দিলুর আজ সারাদিন কেটেছে তুমুল ব্যস্ততায়।রাতের খাবার শেষ করে ঘুমুতে যাচ্ছিলো, এমন সময় রহিমা বেগমের ফোন।
-হ্যালো, আপা।
তুমি এক্ষুনি বাসায় চলো আসো।লিকুর চায়ের দোকান থেকে উত্তর দিকে তিন মিনিট দূরত্বে আমার গাড়ি অপেক্ষা করছে।
-ওকে, আপা আমি আসছি।
উপায় নেই।আপার ফোন। দিলুকে যেতেই হবে।দিলু ৩৫ মিনিটের মধ্যে রহিমা বেগমের বাসায় পৌঁছে গেলো।
-দিলু।
জ্বি আপা।
-খেলা ফাইনাল।
জ্বি আপা।
-কিন্তু এখনি খুশি হবার কিছু নাই।
তা তো বটেই।
-আগে অপারেশন সাকসেসফুল হোক।তারপর দেখা যাক কী হয়।দাদা যেভাবে বলে গেছেন অপারেশন ঠিক সেই সেইভাবে করতে হবে। বুঝেছো?
জ্বি।
দাদা মানে অজিত দেবনাথ রহিমাকে সমস্ত প্ল্যান বুঝিয়ে দিয়ে গেছে।সেদিন মনিষার সংগে ভরপুর মাস্তি করে সকাল বেলা নাশতার টেবিলে অজিতদা বেশ ফুরফুরে।
রহিমা বললো- দাদা কেমন কাটলো সময়। কোনো কষ্ট হয় নি তো?
আরে কি যে বলো।কষ্টের তো প্রশ্নই আসে না।স্বর্গের এমন অপ্সরা এমন স্বর্গদেবী পেলে কোথায়?
-দেশ থেকে এনেছি,দাদা।
সাব্বাস।অনেকদিন হলো এরকম কোনো দেবীকে পুজো দেই নি।
রহিমা বেগম দারুণ খুশি।যাক দাদাকে তাহলে মনিষা সুখ দিতে পেরেছে।মনে মনে রহিমা বলে- মনিষা তোকে আরো খেলতে হবে।প্রস্তুত থাকিস।সমস্যা নেই তোকে পুষিয়ে দেবো।কিন্তু মুখে বলল- দাদা হাতে সময় কম।আপনি চলে যাচ্ছেন।
কি করবো বলো টাইট স্ক্যাজুল।আর আমাদের হাত পা বাঁধা।তুমি তো জানোই।কর্তার ইচ্ছায় কর্ম।বাই দ্য ওয়ে, অপারেশনটা সাজানো হয়েছে জাহাজে।
-জ্বি দাদা।
জেন্ট প্রথমে ভেবেছিলো বম্বিং করে জাহাজ উড়িয়ে দেবে কিন্তু তাতে ঝুঁকি বেশি,তাছাড়া জনমনে সন্দেহ তৈরী হবে অবিশ্বাসযোগ্য মনে হবে নিখুঁত হবে না।
রহিমা কেমন টান টান উত্তেজনা অনুভব করছে।মনে মনে বলছে ধ্যাৎ এতো বর্ণনা মার্কা প্যাঁচালের দরকার কী! ডাইরেক্ট আসল ঘটনা বললেই তো হয়।মুখে বললো- এগজাক্টলি দাদা,আমিও তাই মনে করি।
গুড।প্ল্যান পরিবর্তন করে জাহাজডুবি করা হয়েছে।
রহিমা আঁতকে উঠেলো।বলতে চাইলো – দাদা আমার ভয় করছে।কিন্তু বললো না কারণ ভয়ের কথা বললে দাদা ভাববেন রহিমা কাঁচা প্লেয়ার রহিমাকে দিয়ে হবে না।কিন্তু রহিমা যে কাঁচা খেলোয়াড় নয় তা রহিমার চেয়ে আর কে ভালো জানে!
দাদা বলে চললেন-এখন ডিপেন্ড করছে পুরো বিষয়টি তুমি আর তোমার লোকেরা কীভাবে ডিল করবে। কীভাবে সাকসেস করবে সেটা তোমার ব্যাপার।অপারেশন সাকসেস হলে বাকী দায়িত্ব আমাদের।সেটা আমরা আমাদের মতো করে নেবো।
রহিমা অভয় দিয়ে বললো-দাদা আপনি নিশ্চিত থাকুন।কোনো ভয় নেই।আমার লোকেরা একের লোক।তাজা রক্ত পান করতে তাদের কণ্ঠ একটুও কাঁপে না।
-এটা আমি বিশ্বাস করি রহিমা।আর গত রাতেই আমি তা টের পেয়েছি।আমি খুব শীঘ্রই আবার আসবো।মনিষার বেদীতে আমার আরেকবার পুজো দিতে হবে।ওকে তৈরী রেখো।
আপনার মতো স্পেশাল ঠাকুরের জন্য মনিষার মন্দির অল টাইম রেডি, দাদা।
রহিমা আর অজিত দেবনাথ দু’জনেই হো হো হেসে উঠে চিয়ার্স করে। তারপর সেদিন বাকি প্ল্যান বুঝিয়ে দিয়ে অজিতদা চলে যায়।
দিলুকে ২৫ মিনিটের মধ্যে রহিমা সব বুঝিয়ে বললো।
দিলু বললো- আমি তাহলে সব রেডি করছি।আপনি ইশারা করলেই খেলা শুরু হয়ে যাবে।আপনার ইশারার অপেক্ষায় রইলাম।
রহিমা বেগম বললো : গুড।
দিলু একটা চেক নিয়ে চলে গেলো।
আজ টিটুর বাসায় পার্টি।টিটু লন্ডন চলে যাচ্ছে।ভালো একটা স্কলার্শিপ পেয়েছে।জিলম সন্ধ্যার কিছু পরে রওনা হলো।টিটুর বাসায় জিলম পৌঁছে দেখে এখনো কেউই আসে নি।
জিলম টিটুকে বললো- কিরে দেরি কেনো।আমি একাই। এখনো পর্যন্ত কেউ এলো না।বিষয় কী?
টিটু বললো- আমি তোকে একটু আগেই আসতে বলেছি, বাকিরা পরে আসবে। তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।তাই তোকে আগে আসতে বলেছিলাম
জিলম একটু অবাক হলো।জিলমের সংগে টিটুর কী এমন কথা থাকতে পারে জিলম ভেবে টেবে কিছুই পেলো না।শুধু বললো- লোকজন এসে পড়বে।কি বলবি বলে ফেল।
টিটু জিলমকে বেডরুমে নিয়ে গেলো।
টিটু বললো- বেডে উঠে বস।
জিলম বেডে উঠে বললো- বসলাম। এবার বল।
টুটু শুরু করলো- জিলম।
শুনছি, বল।
-আমি দেশের বাইরে চলে যাচ্ছি বলে ভাবিস না আমি পালিয়ে যাচ্ছি।আমি আসলে যাচ্ছি মূলত যতোটা পড়াশুনার জন্য ডিগ্রি নেয়ার জন্য তার চেয়ে বেশি হলো আমি বিদেশ বিভুঁইয়ের রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি শিক্ষা সংস্কৃতি নিজের চোখে দেখে এসে তারপর এই দেশে রাজনীতি করতে চাই।আমাদের দেশের কালচার আমি আপাদমস্তক সুস্থ ধারায় নিয়ে আসতে চাই আর এই ব্যাপারে আমার প্রধান ভরসাই হলো তুই।যাবার আগে তোকে শুধু এটুকু বলবো- ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়।আজ হোক কাল হোক ক্ষমতা চেঞ্জ হবেই।তুই যদি জনগণের পক্ষে কাজ করিস জনগণের সংগে থাকিস জনগণও তোর সংগে থাকবে।আর পল্টি নিলে জনগণও পল্টি নিবে।আসলে এসব কিছুই তুইও জানিস।আমার অনুরোধ হলো এসব মেনে চলিস।
উপদেশ দিচ্ছিস?
-উপদেশ না,অনুরোধ।
অন্য কেউ হলে এসব দাদাগিরি জিলম মেনে নিতো না।অন্য কেউ জিলমকে এসব বলবার এমন সাহসও পেতো না কিন্তু টিটুর বিষয়টা আলাদা।টিটু যখন খুব ছোট তখনই ওর বাবা মারা গেছে।টিটুর মা খুব স্ট্রাগল করে ওকে বড়ো করেছে।স্কুল জীবন থেকেই টিটু জিলমের বন্ধু।টিটু ছিল বরাবরই ক্লাসের ফার্স্ট বয়।পড়াশুনায় জিলমকে টিটু অনেক সহোযোগিতা করেছে।এসব ঋণ তো আর ভুলবার নয়।জিলম হয়তো ভালো মানুষ নয় কিন্তু অতোটা খারাপও সে নিজেকে মনে করে না।যদিও এদেশে যারা রাজনীতি করে তাদেরকে যে জনগণ মানুষই মনে করে না-এ তথ্য জিলমেরও অজানা নয়।
জিলম কথা না বাড়িয়ে বললো- ওকে, বন্ধু আই মাস্ট ট্রাই মাই বেস্ট।দোয়া রাখিস।বেস্ট অব লাক।
টিটু কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু বলতে পারলো না।ওর চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে।
জিলমেরও কষ্ট হচ্ছিলো কিন্তু চোখে জল এসে যাবে এমনতরো সফট জিলম নয়।এদেশের রাজনীতিবিদ বলে কথা।কিন্তু না,টিটুকে অবাক করে দিয়ে জিলমের চোখের কোণেও দেখা গেলো চিকচিক করছে জল।যার আসলে কোনো রঙ নেই।
সুধীনদার হাতে বিশ্বকবিতার ইংরেজি সংকলন Contemporary World Poetry। রাজুকে বইটা দিয়ে বললেন-এই পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া সহজ ব্যাপার নয়।অনেক কাঠকয়লা পোহাতে হয়েছে।
সংকলনের উপরে লেখা Translated by Raju Ahmad।রাজু খুশি হলো তবে সেই খুশির মাত্রা খুবই সামান্য।আসলে মৌলিক কাজ না করে এসব সংকলন টংকলন করে কী লাভ!রাজুর কাছে মনে হচ্ছে – এসবের পেছনে দাদার নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে কিন্তু কী সেই উদ্দেশ্য! রাজু বিভিন্ন সময়ে লক্ষ্য করেছে দাদাকে হাংরি জেনারেশনের কথা বললে দাদা রেগে যান এড়িয়ে যান।এন্টি এস্টালিশমেন্টকে দাদা কি ভয় পান?রাজু ফালগুনি রায়-এর কথা বলাতে দাদা ‘হ্যাঁ,ফালগুনি তো প্রতিষ্ঠা পেয়েছে’ শুধু এটুকু বলেই এড়িয়ে গেছেন।আর শৈলেশ্বর ঘোষের কথা জানতে চাইলে বলেছেন ‘শৈলেশ্বরের গদ্য ভালো’।এটাও কি এক ধরনের এড়িয়ে যাওয়া নয়!দাদার কাছ থেকে Contemporary World Poetry জাস্ট এক কপি নিয়ে রাজু সেদিন বাসায় চলে এসেছিলো।বইটি বেরিয়েছিলো সহযাত্রী প্রকাশনা থেকে।কিছুদিন পর প্রকাশক স্ট্রোক করে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন।ক্রমশ শরীর প্যারালাইজড হতে থাকে। তিনি প্রকাশনা আর চালাতে না পেরে বন্ধ করে দিয়েছিলেন।আর বাংলাদেশের কথা যদি বলতেই হয় তবে বলতে হবে এখানে প্রকাশনা এখনো ইন্ডাস্ট্রি হয়ে ওঠে নি।হয়ে উঠবার তেমন সম্ভাবনাও নাই।আজকাল তো যা-তা বই মার্কেট পাচ্ছে -‘রবীন্দ্রনাথ এখানে জল বিয়োগ করতে এসেছিলেন’, ‘কুদ্দুসরে কুত্তায় কামড়াইসে’, ‘আজ জরিনার মন ভালো নেই’, ‘মর্জিনা তুই এতো বেশরম ক্যা’, ‘পদ্ম তুই জামাইয়ের বাড়ি যা’ ইত্যাদি। ভাবা যায় এসব বই সেল হচ্ছে হাজার হাজার কপি।শহীদুল জহিরের পর তেমন কোনো ক্লাসিক উপন্যাসিকের আবির্ভাব এ বাংলায় আজ পর্যন্ত ঘটেছে কি? মূল সমস্যা হলো এখানে ভালো ক্রিটিক নেই তাই ভালো লেখকেরও ক্রাইসিস।সাহিত্যের জন্য অনেক কিছু করতে রাজুর ইচ্ছে হয় কিন্তু সাধ থাকলে কী হবে সাধ্য নেই।যেমন সাধ্য নেই জরির কাছে গিয়ে মুখোমুখি বলা- ভালোবেসেছিলাম।
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন