মাদকের ছোবল:- এক যুবকের অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরে আসার গল্প।
সূচনা: যখন ফিসফিস শুরু হলো
শাওন জানত, এই শহরের অলিগলিতে তার মতো হাজারো যুবক হারিয়ে গেছে। তার জীবন ছিল ঝকঝকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র, চোখে ছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন থামল এক সন্ধ্যায়। যখন পৃথিবীটা হঠাৎ বড্ড দ্রুত আর কঠিন মনে হচ্ছিল, তখনই কানে এল সেই বিষাক্ত ফিসফিস।”একবার, শুধু একবার চেষ্টা করে দেখ। সব কষ্ট ভুলে যাবে।
প্রথমবারটা এসেছিল কৌতূহল হয়ে। দ্বিতীয়বার এল হতাশার হাত ধরে। আর তৃতীয়বার এল অনিবার্য অভ্যাসের মতো। মাদকের কণাগুলো যেন শাওনের মস্তিষ্কের প্রতিটি দরজা ভেঙে দিতে শুরু করল। দ্রুতই তার ঝকঝকে জীবনটা ধূসর হতে শুরু করল। ক্লাসের অনুপস্থিতি, মিথ্যা অজুহাত, পরিবারের কাছ থেকে টাকা চুরির চেষ্টা—শাওন যেন নিজের অজান্তেই নিজেকে ধ্বংস করার খেলায় মেতে উঠল।
পতন: নীরবতার আর্তনাদ।
আয়নার সামনে দাঁড়ালে সে নিজেকে চিনতে পারত না; চোখগুলো ক্লান্ত, ত্বক বিবর্ণ, আর মুখে লেগে থাকত এক তীব্র শূন্যতা। মাদক এখন আর “বিস্মৃতি” ছিল না, ছিল তার শ্বাস-প্রশ্বাস।
এক রাতে, মায়ের পুরোনো আলমারি থেকে কিছু টাকা নিতে গিয়ে সে ধরা পড়ল। বাবার শান্ত, কিন্তু পাথরের মতো কঠিন মুখটা দেখে শাওনের মনে হলো, সে কেবল নিজের জীবন নয়, তার বাবা-মায়ের স্বপ্নকেও গলা টিপে মেরে ফেলেছে। সেই রাতে, শাওনের ঘরে কোনো চিৎকার ছিল না, ছিল শুধু গভীর নীরবতা—যা হাজারো কান্নার চেয়েও বেশি ভয়ানক। সেই নীরবতাই যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল,”তুমি শেষ, শাওন। তুমি হেরে গেছো।”
আলোর সন্ধান: যখন আশার কণ্ঠস্বর শোনা গেল
মা-বাবার নীরবতা শাওনকে আঘাত করল, কিন্তু ধ্বংস করল না। একদিন, পুরনো বন্ধু রফিক তাকে জোর করে একটি রিহ্যাব সেন্টারে নিয়ে গেল। প্রথম কয়েকটা দিন ছিল নরকের মতো। তার শরীর চিৎকার করছিল, মন বিদ্রোহ করছিল। কিন্তু সেখানেই সে দেখল তার মতো আরও শত শত যুবককে, যারা মাদকের ছোবলে ক্ষতবিক্ষত।
কাউন্সিলিং সেশনে একজন থেরাপিস্ট শাওনকে জিজ্ঞেস করলেন:”তুমি কিসের জন্য বাঁচতে চাও, শাওন?” ধীরে ধীরে উত্তরটি তার ভেতরে জেগে উঠল। সে বাঁচতে চায় তার বাবা-মায়ের জন্য, এবং সেই ঝকঝকে ভবিষ্যতের জন্য, যা সে একদিন স্বেচ্ছায় ছুড়ে ফেলেছিল।
পুনরুত্থান: ফিরে আসার সংগ্রাম
মুক্তির পথটা কঠিন ছিল। প্রতিটি দিন ছিল একটি ছোট যুদ্ধ। কোনো কোনো দিন সে প্রায় হার মেনে নিত। কিন্তু তখনই তার কানে আসত তার মায়ের কণ্ঠস্বর,”হার মানা চলবে না, আমার ছেলে।”
শাওন শিখল—জীবনের সত্যিকারের লড়াইটা মাদকের সঙ্গে নয়, বরং নিজের ভেতরের দুর্বলতার সঙ্গে। সে নিজেকে গুছিয়ে নিল। সে নতুন লক্ষ্য তৈরি করল: সমাজের সেই যুবকদের পাশে দাঁড়ানো, যারা এখনও সেই বিষাক্ত ফিসফিস শুনছে।
আজ, শাওন সেই রিহ্যাব সেন্টারেই একজন পরামর্শদাতা। তার কাজ হলো—যুবকদের বোঝানো যে পৃথিবীতে যত কষ্টই আসুক না কেন, পালিয়ে যাওয়া সমাধান নয়। প্রতিটি অন্ধকারের পরে আলো থাকে, আর জীবনের সবচেয়ে বড় জয় হলো নিজের ওপর বিশ্বাস রাখা।
শেষ কথা: সংকল্পের জয়
শাওন জানে, সেই বিষাক্ত ফিসফিস কখনোই পুরোপুরি থেমে যাবে না। এটি হয়তো সবসময় কোনো না কোনো কোণে লুকিয়ে থাকবে। কিন্তু এখন শাওনের হাতে আছে প্রতিরোধের ঢাল—দৃঢ় প্রত্যয়, পরিবার এবং নতুন খুঁজে পাওয়া আত্মবিশ্বাস।
আর এই প্রত্যয়ই প্রমাণ করে, আশা আর সংকল্পের কণ্ঠস্বর সবসময় সেই মাদকের ছোবলকে ডুবিয়ে দিতে পারে।

মন্তব্য করতে ক্লিক করুন