তখন খুউব ভোরবেলা

শিউলি ঝরানো ভোরবেলা

সেই আলো আঁধারি ভোরে

ঝুপড়ি ঘরের আগল খুলে মেয়েকে রেখে বেরুল সে

লাইনধারের বস্তি তখনো ছেড়া মাদুরে

ঘুমের ঘোরে এপাশ ওপাশ

জায়গাটা শহর

শহর নয় মহানগর

সাইনবোর্ডে পোস্টারে পোস্টাপিসের পিন কোডে

জমির দলিলে পার্টির দালালে

প্রমোটারে ফ্ল্যাটবাড়িতে

জায়গাটা কলকাতা

নিউটাউনের নিউ কলকাতা।

লাইনধারে হাঁটতে হাঁটতে যেমন যায়

তেমনি করে সেদিনও সে পেরিয়ে গেছিল খালপাড়

কত আর বয়স তেইশ কি চব্বিশ

নেহাতই কমবয়সী

তবু ফ্ল্যাটবাড়ির কলপমাখা বৌদিমণিরা সবাই তাকে ডাকে

কাজের মাসি

আসলে তার নাম একাদশী

বউ ঠেঙানো সোয়ামী সতীন ঘর গেরস্থি ছেড়ে

সুন্দরবনের বনবাদাড় নদী নালা ভেঙে

একদিন এক ফাগুন মাসের জ্যোৎস্নারাতের রাত দুপুরে

কি জানি কি করে

পালিয়ে এলো সে পরপুরুষের ভালবাসার হাত ধরে

তারপর লাইনধারে ঝুপড়ি ঘরে বছর না ঘুরতেই

নীলরতনে খুকি হলাে

তখন ভালোবাসার কালো ভ্রমর নতুন আরেক ফুলের খোঁজে

হঠাৎ একদিন উড়ে গেল

পোড়াকপালে একেই বলে বিধিলিপি

এ কপালকে না দুষে সব স‌ইলে একাদশী

শ্যামলাবরণ মায়ের কোলে

আলোবরণ কচি মেয়ের হাসি।

কে যেন বলল তাকে

তুই ছিলি একাদশী এ হবে পূর্ণিমা

একদিন তাই হবে

এই ভেবে ভেবে

ফ্ল্যাটবাড়িতে বাসনমেজে ঘরমুছে

দেখতে দেখতে একদিন এক রোদসকালে

খুকির চুলে রিবন বেঁধে

পিঠে বইয়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে

তাকে ইসকুলে দিলে পাঠিয়ে একাদশী

তারপর ঐটুকুন এক একরত্তি মেয়ে

এক্কা দোক্কা খেলার মতন

এক্লাস থেকে সেক্লাসে

লাফাতে লাফাতে চললে এগিয়ে

সবে সহজপাঠের শেষে সে যখন ধরলে কিশলয়

পড়শীরা বলল, ‘আমাদের খুপড়ি ঘরের মেয়েদের

এত লেখাপড়া করে হবে টা কি শুনি’

ফ্ল্যাটবাড়ির রোজগেরে গিন্নিরা

একে একে ডেকে বললে,

‘ও একাদশী তোমার এই ফুটফুটে মেয়েটাকে

দাও না গো

খাওয়া দেব পরা দেব

টাকাপয়সা সব দেব

কজের মধ্যে কাজ শুধু

রিমোট হাতে টিভি দেখবে আর

বাচ্চা কাঁদলে ঘুম পাড়াবে

দোলনাতে দোল খাওয়াবে’,

কানে একটু খাটো একাদশী

তবু এসব খাটো কথায় কান দেয়নি সে

এ বাড়ি ও বাড়ি গায়ে গতরে খেটে খুটে

সকাল সন্ধ্যে মেয়ের পড়ার টিউশন দিয়ে

পুর্ণিমা দেখার স্বপ্নটাকে নষ্ট করেনি সে।

ও একাদশী

তোর এত কষ্টের স্বপ্নটাকে

এই শিউলি ঝরানো ভোরে

কারা দিয়ে গেল নষ্ট করে

ঐ টুকুন ফুলের মতন শিশুর শরীর

সে শরীরের পাপড়ি ছিড়ে ফালাফালা করে

বিবস্ত্র করে

রক্তাক্ত করে

ফেলে দিয়ে গেল কোন শকুনের দল?

কোথায় সান্তনা দেবে তা নয়

ঠোঁট উল্টে পড়শিরা দিলে উপদেশ

‘কেন বাপু একলা ঘরে অত ভোরে

মেয়েকে ফেলে কাজে যাওয়া

যা দিনকাল পড়েছে আজকাল

মেয়ে বড় হলে অমন বেহুঁশ হলে চলে’

বলতে বলতে থানা পুলিশ

বলতে বলতে ক্যামেরা কাঁধে মিডিয়া

খানিক পরে বস্তিবাসীর রক্ষাকর্তা

মহানাম্য পুরপিতা পুরমাতা

পার্টির নেতা

‘ও একাদশী তুই কিছু বল না লো ছুড়ি

লাশ নিয়ে যায় পুলিশে

তুই কিছু বল না

মুখ দিয়ে কোন রা নাই

চোখ দিয়ে কোন জল নাই

আমাদে বস্তির ঘরে এমন ঘটনা রোজ-ই ঘটে

তার জন্য এমন পাষাণী হলে চলে।’

সেদিন সন্ধ্যাবেলা আলো জ্বলল না রাস্তার মোড়ে

সেদিন সন্ধ্যাবেলা অন্ধকার

সে এক বিকট আন্ধকার

গোটা নিউটাউন জুড়ে বিদ্যুৎ বিকলের সর্বগ্রাসী অন্ধকার

রাত বাড়লে

বাড়িউলির বারো ঘর এক উঠানের

টালির খাপরার চালে

কদম গাছের ডালে ডালে

জোনাকীরা এলো উড়ে

তারা বললে

‘ও একাদশী

তুই অমন করে মাটিতে উবু হয়ে পড়ে কেনে

বনে বাদাড়ে জলে জংগলে বাঘের সংগে লড়াই করা মানুষ তোরা

সেখানে কটা হায়নার ডরে পড়ে থাকলে চলে।’

তখন কী যে হল

ধড় ফড় করে উঠে বসল, সে

তখন কী যে হল

রুখু চুলের মাথার ভিতরে

লাখে লাখে ঝি ঝি ডাকতে লাগল

সে মরনখাওকী ডাকে কাঁপতে কাঁপতে

সাপুড়ের ঝাঁপি থেকে ছাড়া পাওয়া গোখরোর মতন

ফুঁসে উঠল সে

তারপর অন্ধকার ঘরে সারা ঘর হাতড়ে

কী যেন খুঁজতে লাগল

হতে ঠেকল না কিছুই

লোহার বঁটিটা ছিল পড়ে

সেটাকেই হাতিয়ার করে হাতে তুলে নিয়ে দাঁড়াল সে

আশপাশের টালির খাপরায় পড়শিদের নাকডাকানি ঘুম

তার অদূরে নিশ্চিন্তে ঘুমের ঘোরে

বৌদিমণিদের সারি সারি ফ্ল্যাটবাড়ি

এর মাঝে এক তীব্র ঘেন্নায়

মুখ দিয়ে খুতু ছেটাতে ছেটাতে

সে খুলে ফেললে কাপড় চোপড়

একে একে দূর করে ছুঁড়ে দিলে শাড়ি ব্লাউজ সব

তারপর এই অন্ধকার মহানগরীতে

এলো চুলে

ধকধকে দুচোখে আগ্নেয়গিরি জ্বেলে

হাতিয়ার হাতে

জানোয়ার খুঁজতে বেরুলে উলংগ একাদশী।

মাননীয় গণ

মহানগরীর গলিপথে বা রাস্তায় প্রকাশ্য দিনের বেলায়

অথবা ঝলমলে নিয়ন আলোয়

কৃষ্ণকায় নগ্ন এই নারীর সঙ্গে দেখা হলে

দোহাই আপনাদের

ওকে আপনারা পাগলী বলে ডাকবেন না

ওকে আপনারা পগলী বলে ডাকবেন না।

১৩
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন