শিরোনাম - ছোটগল্প ভিখারিনী -দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

লিখেছেন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রকাশ - 2021-05-17 04:17:00 | ক্যাটাগরি - অন্যান

গল্প - কমলের মাতা ভগ্ন কুটিরে রোগশয্যায় শয়ান। জীর্ণ গৃহ ভেদ করিয়া শীতের বাতাস তীব্রবেগে গৃহে প্রবেশ করিতেছে। বিধবা তৃণশয্যায় শুইয়া থরথর করিয়া কাঁপিতেছেন। গৃহ অন্ধকার, প্রদীপ জ্বালিবার লোক নাই। কমল প্রাতে ভিক্ষা করিতে গিয়াছে, এখনও ফিরিয়া আসে নাই। ব্যাকুল বিধবা প্রত্যেক পদশব্দে কমল আসিতেছে বলিয়া চমকিয়া উঠিতেছেন। কমলকে খুঁজিবার জন্য বিধবা কতবার উঠিতে চেষ্টা করিয়াছেন, কিন্তু পারেন নাই। কত কী আশঙ্কায় আকুল হইয়া মাতা দেবতার নিকট কাতর ক্রন্দনে প্রার্থনা করিয়াছেন; অশ্রুজলে কতবার কহিয়াছেন, 'আমি হতভাগিনী, আমার মরণ হইল না কেন। কখনও ভিক্ষা করিতে জানে না যে বালিকা, তাহাকেও আজ অনাথার মতো দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইতে হইল ক্ষুদ্র বালিকা অধিক দূর চলিতে পারে না--সে এই অন্ধকারে, তুষারে, বৃষ্টিতে কী করিয়া বাঁচিবে।' উঠিতে পারেন না--অথচ কমলকে দেখিতে পাইতেছেন না, বিধবা বক্ষে করাঘাত করিয়া অধীর ভাবে কাঁদিতে লাগিলেন। দুই-একজন প্রতিবাসী বিধবাকে দেখিতে আসিয়াছিল; বিধবা তাহাদের চরণ জড়াইয়া ধরিল সজল নয়নে কাতরভাবে মিনতি করিলেন, 'আমার পথহারা কমল কোথায় ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, একবার তাহাকে খুঁজিতে যাও।' তাহারা বলিল, 'এই তুষারে, অন্ধকারে, আমরা ঘরের বাহিরে যাইতে পারি না।' বিধবা কাঁদিয়া কহিলেন, 'একবার যাও--আমি অনাথ, দরিদ্র, অর্থ নাই, তোমাদের কী দিব বলো। ক্ষুদ্র বালিকা, সে পথ চিনে না, সে আজ সমস্ত দিন কিছু খায় নাই--তাহাকে মাতার ক্রোড়ে আনিয়া দেও--ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করিবেন।' কেহ শুনিল না। সে বৃষ্টিবজ্রে কে বাহির হইবে। সকলেই নিজ নিজ গৃহে ফিরিয়া গেল। ক্রমে রাত্রি বাড়িতে লাগিল। কাঁদিয়া কাঁদিয়া দুর্বল বিধবা ক্লান্ত হইয়া গিয়াছেন, নির্জীবভাবে শয্যায় পড়িয়া আছেন, এমন সময়ে বাহিরে পদশব্দ শুনা গেল। বিধবা চকিত নেত্রে দ্বারের দিকে চাহিয়া ক্ষীণস্বরে কহিলেন, 'কমল, মা, আইলি' একজন বাহির হইতে রুক্ষস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, 'ঘরে কে আছে।' গৃহ হইতে কমলের মাতা উত্তর দিলেন। সে শাখাদীপ পার্বত্য লোক চীর বৃক্ষের শাখা জ্বালাইয়া মশালের ন্যায় ব্যবহার করে। হস্তে গৃহে প্রবেশ করিল এবং কমলের মাতাকে কী কহিল, শুনিবামাত্র বিধবা চীৎকার করিয়া মূর্ছিত হইয়া পড়িলেন।