দেবব্রত সিংহ

কবিতা - ভগবান বিরসা

দেবব্রত সিংহ

বিরসা //

জানিস মা

সারাদিন বোহোনডার বনে বনে

ছাগল চরাই

বাঁশি বাজাই

টুইলা বাজাই

সনঝাবেলায় আলুনা ঘাটো খাতে

আমার ভাল লাগে নাই একদম

আমার একদম ভাল লাগে নাই

একটুন নুন শুদদা জুটে নাই আমাদে

ও মা ঘাস বীজ সিজাই যে ঘাটো রাঁধিস তুই

সে কি নুন বেলগে ভাল লাগে ?

দাদা বলে, দেখ বিরসা

যখন আমি বড় হব

তখন হাটে যাইয়ে এক বস্তা নুন কিনে আনব

আচ্ছা তুই বল দেখনি মা

আমরা ঘাটো খাই

আর দিকুরা ক্যানে ভাত খায় ?

আমাদে ঘরে কড়ুয়া তেলের বাতি জ্বালাবার লাগে

মহুয়া বীজ কুটতে পিষতে

তোর দম যায় বেরাই

তবু সনঝা নামলেই সব অনধাকার

মুন্ডাদে কুঁড়াঘরগুলানে ঘুটঘুটা অনধাকার

উদিকে দিকুদে দালানে কত আলো

ক্যানে দিকুদে দালানে অত আলো জ্বলে ক্যানে ?

দিকুরা জমিদারি করে

আর মুন্ডা রা বেঠবেগারি খাটে ক্যানে ?

দিকুরা পালকি চাপে

আর মুন্ডা রা কাঁধ দেয় ক্যানে ?

জানো মা

আমার আবা বলে

মুন্ডা দে জীবন ত ইরম ই হয়

মুন্ডা দে জীবন ছেড়া টেনার পারা

তার লাগে অত দুখ কীসের,

তুই লিজেও ত বলিস মা

আমাদে জীবনটা ছেঁড়া টেনার পারা

আমি ইদিকে সিয়াই ত উদিকে ছিড়ে

আবার ইদিকে ছিড়ে ত উদিকে সিয়াই,

ক্যানে মা

আমাদে মুন্ডাদে জীবনটা ইরম ক্যানে হয় ?

তুই কাঁদছিস

তুই কাঁদছিস মা

হা দেখ

মু তুলে দ্যাখ

ই জল জঙ্গল লদী পাহাড় বন বাদাড়

খেতি জমিন গা গেরাম ডাঙ্গা ডহর

সব আমার

আমি বিরসা

করমি আর সুগানা মুন্ডার বেটা

বিরসা।

মা //

ডর করে বাপ

আমার বড় ডর করে

তুই আমার পেটের ছেল্যা

তবু তোকে চিনতে লারি

তুই তোর দাদার পারা হলি নাই

তুই কোন মুন্ডারী ছেল্যার পারা হলি নাই

তুই কেমন অন্য মতন

তোর মুখ চোখ সব কেমন অন্য মতন ।

বিরসা //

জানিস মা, সদদাররা বেরাইছে,

সদদাররা ভগবান খুঁজতে বেরাইছে,

বলছে, আমাদে মুন্ডাদে ঘরে নকি

ভগবান জম্ম লিইছে

তুই বল দেখনি মা

সেই ভগবান টা কে বঠে ?

মা //

ইসব কথা কে শিখাল রে তোকে

ইসব লড়াই খেপা সদদারদের কথা

উয়ারা এমনি করে মাথা বিগড়াই

লড়াইয়ে নামাই

মারে ফেলেছে বহুত ছেল্যাকে

না রে বিরসা না

তুই উয়াদে কথা বলবি না

তুই এতটুকুনি একটুন ছেল্যা

তুই ক্যানে থাকিস ইসবের ভিতরে

শুন আমার কথা শুনে

আর সব মুন্ডা ছেল্যারা যেরম হয়

তুই তেমনি হবে

দিকুদে ঘরে গাইচরী (রাখালি) করবি

দুবেলা পেট ভরে ঘাটো খাবি

করম পরবে গুনজাফুলের মালা পরে লাচ করবি

তাবাদে একদিন

কোনো সুন্দরী মেইয়াকে আরানদি করে

গাঁও পহানের শাসন মানে

ঘর সংসার করবি।

বিরসা //

তুই হাসালি দেখছি মা

তুই আমাকে হাসালি

তুই কি একদম পাসুরে গেলি

যা লিয়ে সব মুন্ডা ছেলারা ভুলে থাকে

তা লিয়ে বিরসা ক্যানে ভুলে থাকবেক

যা লিয়ে সব মুন্ডা ছেল্যারা সুখ খুঁজে

তা লিয়ে বিরসা ক্যানে সুখ খুঁজবেক,

জানিস মা,

তোর দুখ আমার রক্তে আগুন ছিটায়

তুই শুনে রাখ

তীর, ধনুক, তরোয়াল, আগুন, দুধ, জল,ধান,

এই সাত সাতটা জিনিস ছুঁয়ে

আমি পণ করেছি মা

আমি বিরসা।

মা //

তুই যে ক্যানে ইরম হলি

আমি ভাবে ভাবে মরি

তোর ঘরের দিকে কোনো লজর নাই

একদম লজর নাই

জানিস আমরা আর ঘাটো খাতে পাব নাই

আমাদে গোটা জঙ্গল খাস করে লিইছে সাহেব সরকার

যে জঙ্গলে আমরা হাজার হাজার চাঁদ থাকে

গরু ছাগল চরাইছি

পাতা কুড়াইছি

কাঠ আনেছি

মধু আনেছি

সেই জঙ্গলটা খাস করে লিইছে

জঙ্গলের ভিতরে যত গাঁ ছিল

যত বসতি ছিল

সব তুলে দিইছে

আখন ইলাকাদার, জমিদার, ইজারাদার, পাহারাদাররা

তাঁবু গাড়ে বসেছে

জঙ্গলে পা দিলে জরিমানায় করছে

হাজতে ঢুকাচ্ছে ।

বিরসা //

সেই লাগেই ত চাইবাসার মিশন ছাড়লম মা

সেই লাগেই ত চাইবাসার মিশন ছাড়ে

আমি আখন চালকাড়ের জঙ্গলে।

মা //

জানিস বিরসা

তুই যেদিন চলে গেলি চালকাড়ের জঙ্গলে

সিদিন থাকে কারো চোখে ঘুম নাই

তোর আবা তোর মা কারো চোখে ঘুম নাই

লোকে বললেক

করমি তোর ছেল্যা ক্ষেপে গেছে

ক্ষেপে যাইয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বুলছে

সেই কথা শুনে আমি আর কি করি

আমি একলা ঘরে বুক চাপড়াই কান্দি।

বিরসা //

তুই শুদু একা লয় মা

গোটা ছোটনাগপুরের মুন্ডারী মা কাঁদছে

আমি চাইবাসার মিশন ছাড়ে

চালকাড়ের জঙ্গলে ঢুকে দেখি

সিখানে আবার আরেকজনা মা কাঁদছে,

সে আমাকে দেখে বললেক ,

বিরসা তুই আমাকে বাঁচা

আমি অশুচ হ ইয়ে গেছি বাপ

তুই আমাকে শুচ করে দে

আমার কান্না কেউ শুনে না

আমার মুয়ের দিকে ভালে কেউ দেখে না

বাবু, বেনিয়া, মহাজন\’, জমিদার

, ইজারাদার, ইলাকাদার

উয়ারা আমার লাজ কাড়ে লিইছে

উয়ারা আমার জঙ্গল কাটে

আমাকে লেংটা করে দিয়েছে

তুই আমার লাজ ঢাকে দে বিরসা

তুই আমাদে ধরতি আবা

তুই ই ধরতিটাকে বাঁচা।

মা //

ধরতি আবা

মুন্ডাদে ঘরে আত আত ছেল্যা থাকতে

আমার ছেল্যাকে ধরতি আবা করবে ক্যানে

আমি ধরতি আবা চাই নাই

আমি আমার ছেল্যাকে চাই

আমার বিরসাকে চাই,

কে শুনছে কার কথা

আষাঢ়ী বাদলের দুযযোগে

ঝড় বইছে শনশন করে

আকাশ ভাঙ্গে জল পরছে ঝম ঝম করে

কড় কড় করে মেঘ ডাকছে

ঘড়িক ঘড়িক বাজ পড়ছে

আলোতে আলোতে ঝলসে যাচ্ছে চালকাড়ের জঙ্গল

ইয়ার মাঝে আচকা শুনি

কারা লাগড়া বাজাচ্ছে

বাজ পড়ার সঙ্গে লাগড়ার শব্দ

দুয়ার খুলে দেখি

লাগড়াই ত বাজছে

ক্যানে ই ঝড় বাদলে লাগড়া ক্যানে

উয়ারা বললেক,

উলগুলান এর আগুন দিয়ে

ধরতি আবা আল্যে

লাগড়াই ত বাজে রে করমি

কান পাতে শুন

আমাদে চালকাড়,মানকিডি, কোচাং,

সিনজুরিয়া,সিদানা,কোটনা,

বাগরি, বিরিসাম,আর নওরতনে

উলগুলান এর লাগড়া বাজছে,

আমি শুদালম,ই ঝমঝমানি ঝড় বাদলে

তোরা কার লাগে লাগড়া বাজাচ্ছিস

চালকাড়ের জঙ্গল ভাঙ্গে মাথা উঁচাই দু হাত তুলে

যে ছেল্যাটা ভিজতে ভিজতে আসছে

সে ত আমার বিরসা

আমার ব্যাটা বিরসা

আয় বিরসা আয়

আমার কাছে আয়

তোর গা মুছাই দি আয়

তুই ঘরের ছেল্যা ঘরে আয়।

বিরসা //

আমাকে আর বিরসা নাই বলিস মা

আমাকে আর বিরসা নাই বলিস

আমি ধরতি আবা

আমি ডাইন, জান, ঝাড়ফুঁক

হাঁড়িয়া, তাড়ি, মদ,

ইসব লিয়ে বলি নাই পূজা করতে সিংবোঙার

আমি কোল, খেড়িয়া, ওঁরাও, মুন্ডা

কারু কাছে শুনাতে আসি নাই

পাদ্রি সাহেবদের স্বর্গরাজ্যির কথা

আমি বলি চল

লিজেদের হক লিজেরা কাড়বি চল

সাহেব সরকার দিকু জমিদার বেনিয়া মহাজন\’

ইজারাদার, ইলাকাদার, পাহারাদার

সব শয়তান

বেঠবেগারি, বেগারখাটা, সেবকপাটটা, আড়কাঠি

খতম কর

সব খতম কর

আমি তোদের আরামের লাগে

জঙ্গলের মাচায় দোল খাওয়ানোর লাগে আসি নাই

আমি তোদের মরতে শিখাব

আমি তোদের মারতে শিখাব।

মা //

হ তুই আখন শুদু চালকাড়ের লয়

গোটা ছোটনাগপুরের দুখ বুঝিস বিরসা

কিন্তূক যে মা তোকে ধরতি দেখাল

তার কোনো দুখ বুঝিস নাই তুই ।

বিরসা //

দুখ , তোর আবার দুখ কীসের মা।

মা //

আয় তবে আয়

আমার কোলে আয়

একবার আমার কোলে আয়।

বিরসা //

না গো মা

আখন আর তোর কোলে না

আখন আর তোর কোলে আমাকে নাই ধরবেক

আখন আমি ধরতি আবা

ই ধরতির যত মানুষ আছে

আমি তাদের ধরতি আবা

আখন আমি বিরসা

ভগবান বিরসা।

১৮
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন