, জোসনা তো কোনো বার্তা পাঠায়নি।
তাহলে হাতে থাকা গোলাপ আর চকলেটগুলো এখন কী হবে?

ভাবলাম, যাই, আগে গিয়ে কথা বলে দেখি—
তবে একটা বিষয় স্পষ্ট— ভীষণ ভয় লাগছে!
অপরিচিত একটি মেয়ে, তাও সামনাসামনি দেখা করতে চাইছে!

আমি সাহস করে তার সামনে দাঁড়ালাম।

মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— ‘‘আপনি এসেছেন! আমি-ই আপনাকে টেক্সট করেছিলাম।’’

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,
— ‘‘কিন্তু কেন? আমি ভেবেছিলাম আপনি জোসনা। আর আপনি নাম্বার পেলেন কোথা থেকে?’’

সে হেসে বলল,
— ‘‘ভাইয়া, আগে শুনেন আমি কেন টেক্সট করেছি।’’

আমি বিরক্ত স্বরে বললাম,
— ‘‘শোনাও, আমার তাড়াতাড়ি কাজ আছে।’’

সে বলল,
— ‘‘অভিনন্দন ভাইয়া! শুনেছি আপনি প্রমোশন পেয়েছেন!’’

আমি বিস্ময়ে তাকালাম।
এ কথা তো অফিস ছাড়া কেউ জানে না।
আর মেয়ে তো আমাদের অফিসেরও নয়!

আমি বললাম,
— ‘‘ধন্যবাদ। তবে আপনি জানলেন কীভাবে? আমি তো আপনাকে চিনিও না।’’

সে মৃদু হেসে জানাল,
— ‘‘আমি নতুন অফিসে জয়েন করেছি ভাইয়া, আর আমি-ই আপনার পদে নিয়োগ পেয়েছি।’’

আমি অবাক হয়ে বললাম,
— ‘‘ও আচ্ছা! আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি আমার ব্যক্তিগত নাম্বার পেলেন কীভাবে?’’

সে বলল,
— ‘‘আমি আপনাকে আগে থেকেই চিনতাম। আর আপনি কাকে ভেবে এসেছেন, সেই জোসনার কাছ থেকেই নাম্বার নিয়েছি।’’

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,
— ‘‘তুমি বলো তো, আমি এখানে কাকে ভেবে এসেছি? আর কার কাছ থেকে নিয়েছো?’’

সে হেসে বলল,
— ‘‘আমি আর জোসনা স্কুলজীবনের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। জানি সে আপনাকে পছন্দ করত, আপনি তাকে।
সে কখনো নিজে কিছু বলতো না, বললেই হয়তো অনেক কিছু বদলে যেত।’’

মেয়েটি আরও বলল,
— ‘‘আমি যখন তাকে বললাম আমার নতুন চাকরির কথা, সে জানতে চাইল অফিসের নাম। আমি বললাম—
তখন সে অবাক হয়ে বলে, ‘ওটা তো ইফাদের পদ! ওর জায়গায় তুই নিয়োগ পেলি!’
তখন আমি বুঝলাম, আপনি আমাদের অফিসেই কাজ করতেন।
আর জোসনা তখন জানাল, কাল রাতে আপনার সঙ্গে তার এনগেজমেন্ট হয়েছে।’’

আমি হতবাক!
আর মেয়েটি একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে কারও ফোনে কল দিল।
কিছুক্ষণ পরই দেখলাম জোসনা এক কোণ থেকে আসছে—
হিজাবে ঢাকা, পায়ে মোজা। আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।

জোসনা বলল,
— ‘‘এ যে আমাদের নতুন সহকারী ম্যানেজার! অভিনন্দন।’’

আমি কিছুটা হেসে বললাম,
— ‘‘ধন্যবাদ। তবে এই ‘সহকারী ম্যানেজার’ শব্দটা যেন একটু বেশি আনুষ্ঠানিক শোনাল।’’

জোসনা বলল,
— ‘‘আপনি বলার আগেই আমি জেনে গেছি। কিন্তু আপনার হাতে কী?’’

আমি সেদিকে তাকিয়ে বলতে গিয়েই হাত থেকে ফুল আর চকলেট পড়ে গেল।

জোসনার মুখে রাগের লাল ছায়া!
আমি বললাম,
— ‘‘এই নাও, তোমার জন্য এনেছিলাম। তোমাকে চমক দিতে এসে নিজেই চমকে গেলাম!’’

কষ্ট করে কোনোভাবে ফুল আর চকলেট দিলাম, বাড়ি ফিরে এলাম।
বাড়িতে এসে দেখি মা ও পরিবারের সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি বললাম,
— ‘‘কি হলো আম্মু, সবাই এমনভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’’

মা বললেন,
— ‘‘তুই কই গেছিলি? তোর প্রমোশনের খবর তুই বললি না যে!’’

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— ‘‘কে বলেছে তোমাকে?’’

মা বললেন,
— ‘‘তোর সারমিন আন্টি বলছে।’’

আমি মাথা নেড়ে বললাম,
— ‘‘আচ্ছা আম্মু, অফিসে যাই। ফিরে এসে কথা বলবো।’’

অফিসে গিয়ে দেখি সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছে, ট্রিট চাইছে।
হালকা আয়োজন করলাম ঠিকই, কিন্তু মনের ভেতরে চলতে লাগল এক অদ্ভুত ঝড়।

রাত হলে ফোন করলাম জোসনাকে—
প্রথম রিং-এই রিসিভ করল।

আমি বললাম,
— ‘‘আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছো?’’

জোসনা বলল,
— ‘‘ওয়ালাইকুম সালাম। আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন, ম্যানেজার সাহেব?’’

— ‘‘ভালো আছি। খেয়েছো?’’

— ‘‘না, খাবো। আপনি?’’

— ‘‘আমি-ও এখন খাবো। আজ একটু দেরি হয়ে গেল।’’

— ‘‘তাহলে আগে খেয়ে নিন, তারপর কথা বলবেন।’’

আমি বললাম,
— ‘‘আচ্ছা।’’

খাওয়ার পর কল দিতে গিয়ে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি ফোনে ১০৮টি মিসড কল!
আর মেসেজে একগাদা রাগের ইমোজি।

আমি তড়িঘড়ি কল দিলাম—
তিনবার কল করলাম, ধরল না।
পাঁচবার পরও সাড়া নেই।

চিন্তিত হয়ে তার মাকে কল দিলাম।

— ‘‘আসসালামু আলাইকুম আন্টি।’’

— ‘‘ওয়ালাইকুম সালাম। হ্যাঁ বাবা, কে বলো তো?’’

— ‘‘আমি ইফাদ।’’

— ‘‘আরে বাবা! কেমন আছো? প্রমোশনের কথা শুনেছি। খুব ভালো লাগলো।’’

আমি বললাম,
— ‘‘আন্টি, জোসনা ফোন ধরছে না, শরীর খারাপ কিছু?’’

আন্টি বললেন,
— ‘‘না রে বাবা, কাল রাতেও ভালো ছিল। আজ ফজরের সময় দেখিনি। দেখছি গিয়ে।’’

আমি চিন্তিত হয়ে বললাম,
— ‘‘আচ্ছা আন্টি, একটু দেখে জানান যেন। অনেক চিন্তায় আছি।’’

আন্টি আশ্বস্ত করলেন।
আর আমি ভাবতে থাকলাম—

ঘণ্টাখানেক পরে…

জোছনা কল দিলো—
— হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। আপনার সঙ্গে আমার আর কোনো কথা নেই।
আমি হালকা গলায় বললাম—
— সরি… গতকাল রাতে একটু ক্লান্ত ছিলাম, তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আপনার কী হয়েছিল? কল ধরছিলেন না তো!
জোছনার কণ্ঠে অভিমানের ছায়া—
— রাখেন আপনার সরি! সারারাত ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভোরে চোখ লেগে গেছে। কল ধরতে পারিনি। সব দোষ আপনার!
— আচ্ছা বাবা! সব দোষ আমি মেনে নিলাম। এখন বলুন, কী করছেন?
— এই তো আবার শুরু হলো! কী আর করবো, আম্মু ঘুমাতে দেয়নি… ঘুমিয়ে পড়বো ভাবছি।
— আচ্ছা, মিস শুনো রাগ করা কিন্তু ভালো না। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি এখন অফিসের দিকে রওনা দিচ্ছি।
— অফিস মানে? তাহলে এখন আমার সঙ্গে আর কথা বলবেন না?
— আরে না না, কী বলছেন! কথা তো বলছি। কিন্তু অফিসও তো যেতে হবে, তাই না? সারাদিন যদি শুধু কথা বলি—
— যাবেন না! কে যেতে বলেছে? আমার সঙ্গে আর কথা বলবেন না।
— জোছনা, একটু বুঝে বলো! নাহলে এখনই বাসায় গিয়ে তুলে নিয়ে আসবো।
জোছনা মনে মনে বলল, “তোমার হাত ধরে চলে যাওয়াই তো চাই।”
— না, বুঝবো না কিছুই! এসে নিয়ে যাও।
— ঠিক আছে। তাহলে আমি আর অফিসে যাচ্ছি না!
— আরে পাগল! কে বলেছে না যেতে? একটু দুষ্টুমি করলাম শুধু। তাও বুঝতে পারলে না! আচ্ছা, অফিসে গিয়ে আমাকে কল দিবেন কিন্তু।
— ঠিক আছে মিস! অফিসে পৌঁছে আপনাকে কল দেব, কথা দিলাম।

এই বলে আমি অফিসে চলে গেলাম। অফিসে পৌঁছে কথা রাখলাম, তাকে কল করলাম। কিছুক্ষণ কথা বললাম— হাসি, অভিমান, আদর আর ভালোবাসা মিলেমিশে একাকার।

এইভাবেই চলতে থাকল আমাদের দিনগুলো।
হঠাৎ একদিন খবর এলো—
আমাদের বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে। সামনে বৃহস্পতিবার!

দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ

বিয়ে— একজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে পরিপূর্ণ এক বাঁক। যেখানে একজন মানুষ শুধু সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হয় না, সে হৃদয়েরও দায়ভার নেয়, জীবনের অনিশ্চয়তা আর ভবিষ্যতের ভারে নতুন করে দাঁড়ায়।

আজ সেই দিন, যেদিন ইফাদের জীবনে জীবনের নতুন পরিচয় যুক্ত হচ্ছে— একজন ‘স্বামী’ হিসেবে।

চারদিকে সাজসজ্জা, কুশল বিনিময়, হালকা হাসির আওয়াজে ঘরের উঠোনে যেন পূর্ণিমার রাত্রি নেমেছে।
বাতাসে আতরের মৃদু ঘ্রাণ, রঙিন কাগজের পাখা ঘুরছে ঘরের কোণে কোণে।
একটা নিঃশব্দ প্রস্তুতি চারদিকে— যেন জীবনের মঞ্চে বড় কোনো নাটক আজ শেষ দৃশ্যের দিকে যাচ্ছে।

ইফাদ, মাথায় সাদা গরম পাগড়ি, গায়ে দুধ-সাদা পাঞ্জাবি, মুখে সামান্য গাম্ভীর্য।
তার চোখে একরাশ আলো, কিন্তু সেই আলোয় লুকিয়ে আছে এক অজানা ছায়া।
সে যেন হাসছে, অথচ ভেতরে কোথাও চাপা এক টানাপোড়েন।

সব আয়োজন যখন শেষ পর্যায়ে, ঠিক তখন,
ফোনটা কেঁপে ওঠে।
ইফাদ সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে একটু আড়ালে গিয়ে ফোনটি কানে তোলে।

— “হ্যালো, ইফাদ ভাই? আমি হেড অফিস থেকে বলছি।
আজই আপনার বদলির ফাইনাল আদেশ এসেছে।
নতুন পদে আপনাকে ১৪ দিনের মধ্যেই রাজশাহী অফিসে জয়েন করতে হবে।
সহকারী ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতির পাশাপাশি দায়িত্বও বাড়বে।”

কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ইফাদের বুকের ভিতর যেন কিছু একটা গড়িয়ে পড়ে।

তার বদলি মানে— এই নতুন জীবনের শুরুতেই পরিবার ছেড়ে একটি অজানা শহরে চলে যাওয়া।
নতুন পরিবেশ, নতুন দায়িত্ব, নতুন সংগ্রাম।

সে একদৃষ্টিতে ঘরের ভেতরের আলোকোজ্জ্বলতা ও মানুষের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এই আনন্দের ঠিক মাঝখানে এখন সে কীভাবে বলবে এমন একটি সংবাদ?

তবু নিজেকে সামলে আবার আয়নায় তাকায়।
চেহারায় উৎসবের রঙ মেখে সে ফিরে যায় অনুষ্ঠানে।
কিন্তু তার চোখ যেন বলছে— “আমি বুঝতে পারছি না, কী রেখে যাচ্ছি, কী নিয়ে যাচ্ছি।”

এদিকে জোসনা নিজের ঘরে বসে আছে।
রেশমি শাড়িতে সাজানো, হাতে মেহেদির রঙ।
চোখে কিছুটা লাজুকতা, কিছুটা কৌতূহল—
সে আজ একজন কন্যা থেকে স্ত্রী হয়ে উঠছে।

কিছুক্ষণ পর, আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে,
মাঝরাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় ইফাদ।
একাকী, নির্জন, ভারাক্রান্ত।

এই সময়, ধীরে ধীরে পেছন থেকে এসে দাঁড়ায় জোসনা।
সে ইফাদের গাম্ভীর্য অনুভব করতে পারে।

— “আপনি এত চুপ কেন?”
— “না, এমনি… একটুখানি চিন্তায় আছি।”
— “কোনো সমস্যা?”

ইফাদ একটু সময় নেয়, তারপর ধীরে ধীরে বলে,

— “আমার বদলি হয়েছে।
রাজশাহী হেড অফিসে যোগ দিতে হবে ১৪ দিনের মধ্যে।
এমনটা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল।
ভেবেছিলাম, বিয়ের পর কিছুটা সময় তোমায় পরিবারের কাছে স্বস্তিতে রাখতে পারব।
কিন্তু…”

জোসনা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে।
তারপর মৃদু হেসে বলে—

— “আপনি কি মনে করছেন, আপনি একা যাবেন?
আপনি যেখানে, আমিও সেখানে।
আপনি দায়িত্ব পালন করবেন, আমি ভালোবাসা।
এটাই তো আজকের রাতের প্রতিশ্রুতি।”

ইফাদের বুকের ভেতর জমে থাকা ভার যেন হালকা হয়ে যায়।
সে বুঝতে পারে, এই সম্পর্ক শুধু ভালোবাসা নয়—
এটি বোঝাপড়া, পরিপক্বতা এবং একে অপরকে সঙ্গ দেওয়ার সাহস।

সে নিচু স্বরে বলে—

— “তুমি থাকলে, আমার নতুন শহর অচেনা নয়।
তুমি থাকলে, আমার জীবন কঠিন নয়।”

বারান্দার ওপর দিয়ে হালকা বাতাস বইছে।
মেঘ পেরিয়ে চাঁদের আলো এসে জোসনার মুখে পড়ে।
সে আলোয় দাঁড়িয়ে, দু’জনে একসঙ্গে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে।

এই ভবিষ্যৎটা এখন কেবল তাদের দু’জনার।

রাত প্রায় মধ্যগামী।
চারপাশ নিস্তব্ধ, কেবল দূরে কোথাও একটি কুকুরের ডাক আর বাতাসে ফুলের মৃদু গন্ধ।
আকাশে চাঁদ ঠিকরে পড়ছে জানালার ফাঁক দিয়ে, ঘরের অন্দরমহলকে দিচ্ছে এক মায়াবী ছায়া।

ঘরটি সাজানো হয়েছে বৈবাহিক রাতের জন্য।
বিছানার চারপাশে ঝুলছে ফুলের মালা, যেন আর্শীবাদ হয়ে মাথার ওপর থেকে নেমে আসে।
মেঝেতে ছড়িয়ে আছে গাঁদা, রজনীগন্ধার পাঁপড়ি।
ঘরের এক কোণে রাখা একটি ধূপকাঠি জ্বলছে ধীরে ধীরে, তার ধোঁয়া যেন মেঘের মতো অলসভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছাদের কোণে।

এই ঘরের একপাশে বসে আছে নতুন কনে— জোসনা।

সাজের ভারে যেন নুইয়ে আছে তার অবয়ব।
রেশমি শাড়ি, হাতে গাঢ় মেহেদির রঙ, —
চোখে একধরনের লজ্জা ও কৌতূহলের সংমিশ্রণ।
সে মাথা নিচু করে বসে আছে নিঃশব্দে, আঁচল দিয়ে মুখ আড়াল করে রেখেছে, যেন চোখের ভাষা প্রকাশ না পেয়ে পড়ে।

তার অপেক্ষার প্রহর কাটছে ধীরে ধীরে।
এই প্রথম, সে আজ একজন কন্যা থেকে স্ত্রী হয়ে উঠছে—
একটি নতুন পরিচয়, একটি নতুন দায়িত্ব, এবং একটি অচেনা অথচ আশ্রয়প্রাপ্ত সম্পর্ক।

অপরদিকে, ইফাদ ঘরের বাইরে কিছুক্ষণ নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিল।
তার বুকের ভিতর চলছে এক অজানা সঙ্কোচ, এক নতুন ভয় আর উত্তেজনা।
সারা দিনের ক্লান্তি যেন এই মুহূর্তে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

কিন্তু সে জানে, আজ তাকে শুধু একজন স্বামী নয়, একজন বন্ধু, একজন আশ্রয়দাতা হয়ে উঠতে হবে।
সে আস্তে করে দরজার কড়ায় টোকা দেয়।

ভেতর থেকে কোনো শব্দ আসে না।
তবু সে ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করে।

আলো ম্লান, বাতাসে শীতলতা, ঘরের ভিতর জোসনার মুখে পড়ে চাঁদের রূপালি ছায়া।
ইফাদ কিছুক্ষণ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে।
তার চোখ জোসনার দিকে স্থির হয়ে থাকে—
একজন নারীর ভিতরকার ভয়, সঙ্কোচ, শুদ্ধতা— সব একসাথে ফুটে উঠেছে সেই নিঃশব্দ অবয়বে।

সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে।
জোসনার পাশেই বসে পড়ে মৃদু স্বরে বলে—

— “আজকের এই দিনটা, এই রাতটা,
আমি কল্পনা করেছিলাম অনেকবার, অনেকভাবে।
কিন্তু এখন, তোমাকে সামনে পেয়ে, কোনো শব্দই যেন যথেষ্ট মনে হচ্ছে না।”

জোসনা কোনো কথা বলে না।
শুধু মাথা আরও নিচু করে বসে থাকে।
তার বুকের ধুকপুকানি যেন বাতাসেও শোনা যায়।

ইফাদ একটু এগিয়ে বলে—

— “আমি জানি, তুমি লজ্জায় আছো। ভয় হয়তো পেয়ে থাকো।
তবে আমি কথা দিচ্ছি, তোমার এই ভয়, এই অচেনা অনুভব— আমি ভাগ করে নিতে চাই।
আমি শুধু তোমার স্বামী নই, আমি তোমার নির্ভরতা হতে চাই।”

এতদিন যে কথা বলা হয়নি, আজ সে তা হৃদয় থেকে বলে ফেলে—

— “জোসনা, আমি হয়তো খুব ধনী নই।
তোমাকে রাজপ্রাসাদ দিতে পারব না।
কিন্তু আমি চাই, আমার হৃদয়ের প্রতিটি অনুভব তুমি বুঝতে পারো।
তুমি আমার সম্মান, আমার ভালোবাসা।
আজ থেকে তুমি শুধু আমার স্ত্রী নও, তুমি আমার ঘর, আমার পৃথিবী।”

এই প্রথম, জোসনা ধীরে ধীরে চোখ তোলে।

তার চোখে ভেসে উঠেছে অশ্রু, কিন্তু সে কাঁদছে না—
সে হাসছে, এমন এক হাসি, যেখানে সম্মতি আছে, আস্থার ছায়া আছে।

সে নরম স্বরে জবাব দেয়—

— “আমি এসেছি, শুধু ঘর বাঁধতে নয়…
এসেছি তোমার সঙ্গে পথ চলতে, হাসি-কান্না ভাগ করে নিতে।
তুমি যেখানে থাকবে, আমি সেখানেই থাকব।
আমি চাই, তুমি যত বড় হও, তোমার পাশে আমার জায়গাটা যেন ছোট না হয়ে যায়।
আর হ্যাঁ, আমি ভয় পাইনি। আমি অপেক্ষা করছিলাম— এই কথাগুলোর জন্য।”

এই সংলাপের পর আর কোনো শব্দ লাগে না।
নীরবতা নেমে আসে চারপাশে, কিন্তু সেই নীরবতাও এখন অর্থপূর্ণ।

ইফাদ ধীরে হাত বাড়িয়ে জোসনার হাত ধরে।
তাদের চোখে চোখ মেলে—
প্রথমবার, যেন অনেক পুরোনো চেনার মতো এক গভীর আত্মিক সংযোগ হয়।

ঘরের আলো নিভে আসে ধীরে ধীরে।
মোমের শিখা শেষ হয়ে আসে।
আর এক নতুন আলো জন্ম নেয়—
দু’টি হৃদয়ের মধ্যে বিশ্বাস আর ভালোবাসার এক আলোকবর্তিকা।

সে রাত সাক্ষী ছিল—
প্রেম নয়, বরং দায়িত্ব, বোঝাপড়া, আর সম্মানের এক গাঢ় বন্ধনের।

বাসর রাতের সকাল:

রাত্রি ফুরিয়ে ভোর আসে নিঃশব্দে।
নতুন এক জীবনের সূচনা হয়ে গেছে আগের রাতেই।
এই সকাল হওয়া উচিত ছিল আরও প্রশান্ত, আরও নিটোল।
কিন্তু বাস্তবতা সবসময় প্রত্যাশা অনুযায়ী চলে না।

বাসর রাতের ক্লান্তি ও আবেগে ডুবে ইফাদ তখনো গভীর ঘুমে।
অন্যদিকে, জোসনা ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় জানালার দিকে।
রোদ ফোটেনি এখনো, তবু আলোয় রূপালি এক ছায়া ছুঁয়ে গেছে তার মুখ।
সে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায়, জানালার পর্দা সরিয়ে রোদ-ভেজা পৃথিবীর দিকে চেয়ে থাকে।
একটি দীর্ঘশ্বাস যেন হঠাৎ বুকের ভেতর জমে যায়— আনন্দে, আশঙ্কায়, কিংবা কোনো অজানা কল্পনায়।

এই মুহূর্তেই, ঘরের বাইরে ভেসে আসে কিছু কণ্ঠস্বর—
প্রথমে ফিসফাস, তারপর ধীরে ধীরে তা উত্তপ্ত বিতর্কে রূপ নেয়।

— “আমি তো আগে থেকেই বলেছিলাম, এত লোককে দাওয়াত দেওয়া ঠিক হবে না।”
— “আপনি বলেছিলেন? বরং আপনিই তো শেষ মুহূর্তে অতিথির তালিকা বাড়িয়েছেন!”
— “আমি বাড়িয়েছি? অতিথিরা তো তোমাদের দিক থেকেই বেশি এসেছে!”

জোসনা অবাক হয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
এই কি তার জীবনের প্রথম সকাল?
এই কি নববধূর সম্ভাষণের প্রথম প্রহর?

সে ওড়না টেনে নেয় মাথায়।
আস্তে আস্তে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।

সেখানে রান্নাঘরের সামনে কিছু আত্মীয়, প্রতিবেশী ও পরিবারের মহিলা সদস্য জড়ো হয়ে আছেন।
কথা হচ্ছে — বিয়েতে কতজন অতিথি এসেছেন, কে কত টাকা খরচ করেছেন, কার খাবার কম পড়েছে কিংবা কে কাকে দাওয়াত না দিয়ে অবজ্ঞা করেছেন— এইসব নিয়ে।

সবার মধ্যে কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে সারমিন আন্টি।

তার কণ্ঠ চড়া, মুখে রাগের রেখা, ভঙ্গিতে একরকম অভিযোগ।

তিনি বললেন—
“আমি তো বিয়ের সব দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলাম।
কিন্তু এখন দেখি, রান্না থেকে শুরু করে অতিথি আপ্যায়ন পর্যন্ত সবকিছু নিয়ে খুঁত ধরছে সবাই!
আর আমাদের এই নতুন বউমা? চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে!
আমার মেয়েটা হলে সব সামলে নিত চটজলদি।”

এই বাক্য জোসনার হৃদয় বিদীর্ণ করে দেয়।

এমন সকাল, এমন সূচনা… এমন তিক্ততা!
তার চোখ জলে ভরে ওঠে, কিন্তু সে কিছু বলে না।

ঠিক তখন, পেছনে থেকে এসে দাঁড়ায় ইফাদ।
চোখে ঘুম জড়ানো থাকলেও মুখে দৃঢ়তা।

সে শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলে—
“আন্টি, আপনার অভিমান থাকতে পারে, কিন্তু আজকের সকালে এমন আচরণ করা কি শোভনীয়?
এই মেয়েটি আজ ঘর বেঁধেছে আমাদের সাথে।
আপনারও ঘরের বউ, আপনার সম্মান।
যদি কোনো সমস্যা হয়, সেটা আমরা পরস্পরে কথা বলেই সমাধান করতে পারি।
এইসব অভিযোগ করে নতুন একটি সম্পর্কের ভেতরে বিষ ঢালা ঠিক নয়।”

সারমিন আন্টি মুখ ফিরিয়ে বলেন—
“এই যুগের ছেলেরা একটু বউ পেলেই মায়ের কথা ভুলে যায়!
আমি তো বোকা, এত আয়োজন করলাম, আর আজ অপমান শুনতে হলো?”

ইফাদ কিছু বলার আগেই জোসনার হাত ধরে আস্তে বলে—
“এসো, চলো ভেতরে যাই। আমাদের দিনটা এমন বিতর্ক দিয়ে শুরু হোক, এটা আমি চাই না।”

জোসনা মাথা নাড়ে। কিন্তু চোখের জল আর বাঁধ মানে না।
সে বুঝে যায়— কল্পনার জীবন আর বাস্তব জীবনের মাঝখানে একটা সূক্ষ্ম দেয়াল থাকে।

এই সকাল তাকে শিখিয়ে দেয়—
প্রেম যতটা নরম, সংসার ঠিক ততটাই কঠিন।
তবে যার হাত শক্ত করে ধরা আছে, তার পাশে থাকলে এই পথও পাড়ি দেওয়া যায়।

বিদায়ের

বাড়ির উঠোনটা আজ অদ্ভুত নিস্তব্ধ।
সেদিনের আলোকচ্ছটা, আতরের ঘ্রাণ, অতিথির কোলাহল— সবকিছু কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

চারদিকেই ছড়িয়ে আছে বিদায়ের প্রস্তুতি।
চেয়ারে রাখা কনেপক্ষের সাদা ব্যাগ, ঠোঁট কামড়ে ধরে রাখা কান্না, অস্ফুট গলায় ফিসফিস করে বলা কথাগুলো—
সবকিছু মিলিয়ে এই ঘর যেন আজ কান্না চেপে রাখা এক বাড়ি।

জোসনা বসে আছে ঘরের কোণে, নতুন শাড়ি গায়ে, মাথায় ওড়না।
চোখদুটো লাল, মুখে নিঃশব্দ চাপা কান্নার ছাপ।
সে জানে— এই ঘর, এই দেয়াল, এই দরজা–জানালা আজকের পর শুধুই স্মৃতি হয়ে যাবে।
তার ছোটবেলার বিছানা, খেলার উঠোন, পড়ার টেবিল— সবই আজ থেকে তাকে ‘মহিলা অতিথি’র চোখে দেখবে।

একসময় মা এসে পাশে বসেন।

মা তাকে চুপচাপ জড়িয়ে ধরেন।
কোনো কথা বলেন না প্রথমে।
শুধু বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে নিয়ে অশ্রু বিসর্জন করেন।
মেয়ের গায়ের ঘ্রাণ নেওয়ার মাঝে যেন শত শত স্মৃতি ভেসে ওঠে—
প্রথম হাঁটা শেখা, স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি, পরীক্ষার আগের রাতে মাথায় তেল দিয়ে ঘুম পাড়ানো…

তারপর মা ফিসফিস করে বলেন—

— “তুই যখন ছোট ছিলি, প্রতিদিন ঘুমাতে যেতিস আমার কোল ধরে।
আজ তুই সেই কোল ছেড়ে যাচ্ছিস কারো হাত ধরতে…
তোর হাতটা শক্ত করে ধরে থাকবি মা, কখনও ছেড়ে দিবি না।”

জোসনা কিছুই বলতে পারে না, শুধু চোখ বন্ধ করে মায়ের কাঁধে হেলে পড়ে।

একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল ছোট ভাই।
চোখের কোণ দিয়ে বারবার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল।
সে কোনো অভিমান দেখায়নি, শুধু মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল চুপচাপ।
আর মনে মনে ভাবছিল—
“আপু কি আর আগের মতো আমায় শাসন করবে না?
ভুল করলে আর কি বলবে— ‘তুই এমন কেন রে?’”

বড় বোন সাদিয়া ধীরে এসে জোসনার হাত ধরে।
— “তুই তো ছোটবেলায় মাকে বলতি— ‘আমি কোনোদিন বিয়ে করব না, আমি তোমার সাথেই থাকব সারাজীবন।’
দেখ, তুইও আমাদের মতোই আজ চলে যাচ্ছিস…”

জোসনা কাঁদতে কাঁদতে বলে—

— “আপু, একটা অনুরোধ… আমার ঘরটায় কেউ এসে যেন না বসে…
ওটা আমার সব স্মৃতির জায়গা, আমার শৈশবের শেষ চিহ্ন…”

একসময় ডাক আসে গাড়ি চলার।

মা এবার হঠাৎ চোখ মুছে উঠে দাঁড়ান।
তিনি মেয়েকে চোখে চোখ রেখে বলেন—

— “তোর জীবনে দুঃখ আসবেই।
সব ঘরে সুখ একভাবে আসে না।
কিন্তু মনে রাখিস, তোর চোখের জল আমাদের কাঁধে এসে পড়ে।
তুই শক্ত থাকিস মা।
নিজেকে ভেঙে ফেলিস না, সংসারটাকে ভালোবাসিস।”

ইফাদ সেই মুহূর্তে সামনের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ছিল।
সে কাউকে কিছু বলেনি, শুধু সবার অনুভূতি চুপচাপ আত্মস্থ করছিল।

একসময় জোসনার চোখে চোখ রেখে এগিয়ে এসে হাত বাড়ায়।

— “তুমি প্রস্তুত?”
— “হ্যাঁ… অন্তত চেষ্টা করছি।”

হাতদুটো একত্রে মিলে যায়—
একটা পুরোনো জীবনকে বিদায় জানাতে, একটা নতুন জীবনের যাত্রায় পা রাখতে।

গাড়ি ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে…
পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর চেহারা কুয়াশায় হারিয়ে যেতে থাকে।
জানালার ফাঁক দিয়ে মা বারবার হাত নাড়ছেন, অথচ চোখের পানি থেমে নেই।
ভাইটি পেছনে ছুটতে ছুটতে দাঁড়িয়ে পড়ে— সাহস করে বলতেও পারেনি, “ভালো থেকো আপু…”

আর জোসনা?
সে জানালার পাশে বসে থাকে নিশ্চুপ।
তার মাথা ইফাদের কাঁধে হেলে আছে, মুখে শব্দ নেই— কিন্তু বুকের মধ্যে চলতে থাকে তীব্র কান্না।

ইফাদ আস্তে করে বলে—

— “আমি জানি, এটা সহজ নয়।
তবে তুমি শুধু বাড়ি বদলাওনি, তুমি আমার জীবনের কেন্দ্র হয়ে গেছো।
আমরা দু’জনে মিলে এই অচেনা পথকে ঘর বানাবো, ঠিক তোমার মতো করে…”

জোসনা চোখ মুছে তাকায়।
মুখে একটুকরো ক্লান্ত কিন্তু দৃঢ় হাসি।

— “তোমার সঙ্গে থাকলে… যে কোনো পথই বাড়ি হয়ে উঠবে।”

গাড়ির চাকা ঘুরতে থাকে।
একটি কন্যা তখন তার পরিচয়ের প্রথম অধ্যায়কে পেছনে ফেলে,
নতুন পরিচয় নিয়ে অজানা ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলে।

নতুন যাত্রা

ট্রেন যখন রাজশাহী স্টেশনে ঢুকল, তখন সকাল প্রায় সাড়ে সাতটা।
ক্লান্ত শরীর, পিঠভরা লাগেজ, আর বুকভরা অনিশ্চয়তা নিয়ে
ইফাদ আর জোসনা ধীরে ধীরে নেমে এল রেলগাড়ির নিচু সিঁড়ি বেয়ে।

নেমেই যেন এক নতুন জগতের মুখোমুখি তারা।

রেলস্টেশনটি ছিল অপেক্ষাকৃত ব্যস্ত, তবে পরিচ্ছন্ন।
ট্রেনের হুইসেল, হকারের ডাক, ছুটে চলা কুলিদের ভিড়ে কোথাও যেন
তাদের দুইজনের নিঃশব্দ উপস্থিতি চাপা পড়ে যাচ্ছিল।

জোসনার মুখে একটা গভীর প্রশ্রয়বোধের ছাপ ছিল,
তবু চোখে লেগে ছিল অজানা ভয়।
এ শহর তার পরিচিত নয়, আশপাশের মুখগুলোও নয়।
এখানে কেউ তার আপন নয়—
শুধু একজন মানুষ, যার হাতে সে নিজের সবটুকু তুলে দিয়েছে।

হাত ধরে হাঁটছিল ইফাদ, ব্যাগ নিজে টেনে নিচ্ছিল।
কিন্তু হঠাৎ এক কুলির সঙ্গে ধাক্কা লাগল তার।
ব্যাগটা ছিটকে পড়ে গেল।

কুলিটা রেগে উঠল—
— “সাবধানে চলতে শেখেন নাই নাকি?”
ইফাদ কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবক তেড়ে এসে বলল—

— “ভাই, আস্তে কথা বলেন।
এটা আমার বন্ধু। সমস্যা থাকলে আমাকে বলেন।”

ইফাদ তাকিয়ে দেখল—
চেনা মুখ, অদ্ভুত আশ্বস্ত চোখ।
সে-ই তো… রাফেদ!

রাফেদ এগিয়ে এসে ইফাদকে জড়িয়ে ধরল।

— “আরে ভাই! অবশেষে রাজশাহী!
এটা কিন্তু তোমার শহর এখন।
এই কুলিরা চিনে না, আমিই চিনিয়ে দেব!”

তারপর সে জোসনার দিকে তাকিয়ে নম্রভাবে বলল—
— “আপা, অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
এসো, আগে একটু বিশ্রাম। তারপর বাকি কাজ।”

রেলস্টেশনের বাইরে অপেক্ষমাণ একটি সাদা মাইক্রোবাসে তাদের ব্যাগ উঠিয়ে দেওয়া হলো।
রাফেদের বন্ধু মেহেদী ছিল ড্রাইভারের আসনে।

গাড়িতে উঠেই জোসনা জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে থাকে।
গাছগাছালি, দোকানপাট, অচেনা মোড়, অচেনা হোর্ডিং—
সবই যেন ছায়ার মতো তাড়া করে।

ইফাদ পাশে বসে ছিল, কিন্তু সে বুঝতে পারছিল—
এই মেয়েটির ভেতরকার ভয়, তার প্রশ্ন, তার নিঃশব্দ স্বপ্নভঙ্গ… সব কিছু।

রাফেদ কথা বলে যাচ্ছিল—
কখনো শহরের গল্প, কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি, কখনো বাড়িভাড়া নিয়ে কৌতুক।
তবে তাতে হয়তো ক্লান্ত শরীরটা কিছুটা স্বস্তি পায়, কিন্তু মনটা নয়।

প্রায় ১৫ মিনিটের পথ পেরিয়ে গাড়ি থামে শহরের এক নিরিবিলি এলাকায়—
তিনতলা একটি বাড়ি, যার তৃতীয় তলায় অপেক্ষা করছিল তাদের নতুন ঘর।

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে রাফেদ বলল—

— “আমি আর মেহেদী কাল রাতেই ঘরটা একটু গুছিয়ে দিয়েছি।
ফ্রিজে দুটো ঠাণ্ডা পানীয় আছে। আর হ্যাঁ, খাটে নতুন চাদর দিয়েছি।
আপা যেন অন্তত শুয়ে পড়তে পারেন—এইটুকু চেয়েছিলাম।”

ঘরের ভেতর ঢুকে তারা থমকে দাঁড়াল।

একটি ছোট ড্রয়িংরুম, যার একপাশে একটি ছোট ডাইনিং স্পেস।
দেয়ালে হালকা ক্রিম রঙ, জানালার পর্দায় নীলচে ফুলের নকশা।
ঘরের মেঝেতে জোসনার ব্যবহারের জন্য রাখা ছিল একটি ছিপছিপে আয়না, একটি দানবাক্স, এবং টেবিলে রাখা একটি ছোট্ট কার্ডে লেখা—
“আপনারা দুজন একসাথে থাকুন, সুখে থাকুন — শুভকামনায়, রাফেদ”

জোসনার চোখ ভিজে ওঠে।

সে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকলেও তার চোখে ভেসে উঠে—
এই অচেনা শহরের ভিতরেও মানুষ আছে,
যারা শুধু অতিথি নয়, আপন হয়ে উঠতে জানে।

ইফাদ পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বলল—

— “এই ঘরটা হয়তো প্রাসাদ নয়,
কিন্তু আমরা যদি একে ভালোবাসি, একে গড়ে তুলি,
তবে এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ হয়ে উঠবে।”

জোসনা তাকিয়ে থাকে তার দিকে।

তার চোখের ভাষায় লেখা থাকে—
“তুমি থাকো পাশে, তবে এই অচেনা ঘরও ঘর হয়ে উঠবে।”

নতুন শহর

নতুন শহরে নতুন জীবন শুরু হয়েছে বেশ কয়েকদিন।
ইফাদ অফিসে যায় সকালবেলা, ফিরে আসে সন্ধ্যায় ক্লান্ত দেহ আর বিষণ্ণ মুখ নিয়ে।
অন্যদিকে, জোসনা সারাদিন কাটায় সেই ছোট্ট ফ্ল্যাটের চার দেয়ালের মাঝে—
একটি বারান্দা, দুটি জানালা, কয়েকটা বাসন আর অসীম নিঃসঙ্গতা।

প্রথমদিকে ঘর গোছানো, রান্না, একাকী ভাবনা— সবই যেন ছিল ‘নতুন জীবনের অংশ’ ভেবে সহনীয়।
কিন্তু সময় যত গড়ায়, একাকীত্বের সেই মৌন সুর ক্রমে শব্দহীন আর্তনাদে রূপ নেয়।

একদিন দুপুরে রান্না করতে গিয়ে হঠাৎ গ্যাস শেষ হয়ে যায়।

জোসনা ব্যস্ত হয়ে ফোন করে ইফাদকে।

— “হ্যালো, তুমি কি গ্যাস শেষ হয়ে গেছে বুঝেছিলে?”
— “না তো, আমি ভাবছিলাম তোমার ভালোবাসায়ই রান্না হবে!”
— “তোমার ভালোবাসা গন্ধে ফুটে ওঠে নাকি? এখন ভাত আর ডাল দুটোই আধা কাঁচা!”
— “তাহলে ওটাকে বলো আধা আধা প্রেম, খেতে দারুণ হবে!”
— “তুমি হাসি দাও, আমি পেট ব্যথায় মরছি!”

এই কথোপকথনের পর উভয়ের মুখেই অজান্তে হালকা হাসি ছড়িয়ে পড়ে।
দুজনই বুঝে—
এ জীবনে কেবল দুঃখ নয়, মাঝেমধ্যে এমন ছোট ছোট বিপত্তিও হয় এক ধরনের ‘একসাথে থাকা’র স্মৃতি।

তবে ওই রাতেই ইফাদ ফিরে আসার পর ঘটে এক অন্যরকম মুহূর্ত।

সে দরজা খোলামাত্র দেখে— ঘর পরিষ্কার, খাবার টেবিলে রান্না গন্ধ ছড়াচ্ছে,
কিন্তু জোসনা এক কোণে বসে, চুপচাপ।

জিজ্ঞেস করতেই সে বলে—

— “তোমার অফিসে ব্যস্ততা আমি বুঝি,
তবে আজ আমার মনটা ভীষণ ভার হয়ে আছে।
তুমি যেভাবে চলে যাও, ঘরটায় যেন আর কিছু থাকে না।
আমি সারাদিন নিজেকেই খুঁজে পাই না।
এ শহরে কেউ ডাকেও না, কেউ পাশে বসেও না।
তুমি এলে সব ঠিক হয়, কিন্তু তুমি এলে সন্ধ্যা হয়ে যায়…”

ইফাদ আস্তে আস্তে তার পাশে এসে বসে।
একটু থেমে বলে—

— “জোসনা, আমি জানতাম না তুমি এত একা বোধ করো।
তোমার মুখে হাসি দেখেই আমি ভাবতাম, সব ঠিক আছে।
আজ বুঝলাম, তুমি কেবল ঘর চাইনি— তুমি সময় চেয়েছিলে, সঙ্গ চেয়েছিলে।
ভালোবাসা শুধু দায়িত্ব নয়, সময়ও…”

জোসনা এবার মুখ তোলে।
তার চোখে জল টলমল করছে,
তবু সে মৃদু হেসে বলে—

— “আমি যদি একদিন চুপচাপ চলে যাই, তুমি খুঁজবে?”
ইফাদ হেসে বলে—

— “চুপচাপ চলে গেলে আমি পোস্টার লাগিয়ে বলব—
‘আমার বউ নিখোঁজ, খুঁজে পেলে রান্না করা শর্তে ফেরত দিন!’”

এই কথায় দুজনেই হেসে ওঠে।
আর এই হাসির মধ্যেই ভাঙে অভিমান, গলে যায় দিনের সব নীরবতা।

সে রাতের খাওয়ার টেবিলে ইফাদ নিজেই চামচ হাতে তুলে নেয়।

— “আজ আমি খাওয়াবো। অফিসে এত রিপোর্ট বানিয়েছি, এখন একটু ভালোবাসার হিসাব করি।”

জোসনা রেগে যাওয়ার ভান করে বলে—

— “তুমি না খাওয়াও, আমি খেতে পারি।
তোমার হাত থেকে ভাত পড়ে যাবে—
আর পড়লে আমি তো ফাইন দিয়ে খাবারটা কিনতে পারব না!”

— “তুমি পড়লেও আমি তোমাকে উঠাবো…
ভাত পড়লেও আমি গরম করে দিবো।
তুমি শুধু থেকো। বাকিটা আমি ঠিক করে নেবো।”

সেই রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে জোসনা হঠাৎ বলে ফেলে—

— “তুমি জানো, এ শহরটা এখন আর তেমন অচেনা লাগছে না…”

ইফাদ হেসে জিজ্ঞেস করে—
— “কেন?”
— “কারণ তুমি আছো।
তুমি যখন থাকো, চার দেয়ালও কথা বলে…
আর বাতাসেও যেন তোমার গন্ধ থাকে।”

চাঁদ উঠেছে আকাশে।
জোসনা মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে ইফাদের কাঁধে।
একদম নীরব রাতে দুজনার নিঃশ্বাসে মিশে আছে একরাশ তৃপ্তি, ভরসা আর মৃদু হাসি।

তৃতীয় অনুচ্ছেদ

সময়ের গতি থেমে থাকে না।
নতুন শহরের অভ্যাস, সংসার জীবনের বোঝাপড়া, ছোটখাটো মান–অভিমান আর ঘনিষ্ঠতার ভিতর দিয়ে গড়ে উঠছিল জোসনা ও ইফাদের বৈবাহিক জীবন।
তাদের দু’জনের মধ্যকার সম্পর্ক ক্রমশ শক্ত হয়ে উঠছিল— যেন কাঁচ নয়, যেন ধাতু।

তবে সেই সম্পর্কের ভিতরেই একদিন ভেসে এলো নতুন এক খবরে রঙিন ঢেউ।

জোসনার শরীরে আস্তে আস্তে কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছিল।
অস্বস্তি, ক্লান্তি, হঠাৎ বমিভাব…
তখনো ইফাদ বুঝে উঠতে পারেনি—
কিন্তু একদিন হাসপাতালে গেলে চিকিৎসক স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে বললেন—

— “অভিনন্দন! আপনি বাবা হতে চলেছেন।”

ইফাদ প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারেনি।
তার চোখে যেন বিশ্বাস আর বিস্ময় মিশে গেল।
জোসনার দিকে তাকিয়ে সে বলল—

— “তুমি… তুমি সত্যিই?”

জোসনা মাথা নিচু করে হাসল।
সে কিছু বলেনি, তবু তার চোখ বলে দিচ্ছিল—
“হ্যাঁ, তুমি একজন বাবা হতে চলেছো… আর আমি এক নতুন জীবনের উৎস হতে চলেছি।”

এরপর সময় ধীরে ধীরে এগোয়।
জোসনার শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মনেও আসে এক ধরনের অজানা আতঙ্ক।
নতুন শহর, নতুন মানুষ, চিকিৎসা, ওষুধ— সবকিছুতেই তার মাঝে দ্বিধা জমে যায়।

তাই শেষমেশ ঠিক হয়, সন্তানের জন্মের আগেই সে দেশের বাড়ি ফিরে যাবে—
নিজের মা, বোন, পরিবারের ছায়ায় থাকলে অন্তত মন শান্ত থাকবে।

বিদায়ের মুহূর্তটি ছিল ভীষণ ভারী।

ট্রেন ছাড়ার সময় ইফাদ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকে,
আর জোসনা জানালার পাশে বসে চুপ করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।

— “তুমি ঠিক করে খাবে, বেশি হাঁটবে না, আর রাতে দেরি করে ঘুমাবে না… ঠিক আছে?”
— “আমি এখন শুধু নিজের জন্য বাঁচছি না, তোমার একটা টুকরো আমার ভিতরেও আছে।”

ট্রেন চলতে থাকে,
আর ইফাদ বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শুধু তাকিয়ে থাকে সেই চলে যাওয়া কামরাটার দিকে।

জোসনা চলে যাওয়ার পর ইফাদের দিনগুলো কেমন যেন স্থবির হয়ে যায়।
অফিস, ঘর, বারান্দা— সব যেন শূন্যতায় ভরে ওঠে।
সে রাতে ঘুমাতে পারে না, অফিসে মন বসে না।

প্রতিদিন ফোনে কথা হয় ঠিকই,
তবু একটা ভয়ের ছায়া তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে—
“সব ঠিক তো? ও ঠিকমতো খাচ্ছে তো?
যদি হঠাৎ কিছু হয়?… যদি সময়ের আগে কষ্ট হয়?… আমি তো কাছে নেই…”

একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ ফোন এল।

— “হ্যালো, ইফাদ?”
— “হ্যাঁ, বলো! কী হয়েছে?”
— “তোমার কন্যাসন্তান হয়েছে!”
— “কি? আমার… মেয়ে?… সত্যি?!”

কণ্ঠ থেমে যায়।
তারপর হঠাৎ চোখ থেকে ঝরে পড়ে দু’ফোঁটা অশ্রু।
সেই অশ্রু ছিল—ভয় কেটে যাওয়ার, আনন্দের, বিস্ময়ের, ভালোবাসার।

সেই মুহূর্তে ইফাদ আর কোনো শব্দ খুঁজে পায়নি,
শুধু নিঃশব্দে বারবার বলছিল—
“ধন্যবাদ, জোসনা… ধন্যবাদ আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর উপহারটি দেওয়ার জন্য।”

তিনদিন পর ইফাদ ছুটি নিয়ে ছুটে যায় গ্রামের বাড়ি।

জোসনার পাশে এসে দাঁড়ায়—
সে তখন বিছানায় শুয়ে ক্লান্ত, মুখে শিশুর মা হওয়ার গর্বময় প্রশান্তি।

ইফাদ খুব আস্তে তার কপালে চুমু দিয়ে বলল—

— “তুমি কেমন আছো?”
— “তোমার কন্যা কিন্তু তোমার মতোই হাসে।”
— “তোমার মতোও… কারণ ওর চোখে ঠিক তোমার মতোই শান্তি।”

ছোট্ট সেই শিশুটিকে কোলে তুলে নিল ইফাদ।

সে শিশুর মুখে হাত ছুঁইয়ে বলল—

— “তোমার নাম রাখব ‘আসফা মণি’।
আসফা মানে– নির্বাচিত,
আর তুমি তো আমাদের জীবনের সবচেয়ে অমূল্য রত্ন।”

জোসনার চোখে জমে থাকা জলটুকু এবার গড়িয়ে পড়ে।
সে বলল—

— “তোমার কাঁধে এখন শুধু স্বামীর নয়, বাবার দায়িত্বও… পারবে তো?”

ইফাদ মুচকি হেসে বলল—

— “আমার মেয়ে যদি তোমার মতো হয়,
তাহলে আমি তার ভেতরে তোমাকেই খুঁজে পাবো বারবার…
তাই দায়িত্ব নয়, এ আমার ভালোবাসার দ্বিতীয় সুযোগ।”

বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর থেকেই বদলে যায় ইফাদ।

আগে সে রাত করে ফিরত, এখন সে অফিস থেকে দৌড়ে আসে।
আগে সে বলত—“ক্লান্ত লাগছে”, এখন বলে— “বাচ্চাকে একটু কোলে নিই না…”

জোসনার খেয়াল রাখায় তার ভেতরে আসে নতুন সংবেদনশীলতা—
ওষুধ ঠিকমতো খেয়েছে কিনা, রাতে ঘুম ঠিক হয়েছে কিনা, মেয়েকে সময়মতো খাওয়ানো হয়েছে কিনা—
সব কিছুতেই সে এখন একজন প্রেমিকের চেয়ে বেশি— একজন নিবেদিত স্বামী ও পিতা।

আর জোসনা?
সে এক নতুন আশ্রয় খুঁজে পায় ইফাদের চোখে, আচরণে, যত্নে।

মেয়ের ছোট্ট হাত যখন তার আঙুল ধরতে শেখে,
তখন সে অনুভব করে—
ভালোবাসা কেবল প্রণয়ের নয়, ভালোবাসা বংশ পরম্পরায় বয়ে চলা এক শুদ্ধ স্নেহও।

সময় কখনও থেমে থাকে না।
আসফা মণি বড় হতে শুরু করল— তার প্রথম হাঁটা, প্রথম শব্দ, প্রথম স্কুলে যাওয়া, প্রথম বন্ধু—
সবকিছুতেই যেন ইফাদ আর জোসনার জীবন পূর্ণ হয়ে উঠল।

তাদের প্রতিদিনের আলোচনার কেন্দ্রে এখন আর প্রেমিক-প্রেমিকার হাসিমাখা দুপুর নয়,
বরং মেয়ের স্কুলের পড়া, তার শারীরিক যত্ন, তার বন্ধুদের নাম, কিংবা টিফিনে কী দেওয়া হবে— এসব।

একদিন সন্ধ্যায় ইফাদ ফিরে এসে চুপচাপ বসে রইল বারান্দায়।
জোসনা তখন রান্নাঘরে, আসফা বই হাতে বসে আঁকিবুঁকি করছে।

কিছুক্ষণ পর জোসনা এসে জিজ্ঞেস করল—

— “চা খাবে?”
— “হ্যাঁ।”
— “চিনি কম দেব?”
— “তোমার মতো দাও…”

এই কথার মাঝে ছিল না কোনো অভিমান, তবু ছিল একটা অজানা দূরত্ব।
যেখানে ভালোবাসা আছে, কিন্তু তার প্রকাশ নেই;
যেখানে গুরুত্ব আছে, কিন্তু তা প্রকাশ পায় অন্য মাধ্যমে।

একদিন রাতে খাবার খেতে খেতে আসফা হঠাৎ বলল—

— “বাবা, তুমি কি মাকে এখনো ভালোবাসো?”
চোখের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল ছোট্ট মেয়েটা।
তার কণ্ঠে ছিল সরলতা, কিন্তু প্রশ্নে ছিল তীক্ষ্ণতা।

ইফাদ থমকে গেল।
তার চোখ জোসনার চোখের সঙ্গে মিলল,
আর সেই চোখে ফুটে উঠল পুরোনো দিনের প্রতিচ্ছবি।

সে মৃদু হেসে বলল—

— “ভালোবাসি তো, তবে এখন ভালোবাসার রূপটা পাল্টে গেছে।
আগে সে ছিল হাত ধরা— এখন সে হয়ে গেছে কপালে হাত রাখা।”

জোসনা কিছু না বললেও চোখ নামিয়ে নেয়।
সে বোঝে—
ভালোবাসা এখন আর গোলাপের পাঁপড়ি নয়, এখন তা নিত্যদিনের ভাত রান্না,
মেয়ের স্কুল ড্রেস গুছিয়ে রাখা,
আর কখনো-কখনো চুপ করে পাশে বসে থাকার মতো নিঃশব্দ ভাষা।

কিছুদিন পর, এক রাতে,
জোসনা হঠাৎ বলল—

— “তুমি কি কখনো মনে করো না— আমরা একসময় একে অন্যকে ছাড়া থাকতে পারতাম না?”

ইফাদ একটু চুপ থেকে বলল—

— “মনে পড়ে… কিন্তু এখন আমরা একে অন্যকে ছুঁয়ে না থেকেও টিকে আছি।
কেন জানো? কারণ ভালোবাসা এখন অভ্যাস হয়ে গেছে…
তোমায় ছাড়া কিছুই কল্পনা করি না— এমনকি অভিমানটাও নয়।”

একদিন সকালে ইফাদ ঘুম থেকে উঠে দেখে, জোসনা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে,
চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে আছে।

— “কী হয়েছে?”
— “কিছু না…
আজ খুব করে তোমার সেই আগের মতো ভালোবাসা পাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল…”

ইফাদ হেসে উঠে এসে তার কপালে হাত রাখে।

— “তুমি কি জানো, এখনো ঘুমাতে যাওয়ার আগে তোমার মুখটাই আমি মনে করি।
শুধু বলি না।”

সেই মুহূর্তে চারদিকে নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে যায়।
আসফা তখন পাশের ঘরে ছবি আঁকছিল।
তার আঁকার কাগজে ছিল—
একটি বাড়ি, একটি গাছ,
আর এক বাবা-মা, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, হাত ধরা।

জীবনের গভীরে এমনই—
সব কিছু প্রকাশ করতে হয় না,
অনেক কিছু নিঃশব্দেই বলা যায়, বোঝা যায়, অনুভব করা যায়।

জোসনা: “তুমি কি আগের মতো করে আর আমাকে ভালোবাসো না?”
ইফাদ: “ভালোবাসা তো পাল্টায়… আগে ছিল চোখে, এখন তা বাস করে দায়িত্বে।”

আসফা: “বাবা, তুমি সবসময় মাকে একাই থাকতে দাও কেন?”
ইফাদ (মৃদু হাসি দিয়ে): “কারণ আমি জানি, সে একা নয়… তার বুকের ভেতরে আমিই আছি।”

জোসনা (চোখে জল নিয়ে): “কখনো কখনো খুব বলতে ইচ্ছে করে— তুমি আমাকে আগের মতো করেই চাও…”
ইফাদ: “তুমি আগের মতো আছো বলেই তো আমি এখনো বদলাইনি

সময়ের সঙ্গে মানুষের চাহিদা যেমন বদলায়, তেমনি বদলায় অনুভবের প্রকাশ।
ভালোবাসা কখনো সরলরেখায় চলে না।
তার মাঝে ওঠানামা থাকে, ভুল বোঝাবুঝি থাকে,
আর থাকে কিছু কথা— যা বলা হয় না, অথচ বোঝা হয় খুব গভীরে।

একদিন দুপুরে,
ইফাদ অফিস থেকে ফিরে দেখে,
জোসনা খুব নীরব।
মুখে কোনো রাগ নেই, আবার স্নেহও নেই।
সে কেবল জানালার পাশে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।

— “কি হয়েছে?”
— “কিছু না।”
— “এভাবে বসে আছো কেন?”
— “ভালো লাগে।”

কিছু বলার ছিল, কিন্তু জোসনা বলেনি।
তবে তার চোখ বলছিল— অনেক কিছু জমে আছে।

সেদিন রাতে,
আসফা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর
দুজন মুখোমুখি বসে ছিল।

ইফাদ বলল—
— “তুমি কি আমার উপর অভিমান করেছো?”

জোসনা প্রথমে কিছু না বলে চোখ নামিয়ে রাখে,
তারপর বলল—

— “আসলে…
তুমি এখন সব ঠিকঠাক করো—
বাচ্চার যত্ন, আমার ওষুধ, বাজার…
কিন্তু আমি তোমার চোখে নিজেকে দেখি না অনেকদিন।
তুমি দায়িত্ব পালন করো, কিন্তু তুমি আর ভালোবাসো না সেই আগের মতো।
তুমি পাশে থাকো, কিন্তু কখনো আমাকে খুঁজে পাও না।”

এই কথাগুলো যেন ইফাদের ভিতরকার মাটিকে একবারে নাড়িয়ে দেয়।

সে ধীরে ধীরে বলে—

— “তুমি ঠিক বলছো।
ভালোবাসা এখন এতটা ‘চলমান’ হয়ে গেছে যে কখনো থেমে তোমার দিকে তাকাইনি হয়তো।
তবে জানো, আমি প্রতিদিন তোমার মুখ দেখেই বের হই,
আর রাতে তোমার শ্বাস শুনেই ঘুমোই…
আমার ভালোবাসা হয়তো চুপ করে গেছে, কিন্তু মরে যায়নি।”

জোসনার চোখে জল আসে।

— “আমি কখনো চাইনি তুমি ফুল দাও, সিনেমায় নিয়ে যাও।
শুধু মাঝে মাঝে একটা প্রশ্ন করো— ‘তুমি কেমন আছো?’
এইটুকু পেলেই হয়তো আমার অভিমান মুছে যেত…”

সে কথা বলতে বলতে ভেঙে পড়ে।

ইফাদ উঠে এসে তার কপালে চুমু খায়।

— “তুমি কখনো বোঝাতে চাওনি, আমিও বুঝতে পারিনি।
আমরা দুজনেই নিরব ছিলাম…
এখন থেকে আমি প্রতিদিন জিজ্ঞেস করবো— ‘তুমি কেমন আছো?’
আর প্রতিদিন মনে করিয়ে দেব— তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।’”

সেই রাতের পর…
কিছু বদলে যায়।
কোনো নাটকীয়তা নয়, বরং ছোট ছোট পরিবর্তন।

ইফাদ এখন আর ফোনে ব্যস্ত থাকে না খাওয়ার সময়।
জোসনা এখন আর চুপ করে নয়, মাঝেমধ্যে ইফাদের পছন্দের খাবার রান্না করে।

আসফা মাঝেমধ্যে দেখে—
তার বাবা ও মা বারান্দায় একসাথে বসে চা খায়,
আর হাসতে হাসতে বলে—

— “তুমি আগের মতো সুন্দর করে কথা বলো না!”
— “তুমি আগের মতো রেগেও যাও না!”
— “আসলে আমরা আগের মতোই আছি— শুধু ভাষাটা বদলে গেছে।”

পরের দিন

আসফা ছবি আঁকছিল।
সে হঠাৎ বলল—

— “মা, তোমরা একে অন্যকে এখনো ভালোবাসো?”
জোসনা হেসে বলল—

— “ভালোবাসি না বললে কি এই ঘর এতদিন টিকে থাকত?”

আসফা তখন একটা নতুন ছবি দেখিয়ে বলল—

— “এটা তোমাদের জন্য—
একটা ঘর, একটা গাছ, আর একটা সিঁড়ি…
যে সিঁড়ি দিয়ে তোমরা একসাথে উপরে উঠছো— হাত ধরে।”

❖ সমাপ্তি

ভালোবাসা এক নদীর মতো—
কখনো শান্ত, কখনো ঢেউয়ের মতো ছুটে চলা,
কখনো আবার নিঃশব্দে বয়ে যাওয়া…

জোসনা ও ইফাদ—
তারা দুজনেই বুঝেছিল—
ভালোবাসা চিৎকারে নয়, টিকে থাকে মৃদু ভরসায়।
সংসার কখনো নিখুঁত হয় না,
তবে যদি ভালোবাসা থাকে ভিতরে—
তবে সামান্য ভুল বোঝাবুঝিও একদিন গল্প হয়ে যায়।

এটিই ছিল তাদের গল্প—
একটা চুপচাপ শুরু,
কিছু অভিমান, কিছু হাসি,
একটি সন্তান,
আর শেষ পর্যন্ত—
একটি হৃদয়ের সমাপ্তি।

ভালোবাসা কখনো হঠাৎ হারিয়ে যায় না,
সে শুধু নতুনভাবে প্রকাশ পায়— নিরব অভিমানে, কিংবা এক গোপন স্পর্শে।

❖ সতর্কীকরণ

এই গ্রন্থে বর্ণিত চরিত্র, ঘটনা ও স্থানসমূহ লেখকের কল্পনায় গঠিত।
কোনো ব্যক্তি, সম্প্রদায় বা ঘটনার সঙ্গে মিল থাকলে তা সম্পূর্ণভাবে কাকতালীয়।
উপন্যাসে ব্যবহৃত সংলাপ ও অভিব্যক্তি কেবল সাহিত্যিক প্রয়োজনে অন্তর্ভুক্ত,
যা কারো প্রতি বিদ্বেষ বা অপমানসূচক নয়।

পাঠকদের অনুরোধ করা যাচ্ছে—
এই কাহিনীকে বাস্তব জীবনের নির্ভুল প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা না করে,
সাহিত্যিক উপলব্ধি ও সম্পর্ক-বোঝাপড়ার সংবেদনশীল আয়নায় পাঠ করুন।

❖ উৎসর্গ

জোসনা… যাকে দেখে খুব ভালো লাগে যাকে নিয়ে লিখতে ভালো লাগে প্রিয় ভূতনি

যার নিঃশব্দ অভিমান, একটানা নীরবতা,
আর হারিয়ে যাওয়া চোখ দু’টি আমাকে শেখায়—
ভালোবাসা শুধু পাওয়া নয়,
ভালোবাসা হলো না-পাওয়ার ভিতরেও থেকে যাওয়া।

❖ লেখক পরিচিতি

আশরাফুল ইসলাম — যিনি সামাজিক মাধ্যমে পরিচিত ‘নেশান্তপ্রতীক আশরাফ’ নামে,
জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের এক প্রান্তসীমান্তে— টেকনাফ, কক্সবাজারে।
তাঁর লেখালেখির শুরু মূলত ব্যক্তিগত অনুভবের খাতা থেকে,
যেখানে শব্দ হয়ে উঠেছে তাঁর অনুভূতির ভাষা।

বর্তমানে অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আশরাফ,
এই উপন্যাস ‘পথভ্রষ্ট’ তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যকর্ম।

একটি সাধারণ প্রেমঘটিত বাস্তবতা থেকে জন্ম নেওয়া এই কাহিনী তাঁর নিজের মতো করেই বলার প্রচেষ্টা—
যেখানে কোনো চরিত্র এককভাবে নায়ক নয়,
বরং সবাই মিলে গড়ে তুলেছে সম্পর্কের এক চলমান আয়না।

লেখকের বিশ্বাস—
ভালোবাসা কখনো নিখুঁত হয় না, তবু সেই অপূর্ণতার মাঝেই তার সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে।

১৮৯
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন