এই মুহুর্তে আমার হাতে কবি ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতার বই ‘কালো কৌতুক’। ৫৬ পৃষ্ঠার বই, মানে সাড়ে চার ফর্মা। কবিতা রয়েছে ৩৪টি। বইয়ের ফ্ল্যাপ থেকে জেনে নেয়া গেলো, তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৭; এর মধ্যে ‘পেন্টাকল’ বইয়ের জন্য পেয়েছেন কলকাতা থেকে কৃত্তিবাস পুরস্কার , প্রিন্টার্স লাইনে বইটির সংস্করণ বিষয়ে লেখা আছে এরকম: প্রথম দিব্যপ্রকাশ সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১৮। এখান থেকে আমি বুঝে নিই দিব্য’র আগেও অন্য কোনো প্রকাশনা বইটি প্রকাশ করেছিল। এই অদ্ভুত সময়ে যখন পাঠক ফেসবুকে ঢুকে আর চায় না বের হতে- একটি কবিতার বইয়ের একাধিক সংস্করণ প্রকাশ পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয় নিশ্চয়ই। সুতরাং এই বইয়ের পাঠক ও লেখক উভয়কেই অভিনন্দন।
একজন কবিকে সার্বিকভাবে মূল্যায়ন করতে হলে তার সিংহভাগ কবিতা পাঠ করে নেয়া জরুরি। কিন্তু আমি অসহায় বোধ করছি কারণ ইমতিয়াজ মাহমুদের অন্য কোনো বই আমার সংগ্রহে নেই। এ অক্ষমতা একান্তই আমার। তবে আমার জানা নেই বইগুলো বাজারে দুষ্প্রাপ্য কিনা, নাকি পাওয়া যাচ্ছে এভেইলেবল (available)। অগত্যা ‘কালো কৌতুক’ পাঠ করে আমার যে অভিজ্ঞতা তা-ই বোলবার প্রয়াসী হবো নাতিদীর্ঘ এই আলোচনায়।
এই সময়ের কবিতা সম্পর্কে পাঠক ও সমালোচক মহলের একটি কমন কথা হলো- এখনকার কবিতা দুর্বোধ্য। কিন্তু ইমতিয়াজের কবিতার ভাষা আমার কাছে সহজ সাবলীল ও প্রাজ্ঞল মনে হয়েছে। যেমন:
আমি যেখানে
পা
রাখি
সেখানেই
তৈরি হায় যায় কবর।
[বন্ধু কী খবর?/ কালো কৌতুক]
ইতোমধ্যে ইমতিয়াজ কবিতার জগতে ব্যাপক পরিচিত একটি নাম। জনপ্রিয়ও বটে। এই জনপ্রিয়তার কারণ কী ভাষার প্রাঞ্জলতা নাকি অন্য কিছু? অবশ্য ‘জনপ্রিয়’ শব্দটি সবার কাছে সমানভাবে প্রিয় নয়। কেউ বা অধিকাংশ লেখক মনে করেন, শব্দটি ‘সাময়িকতা’ কে প্রকাশ করে। ইমতিয়াজ সাময়িক সময়ের জন্য কবি না চিরায়ত কবি তা নিশ্চিত হতে হলে অপেক্ষা করতে হবে। একমাত্র মহাকাল-ই এর বিচারক। আমার আলোচনার বিষয়- ‘কালো কৌতুক’ পাঠের অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতা তো আর দুই এক কথায় বোলে দেয়া সম্ভব নয়- তাই পাঠকের কাছে একটু ধৈর্য্য প্রত্যাশা করছি।
প্রথম কবিতা থেকে শুরু করা যাক। কবিতাটির শিরোনাম ‘উম্মাদ’। এখানে কবি লিখেছেন-‘উম্মাদ হওয়ার মুহুর্তে মানুষ দুটি ভিন্ন ভিন্ন জগতের নোম্যানস ল্যান্ডে চলে যায়।’ সেই ভিন্ন দুটি জগতের স্বরূপ কী তা কবিতা থেকে বুঝে নেয়া সম্ভব হলো না। তবে কবির এ কথা সত্য যে উম্মাদ সাহায্যের জন্য চিৎকার করলেও মানুষেরা তার অর্থ উদ্ধার করতে ইচ্ছাকৃতভাবেই ব্যর্থতার পরিচয় দিতে পছন্দ করেন।
‘ঈদ’ একটি চমৎকার কবিতা। উচ্চারণ ভঙিমা পরোক্ষ যা ভালো কবিতায় কাম্য। ‘ঈদ’, ‘হারুন’ এবং আরো কিছু কবিতায় ‘থানা-পুলিশ’ শব্দগুলো এসেছে ঘুরে ফিরে। এর সঙ্গে তার পেশা জীবনের কোনো প্রভাব আছে কি! যতদূর জানি তিনি প্রশাসনে চাকরি করেন। পেশা জীবনের কিছুটা প্রভাব লেখার মধ্যে থাকা অস্বাভাবিক নয় মোটেই। তবে শব্দগুলোর ব্যবহার যথার্থই প্রাসঙ্গিক। ‘ঈদ’ এ বাবা সন্তানকে তার ঈদ দিয়ে দিতে চাইছেন। যেহেতু সন্তানের ঈদ হারিয়ে গেছে। আবার বাবা তার স্ত্রীর ঈদ চুরি করে রেখেছেন। খটকা লাগছে এখানেই-যিনি বা যারা ‘ঈদ’ চুরি করেন তারা কি তা স্বীকার করেন? অথবা হয়তো বিষয়টা এমনও হতে পারে- আমি কবিতাটি বুঝি নি বলেই আমার খটকা লাগছে। হতেই পরে, আমি তো আর সর্ববোদ্ধা নই।
গ্রন্থের তৃতীয় কবিতা ‘অসার্থকতা’। প্রেমিক তার প্রেমিকাকে হারাতে চলেছেন কারণ প্রেমিকার বিয়ে একটি ইঁদুরের সঙ্গে। সন্দেহ নেই প্রমাণ পরিমাণ ব্যঙ্গ’র উপস্থিতি। কিন্তু কবিতাটির মধ্যে দহনের একটা ঘ্রাণ পাঠকের নাসারন্ধ্র বরাবর পৌঁছেও শেষ পর্যন্ত থেমে যায় কারণ-‘আমার মানুষজন্ম ব্যর্থ হয়ে যায়’-বাক্যটি পাঠককে কাঙ্খিত দহন যন্ত্রণার সুরসুরি দিতে ব্যর্থ না হলেও, সার্থক যে হয়েছে তাও বলা সম্ভব হচ্ছে না।
‘হারুন’ ও ‘সব কবি মরে যাবে’ কবিতায় উপসংহারে দোজখ এর কথা আছে। ‘হারুন’ এ দোজখে যাবার বিষয়টি বোধগম্য হলেও ‘সব কবি মরে যাবে’ কবিতায় দোজখে প্রবেশের বিষয়টি বোধগম্য নয় অন্তত আমার মতো একজন সাধারণ পাঠকের কাছে। ‘হারুন’ কবিতার উল্লেখযোগ্য বাক্য উদ্ধৃত করতে চাই:
মানুষ কতটা হারামি হতে পারে বারান্দা
থেকে বউ না পড়লে তা বোঝাই যায় না।
‘কালো কৌতুক’ কবিতার শুরুটা হয়েছে কাব্যিকভাবে। বলা হয়েছে একজন শিল্পীর কথা। শিল্পীর শরীর ভরে উঠেছে আঙুলে। মুখে পিঠে বুকে হাঁটুতে সর্বত্রই আঙুল। কবিতার শেষে বলা হয়েছে- ‘শিল্পীকে নিয়ে ডকুমেন্টারি ইত্যাদি তৈরি হয়েছে কিন্তু তিনি এসবের কিছুই দেখতে পান না কেননা তার দু’চোখ থেকেও বের হয়েছে দশটি আঙুল।’ প্রশ্ন হলো-তিনি যদি দেখতেই না পান তাহলে গজিয়ে ওঠা আঙুল গুলো দিয়ে তিনি কীভাবে ফুলের চারা লাগান যুদ্ধ করেন ছবি আঁকেন। এর উত্তর নিশ্চয়ই কবির কাছে আছে, আছে কবিতার মধ্যেও। উত্তর যা-ই হোক না কেনো কবিতাটি যে গভীর বক্তব্যাশ্রয়ী এতে সন্দেহ নেই।
‘কান্নার ক্বাসিদা’ একটি আঙ্গিক প্রধান কবিতা। গভীরতা খুব তীক্ষ্ম নয় তবে একটি বাক্য উত্তীর্ণ বলে মনে হয়েছে।
বাক্যটি এরকম:
আর এদিকে সাতটা সাগরের পানি কী যে উল্লাসে মেঘ হয়ে আকাশে ভেসে গেল, তারা যদি জানত পতনের জন্যই এইসব উড্ডয়ন, আহা!
‘জীবনের প্রকার’ একটি কমপ্লিট কবিতা। বর্ণনার পরম্পরা অসাধারণ। পাঠক পাঠ করলেই বুঝে উঠবেন তাই বিশেষ ভাবে বিশ্লেষণের প্রয়োজন দেখছি না।
‘অসার্থকতা’য় যে-দহনের ঘ্রাণ পৌঁছে যেতে পারে নি পাঠকের কাছে, ‘একদিন’ কবিতায় তা পেরেছে বৈ কি:
‘আমার কবরের পাশ দিয়ে তুমি হেঁটে যাবে ঠিকই, আমি ফিরেও তাকাবো না। ’
মজার ব্যাপার হলো- এ বাক্যে আমরা পেলাম অভিমান মিশ্রিত দহন।
ইমতিয়াজের কবিতায় পরোক্ষ উচ্চারণ একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। তার অনেক কবিতায়ই এই বৈশিষ্ট্য অস্তিত্বমান। ‘সমুদ্র’ তেমন একটি কবিতা। তবে কবিতাটিকে আমার সাম্প্রতিক সময়ের একটি টিপিক্যাল কবিতা বলে মনে হয়েছে। বর্ণনা ভঙিমা মাহমুদীয় হলেও মনে হয়েছে কিছুটা যেন অন্য দশজন কবির মতোই। তবে আমার এ মূল্যায়ন সর্বজনীন নয়। আরো কিছুটা ভেবে নেবার অবকাশ নিশ্চয়ই রয়ে গেলো-কবির না হোক, অন্তত আমার এবং পাঠকের- আ-মা-দে-র।
‘শখ’ কবিতায় একটু যৌন গন্ধের ছোঁয়া লেগে আছে বলে মনে হচ্ছে কি? একটু অবাক লাগছে ৩৪টি কবিতার মধ্যে মানুষজন্মের অনিবার্য অনুসঙ্গ ‘যৌনতা’ কে ইমতিয়াজ যেন কিছুটা এড়িয়ে গেছেন। এটাও কি সেই প্রশাসনিক জঙ্গমেরই বহিঃপ্রকাশ?
অধিকাংশ বা প্রায় সব কবিতাতেই ইমতিয়াজ আঙ্গিকে ভিন্নতা আনয়নে প্রয়াসী হয়েছেন। এটা কি এক ধরনের এক্সপেরিমেন্ট (Experiment) নাকি বিষয়টি তার সহজাত? ‘স্বপ্ন’, ‘ইনসমনিয়া’, ‘চোখ’, ‘গাছের কথা বলি’ ইত্যাদি কবিতায় আঙ্গিক নিয়ে ব্যাপক নাড়াচাড়া করেছেন। আঙ্গিক যেমনই হোক ‘কবিতা’ শেষ পর্যন্ত কবিতা হলো কিনা সেটাই বিবেচ্য। তবে তার আঙ্গিক কবিতাকে খরখরে করে ফেলেনি এবং ভাষার দিক থেকে যথেষ্ট সাবলীল যা পূর্বেই উল্লেখ করেছি।
‘স্বপ্ন’ এবং আরো কিছু কবিতায় ইমতিয়াজ উইলিয়াম জেমস কথিত Stream of Consciousness প্রয়োগ করেছেন। তবে তার চেতনা প্রবাহের ব্যবহার জেমস জয়েস বা ভার্জিনিয়া উলফের মতো সর্ববিস্তারি নয়। হওয়াটা জরুরিও নয় বোধ করি।
‘লাইভ’ কবিতাটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত টানটান, কোথাও বর্ণনা ঢিলে বা জোলো হয়ে ওঠেনি। কবিতাটি জোনাথোন সুইফটের ‘গালিভার্স ট্রাভেলস’ মনে করিয়ে দেয়। ইমতিয়াজ আঙুল তুলে দেখিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন-একটি দেশের অস্থিমজ্জার সার্বিক দূষণ আর নালি ঘা। আমি ‘লাইভ’ কে কবির একটি উল্লেখযোগ্য ও সফল কবিতা বলেই মনে করি। একটি বাক্য উপস্থাপন করি:
আমাকে অনুরোধ করতে হবে কেন আশ্চর্য!
সে তো এমনিতেও মানুষ।
আলোচনা দীর্ঘায়িত করতে চাই না, তাই সংক্ষেপে শেষ করি। ‘দোলনা’, ‘খেলনা’, ‘রুচি’, ‘সম্পর্ক’, ‘বাজার’- এই কবিতাগুলি পাঠকের ভালো লাগবে বলে বিশ্বাস করি। বলার অপেক্ষা রাখে না কবিতাগুলোতে ইমতিয়াজ ‘মাহমুদীয়’ সুর ও স্বর বজায় রেখেছেন। ‘খোঁজ’ এমন একটি কবিতা যা ‘কবিতা’ হয়ে উঠেছে পুরোদস্তুর কিন্তু কেনো হয়ে উঠেছে বলা মুশকিল কারণ কবিতার কোনো সর্বজনিন সংজ্ঞা নেই। আর যদি সংজ্ঞা কখনো আবিষ্কার হয়েও ওঠে তবে অনাগত সেই সংজ্ঞার নিরিখে ‘খোঁজ’কে কবিতাই বোলতে হবে- এইটুকু বোলতে পারি।
আমার এই অক্ষম আলোচনা ইমতিয়াজের কবিতার সবলতা যা দুর্বলতা বয়ানের জন্য নয়। নয় পাঠককে ভালো মন্দ কবিতা চিনিয়ে দেবার উদ্দেশে, বরং ব্যক্তিগত ভালোলাগার ভালো না লাগার অভিজ্ঞতাগুলোই পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করতে চেয়েছি- এর বেশি কিছু নয়। ইমতিয়াজ মাহমুদ তার স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বরে ভাস্বার হয়ে উঠবেন- প্রত্যাশা রইলো।
ইমতিয়াজ মাহমুদ- এর ‘কালো কৌতুক’


০
০
সেভ বা রিয়েক্ট করার জন্য লগইন করে নিন!
৯৯
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন