বিকেলবেলা কলেজ পড়িয়ে ফিরলেন মা

সন্ধ্যেবেলা অফিস সেরে ফিরলেন বাবা

সাবির মায়ের কান্ডজ্ঞান নেই এতটুকুন

তক্ষুনি শুনিয়ে দিলে খবরটা,

“গার্জেন কল হয়েছে বাবান এর

আজ ওকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে স্কুলে”

যাকে নিয়ে এত কথা তার কোনো হেলদোল নেই

দুঃখ ও নেই

কান্নাকাটি ও নেই

সে রোজ যেমন স্কুল থেকে ফিরে

কার্টুন দেখে টিভিতে

তেমনি একমনে দেখে যাচ্ছিল কার্টুন ।

খবরটা কানে যেতেই হঠাৎ কেমন হয়ে গেলেন বাবা

অফিসের ব্যাগটা রেখে মাথায় হাত দিয়ে

বসে পড়লেন সোফাতে ,

মা তখন ডাকলেন ছেলেকে

“বাবান শোনো ”

মায়ের ডাক শুনে রিমোট হাতে বাবান এলো ছুটে

মা শুধোলেন,তুমি আজ কি করেছো স্কুলে

ঝগড়া ?

মারপিট ?

বাবান বললে, “কই আমি তো কিছু করিনি মা

আমি কিছুই করিনি ”

মা আবার শুধোলেন,তুমি করনি কিছুই !

বাবান বললে “,সত্যি বলছি মা

তোমার গা ছুঁয়ে প্রমিস করছি মা

আমি কিছুই করিনি

রাইমস আন্টির ক্লাসে খুব মেঘ করেছিল আকাশে

কাচের জানলা দিয়ে মেঘ দেখছিল সবাই

আমি শুধু বলেছি “আয় বৃষ্টি আয় ”

তাই শুনে আন্টি আমাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে দিলে” ।

রাতের বেলা শোবার ঘরে বাবা-মায়ের ভীষণ ঝগড়া ,

বাবার একটাই কথা ,”ছেলেকে মানুষ করব বলে

কত কষ্ট করে ভর্তি করেছিলাম

ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক স্কুলে

তুমি সব দিলে মাটি করে ।”

বাবার কথা শুনে ভারী অবাক লাগলো মায়ের ,

“আমি মাটি করে দিলাম সব “!

বাবার গলায় জোর বেড়ে গেল আরো ,

“হ্যাঁ

তুমিই দিলে মাটি করে সব

আমি তোমাকে কতবার কত করে বলেছিলাম

বাড়িতে ওর সঙ্গে কথা বলবে না বাংলায়

যতক্ষন থাকবে

ইংলিশে বলবে

ইংলিশে কথা বলার হেভিটটা

প্র্যাকটিস করতে হবে ওকে

এখন থেকেই করতে হবে ।”

হতবিস্মিত মায়ের বিস্ময়ের যেন শেষ নেই ,

“ছেলের সঙ্গে বাড়িতে

কথা বলা যাবে না বাংলায়

ইংলিশে বলতে হবে আমাকে

এসব কি বলছ তুমি ?”

বাবার গলায় একরোখা জেদ ,

“আমি যা বলছি ঠিক বলছি ”

এবার রুখে দাঁড়ালেন মা ,

তুমি যা বলছো তা ঠিক বলছো না

পৃথিবীর কোন ও মা

নিজের মাতৃভাষা ছেড়ে

সন্তানের সঙ্গে অন্য ভাষায় কথা বলে না

পৃথিবীর কোন ও মা

অন্য ভাষা কে মাতৃভাষা করার পাঠ

সন্তানকে শেখায় না

যদি এমন কাজ করে কোনো মা

তাহলে জানবে সে অসুস্থ

মানসিকভাবে অসুস্থ

তার চিকিৎসার দরকার

উপযুক্ত চিকিৎসার দরকার ।”

ঝগড়াটা কত রাত অবধি গড়িয়েছিল কে জানে

সকালবেলা চায়ের টেবিলে রফা হল দুজনের

গার্জেন কল এ একা যাবে না কেউ

যেতে হলে দুজনেই যাবে স্কুলে ।

স্কুল মানে মহানগরীর ঝাঁ-চকচকে

তেরো তলা বিল্ডিং এর

নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল

অক্সফোর্ড মডেলের বিশুদ্ধ বিলিতি স্কুল

রেক্টর এর নাম ডক্টর ডেভিড স্মিথ

তার তের তলার অফিস ঘর

একেবারে মিনিস্টারদের মতন

ভিজিটরস রুম

সিকিউরিটি সেক্রেটারি পার্সোনাল সেক্রেটারি সব ।

সিসিটিভির ফুটেজ দেখলে দেখা যেত

রেক্টর এর ঘর থেকে বেরোনোর সময়

কারো মুখে কোন ও কথা নেই

থমথমে মুখ

তবে বাবার চেয়ে মায়ের মুখখানা বেশি থমথমে

গাড়িতে উঠে বসতেই ক্ষোভে ফেটে পড়লেন মা ,

লোকটা নিজেকে কিভাবে বলতো

একটা স্ট্যান্ডাড ওয়ানের বাচ্চা ছেলে

মেঘ দেখে ক্লাসের মধ্যে

“আয় বৃষ্টি আয় ”

বলে আবেগে উচ্ছাসে কথা বলে ফেলেছে বাংলায়

তার জন্য কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার পানিশমেন্ট

তার জন্য গার্জেন কল

তার জন্য গার্জেনের মুচলেকা

আমার ছেলে এমনটা আর কখনো করবে না

ক্লাসের মধ্যে কখনো আর বাংলায় কথা বলবে না

ছি :।

তুমি কেন করতে গেলে মুচলেকায় সই

দেখলে তো আমি কেমন শুনিয়ে দিলাম মুখের ওপরে

এটা অক্সফোর্ড না

এটা ইংল্যান্ড না

এটা আমাদের বাংলা ।”

বাবার কোনো ক্ষোভ নেই

মায়ের কথা শুনে বাবার মুখে ফুটে উঠল হাসি ,

কর্পোরেট অফিসের মেজ সাহেব এর

কৌতুকের হাসি ,

তুমি তো ভালো করে

কথাই বলতে পারছিলে না রেক্টর এর সঙ্গে ।”

মায়ের গলায় জোরালো প্রতিবাদ ,

“কোথায় দেখলে পারছিলাম না

আমি আমার মতন করে বলেছি

যা বলার সব বলেছি

চুপ দিয়ে মুখ বুজে তো থাকি নি ।”

এবার বাবার মুখে বাঁকানো কথার ফুলঝুরি ,

“তফাতটা এখানেই বুঝলে

‍কলেজের বাংলা ম্যামের বাঙালি ইংলিশ এর সঙ্গে

রেক্টর সাহেবের ইউরোপিয়ান ইংলিশের এখানেই তফাত।”

ফুঁসে উঠলেন মা,

“তাতে হয়েছে টা কি বলতো

কি এমন মহা অপরাধ হয়েছে ।”

তখন মাথা ঠান্ডা করে বোঝাতে চাইলেন বাবা ,

“না

মানে অন্য কিছু না

তুমি হয়তো খেয়াল করনি অত

তোমার বাঙালি ইংলিশ শুনে

ডক্টর স্মিথ কেমন হাসছিলেন মুচকি মুচকি

জানো রেক্টর সাহেব আমাদের বড় সাহেবের কে হয় জানো

দুজনে একেবারে ইন্টিমেট ফ্রেন্ড

ক্লাবের পার্টিতে হোটেলের ককটেলে

এক গেলাসের বন্ধু

কি বলবো তোমাকে

রেক্টর সাহেবের মুখে ওই হাসি দেখে

আমার মাথা কাটা যাচ্ছিল লজ্জায় ।”

মাকে তবু নড়ানো গেলোনা একচুলও

মায়ের সাফ কথা ,

তোমার ওই ইউরোপিয়ান ইংলিশের রেক্টর সাহেব

তিনি যখন কথা বলবেন আমাদের বাংলায়

তখন তার কথা শুনে হাসতে পারি আমিও

এতে লজ্জার কি আছে

আর লজ্জার কথা তুললে যখন

তখন শুনে রাখ ,

তোমার রেক্টর সাহেবের যদি

বাংলা বলতে না পারার জন্য কোন ও লজ্জা না হয়

তাহলে আমার কেন ইউরোপিয়ান ইংলিশ

বলতে না পারার লজ্জা হবে

দেখো তার ইংলিশ তার কাছে

আমার বাংলা আমার কাছে ।”

এরপর আর কোনও কথা হল না দুজনের

সারা পথ আর কোন ও কথা হল না

দিন ফুরোতে সন্ধে হতেই মায়ের পড়ার ঘরে

জ্বলে উঠল আলো

সেই আলোয় অনেক রাত অবধি পড়াশোনা

পড়াশোনা মানে অন্য কিছু না

রবীন্দ্রনাথ

শুধু রবীন্দ্রনাথ ,

এক সময় গভীর রাতে মায়ের দৃপ্তকন্ঠে

উচ্চারিত হলো

বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান এর প্রার্থনা ,

“হে বিধাতা ,

দাও দাও মোদের গৌরব দাও

দুঃসাধ্যের নিমন্ত্রণে

দুঃসহ দুঃখের গর্বে ।

টেনে তোল রসাক্ত ভাবের মোহ হতে ।

সবলে ধিক্কৃত করো দীনতার ধুলায় লুণ্ঠন ।

দূর করো চিত্তের দাসত্ব বন্ধ ,

ভাগ্যের নিয়ত অক্ষমতা

দূর করো মূঢ়তায় অযোগ্যের পদে

মানব মর্যাদা বিসর্জন ,

চূর্ণ করো যুগে যুগে স্তূপীকৃত লজ্জা রাশি

নিষ্ঠুর আঘাতে ।

নিঃসংকোচে

মস্তক তুলিতে দাও

অনন্ত আকাশে

উদাত্ত আলোকে

মুক্তির বাতাসে ।”

পরে পড়বো
৪৭
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন