মাঠঘাট পেরিয়ে ছুটতে-ছুটতে ট্রেনটা বিকেল শেষ করে দিল। জানালায় বসে রোদ মরে যেতে দেখেছিল সে, ছায়া গাঢ় হতে-হতে ঘোলা পৃথিবী। ছুটন্ত ট্রেন থেকে অনীক সূর্য-হারানো পৃথিবীর শরীর চুঁইয়ে বেরনো অন্ধকারকে অনুভব করতে পারল এক সময়। পর-পর এইসব পরিবর্তন দেখতে-দেখতে অদ্ভুত বিষণ্ণ আরামে আক্রান্ত হয়ে গেল সে। অনীক জানালায় মাথা রেখে চাঁদ উঠতে দেখল।
আর তখনই পৃথিবীটা অন্যরকম হয়ে গেল। গাছগাছালি, মাঠ আর অপূর্ব নীল আকাশকে স্নান করাতে সোনার থালার মতো চাঁদ পৃথিবীর সামান্য ওপরে গুঁড়ি মেরে উঠে এসেছে। একদম নিটোল নারীর মতো চাঁদ। এই মুহূর্তে নিজের শরীরের আলোয় সে আলোকিত। এমন উদাসীনা নারীর খবর একমাত্র শুক্লপক্ষই দিতে পারে। ক্রমশ সেই তিরতিরে জ্যোৎস্নায়ভেজা অলৌকিক প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে একটা তীব্র আকর্ষণ অনীকের বুকে পৌঁছে গেল। এমন এক মায়াময় ভুবন পৃথিবীতে তার জন্যে অপেক্ষা করছে অথচ সে ট্রেনের কামরায় নেহাতই প্রয়োজনের তাগিদে বসে–এ হতে পারে না। মানুষ শত চেষ্টা করলেও এক জীবনের বেশি বাঁচতে পারে না। যা কিছু প্রয়োজন তা যত জরুরিই হোক, সেই জীবন শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই ফুরিয়ে যায়। অতএব নিয়ম ভাঙতে যে ক্ষতি তার জন্যে তোয়াক্কা করে কী লাভ। ট্রেনের গতি। কমতে-কমতে এক নাম-না-জানা স্টেশনে ক্ষণিকের জন্যে জিরোতেই অনীক নেমে পড়ল। প্ল্যাটফর্মে। প্ল্যাটফর্ম না বলে ইটবাঁধানো চত্বর বলাই সঙ্গত।
নামামাত্রই ট্রেনটা নড়ে উঠল। তারপর যেতে হয় তাই যাচ্ছি এমন ভঙ্গিতে আলোকিত কামরাগুলো একে-একে চোখের সামনে থেকে সরে গেল। আর কেউ কি নেমেছেন এই স্টেশনে। অথবা এখান থেকে ওই ট্রেনে কেউ কি চলে গেল? বোঝা গেল না এই মুহূর্তে, কারণ শূন্য রেললাইনের পাশে বাঁধানো চত্বর ফাঁকা। সন্ধের অন্ধকারের সঙ্গে জ্যোৎস্নার মিশেল এখানে তেমন জমেনি স্টেশনবাড়ির পিছনে গাছগাছালি থাকায়। অনীক এগিয়ে গেল। স্টেশন বলতে দু খানা ঘর। তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাকে দেখছিল এক প্রৌঢ়। বললেন, তিনিই স্টেশনমাস্টার। দ্বিতীয় কর্মচারীটির শরীর খারাপ বলে আসেনি। এরপর আর কোনও ট্রেন এই স্টেশনে থামবে না। অতএব ঝাঁপি বন্ধ করে চলে যাবেন তিনি রেলের দেওয়া বাসায়।
ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, মহাশয়ের গন্তব্য কোথায়?
অনীক মাথা নাড়ল। তার কী অর্থ তা সে নিজেই জানে না। স্টেশনমাস্টার যেন অদ্ভুত কিছু দেখলেন। অনীক উলটে জিজ্ঞাসা করল, এখানে চায়ের দোকান আছে?
দোকান? খেপেছেন? কিনবে কে? আমার সংসারের যা কিছু দরকার তা সুরজগঞ্জ থেকে নিয়ে আসি। পাক্কা দশ মাইল। কিন্তু এখানে কি উদ্দেশ্যে আসা বুঝলাম না।
উদ্দেশ্যবিহীন। যেতে-যেতে ভালো লেগে গেল তাই নেমে পড়লাম। আপনি আপনার কাজ শেষ করে ঘরে ফিরে যান, আমি একটু চারপাশ ঘুরেফিরে দেখি।অনীক এগোতে চাইল।
স্টেশনমাস্টার পাশে এলেন, চারপাশে ঘুরবেন মানে? কিস্যু দেখার নেই এখানে। আমরা কি নিঃসঙ্গ, তা আপনি বুঝতে পারবেন না। স্টেশনের পাশে বাসা বলতে আমার দুটো ঘর, রামবিলাস থাকে এখানেই, এই অফিসঘরে। তারপর আর কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবেন না আপনি। এই রাতেরবেলায় মানুষজনের মুখ দেখতে পাবেন না!
আমি তো সেইরকম আশা করেই ট্রেন থেকে নেমেছি।
উন্মাদ-দর্শনের সুখ থেকে ভদ্রলোককে বঞ্চিত করে অনীক অফিসঘরের পাশ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। ডান হাতেই স্টেশনমাস্টারের দু-ঘরের বাসা। চারপাশে লম্বা-লম্বা গাছ থাকায়। ফালি-ফালি জ্যোৎস্না তার গায়ে নকশা এঁকেছে। এত চুপচাপ চারধার যে দু-কান পরিষ্কার হয়ে যায়। অনীক দেখল একটানা বাঁধানো পথ চলে গেছে মাঠের মধ্যে দিয়ে। ওই পথেই তাকে যেতে হবে। স্টেশনমাস্টারের বাসায়হ্যারিকেনের আলো জ্বলছে। এই সময় হলুদ শাড়িপরা একজনকে বারান্দায় বেরিয়ে আসতে দেখল সে। মুখচোখ দেখা যাচ্ছে না দূরত্বের কারণে যতটা তার চেয়ে ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকার জন্যে।
চায়ের দোকানের খবর নিচ্ছিলেন, এক কাপ চা না হয় আমার এখানেই খেয়ে যান। কথা বলার লোক তো এসময় পাই না, একটু গপ্পো করা যাবে। কথা শেষ করেই সম্মতির অপেক্ষা না করে হাঁকলেন, ওগো, এই ভদ্রলোককে চা খাওয়াতে হবে।
বারান্দা থেকে প্রশ্ন ভেসে এল, কেন?
একটাই শব্দ কিন্তু অদ্ভুত উচ্চারণে কীরকম অর্থবহ হয়ে উঠল। অনীক কৌতূহলে মহিলাকে দেখতে চাইল। এইরকম একটা প্রশ্ন শুনতে পাবে তা কল্পনায় ছিল না। স্টেশনমাস্টার যে বেশ বিব্রত তা তাঁর গলার স্বরে স্পষ্ট, না, মানে এখানে তো কোনও চায়ের দোকান নেই।
এখানে তো কোনওকিছুই নেই। চটজলদি কথাগুলো ভেসে এল।
তুমি অমন করে বলছ কেন? ভদ্রলোক আমাদের এই জায়গা দেখতে ট্রেন থেকে নেমে এসেছেন। এখানে থাকার জায়গা নেই। চায়ের কথা বলছিলেন—তাই–
আমাদের জায়গা মানে? তুমি এখানে থাকতে চাও না, আমি চাই, আমার জায়গা।
বেশ, তাই হল। আসুন ভাই। স্টেশনমাস্টার এগিয়ে গেলেন।
এতক্ষণ অনীক ঠিক করেছিল সে এখানে চা খাবে না। হয়তো স্টেশনমাস্টার প্রায়ই লোক ধরে আনেন চা খাওয়াবার জন্যে আর সেই কারণে ভদ্রমহিলা বিরক্ত। অতএব একজন উটকো মানুষকে তিনি চা না খাওয়াতেই পারেন। কিন্তু ওই যে কথাটা, আমার জায়গা, অনীককে আকর্ষণ করল। একজন প্রৌঢ় স্টেশনমাস্টারের স্ত্রী ওই জ্যোৎস্নাক্রান্ত চরাচরকে নিজের জায়গা বলে মনে। করছে শোনার পর তাকে কাছে গিয়ে দেখার লোভ হল ওর।
মহিলা একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছিলেন। অনীক কাছাকাছি হতেই বুঝল তিনি সুশ্রী আর বয়স কখনওই পঁচিশের বেশি নয়। অসমসাহসী স্বামী-স্ত্রী সে অনেক দেখেছে কিন্তু এদের স্বামী-স্ত্রী বলে ভাবতে ইচ্ছে করছিল না এই মুহূর্তে। মহিলার গৌরবর্ণের সঙ্গে হলুদ শাড়ি চমক্কার সঙ্গত করছে। প্রায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, এখানে চায়ের দোকান নেই বলে উনি। আপনাকে চা খেতে ডেকেছেন। আপনার আর যা-যা প্রয়োজন তা এখানে মেটানোর ব্যবস্থা নেই। বলে উনি কী আমাকে তার আয়োজন করতে বলবেন?
স্টেশনমাস্টার চাপাগলায় বলে উঠলেন, ছি: রাণু, এসব কী বলছ?
অনীক মাথা নাড়ল, আপনাকে চা করতে হবে না।
কেন হবে না?
আপনার ইচ্ছে নেই বলে।
বাঃ, আপনি খুব ভালো। ভালো লোককে চা খাওয়াতে আমার আপত্তি নেই। বসুন।
রাণু নামের মহিলা পাখির মতো পা ফেলে ভেতরে চলে গেলেন।
স্টেশনমাস্টার হাসলেন, যাক, নরম হয়েছে। এমন সব বেখাপ্পা প্রশ্ন করে যে–।
ওঁর কথা শেষ হল না, রাণু ফিরে এলেন, আপনি মতলববাজও হতে পারেন।
কি বলছ তুমি? স্টেশনমাস্টার প্রতিবাদ করলেন।
থামো! কতক্ষণ চেনো তুমি ওঁকে? এই যে আমার ইচ্ছে নেই বলে চা করতে নিষেধ করলেন, এটাও তো প্ল্যান করে বলতে পারেন। ওটা বললে আমি গলে গিয়ে চা বানিয়ে আনব। রাণু যেন শিউরে উঠলেন, ঠিক ওই ভুলটাই করতে যাচ্ছিলাম।
আপনাকে একটুও বিব্রত হতে হবে না। আমার চায়ের দরকার নেই। আচ্ছা, আসি।
অনীক চলে যাওয়ার জন্যে ফিরতেই রাণু এগিয়ে এলেন, দাঁড়ান। আমি বিব্রত হচ্ছি কে আপনাকে বলল? আমি বলেছি আপনাকে?
না, আপনার কথা শুনে মনে হল।
বাঃ। আপনার দেখছি অন্য কোনও বোধ বেশ কাজ করে। চমৎকার।
অনীক চমকে উঠল। এই লাইনটি যে মেয়ে ওইভাবে উচ্চারণ করতে পারে সে নিপাট সাধারণ নয়। এখন চাঁদের তেজ বাড়ছে। রাণুর মুখচোখ অনেকটা স্পষ্ট।
ওঁর গলা বেশ লম্বা, কাঁধ চওড়া। বাঙালি মেয়েদের তুলনায় যথেষ্ট দীর্ঘ। প্রচলিত সুন্দরী নয় কিন্তু ভালো লাগা তৈরি হয় কিছুক্ষণ থাকলেই।
যাকগে! আপনি এখানে এসেছেন কেন?
প্ল্যান করে আসিনি। ট্রেনের জানালা থেকে জায়গাটা দেখে ভালো লেগে গেল।
লাগবেই। এটা আমার জায়গা। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই ওই ভৈরবীর কথা শুনেছেন?
ভৈরবী। কে?
অভিনয় করছেন না তো?
বিশ্বাস করুন। আমি জ্যোৎস্নায় ডোবা গাছগাছালি আর নির্জনতা দেখে নেমে পড়েছি।
তাহলে ভালো। আপনি গাছ চেনেন?
কিছু-কিছু?
আপনার সঙ্গে আমার এর আগে দেখা হয়েছিল। রাণু এক পা এগিয়ে এলেন।
আমার সঙ্গে? অনীক এবার বিব্রত। এমন কথা-বলা-মহিলাকে সে কোথাও দেখেছে কিনা মনে। করতে পারছে না। অথচ ভদ্রমহিলা তাঁর স্বামীর সামনেই স্বাভাবিক গলায় ঘোষণা করলেন, দেখা হয়েছিল। স্টেশনমাস্টার সমাধানের চেষ্টায় বললেন, উনি কোথায় থাকেন জানলে তুমি বুঝতে পারবে সেখানে কখনও গিয়েছিলে কিনা।
আমি আগে গিয়েছিলাম কিনা, তা উনি কী করে জানবেন? সেটা আমি বলতে পারি। হ্যাঁ, এখন মনে হচ্ছে, আপনাকে আমি এর আগে দেখেছি। বসুন। রাণু চলে গেলেন ভেতরে। স্টেশনমাস্টার বারান্দাতেই বসার ব্যবস্থা করলেন।
অনীক খুব ফাঁপরে পড়েছিল। ভদ্রমহিলাকে সে কিছুতেই মনে করতে পারছেনা। মানুষের শরীর সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে বদলায়। কিন্তু কতটা পরিবর্তন হলে এত অচেনা মনে হবে?
বেশ চকমকে জ্যোৎস্না, কি বলেন? কাঁধের ঝোলা নামিয়ে রাখল অনীক।
আমি জানি। ভদ্রলোক নিচুগলায় বললেন।
জানেন?
বুঝতেই পারছেন, কথাবার্তায় একটু আসলে নির্জনে একা থাকতে-থাকতে–।
স্টেশনমাস্টার কোনও কথাই পুরোটা বলেন না।
আপনি কী অ্যাবনর্মালিটির কথা বলছেন?
ঠিক তা নয়, আবার অনেকটাই।
তাহলে তো ডাক্তার দেখানো উচিত।
কোথায় যাব? ছুটি চাইলে পাওয়া যায় না যে, শহরে গিয়ে দেখাব। আবার দিনেরবেলায় ও খুব নৰ্মাল। কথাবার্তা কম বলে কিন্তু কোনও ক্রটি পাবেন না।
বিয়ের পর থেকেই এইরকম?
এইরকম মানে এমন সব প্রশ্ন করে যা সাধারণ মানুষ করে না। এই তো, গতকাল আমাকে বলল ওর সঙ্গে যেন রাত্রে কথা না বলি কারণ গাছেরা ওর সঙ্গে আলাপ করবে সারারাত ধরে, আর। আমাকে নাকি ঠাকুরদা বলে মনে হচ্ছে ওর। বলেই সামান্য হাসলেন ভদ্রলোক, বয়সের ব্যবধান তো আছেই। লেট ম্যারেজ। গরিবঘরের মেয়ে বলে ওকে স্ত্রী হিসেবে পেয়েছি। নইলে কত ভালো বিয়ে হত ওর।
বিয়ে কতদিন হয়েছে?
বছর সাতেক। একেবারেই বালিকা ছিল। মামারা রাজি হয়ে গেল। বাপ-মা নেই।
সন্তান?
নো। আর এখন তো নো চান্স! অদ্ভুত উদাস গলায় বললেন স্টেশনমাস্টার।
নিন। খেয়ে দেখুন। একেবারে গ্রাম্য চা। এক কাপ চা হাতে রাণু ফিরে এলেন। কাপটা এগিয়ে ধরলেন অনীকের সামনে।
এর দরকার ছিল না।
সেটা আমি বুঝব। নেবেন না ফেলে দেব?
অগত্যা নিতে হল অনীককে। স্টেশনমাস্টারের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি?
স্টেশনমাস্টার হাতজোড় করলেন, না-না। আমি চা পান করি না।
অনীক তাকাল। পৃথিবীতে এখনও কিছু মানুষ আছেন যাঁরা চা, কফি, পান, ধূমপান, অথবা মদ্যপান করেন না। ডাল-ভাত-তরকারি খেয়ে বেশ বেঁচে যান যে কদিন পারেন। কোনওকিছু হারাচ্ছেন বলে তাঁদের ধারণাও নেই। স্টেশনমাস্টারের মুখে তেমন সারল্য আছে।
চা শেষ করতে হল তাড়াতাড়ি। ওঁরা চুপচাপ দেখছিলেন যেন পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে। কাপ ফিরিয়ে দিয়ে অনীক বলল, অনেক ধন্যবাদ। এবার আমি চলি।
শব্দ করে হেসে উঠলেন রাণু, কোথায়?
একটু ঘুরে বেড়াই।
দাঁড়ান, আমরাও যাব। আপনি তো এখানকার কিছুই চেনেন না। নতুন জায়গায় কেউ চিনিয়ে না দিলে অনেক কিছু অজানা থেকে যায়। এক মিনিট। কাপ হাতে রাণু দ্রুত ভেতরে চলে গেলেন।
স্টেশনমাস্টার বললেন, হয়ে গেল।
তার মানে?
দূর! রাত-বিরেতে জঙ্গলে-মাঠে ঘুরতে আমার একদম ভালো লাগে না।
বেশ তো, আপনারা থাকুন, আমি চলি।
আপনি আচ্ছা লোক। আমার ঘরে আগুন লাগিয়ে আপনি বাইরে ঘুরে বেড়াবেন। এখন যদি বলি যাব না তাহলে সাতদিন অশান্তি চলবে। বিয়ে করেছেন?
না।
তাহলে ব্যাপারটা বুঝবেন না।
স্টেশনমাস্টারের কথা শেষ হওয়ামাত্র রাণু বেরিয়ে এলেন। স্টেশনমাস্টারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, যাবে তো?
চলো।
অনীক দেখল এরা দরজা খোলা রেখেই বেরিয়ে পড়ল। অর্থাৎ এটা এমন জায়গা যে চুরি করতেও কেউ আসবে না। সে দেখল যে রাস্তাটা মাঠঘাট পেরিয়ে স্টেশনের গায়ে পৌঁছেছে সেটা ধরে সরু পায়ে-চলা পথ বেছে নিলেন রাণু। তিনিই আগে হাঁটছেন। চাঁদ এখন বেশ ওপরে উঠে এসেছে। অল্প-স্বল্প বাতাস বইছে। ছোটবড় গাছগুলোর ফাঁক গলে জ্যোৎস্না ছড়িয়ে রয়েছে। ঘাসে। এইরকম সময়ে সঙ্গে দুজন মানুষ মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু কীভাবে এদের সঙ্গ এড়ানো যায়? এই সময় স্টেশনমাস্টার জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা কতদূরে যাব?
রাণু বললেন, আমরা তো যাচ্ছি না। আমরা ঘুরছি।
অনীক মুখ খুলল, আমার জন্যে আপনারা মিছিমিছি পরিশ্রম করছেন।
রাণু বললেন, দূর! আপনার জন্যে কেন, আমি শুক্লপক্ষের রাত্রে ঘুমাই না। সারারাত জ্যোৎস্না দেখি, ভোরবেলায় খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিনভোর ঘুমাই।
অনীক অবাক হয়ে তাকাল। আজ পর্যন্ত কোনও নারী এমন কথা বলেছে বলে সে শোনেনি। স্টেশনমাস্টার বললেন, একটু বসলে হয় না। ওখানে সুন্দর একটা কালভার্ট আছে।
তোমরা বসতে পারো। আপনি বসবেন?
অনীক মাথা নেড়ে না বলতেই রাণু খুশি গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ভালো। এতদিনে একজন ভালো সঙ্গী পাওয়া গেল। চলুন।
অনীক দেখল স্টেশনমাস্টার সোৎসাহে তাঁর কালভার্টের দিকে এগোলেন। এমন নির্জন রাত্রে কোনও পুরুষ নিজের স্ত্রী-কে একদম অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে ছেড়ে দিতে পারে? কেউ শুনলে বিশ্বাস করবে? সিনেমায় হয়।
আপনি হিজল গাছ দেখেছেন?
দেখেছি। পাশাপাশি হাঁটতে-হাঁটতে অনীক বলল, জলের ধারে হয়।
তাই বলুন। এখানে কোথাও জলাভূমি নেই, এমনকী পুকুরও। অথচ আমার হিজল দেখতে খুব ইচ্ছা করে। আচ্ছা, আপনার এখন কি ইচ্ছে করছে?
অনীক তাকাল। জ্যোৎস্নায় উচ্ছ্বসিত শরীর নিয়ে রাণু হেঁটে যাচ্ছেন। সে বলল, যতটা পারি এমন একটা রাতকে বুকে ভরে নিতে।
আপনি ভেবেছিলেন যে এই নির্জন জ্যোৎস্নায় আমার মতো একজনকে একা পাবেন?
না, ভাবিনি।
পেয়ে কেমন লাগছে।
আর-এক ধরনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
কীরকম?
এক উপভোগ করার আনন্দ। হঠাৎ খেয়াল হল অনীকের ঝোলাটার কথা। চেয়ারে ফেলে এসেছে।
আপনি দেখছি স্বার্থপর। রাণু মাথা নাড়লেন, আমার ইচ্ছে, কবি লিখেছেন, শীতল চাঁদের মতো শিশিরের ভেজা পথ ধরে আমরা চলিতে চাই–।
হাত তুলে থামিয়ে দিল অনীক, এখানেই থামুন। ভাবতে ভালো লাগবে। তার পরের লাইনটা আমার মোটেই পছন্দ নয়। মরবার কোনও বাসনা আমার নেই।
বাঃ। আপনি দেখছি বেশ শিক্ষিত।
কবিতা পড়া শিক্ষিতের লক্ষণ কিনা জানি না।
কিন্তু ওটা কোন মরণের কথাকবি লিখেছেন? তারপরে যেতে চাই মরে। মরতে চাই না, যেতে চাই মরে। বুঝলেন মশাই! আপনি মরণ বুঝবেন না। কখনও-কখনও প্রবলভাবে জীবন পাওয়ার উপলব্ধিতে মরণ বলতে সুখ হয়।
বিস্ময় বাড়ছিল অনীকের। অভাবগ্রস্ত এক পরিবারের বাপ-মা-হারা কোনও অনাথ কিশোরীকে
আত্মীয়স্বজন যখন বয়স্ক কোনও পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয় তখন ধরেই নেওয়া যায় একমাত্র শরীর ছাড়া তার বিকাশ অন্যত্র হয় না। অথচ রাণু যে কথা বলছেন তা অশিক্ষিতের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রথম আলাপে যে বিভ্রম জাগছিল এখন তা মোটেই নেই।
আপনি এখানে কবিতার বই পান?
মানে?
আপনার কথার সূত্রে জিজ্ঞাসা করছি।
আমি খুব অশিক্ষিত। ছেলেবেলায় পড়ার বইতে যেসব কবিতা থাকে তার বাইরে কিছু পড়িনি। অনেকদিন আগে, তখন আমরা অন্য স্টেশনে থাকতাম, এক ভদ্রলোক ওয়েটিং রুমে একটা বই এর প্যাকেট ফেলে গিয়েছিলেন। উনি সেই প্যাকেট আমাকে এনে দেন। তাতে জীবনানন্দ। দাশের তিনটে কবিতার বই ছিল। এত বছর ধরে ওগুলোই পড়ি।
পড়ে বুঝেছিলেন?
ঠিক বুঝিনি। একটু-একটু ভালো লাগছিল। বারংবার পড়তে-পড়তে অন্যরকম মানে মনে এল। তারপর এখানে আসার পর মনে হল ও-সবই আমার কথা। পৃথিবীতে আরও অনেক কবি অনেক লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ তো বিশ্বকবি। কিন্তু আমার কাছে ওই তিনটে বই এত বড় যে বোধহয় এক জীবনে বুঝে উঠতে পারব না। চাঁদটাকে দেখুন।
অনীক তাকাল। একচিলতে কালচে মেঘ গোল চাঁদের মাথায় জড়িয়ে আছে। মানুষ যতই চাঁদে হেঁটে বেড়াক, পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়িয়ে চাঁদকে দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। রাণু হাসলেন, কলঙ্ক আপনার কেমন লাগে?
একটু-আধটু থাকলে মন্দ হয় না। কিন্তু সত্যি করে বলুন তো, জীবনানন্দের তিনটি বই ছাড়া আপনি এখন পর্যন্ত আর কারও কোনও লেখা পড়েননি? অনীকের বিস্ময় যাচ্ছিল না।
না। পড়ার সুযোগ তো কখনও হয়নি। তা ছাড়া এই তিনটে শেষ না করে অন্যের বই পড়ি কি করে? রাণু চাঁদের দিকে মুখ তুললেন।
আপনার এখনও শেষ হয়নি?
না। আসলে আমি তো একটা গর্দভ, আজ যে মানে ঠিক করি কাল সেটা বদলে যায়। যেমন ধরুন একটা লাইনের কথা, হেমন্ত বিয়ায়ে গেছে শেষ ঝরা মেয়ে তার সাদা মরা শেফালির বিছানার পর। প্রথম পড়ার সময় মনে হয়েছিল শেফালিকে হেমন্তের মেয়ে হিসেবে কবি ভেবেছেন। গাছেরতলায় শেফালি ঝরে পড়ে আছে, হেমন্ত বিদায় নিচ্ছে। স্টেশনের কাছে কিছু শেফালির গাছ আছে। পুজোর পর এক ভোরে সেখানে গিয়ে বর্ণনা মিলিয়ে নিতে চমকে উঠলাম। কবি লিখেছেন সাদা মরা শেফালির বিছানার ওপরে হেমন্তের শেষ সন্তান রয়ে গেছে। অথচ শেফালির গালচের ওপর আমি কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না। পরের দিন গিয়ে চেয়ে থাকতে ফুলগুলো যেন চোখের আড়ালে চলে গেল। আমি যেন স্পষ্ট ফুলের বিছানার ওপর। হিমশীতকে শুয়ে থাকতে দেখলাম। বাড়িতে এসে ওঁকে বললাম। উনি ভাবলেন আমার মাথা আরও খারাপ হয়েছে। আসলে এসব কাউকে বোঝানো যায় না। কথা বলতে-বলতে রাণু হঠাৎই উদাস হয়ে গেলেন। আর এই সময় ওঁকে খুব একলা বলে মনে হচ্ছিল অনীকের। সে মুখ। ফিরিয়ে সামনে তাকাতেই একটা অদ্ভুত গাছ দেখতে পেল। গাছটার শরীর বিশাল কিন্তু কোনও পাতা নেই, ফুল-ফল তো দূরের কথা। যেন আকাশটাকে জালের মতো শুকনো ডাল দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে।
রাণু বললেন, কী মনে হচ্ছে, মরা গাছ? মোটেই না। আমি এখানে আসার পর থেকেই গাছটাকে ওই অবস্থায় দেখছি। কোনও পাতা দেখিনি কখনও অথচ ডাল মরেনি।
জ্যোৎস্না ওর সর্বাঙ্গে কিন্তু তবু গাছটাকে অসুন্দর দেখাচ্ছে। রাণু বললেন, দেখেছেন?
অনীক দেখেছিল। একেবারে উঁচু ডালে একটা পাখি বসে আছে। তার গায়ের রং বেশ ধূসর। গোল মুখ ঘুরিয়ে তাকানোর ভঙ্গিতে পরিচয় বোঝা গেল। এত কাছ থেকে গাছে প্যাঁচা বসে থাকতে অনীক কোনওদিন দেখেনি। আরও একটু হাঁটতে কিছু লম্বা ঘাসের জঙ্গল দেখা গেল। কোমর পর্যন্ত বড়জোর। রাণু বললেন, ওখানে কয়েকটা খরগোশ আছে। দেখবেন?
কীভাবে দেখা যায়?
বসে থাকতে হবে চুপচাপ। রাত ফুরিয়ে যাওয়ার আগে দেখা পেলেও পাবেন।
আপনি বসে থাকেন নাকি?
মাঝে-মাঝে। গত সপ্তাহে দেখে গেছি একটা খরগোশের বাচ্চা হবে।
অনীক রাণুর দিকে তাকাল।
বেশ কিছুটা হাঁটার পর, জ্যোৎস্নায় চুপচাপ মাখামাখি হওয়ার পর রাণু বললেন, দাঁড়ান।
অনীক দেখল গাছটা অতি সাধারণ। কিন্তু তার তলায় একটা পাখির বাসা ভেঙে পড়ে আছে, রাণু উবু হয়ে দেখলেন। বাসায় ডিম ছিল, ভেঙে গেছে। রাণু উঠে দাঁড়িয়ে হাসলেন, আমাদের আগে জীবনানন্দ এসব দেখে গেছেন, চডুয়ের ভাঙা বাসা শিশিরে গিয়েছে ভিজে, পথের উপর পাখির ডিমের খোলা, ঠান্ডা কড়কড়। উঃ, এই কড়কড় শব্দটা যে কি মারাত্মক শূন্যতা তৈরি করে। হাত দিয়ে দেখুন ডিমে, টের পাবেন।
হাত না দিয়েই টের পাচ্ছি।
তাই? আপনারা পণ্ডিত লোক তোসব অনুভবে বুঝতে পারেন। আমি এত কম বুঝি যে মিলিয়ে নিয়ে দেখতে হয়। রাণু হাঁটতে শুরু করলেন আকাশের দিকে মুখ তুলে।
তারপর হঠাৎ আঙুল তুলে বালিকার মতো চিৎকার করে উঠলেন, দেখুন, দেখুন।
অনীক দেখল অনেকদূরে প্রায় অস্পষ্ট একটা কিছু উড়ে যাচ্ছে।
কি দেখলেন?
পাখিটা।
উঃ, আজ আকাশে একতিল ফাঁকাও নেই নক্ষত্রদের জন্যে আর আপনার পাখিটার দিকে নজর গেল? আজ নিশ্চয়ই সব মৃত, নক্ষত্র জেগে উঠেছে। আচ্ছা, প্রেমিক চিল-পুরুষ দেখেছেন আপনি? গলায় অদ্ভুত আবেগ এল রাণুর।
না। চিলদের কে নারী কে পুরুষ আমি আলাদা করতে পারি না।
জীবনানন্দ করেছিলেন। প্রেমিক চিল-পুরুষের চোখ শিশিরভেজা হয়। শিশির-ভেজা কিন্তু ঝলমলে। ওই সমস্ত নক্ষত্রের মতো। একটু চুপ করে রাণু জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, আপনি কখনও প্রেম করেছেন?
প্রেম?
না, না। এই গাছপালা বা পাখির সঙ্গে নয়, মানুষের সঙ্গে?
হেসে ফেলল অনীক, না!
আপনি বিয়ে করেননি?
এখনও সুযোগ হয়নি।
ও। ধরুন, যদি আপনি কখনও প্রেম করেন তাহলে কেন তা করবেন?
প্রেম কেউ কী করে? শুনেছি ওটা আপনা-আপনি এসে যায়।
আশ্চর্য! একটা মানুষকে দেখে আপনার মনে আপনা-আপনি প্রেম এল আর হাজার মানুষকে দেখে তা এল না, তাই তো?তাহলে ওই একজনের কী বিশেষত্ব?
বলতে পারব না।
আমিও বুঝতে পারি। এই যে প্রতিদিন যে ট্রেনগুলো স্টেশনে এসে দু-মিনিটের জন্য দাঁড়ায়, তার জানালায় কত মানুষের মুখ। আমি রোজ তাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখি কিন্তু একবারও কাউকে দেখে মনে প্রেম আসেনি।
আপনি তো বিবাহিতা?
তাতে কী হল?
আপনার স্বামীর জন্যে নিশ্চয়ই–
একটুও না। ওকে বিয়ের সময় যখন দেখি তখন আমি কিছুই ভাবিনি। পরে একসঙ্গে থাকতে থাকতেও মনে প্রেম এল না। আমার কাছে ও কখনও বাবা, কখনও ভাই, কখনও বন্ধু। ওর জন্যে আমার মনে প্রেম নেই এটা ও জানে কিন্তু তার জন্যে একটুও দুঃখ পায় না। কারণ, আমি যে ওর স্ত্রী এটাই শেষ কথা বলে ভাবে।
আপনাকে কেউ প্রেম নিবেদন করেনি?
হুঁ, করেছে। আমি বাবা মিথ্যে বলতে পারি না। বিয়ের আগে করেছে, বিয়ের পর দুজন। আর তার জন্যে আমার সব কেমন গুলিয়ে গেছে।
কীরকম?
বিয়ের আগে আমাকে যারা প্রেম-নিবেদন করেছে, তাদের বয়েস কারও চল্লিশ কারও পনেরো। একটু একা পেলেই মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলত ওরা। সেটা যে প্রেম-নিবেদন করা তা তখন না বুঝলেও ওরা যে কথাগুলো বলে অন্যকিছু চাইছে, তা টের পেতাম। রাণু হেসে ফেললেন, মেয়েরা অবশ্য অনেক কিছু আগাম টের পায় বলে গর্ব করে কিন্তু এ ব্যাপারটায় আমার ভুল হয়নি। বাপ-মা ছিল না, গরিব মামার কাছে মানুষ, তাই একটু ভয়ে-ভয়ে থাকতে হত।
ওরা নিশ্চয়ই কবিতার লাইন বলত না!
মাথা খারাপ। একজন ছিল মুদিওয়ালা। আমরা কাকা বলতাম। সে বলত, এই তোর আঙুল কী সুন্দর, চাঁপার মতো। কেউ আমার হাতের প্রশংসা করত, কেউ বলত আমার নাকি হাঁসের মতো গলা। আমার বন্ধুর দাদা বলেছিল, তোর পা-দুখানার যা শেপ, খুব প্রভোকেটিভ। মানে বুঝিনি কিন্তু শব্দটা মনে আছে। আর একজন বলেছিল, তোমার কোমরটা এত সরু যে মুঠোয় ধরা যায়। এরা সবাই আমার চেয়ে বড় কিন্তু কেউ আমার মুখের প্রশংসা করেনি। তাই ওসব শুনলেই বাড়ি ফিরে এসে এক ফাঁকে আয়নায় নিজের মুখ দেখতাম। মনে হত নিশ্চয়ই আমার মুখ দেখতে। খারাপ, না হলে লোকে তো প্রথমে মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু সেই প্রশংসাও জুটল। পাশের। বাড়িতে আমার সমবয়সি কলকাতার একটি ছেলে এসেছিল। সে আড়ালে পেয়ে বলল, তোমার চোখদুটো কী গভীর, দীঘির মতো। আমার খুব ভালো লেগেছিল। কিন্তু আমি সমস্যায় পড়লাম। এতগুলো মানুষ আলাদা-আলাদা করে হয় আমার আঙুল, নয় হাত-পা, নয় গলা অথবা চোখকে সুন্দর বলছে। এই পুরো আমাকে কেউ সুন্দর বলছে না। একদিন আমার চেয়ে একটু ছোট একজন নিরালায় পেয়ে ফস করে বলল, এই তোর বুকে হাত দিতে দিবি?কী সুন্দর বুক তোর! আমার রাগ হয়ে গেল। ছেলেটা বুকের কথা বলেছে বলে যতটা নয় তার চেয়ে ঢের বেশি ও মিথ্যে বলছে। খেপে গিয়ে জিগ্যেস করলাম, তুই বুঝলি কী করে আমার গায়ে জামা নেই? ছেলেটা এমন ঘাবড়ে গেল আর কোনওদিন বিরক্ত করেনি। ক্রমশ আমি বুঝতে পারলাম, আমার চেয়ে যারা বয়স্ক তারা শরীরের সেইসব অঙ্গের প্রশংসা করে, যা দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু যে আঙুলের প্রশংসা করছে, তাকে আঙুল ধরতে দিলে তাই নিয়ে সারাজীবন বসে থাকবে না। সে সুযোগ পেলেই ঢাকা-শরীরের দিকে এগোবে। এটা বোঝবার পর মনে হল সবাই আমার সঙ্গে ভান করছে। আর তাই কাউকেই আমার ভালো লাগল না।
চুপচাপ কথাগুলো শুনতে-শুনতে হাঁটছিল অনীক। এত স্পষ্ট গলায় কোনও মেয়ে যে তার উপলব্ধির কথা বলতে পারে তা ধারণা করতে পারেনি। এখন চাঁদ মাথার ওপর চলে এসেছে। চমৎকার সাদা এক নাম-না-জানা পাখি উড়ে গেল জ্যোৎস্না মেখে। অনীক গল্পের রেশ ধরে রাখতে চাইল, বিয়ের পরে?
আপনার এসব শুনে কী লাভ? আচমকা প্রশ্ন করলেন রাণু।
আপনাকে জানতে ইচ্ছে করছে, তাই।
কখন থেকে?
মানে?
এই জানার ইচ্ছেটা কখন থেকে হয়েছে? আপনি তো আমাদের কোয়ার্টার্সে বসতেই চাইছিলেন
না। ঠিক কি না?
হ্যাঁ ঠিক। কিন্তু আপনার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর। ঠিক আছে।
না, ঠিক নেই। বিয়ের পর যারা প্রেম-নিবেদন করেছে তাদের বক্তব্য একইরকম। আমার সঙ্গে আমার স্বামীকে মানায় না, আমাকে অনেক-অনেক সুখী করতে পারে তারা যদি স্বামীকে ছেড়ে চলে যাই তাদের সঙ্গে। অথবা স্বামীর কাছেই থাকি আর তারা লুকিয়ে-চুরিয়ে আমাকে সঙ্গ দেবে। হাসলেন রাণু। আসলে আমরা খুব বোকা। আমরা কেউ বুঝি না সময়ের কাছে এসে। সাক্ষ্য দিয়ে চলে যেতে হয় কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি। আমরা কেউ ভাবতে চাই না আমার বুকে প্রেম এল যার জন্যে, তার অনুভূতি কীরকম? সে কি আমাকে চাইছে? শুধু মানুষের বেলায় নয়, এই যাকে আমরা প্রকৃতি বলি, এই জ্যোৎস্না, গাছপালা, ফুল অথবা আকাশ–এরাও কি আমাকে চায়? আমি চাইলেই কী ওদের সঙ্গে প্রেম হয়ে গেল? ওদেরও তো চাওয়া দরকার। আমার স্বামী বলেন, ওদের প্রাণ নেই, থাকলেও বোঝার এবং বোঝনোর ক্ষমতা নেই। কি বোকা-বোকা কথা বলুন তো! আপনি একটা গাছের কাছে রোজ আসুন, তাকে ভালোবাসুন, তার শরীর থেকে আবর্জনা পরিষ্কার করে দিন, দেখবেন যেই তার আপনাকে ভালো লাগবে, অমনি সে কেমন চনমনিয়ে উঠবে, যা অন্য কেউ এলে হবে না।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন রানু। তাঁর চোখ সামনের দিকে। অনীক দেখল মাঠের গায়ে গাছপালার মধ্যে মন্দিরের আদল দেখা যাচ্ছে।
রাণু বললেন, ওপাশে যাব না।
কেন?
ওখানে একজন মহিলা থাকেন। লোকে বলে ভৈরবী।
ও, ওঁর কথাই তখন বলছিলেন?
ভদ্রমহিলা দিনেরবেলায় বের হন না। জ্যোৎস্নারাত্রেও নয়। কৃষ্ণপক্ষের রাতে ঘুরে বেড়ান মাঠে মাঠে। শুনেছি রাত্রে দেখতে পান।
অদ্ভুত!
আপনার কাছে অদ্ভুত লাগতে পারে কিন্তু আমি সহ্য করতে পারি না। উনি সেই থুরথুরে অন্ধপেঁচার মতো যে সোনালি ফুলের স্নিগ্ধঝাঁকে জোনাকির মাখামাখি কোনওদিন দেখতে পাবে না, উলটে বলবে, বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে। চমত্তার! ধরা যাক দু-একটা দুরএবার।
অনীক হেসে ফেলল শব্দ করে। রাণু মুখ ফেরালেন, হাসলেন কেন?
আমি লাইনটার অন্য অর্থ জানি।
যেমন?
পরের লাইনে তিনটে শব্দ আছে, তুমুল গাঢ় সমাচার। একটা অন্ধ জরাগ্রস্ত পেঁচার কাছে দু একটা ইঁদুর ধরতে পারা মানে বেঁচে থাকা। বাঁচার জন্যে সংগ্রাম করা। পৃথিবীর সমস্ত অশক্ত মানুষ যে সংগ্রাম করছে, এ তারই প্রতিচ্ছবি। জীবনের এই স্বাদ আপনার অসহ্য বোধ হল?
এ আপনার ব্যাখ্যা। আপনাদের। আমি এ মানি না।
কিন্তু কবিতা শুধু ব্যবহারে নয়, শব্দ থেকে উঠে আসা দ্বিতীয়, কখনও তৃতীয় মানেতে তার বিচরণ।
হয়তো। কিন্তু যে পেঁচা সারারাত জ্যোৎস্নার ফিনিক দেখে মুখ গুঁজে রইল সে চাঁদ ডুবে গেলে ছটফটিয়ে ইঁদুর ধরতে বেরিয়ে আসবে কীসের ইশারায়? তা ছাড়া, মশাই, মনে রাখবেন, ওই পেঁচাটি অন্ধ ছিল। অন্ধের কিবা দিন কিবা রাত। সে কি করে বুঝবে কখন আলো জ্বলছে অথবা নিবে গেছে?
অনীক হোঁচট খেল। সত্যি তো। অন্ধ শব্দটি নিয়ে সে কখনও ভাবেনি।
রাণু হাসলেন, অন্ধত্ব তাহলে অভ্যেসের কাছে হার মানে, তাই না?
অনীক আপত্তি জানাল, সব পেঁচাই অন্ধ হয়ে যায় আলো জ্বললে। জ্যোৎস্নাও তো আলো, এই যেমন চারপাশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু পেঁচার কথা থাক, ওই ভৈরবী নিশ্চয়ই অন্ধ এবং থুরথুরে নন?
চেহারায় নয়, মনে। নইলে দিনেরবেলায় দেখা যায় না কেন? কোনও জ্যোৎস্নারাত্রে ওকে দেখতে পাই না কেন?
হয়তো নিজেকে আড়ালে রাখতে চান।
আপনি ওর কাছে যেতে চান?
আগ্রহ যে হচ্ছেনা তাই বাবলি কী করে?
তাহলে এখন ফিরে যান স্টেশনে। অমাবস্যায় আসুন। যখন এইসব চরাচর অন্ধকারে ডুবে যাবে, ডুবে গিয়ে চরিত্র হারাবে, তখন নিজেকে হারান।
আপনি অন্ধকারকে খুব ভয় পান, না?
আপনি পান না?
হ্যাঁ, পাই।
দু-চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ তুললেন রাণু, আচ্ছা, আপনি কীরকম লোক? আমার কি কিছুই আপনার ভালো লাগছে না?
নিশ্চয়ই লাগছে।
সেটা আমার আঙুল, হাত-পা, গলা, মুখ অথবা বুক নয়, তাই তো?
হ্যাঁ।
সব মিলিয়ে এই আমি, আমাকেই, কিনা? আমাকে নিয়ে কোথাও হারিয়ে যেতে, অথবা আমার সঙ্গে গোপনে আনন্দ করতে নিশ্চয়ই আপনার ইচ্ছে করছে না? রাণু চোখ খুলছিলেন না।
অনীক একটু ভাবল, তারপর মাথা নাড়ল, না।
তাহলে?
তোমাকে দেখার ম তো চোখ নেই–তবু গভীর বিস্ময়ে আমি টের পাই–তুমি আজও এই পৃথিবীতে রয়ে গেছ। মন্ত্রমুগ্ধের মতো লাইনগুলো আবৃত্তি করল অনীক। এ যেন তার কথা, তারই কথা।
চোখ খুললেন রাণু। যেন নক্ষত্রের উজ্জ্বল জলে তার চোখ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার। খানিক আগে যে ধবল পাখি জ্যোৎস্নায় মিশে গিয়েছিল সে যেন কোনও নাম-না-জানা ফুলের ফুটে ওঠার খবর নিয়ে এল। এই তিরতিরে রাত্তিরে, নির্জনতা যখন বড় ভয়াবহ, হাওয়ায় এক অতীন্দ্রিয় কাঁপন টের পেয়ে গাছেরা পুলকিত, এই তারা-জ্বলা-রাতে রাণু এগিয়ে এলেন অনীকের সামনে। বললেন, আমি এক সামান্য নারী, তুমি আমাকে অসামান্যা করো।
মুগ্ধ তো ছিলই, লুব্ধ হল অনীক। রক্তে সর্বনাশের ঝড় উঠল, বুকে গোখরোর ফণা। এখনও সে সেই পুরুষ যার কোনও যোনিচক্র স্মৃতি নেই। প্রতিটি রোমকূপে এখন দাউদাউ চিতা। তবু সে কথা বলল, রাত ফুরুলে কী হবে?
আপনি চলে যাবেন।
আর তুমি?
হেসে উঠলেন রাণু, আমি এইসব গাছপালা, জ্যোৎস্না আর আকাশের সঙ্গে আপনাকে নিয়ে দারুণভাবে বেঁচে থাকব।
আমি যদি না যাই।
আপনি রসিকতা করছেন।
রসিকতা?
একতিল বেশি রাত্রির মতো আপনার জীবন। সেই একতিল কম আর্ত রাত্রি আমি। অতএব আপনার জীবনের কাছে আমি মূল্যহীনা।
আমি মানি না। যখনই জ্যোৎস্না ফুটবে, চরাচর এমন স্বপ্নিল হয়ে উঠবে তখনই আমি দু-হাত বাড়িয়ে তোমাকে চাইব।
কিন্তু যেই চাঁদ ডুবে যাবে, যখনই অন্ধকার নামবে অথবা ভোরের শিশির শুকিয়ে সূর্য উঠবে। তখন আমি ছায়ার মতনও থাকব না আপনার মনে। আর তার জন্যে আমার কোনও আক্ষেপ নেই। এই এক রাত্রি যত দিতে পারে তাই জীবনভরে নিতে চাই। স্পষ্ট আহ্বান খোদিত হল রাণুর চোখে-মুখে-শরীরে।
কালো মেঘ যা এতক্ষণ ইতিউতি ছড়িয়ে ছিল, যেন এই কথা শুনে গড়িয়ে এল চাঁদের বুকে, চটজলদি জ্যোৎস্না উধাও। স্লেট রঙের আলো ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীতে। চক্ষুষ্মান হয়ে পেঁচা খুঁজে ফিরতে শুরু করল তার রাতের আহার। রাণুর আক্ষেপ শোনা গেল, আহ, এ কেন হল?
আর তখনই অনীক দেখল। দেখল না বলে দর্শন করল বলা ঢের ভালো। জঙ্গল-ঘেরা মন্দির থেকে একটি মূর্তি চকিতে বেরিয়ে এল মাঠের মধ্যে। দু-হাত আকাশে তুলে যেন সে। মেঘগুলোকে ঠেলে দিচ্ছে চাঁদের বুকে অথবা তাদের আটকে রাখতে চাইল যেমন করে বেয়াড়া সূর্যকে বগলে দাবিয়ে রেখেছিল পবনপুত্র।
অথবা এসবই অনীকের মনে হওয়া। মহিলা মাথার ওপর হাত তুলে আরাম করলেন। তারপর দ্রুত মিলিয়ে গেলেন ঝোঁপের আড়ালে। মিলিয়ে যাওয়ার আগে মনে হল তিনি বসে পড়লেন। ওই কালচে আলোয় চারপাশ বেশ অস্পষ্ট। অনীক রাণুর দিকে তাকাল। মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ভৈরবীর উপস্থিতি তিনি জানেন বুঝতে অসুবিধে হল না। সেই মুহূর্তেই দুরের। ঝোঁপের আড়ালে মূর্তিটিকে উঠে দাঁড়াতে দেখা গেল। মাথা এবং কাঁধ প্রথমে দৃশ্যমান হওয়ার পর শরীরটা বেরিয়ে এল। অনীকের মনে হল ভৈরবীর কোনও রহস্য নেই। প্রাকৃতিক প্রয়োজনে তাকেও ঝোঁপের আড়ালে আসতে হয়। হয়তো মন্দিরে কোনও টয়লেট নেই। এসব অঞ্চলে। সেটা স্বাভাবিক।
চলুন, মহিলার সঙ্গে আলাপ করি।
না।
কেন?
ও আপনাকে একটা ছাগল কিংবা ভেড়া করে দেবে।
দূর! এসব কখনও হয় নাকি?
আপনি বুঝতে পারবেন না। ছাগল ভেড়ারা বুঝতে পারে না তারা কি।
অনীক হাসল, হ্যাঁ। মানুষের মধ্যেও অনেক ছাগল ভেড়া আছে, অন্তত বিশেষ-বিশেষ মহিলাদের সঙ্গে তাঁরা সেইরকম আচরণ করে।
তবে?
আমার তো সেই ভয় নেই। রক্ষাকবচ আছে, আপনি।
রাণু কেঁপে উঠলেন, সত্যি বলছেন?
সত্যি।
ওরা এবার এগোল। রাণুর পায়ে এখনও জড়তা। মাঠের মাঝখানে সেই নারী যাকে ভৈরবী বলা হয়, একা। দুটি মানুষের পায়ের চাপে ঘাসেরাও শব্দহীন। অনীক দেখল একেবারে কাছাকাছি। পৌঁছেও মহিলা তাদের যেন ঠিকঠাক লক্ষ করছেন না। গেরুয়া শাড়ি-জড়ানো শীর্ণ শরীরটি কি কখনও সুন্দরী ছিল?
ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল। চোখ এবং মুখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে অসুবিধে হল না এই রমণী প্রায় অন্ধ। আপ্রাণ চেষ্টায় জিজ্ঞাসা করলেন, কে? কেউ কি ওখানে?
অনীক কথা বলল, হ্যাঁ। আমরা।
এত রাত্রে এখানে কেন?
এমনি। চাঁদের আলোয় পৃথিবী দেখতে বেরিয়েছিলাম।
বাঃ। দেখা হল?
না, মানে এখনও মন ভরেনি।
ওইটাই মুশকিল। কোনওদিন মন ভরে না। তোমাদের সন্তান নেই?
হকচকিয়ে গেল অনীক। রাণু ঠোঁট কামড়ালেন।
ও, হয়নি বুঝি? মাকে ডাকো, হবে। সন্তানই তো সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখে। আচমকা পায়ে মেপে মেপে রাস্তা করে ভৈরবী চলে গেলেন মন্দিরের দিকে। একটা পোড়ো ছোট মন্দির যার চারপাশে জঙ্গল। সাধারণত গ্রামের মানুষেরা নিজেদের প্রয়োজনে এইসব মন্দিরে আসে আর তাই বেঁচে আছেন ভৈরবী।
এখন এই মাঠে ওরা দুজন। অনীক হাসল, দেখলেন তো, আপনার কল্পনার সঙ্গে ওর কোনও মিল নেই। একজন স্বাভাবিক বয়স্কা মানুষ, চোখে হয়তো ছানি পড়েছে। কোনওকিছু বানাতে উনি পারেন না।
কে বলল?
মানে?
ওই যে কথাটা বলে গেল, সন্তান, সন্তান হয়নি তাহলে আমার সঙ্গে কারও তো সম্পর্ক হবে না। আমি যাকে ভালোবাসব, সে আমাকে ভালোবাসবে, আমাদের কোনও সম্পর্ক তৈরি হবে না। যতদিন না সন্তান আসবে। মনের মধ্যে এই যন্ত্রণা ঢুকিয়ে দিয়ে গেল ও, এও তো বশীকরণ। গোঙানি ফুটল রাণুর গলায়।
এ বশীকরণ নয়, এ আনন্দের উৎসাহ। আপনি উৎসাহিত হচ্ছেন না কেন?
কি করে হব? আমি যাদের ভালোবাসি, এই মাটি, গাছ, চাঁদ, আকাশ–এরা আমার বৃদ্ধ, স্থবির প্রেমিক। আমি যাকে ভালোবাসি না, যিনি আমার স্বামী, তিনি অক্ষম। আমার সন্তানের জন্য আঁতুড়ঘর, আর শ্মশানের চিতা একাকার। রাণুর আক্ষেপ শেষ হওয়ামাত্র মেঘ সরে গেল চাঁদের মুখ থেকে। চাঁদ হেলে গেছে অনেকটা। দু-হাত বাড়িয়ে রাণু বললেন, আপনি কীরকম পুরুষ?
এখন চারপাশ দিনের আলোর মতো আলোকিত। অনীক বলল, আপনাকে জননীর সম্মান দিতে গিয়ে আমি পিতৃত্বের অধিকার হারাব। আমি যে পিতা হতে চাই।
অদ্ভুত চোখে তাকালেন রাণু, সেটা কীভাবে সম্ভব?
আমি জানি না।
যদি ও রাজি হয় আমাকে মুক্ত করে দিতে–।
আমি প্রস্তুত।
তাহলে চলুন, এখনই, এই রাত্রে ওর কাছে ফিরে যাই, গিয়ে কথা বলি।
ওরা দুজনে দ্রুত জ্যোৎস্না মাড়িয়ে ফিরে এল সেইখানে যেখানে স্টেশনমাস্টারকে রেখে গিয়েছিল। গিয়ে দেখল মানুষটা নেই। অনেক ডাকাডাকিতেও তার সাড়া পাওয়া গেল না। উদ্বিগ্ন রাণু বললেন, বড্ড ঘুমকাতুরে। নিশ্চয়ই ফিরে গেছে বাসায়। চলুন।
যেতে-যেতে চাঁদ দিগন্তে চলে যাচ্ছিল। অদ্ভুত প্রাচীন এক ছায়া নেমে আসছিল পৃথিবীতে। স্টেশনের কাছে পৌঁছে ওরা থমকে দাঁড়াল। স্টেশনমাস্টার তাঁর পোশাক পরে তৈরি, এমনকী পোর্টারও উর্দি এঁটে লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে। দেখামাত্র ভদ্রলোক বললেন, আজ ভোরে এখান দিয়ে একটা স্পেশ্যাল ট্রেন যাওয়ার কথা ছিল। কী মনে হতে মাঝরাতে ফিরে এলাম। এসে বেঁচে গেলাম।
রাণু জিজ্ঞাসা করলেন, কীরকম?
তার এসেছে। ট্রেনটা এখানে, আমার এই স্টেশনে কিছুক্ষণের জন্যে থামবে। খুব বড়-বড় ভি.আই.পি. থাকবে গাড়িতে। তোমাদের সঙ্গে বেড়াতে গেলে চাকরি চলে যেত।
ব্যস্ততা বাড়ল। দূরে ইঞ্জিনের আলো দেখা যাচ্ছে।
রাণু বললেন, এই সময় ওঁকে অন্যরকম দেখায়।
হ্যাঁ। বেশ দায়িত্বশীল মানুষ।
ইস, চাঁদ ডুবে গেল।
হ্যাঁ।
আপনার ঘুম পাচ্ছে না?
তেমন নয়।
চা খাবেন? আমি খুব ভালো চা করতে পারি।
তা তো জানি।
না, সন্ধেবেলার মতো নয়, ভোরের চা অনেক ভালো হবে।
থাক। ভাবছি ট্রেনে যদি চলে যাই কীরকম হবে?
ভি. আই. পি.-দের সঙ্গে?
তা কেন? একটু জায়গা পেলেই হবে। ওঁকে বলব?
আপনার কোনও চিন্তা নেই। উনি বললে কেউ না বলতে পারবে না।
ট্রেনটা এল। ঝাঁকে-ঝাঁকে আলো ঝাঁপিয়ে পড়ল প্ল্যাটফর্মে। বড়-বড় ভি.আই.পি.-রা ঘুমোতে ব্যস্ত। গার্ড এলেন হনহনিয়ে। স্টেশনমাস্টার তাঁর সঙ্গে ব্যস্ত। অনীক তাকাল রাণুর দিকে। কী দারুণ গর্বিতা রমণীর মতো চেয়ে আছে ট্রেনটার দিকে। যে কারণে ফিরে আসা, তা এখন এই মুহূর্তে মনে করিয়ে দেওয়ায় মন সায় দিল না।
ফাঁক পেয়ে স্টেশনমাস্টার এগিয়ে আসতেই অনীক তাঁকে ইচ্ছে জানাল। ভদ্রলোক বললেন, চলে যাবেন? ও। আচ্ছা আসুন। একেবারে প্রথম কামরা খালি আছে।
অনীক বলল, এলাম।
ভালো থাকবেন। রাণু বললেন।
আর কিছু বলবেন না?
না। মাথা নাড়লেন রাণু।
জীবনে অনেকবারই এমন হয়েছে। ঠিক সময়ে নিজেকে মেলতে পারেনি বলে সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। আজ ওই জ্যোৎস্নায় মাঠে কেন সক্রিয় হয়নি বলে আজ যে আপশোস এই বুকে, তা আজীবন বহন করতে হবে। ট্রেনের কামরা থেকে মুখ বাড়িয়ে সে কাউকে দেখতে পেল না। অনেক পেছনের প্ল্যাটফর্মে ওরা দাঁড়িয়ে আছে।
ট্রেন ছাড়তেই খেয়াল হল। ঝোলাটা পড়ে আছে স্টেশনমাস্টারের বারান্দায় পাতা চেয়ারে। সেই ঝোলায় ডায়েরি, টাকাপয়সা। ডায়েরিটা বড় জরুরি। চটজলদি নেমে পড়ল অনীক। নামতে নামতে অনেকটা দূরে। শব্দ তুলে ট্রেনটা চলে গেল ভোর-ভোর পৃথিবীতে।
একটু দাঁড়াল সে। এই যে ফিরে যাওয়া এ বড় অস্বস্তির। রাণু কী একে বাহানা ভাববে? ভাবলেও উপায় নেই। ডায়েরিটা তার দরকার। শ্লথ পায়ে সে যখন স্টেশনের সামনে ফিরে এল তখন জায়গাটা ফাঁকা। রামবিলাস না কি যেন নাম পোর্টারের, দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। ওর পাশ কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সে। কোয়ার্টার্সে কোনও আলো জ্বলছেনা। ওরা কি এরমধ্যে ঘরে ফিরে গেছে? সে ধীরে-ধীরে বারান্দায় এল। ঝোলাটা পড়ে রয়েছে চেয়ারে। সেটা তুলে নিতেই কান্নার আওয়াজ কানে এল। ডুকরে-ডুকরে কান্না। তারপর স্টেশনমাস্টারের। গলা বাজল, শান্ত হও। শক্ত হও রাণু।
আমি আর পারছি না। কান্না ছিটকে উঠল।
কিছুই হল না? অদ্ভুত অসহায় গলা স্টেশনমাস্টারের।
কিচ্ছু না। এত কথা বলেছি এত কথা–রাণু ককিয়ে উঠলেন, আমাদের কি হবে?
আমরা অপেক্ষা করব। শান্ত গলায় জবাব দিলেন স্টেশনমাস্টার। থরথরিয়ে কেঁপে উঠল অনীক। এই ভোর-ভোর অন্ধকারে তার দিকে তাকিয়ে যেন সেই অন্ধ থুরথুরে পেঁচা বলে উঠেছে, ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার।
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন