সাতসকালে কুঞ্জে এলো ললিতা
বৃন্দার দুটো হাত ধরে
আকুলি বিকুলি করে
সে বললে,
তুই কিছু একটা কর ভাই
এবার একটা কিছু কর
কোন একটা উপায় খুঁজে বের কর
যা অবস্থা দেখছি রাই’য়ের
ওকে আর পারা যাবে না বাঁচাতে
চোখের সামনে ওর এই উন্মাদিনী দশা
সে দেখতে আর ভালো লাগছে না
এতটুকুও লাগছে না ভালো ।
বৃন্দা বললে, ভালো তো আমারও
লাগছে না রে ললিতা।
ললিতা বললে, আচ্ছা বৃন্দা,
তুই একটা কথা বলতো আমায়
মথুরা জায়গাটা কি অনেক দূরে
সেখানে কি যাওয়া-আসা করে না কেউ
বৃন্দাবনের কেউ কি যায় না সেখানে ?
বৃন্দা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে,
সে গেলে কি হবে
আমাদের কানু আর সে কানু নেই
সে এখন রাজা
মথুরার রাজা
রাজার সঙ্গে দেখা করা কি কম কথা,
সে খুব দুষ্কর
রাজদরবারে ঢুকতেই দেবে না কাউকে।
ললিতা বললে, রাই কি বলছিল জানিস
রাই বলছিল তোদের যেতে হবে না কাউকে
আমি নিজেই যাব মথুরায়
আমায় যদি চিনতে না পারে
আমি তার পায়ে ধরে কেঁদে ভাসাবো ।
বৃন্দা বললে, ছি ছি
কি লজ্জার কথা শোনালি রে ললিতা
রাই মথুরায় গিয়ে পায়ে ধরবে কানুর !
পায়ে ধরে কেঁদে কেটে ভাসাবে !
যা দেখছি
সত্যি ওর আর কিছু নেই
মাথা টাথা সব গেছে
নইলে বৃন্দাবনে আমার কুঞ্জে এসে মান ভাঙাতে
যে রাইয়ের পায়ে ধরেছিল কানু
আজ মথুরায় গিয়ে
সেই কানুর পায়ে ধরবে রাই
কথাটা যে বলল কি করে আমি সেটাই ভাবছি।
ললিতা বললে, দেখ ভাই
এত শত ভাবার মতন সময় নেই এখন
এখন ওর উন্মাদিনী দশা
এই দশা তে পড়ে মাথার কোনো ঠিক নেই ওর
এখন যা করার সে করতে হবে আমাদেরই
যে করেই হোক কিছু একটা করতে হবে
পথ একটা বের করতেই হবে খুঁজে।
বৃন্দা বললে, পথ আর কী খুঁজব বল
পথ এখন একটাই
যা দেখছি
ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলোর মতন
যেতে হবে আমাকেই
শেষমেষ আমাকেই যেতে হবে মথুরায় ।
এসব ভেবে টেবে
একদিন এক বিদেশিনীর বেশে
বৃন্দা পাড়ি দিলে মথুরায়
সেখানে গিয়ে দেখলে
মহারাজ শ্রীকৃষ্ণের রাজদরবারে
প্রহরীদের কড়া প্রহরা
বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ
রাজকার্য ব্যতিরেকে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ।
তবু একজন বিদেশিনী সন্ন্যাসিনীর কাতর অনুরোধে
তারা কি বুঝলো কে জানে
দু দণ্ডের জন্যে মঞ্জুর করলে অনুমতি
সে অনুমতি নিয়ে বৃন্দা ঢুকলে রাজদরবারে
সেখানে “মহারাজের জয় হোক”বলে জয়ধ্বনি দিয়ে
নতমস্তকে দাঁড়াতেই
মথুরার রাজা ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন,
তোমায় তো চিনতে পারছিনে বিদেশিনী
কে তুমি?
সে কথা শুনে হাসলে বৃন্দা,
বললে, এখন কেন চিনবে আমায়
আর কি চেনার দিন আছে ।
রাজা শুধোলেন, তার মানে ?
বৃন্দা বললে, তার মানে আর কি বলব আমি
যে কালে চিনতে হে কানু
সে কালে রে কালে খেয়েছে,
তখন তুমি ছিলে রাখাল
এখন হয়েছো ভূপাল
আর কি তোমার আছে সেকাল
রাধারানির পায়ে ধরা
সেকাল কি আর মনে আছে ?
রাজা বললেন, আমি তোমার এসব কোন কথাই
বুঝতে পারছি না বিদেশিনী
আমি তোমায় চিনতেও পারছি না ।
তখন বৃন্দা বললে, আমিও তোমায় পারছি না চিনতে
রাজমুকুট পরা মহারাজ শ্রীকৃষ্ণকে
চিনতে পারছিনা আমি
তবে হ্যাঁ,
মহারাজের মতন দেখতে
একেবারে অবিকল দেখতে
একজন কে দেখেছি বৃন্দাবনে।
তখন উদগ্রীব হয়ে শুধোলেন মহারাজ,
– সে কেমন ছিল দেখতে ?
– সে দেখতে ছিল অপরূপ
সে রূপ যে দেখেছে সেই মজেছে ভালোবাসায়
-আচ্ছা তার গায়ের রঙ ছিল কেমন ?
-সে ছিল কালো
তমাল তরুর মতন কালো।
-তার ভঙ্গিটি কেমন ছিল ?
-সে ছিল বাঁকা।
-তার মাথায় ছিল কি?
-মাথায় ছিল ময়ূর পালক।
-সে কি কিছু বাজাত ?
-সে বাজাত বংশী বেণু।
-সে মাখত কী ?
-সে মাখত কদম ফুলের রেণু।
-সে করত কী ?
-সে গোষ্ঠে যেত গরু চরাতে।
-সে কি বাঁধা থাকত কারো কাছে ?
-হ্যাঁ থাকত।
-কার কাছে থাকত বাঁধা ?
-আয়ান ঘোষের বউ রাধিকার কাছে বাঁধা থাকত ।
-সে আবার কেমন কথা
আয়ান ঘোষের বউয়ের কাছে
সে বাঁধা থাকবে কেমন করে ?
-কদম তলায় যমুনার ঘাটে
যদি একদিন দেখা না হত
তাহলে সে কেঁদে আকুল হয়ে বাজাত বাঁশি
রাত দুপুরে দিন দুপুরে বাঁশি বাজাত ।
– বাঁশি বাজালে কি হতো?
-বাঁশি বাজালে আয়ান ঘোষের বউ ছুটে যেত
লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে
কলসি কাঁখে যমুনাতে জল আনতে ছুটে যেত।
-যেদিন সে বাজাতনা বাঁশি সেদিন কি হত ?
-সেদিন আর কি হবে
কুঞ্জে এসে মুখ ভার করে বসে থাকত ।
-মুখ ভার করে কি করত
সে কি কখনো মান করত ?
– মান ও সে করত
তবে তার কারণ ছিল আলাদা ।
-কী কারণ ?
-সে আর শুনে কি হবে ।
-বলো না শুনি।
-ওই যে ছেলেটা বাঁশি বাজাত কদমতলায়
যে তার ভালবাসায় পাগল হয়ে
দিন রাত বাজাত বাঁশি
সে যেদিন রাত কাটালে চন্দ্রাবলীর কুঞ্জে
সেদিন মস্ত অভিমানে
কারো সঙ্গে কোনো কথা না বলে
সে চুপচাপ মান করে রইলে বসে।
-তখন হল টা কি ?
– তখন আর কি হবে
কদমতলায় বাঁশি ফেলে
ছেলেটা এলো ছুটে ।
– তারপর কি হল ?
– তারপর যা হবার তাই হল
বৃন্দার কুঞ্জে এসে
রাইয়ের পায়ে ধরে মান ভাঙাতে হল ।
-মান ভাঙিয়ে কি হল?
-সে আর শুনে কাজ নেই ।
-কেন বলত।
-এখন সেই ভালবাসার পাখি
শিকল কেটে চলে এসেছে মথুরায়।
-মথুরায় এসে কি হয়েছে তার ?
– মথুরায় তাকে সোনার খাঁচায় ভরে রেখেছে রানি
মথুরার মহারানি।
-তাহলে এখন আমায় করতে হবে কি ?
-আপনাকে এর সুবিচার করতে হবে মহারাজ ।
-কি সুবিচার চাও তুমি ।
-পাখিকে এবার ছেড়ে দিতে হবে মহারাজ
সোনার খাঁচার গারদ খুলে
তাকে এবার মথুরা থেকে
ছেড়ে দিতে হবে বৃন্দাবনে।
সে কথা শুনে মথুরার রাজা
তাঁর রাজমুকুট খুলে রেখে
হেসে বললেন,
অনেক হয়েছে বৃন্দা
আর না
অর তোমায় বলতে হবে না কিছু
দোহাই তোমার
এবার রাখো হেঁয়ালি
বলো ব্রজের সব কুশল তো ?
তখন বৃন্দা বললে, ব্রজের কেউ কুশলে নেই কানু
তোমার কদম
তোমার যমুনা
তোমার ধবলী
তোমার কুঞ্জ বন
তোমার নিধু বন
কেউ নেই কুশলে।
কানু শুধোলে, কেন
কুশলে নেই কেন
তাদের হয়েছেটা কি ?
বৃন্দা বললে,
যমুনা এখন বইছে উজানে
কদমের যত ফুল ছিল
রেনু ছিল
পাতা ছিল
সব গেছে ঝরে
তোমার ধবলী তোমার শ্যামলী
আর যায়না গোষ্ঠে
সারা দিনমান তারা বসে থাকে বৃন্দাবনের পথে
তোমার কুঞ্জ বন তোমার নিধুবন
সেখানে যত গাছ ছিল
সব কাঠ হয়ে গেছে শুকিয়ে ।
তাই শুনে কানু শুধোলে,
আর তোমাদের রাই
বিনোদিনী রাই ?
বৃন্দা বললে, রাইয়ের কথা চাইছো জানতে
সে কথা বলার ভাষা নেই আমার
সে ভাষায় গান বেঁধেছেন কবি
আমি সেই গানের কথা বলতে পারি
‘হরি গেও মধুপুর হাম কুলবালা–
কি কহসি কি পুছসি শুন প্রিয় সজনী
কৈছনে বঞ্চব ইহ দিন রজনী
নয়নক নিন্দ গেও বয়নক হাস
সুখ গেও পিয়া সঙ্গ দুখ হাম পাশ।
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন