শিরোনাম: কুসংস্কারের জন্ম

গল্পকার: Author Avatar শংকর ব্রহ্ম

ছোটগল্প

কুসংস্কারের জন্ম
(কিশোর গল্প)
শংকর ব্রহ্ম

সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে, জানলা দিয়ে পেয়ারা গাছের দিকে তাকিয়ে টুকাইয়ের মনটা দুমড়ে-মুষড়ে গেল। দেখল একটা শালিক পেয়ারা গাছের ডালে বসে একা একা ঠোঁট দিয়ে গা ঘষছে। তারপর সে অনেক খুঁজল আর একটা শালিক দেখা পাওয়ার জন্য। কিন্ত না, সে কোথায়ও আর একটা শালিক দেখতে পেল না। বুঝল দিনটা তার আজ ভাল যাবে না। এক শালিক দেখলে দিন খারাপ যায় সে শুনেছে বন্ধুদের কাছে। দু’শালিক দেখলে ভাল যায়, এটা বন্ধুরা সবাই বলে। টুকাইও তা বিশ্বাস করে। কিন্তু টুকাইয়ের মা এসব বিশ্বাস করেন না। তিনি বলেন,এসব কুসংস্কার।
– কুসংস্কার মানে কি মা? টুকাই জানতে চায়। টুকায়ের বয়স দশ বছর। ক্লাস ফোরে পড়ে।এখনও সে এইসব ভারি ভারি শব্দের মানে জানে না।
টুকাইয়ের মা টুকাইকে বলে – কুসংস্কার মানে ভুল ধারণা, মিথ্যে বিশ্বাস।

টুকাই অবশ্য মার একথা শুনে, পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি। বন্ধুরা সবাই বলে, এক শালিক দেখতে নেই। এক শালিক দেখলে,দিন খারাপ যায়। তাই দু শালিক না দেখা পর্যন্ত সেখান থেকে সরতে নেই। টুকাইও তাই করবে ভাবল। কিন্তু টুকাই দুই শালিক দেখার আগেই পেয়ারা গাছে বসে থাকা শালিকটা আচমকা হুস করে কোথায় উড়ে চলে গেল। টুকাই মন খারাপ নিয়ে বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। দেখল পিসিমা আচারের বয়মগুলি ঘর থেকে বের করে রোদে দিচ্ছেন। তা দেখে তার মন খারাপ কিছুটা ফিকে হয়ে এলো।

ছোটবেলা থেকেই টুকাইয়ের খুব আচার খাওয়ার লোভ । পিসিমা বাড়িতে আচার বানিয়ে বয়মে করে রোদে শুকোতে দেয়। কত রকমের আচার। কুল, আম, তেতুল, চালতা, পেটমোটা লাল লঙ্কার আচার।
বাড়ির সব কাজকর্ম সেরে পিসিমা বোসেদের পুকুরে স্নান করতে যায় রোজই। টুকাই তক্কেতক্কে থাকে, কখন পিসিমা স্নানে যান। পিসিমা স্নানে যাওয়া মানে তার স্বাধীনতা। পিসিমা স্নানে চলে গেল, সে বয়াম থেকে কিছুটা তেতুলের আচার তুলে নিয়ে, একটা কলাপাতা ছিঁড়ে তাতে মুড়ে এনে তার পড়ার ঘরের বইয়ের তাকে বইয়ের আড়ালে লুকিয়ে রাখে।
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে খেলতে যাওয়ার সময়, সেই আচারের কলাপাতায় মোড়া পুটলিটা নিয়ে যায়। বন্ধুরা সবাই মিলে তাড়িয়ে তাড়িয়ে সেই আচার খেয়ে খুব তারিফ করত টুকায়ের। গর্বে পিসিমাকে নিয়ে টুকাই মনে মনে প্রার্থনা করত, পিসিমা যেন আরও বহুকাল বেঁচে থাকেন।
সকালের স্কুল সেরে, সেখান থেকে এগারোটায় বাড়ি ফিরে, টুকাই আজও তক্কেতক্কে ছিল, পিসিমা কখন স্নান করতে বোসেদের পুকুরে যান। গেলে পরে আজও এক খাবলা আচার তুলে নেবে চালতার,বন্ধুরা কেউ কেউ চালতার আচার খেতে চেয়েছে। এমনই মতলবে টুকাই বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল। সে সুযোগও কিছুক্ষণের মধ্যে এসে গেল তার। পিসিমা গামছা নিয়ে স্নানে বেরিয়ে গেলেন।
টুকাই এদিক সেদিক ভাল করে লক্ষ্য করে দেখল কেউ তাকে দেখছে কিনা। চারপাশ ভাল করে দেখে যখন নিশ্চিন্ত হল, কেউ তাকে
দেখছে না। সে তখন একটা কলাপাতা ছিঁড়ে,
চালতার আচারের বয়ামের ঢাকনা খুলে সবে মাত্র দু’টুকরো আচার তুলেছে। অমনি পিছন থেকে কেউ তার কান ধরে টান দিল। পিছনে ফিরে দেখে পিসিমা স্বয়ং।
টুকাই সেখানেই আচার ফেলে দিয়ে, দে দৌড়। গিয়ে লুকালো সরকারদের বাঁশ বাগানে, যেদিকটায় খুব একটা কেউ আসে না। বাঁশ বাগানে বসে বসে টুকাই তখন ভাবছে, আজ সকালে এক শালিক দেখার ফলেই আজ পিসিমার কাছে ধরা পড়ে গেছে। আগে তো কতবার আচার তুলে নিয়েছে বয়মের ঢাকনা খুলে। কই, কখনও তো এমনটা হয়নি? এসব ভাবতে ভাবতেই আবার টুকাই দেখল, একটা শালিক নীচে পড়ে থাকা শুকনো বাঁশপাতা থেকে খুঁটে খুঁটে কী সব খাচ্ছে। আবার এখানেও এক শালিক। এসব দুর্ভাবনার মধ্যেই টুকাই দেখতে পেল কোথা থেকে আর একটা শালিক উড়ে এসে প্রথম শালিকটার সাথে মিশে সেটাও বাঁশপাতা থেকে খুঁটে কী সব খেতে লাগল। দুই শালিক দেখে টুকাই মনে মনে স্বস্তি পেল।
পিসিমা ঘাটে গিয়ে দেখল, মাথায় দেওয়ার শ্যাম্পু ভুল করে ঘরে ফেলে রেখে এসেছে। সেটা নিতে ফিরে এসেই দেখে, টুকাইযের এই কান্ড।
পিসিমা স্নান সেরে বাড়ি ফিরে টুকাইকে না দেখতে পেরে, বারকয়েক টুকাই টুকাই বলে চিৎকার করে ডাকলেন। কোন সাড়া না পেয়ে শেষে খুঁজতে বের হলেন। অনেক খোঁজা-খুঁজির পর সরকারদের বাঁশ বাগানে তাকে দেখতে পেল। সেখানে এসে, সেখান থেকে টুকাইকে ধরে নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় তার কাছে জানতে চাইল। হ্যাঁরে, তুই চাইলে কি আমি তোকে আচার খেতে দিতাম না? তুই কাউকে না বলে নিজে বয়াম খুলে চুরি করতে গেলি কেন?
টুকাই মৃদু স্বরে পিসির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার খাওয়ার জন্য নয়।
– তবে? পিসিমা জানতে চাইলেন।
– বন্ধুদের জন্য
– ও আচ্ছা। তাই বল।

ঘরে ফিরে টুকাই যখন বুঝতে পারল,পিসিমা এই ব্যাপারে মাকে কিছুই বলেনি। তখন মনেমনে ভাবল, নিশ্চয়ই বাঁশ বাগানে দুই শালিক দেখার সুফল এটা।
অন্যান্য দিনের মতো টুকাই মায়ের সঙ্গে ভাত খেয়ে, নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল বিকেলে, টুকাই ঘুম থেকে উঠে মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে খেলতে যাওয়ার জন্য বের হবে, ঠিক তখনই পিসিমা তাকে কাছে ডাকলেন।
টুকাই ভয়ে ভয়ে পিমিমার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
পিসিমা পিছন থেকে তার ডান হাতটা সামনে এনে, তাকে কলাপাতায় মোড়া বেশ কয়েকটুকরো চালতার আচার দিয়ে বলল, যা বন্ধুদের নিয়ে গিয়ে দিবি।
আচার পেয়ে আনন্দে টুকাইয়ের মনটা ভরে উঠল। সে এক ছুটে মাঠে গিয়ে, বন্ধুদের ডেকে আচার বিলি করে দিল তাদের মধ্যে। বন্ধুরাও চালতার আচার পেয়ে খুব খুশি হয়ে উঠল। তারপর তারা তাড়িয়ে তাড়িয়ে আচার খেতে থাকে।
টুকাই তাদের বলে, জানিস তো আজ দুপুরে দুই শালিক দেখেছি। তারপর খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। বিকেলে ঘুম থেকে ওঠার পর, মাঠে আসার সময় পিসিমা ডেকে আমাকে এগুলি দিয়ে বলল, যা এগুলি নিয়ে গিয়ে বন্ধুদের দিবি।
বন্ধুদের একজন শুনে বলল, এটা নিশ্চিৎ দুই শালিক দেখার সুফল।
তার কথা শুনে, টুকাইয়ের মনে হল, তাকে বলে, সকালে এক শালিক দেখে, আচার চুরি করতে গিয়ে পিসিমার কাছে ধরা পড়ে গেছিল। কথাটা তার মুখে এসে গেছিল প্রায়। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিল টুকাই। পরক্ষণেই তার মনেহল,আচার চুরি করতে গিয়ে পিসিমার কাছে ধরা পড়ে গেছিল শুনলে হয়তো বন্ধুদের কাছে তার গুরুত্ব ও সম্মান কিছুটা কমে যেতে পারে।
একথা কাউকে না বললেও, টুকাইয়ের স্থির বিশ্বাস, এক শালিক দেখার কুফল এটা।
মা কুসংস্কার-টংস্কার কী সব বলে এটাকে। মা কিচ্ছু জানে না। বাবাকে একবার জিজ্ঞেস করতে হবে। বাবা না জানলে স্কুলের প্রশান্ত স্যারকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে।

এখন পর্যন্ত গল্পটি পড়া হয়েছে ১১৮ বার
যদি গল্পটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন