জরির কথা ভাবতে ভাবতে রাজু কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো মনে নেই।রাজুর ঘুম ভাঙলো ১১ টায়। নাশতা করে ১২ টার দিকে রাজু হাজির হলো সুধীনদার দোকানে।সুধীনদা সিগ্রেট ফুঁকছিলেন।
রাজুকে দেখে বসতে বললেন।রাজু ১৫ বছরের পুরনো চেয়ারটিতে বসলো।
সুধীনদা রাজুর জন্য চা আনালেন।
রাজু চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললো- দাদা অনুবাদ কমপ্লিট।
দাদা সিগ্রেটে ধোঁয়া উড়িয়ে বললেন- গুড।
রাজু সুধীনদাকে থ্যাঙ্কস জানালো।
– অনুবাদ তো কমপ্লিট হলো।এবার একটা সংকলন করতে হবে।
কী সংকলন দাদা?
-এশিয়ার প্রমিনেন্ট কবিদের কবিতা নিয়ে সংকলন।ইংরেজিতে করতে হবে।
ম্যাটার পাবো কোথায়?
-ম্যাটার তোমাকে আমি দিবো।তুমি শুধু গুছিয়ে দিবে।
ওকে, দাদা।আপনি ম্যাটারের ব্যবস্থা করেন।আমি বাকিটা গুছিয়ে দিবো।
সুধীনদা লাইটার জ্বেলে দ্বিতীয় সিগ্রেট ধরিয়ে আনমনে কী যেনো ভাবছেন।দাদার ভাবনার মধ্যে রাজু কখনো বাধ সাধে না।রাজু বরং দাদার সরব হবার অপেক্ষায় থাকে।সুধীনদা চোখ বন্ধ করে সিগ্রেট ফুঁকে যাচ্ছেন।রাজু তাকিয়ে আছে সুধীনদার বন্ধ চোখের দিকে।এমন সময় সুদীনদার ফোন বেজে উঠলো।সুধীনদা কল রিসিভ করে ‘হ্যালো’ আর ‘জ্বি দাদা জ্বি দাদা’ ছাড়া অন্যকিছুই বলছে না।কথা বলার মাঝখানে বার দুয়েক সে রাজুর দিকে তাকালো। রাজু তখন একটা বইয়ে চোখ বুলাচ্ছে,তাই সুধীনদা যে ফোনে কথা বলতে বলতে রাজুর দিকে চোরা চোখে তাকিয়ে ছিলো তা রাজুর চোখ এড়িয়ে গেছে।কথা শেষ করে সুধীনদা বললেন- রাজু।
রাজু বইয়ের পাতায় চোখ রেখেই বললো- জ্বি দাদা।
-এশিয়ার ২২ জন কবি নেবো।
বেশ তো।
-সংকলনের নাম হবে ‘টোয়েন্টি টু গ্রেট পোয়েটস অব এশিয়া’।চলে?
রাজু জিজ্ঞেস করতে চাইলো- সংখ্যাটা ২২ কেনো; কিন্তু কী ভেবে আর জিজ্ঞেস না করে দাদার কথায় সায় জানিয়ে বললো-হ্যাঁ চলবে দাদা।
-গুড।শোনো আজ একটু তাড়া আছে।১০০ টা টাকা দাও।সকালে টাকা যা এনেছিলাম শেষ হয়ে গেছে।
রাজু দাদাকে ১০০ টাকা দিয়ে চলে এলো ‘চৌচির গ্রন্থপ্রকাশ ‘-এর শোরুম ‘চৌচির’-এ। ।এবং মুশায়েরা জেমস জয়েস সংখ্যা করেছে।নীৎসে সংখ্যাও করেছে।এবং মুশায়েরা খুব গুরুত্বপূর্ণ লেখক নিয়ে সংখ্যা করে কিন্তু অধিকাংশ লেখকেরই ভাষা খুব বাজে।অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এইসব লেখক বাংলা ভাষাটাকেই যেনো ক্রমশ অনুপস্থিত করে দিচ্ছে! রাজু সেলিম ভাইকে বললো সংখ্যা দু’টি রাজুর জন্য রেখে দিতে।পরে এসে নিয়ে যাবে।সেলিম ভাই ভালো মানুষ। রাজুকে সে নিয়মিত এই সেবাটা দিয়ে যাচ্ছে।রাজু সেলিম ভাইয়ের প্রতি সত্যিই কৃতজ্ঞ।
‘চৌচির’ থেকে রাজু হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো স্বাধীনতা উদ্যানের মন্দিরের সামনে।জরিকে মনে পড়ছে।আর মনে পড়ছে একটি কবিতা।কবি সম্ভবত এই মন্দিরের কথাই কবিতায় বলেছেন।রাজু সরবে কবিতাটি পাঠ করে নিতে চাইলো
১ টি গোলাপ ৪ টি গোলাপ ৩ টি গোলাপ ( বোল্ড হবে)
(কবিতার ফন্ট ছোটো হবে),,,,,,
তার সাথে একটি দীর্ঘ বিরতি কেটে গিয়েছিলো
আমাকে খুঁজে বের করা তার কাছে সহজ ছিলো না
কারণ আমি কখনো চাইনি সে আমাকে খুঁজে পাক
সাত বছর পর দেখা হলো স্বাধীনতা উদ্যানে
আমি পছন্দ করি বলে কবিতার মতন
কপালে পরেছিলো কালো টিপ
‘কাকতালীয়’ বলে যে একটা ব্যাপার আছে
বিশ্বাস না করে পারলুম না
সে পরেছিলো একটি কালো জামদানি
আমার পরনেও কালো পাঞ্জাবি আর জিন্স
মন্দিরের সামনে অচল মুদ্রার মতন পুকুর, তার সিঁড়িতে
বসলাম পাশাপাশি। মাঝখানে শূন্যতা। সংস্কারের দেয়াল
ঝুপঝুপ বৃষ্টি শুরু হলো
আমরা মন্দিরের বাউন্ডারির ভেতরে ঢুকে পড়লাম
পশ্চিম পাশে একটি নতুন ঘর তখোন অর্ধনির্মিত
তার বারান্দায়- কী অদ্ভুত- দুইটি চেয়ার
আমাদের উদ্দেশেই বুঝি রাখা ছিলো!
ওখানটায় বসে চেয়ার দুইটির শূন্যতা উড়িয়ে দিলাম
তার ঠোঁট কাঁপছিলো। কথা বলতে পারছিলো না
অপরাধীর মতন মাথা নিচু করে বসে আছে
এতোদিন পরেও কি মানুষ ওসব মনে রাখে!
বেশ কিছুক্ষণ পর
ব্যাগ থেকে সে বের করলো আটটি লাল গোলাপ
প্রথমে একটি গোলাপ কম্পিত হাতে
আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো
তারপর চারটি গোলাপ
তারপর তিনটি গোলাপ
আমি তাকে ধন্যবাদ দেই নি
আমার চোখের ভাষায় সম্ভবত
সে তা টের পাচ্ছিলো
আর তাকিয়ে ছিলো-
কী গাঢ় আর স্নিগ্ধ দু’টি চোখ
করতলে অন্ধকার নিয়ে অনন্তকালের মতো বহমান
আমি তার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছিলাম
কিন্তু তখোন অনেক দেরি হয়ে গ্যাছে
সে ফিরে গিয়েছিলো আমার ক্ষমা আর অক্ষমতা নিয়ে
আমিও ফিরে এসেছি তার বিলম্বিত ভালোবাসা নিয়ে
আমার শুধু মনে পড়ছিলো- ভলোবাসা হয়তো শেষ কথা নয়!
রাজু যখন কবিতা পাঠ করছিলো তখন মন্দির থেকে উত্তর দিকে উদ্যানের গাছের আড়ালে একটি ছায়া সরে যাচ্ছিলো উদ্যানের পশ্চিম দিকে প্রধান সড়কের দিকে যেখানে অপেক্ষা করে আছে একটি কালো গাড়ি।রাজুর তা জানবার কথা নয়।
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন