মেঘ

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

আমি বৃষ্টি করিব না। কেন বৃষ্টি করিব? বৃষ্টি করিয়া আমার কি সুখ? বৃষ্টি করিলে তোমাদের সুখ আছে। তোমাদের সুখে আমার প্রয়োজন কি?
দেখ, আমার কি যন্ত্রণা নাই? এই দারুণ বিদ্যুদগ্নি আমি অহরহ হৃদয়ে ধারণ করিতেছি। আমার হৃদয়ে সেই সুহাসিনীর উদয় দেখিয়া তোমাদের চক্ষু আনন্দিত হয়, কিন্তু ইহার স্পর্শ মাত্রে তোমরা দগ্ধ হও। সেই অগ্নি আমি হৃদয়ে ধরি! আমি ভিন্ন কাহার সাধ্য এ আগুন হৃদয়ে ধরে?
দেখ, বায়ু আমাকে সর্ব্বদা অস্থির করিতেছে। বায়ু, দিগ্‌বিদিক্ বোধ নাই, সকল দিক্ হইতে বহিতেছে। আমি যাই জলভারগুরু, তাই বায়ু আমাকে উড়াইতে পারে না।
তোমরা ভয় করিও না, আমি এখনই বৃষ্টি করিতেছি-পৃথিবী শস্যশালিনী হইবে। আমার পূজা দিও।
আমার গর্জ্জন অতি ভয়ানক-তোমরা ভয় পাইও না। আমি যখন মন্দগম্ভীর গর্জ্জন করি, বৃক্ষপত্র সকল কম্পিত হইয়া, শিখিকুলকে নাচাইয়া, মৃদু গম্ভীর গর্জ্জন করি, তখন ইন্দ্রের হৃদয়ে মন্দারমালা দুলিয়া উঠে, নন্দসূনুশীর্ষকে শিখিপুচ্ছ কাঁপিয়া উঠে, পর্ব্বত-গুহায় মুখরা প্রতিধ্বনি হাসিয়া উঠে। আর বৃত্রনিপাতকালে, বজ্রসহায় হইয়া যে গর্জ্জন করিয়াছিলাম, সে গর্জ্জন শুনিতে চাহিও না-ভয় পাইবে।
বৃষ্টি করিব বৈ কি? দেখ, কত নবযূথিকা-দাম আমার জলকণার আশায় ঊর্দ্ধমুখী হইয়া আছে। তাহাদিগের শুভ্র, সুবাসিত বদনমণ্ডলে স্বচ্ছ বারিনিষেক, আমি না করিলে কে করে?
বৃষ্টি করিব বৈ কি? দেখ, তটিনীকুলের দেহের এখনও পুষ্টি হয় নাই। তাহারা যে আমার প্রেরিত বারিরাশি প্রাপ্ত হইয়া, পরিপূর্ণ হৃদয়ে হাসিয়া হাসিয়া, নাচিয়া নাচিয়া, কল কল শব্দে উভয় কূল প্রতিহত করিয়া, অনন্ত সাগরাভিমুখে ধাবিত হইতেছে, ইহা দেখিয়া কাহার না বর্ষিতে সাধ করে?
আমি বৃষ্টি করিব না। দেখ, ঐ পাপিষ্ঠা স্ত্রীলোক, আমারই প্রেরিত বারি, নদী হইতে কলসী পূরিয়া তুলিয়া লইয়া যাইতেছে, এবং “পোড়া দেবতা একটু ধরণ কর না” বলিয়া আমাকেই গালি দিতেছে। আমি বৃষ্টি করিব না।
দেখ, কৃষকের ঘরে জল পড়িতেছে বলিয়া আমায় গালি দিতেছে। নহিলে সে কৃষক কেন? আমার জল না পাইলে তাহার চাষ হইত না-আমি তাহার জীবনদাতা। ভদ্র, আমি বৃষ্টি করিব না।
সেই কথাটি মনে পড়িল,
মন্দং মন্দং পবনশ্চানুকূলো যথা ত্বাং
বামশ্চায়ং নদতি মধুরশ্চাতকস্তে সগর্ব্বঃ।
কালিদাসাদি যেখানে আমার স্তাবক, সেখানে আমি বৃষ্টি করিব না কেন?
আমার ভাষা শেলি বুঝিয়াছিল। যখন বলি, I bring fresh showers for the thirsting flowers, তখন সে গম্ভীরা বাণীর মর্ম্ম শেলি নহিলে কে বুঝিবে? কেন জান? সে আমার মত হৃদয়ে বিদ্যুদগ্নি বহে। প্রতিভাই তাহার বিদ্যুৎ।
আমি অতি ভয়ঙ্কর। যখন অন্ধকারে কৃষ্ণকরাল রূপ ধারণ করি, তখন আমার ভ্রূকুটি কে সহিতে পারে? এই আমার হৃদয়ে কালাগ্নি বিদ্যুৎ তখন পলকে পলকে ঝলসিতে থাকে। আমার নিঃশ্বাসে, স্থাবর জঙ্গম উড়িতে থাকে, আমার রবে ব্রহ্মাণ্ড কম্পিত হয়।
আবার আমি কেমন মনোরম! যখন পশ্চিম-গগনে, সন্ধ্যাকালে লোহিতভাস্কারঙ্কে বিহার করিয়া স্বর্ণতরঙ্গের উপর স্বর্ণতরঙ্গ বিক্ষিপ্ত করি, তখন কে না আমায় দেখিয়া ভূলে? জ্যোৎস্না-পরিপ্লুত আকাশে মন্দ পবনে আরোহণ করিয়া কেমন মনোহর মূর্ত্তি ধরিয়া আমি বিচরণ করি। শুন পৃথিবীবাসীগণ! আমি বড় সুন্দর, তোমরা আমাকে সুন্দর বলিও।
আর একটা কথা আছে, তাহা বলা হইলেই আমি বৃষ্টি করিতে যাই। পৃথিবীতলে একটি পরম গুণবতী কামিনী আছে, সে আমার মনোহরণ করিয়াছে। সে পর্ব্বত-গুহায় বাস করে, তাহার নাম প্রতিধ্বনি। আমার সাড়া পাইলেই সে আসিয়া আমার সঙ্গে আলাপ করে। বোধ হয়, আমায় ভাল বাসে। আমিও তাহার আলাপে মুগ্ধ হইয়াছি। তোমরা কেহ সম্বন্ধ করিয়া আমার সঙ্গে তাহার বিবাহ দিতে পার?
এখন পর্যন্ত কবিতাটি পড়া হয়েছে ৯৭ বার
যদি কবিতাটা সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন