কলেজের করিডোরে কখনো এক মিনিটও দাঁড়াই নি তোমার সঙ্গে- দাঁড়িয়ে কুশল বিনিময় কিংবা এক ঝলক চোখে চোখ রাখা! অথচ সেই তোমাকে নিয়েই আমার সঙ্গে কতো কিছু রটে গিয়েছিলো!
তখোন থেকেই আমি বুঝে নিয়েছিলাম- যা রটে
তা সব সময় বটে না।
একদিন আমি বেঞ্চিতে বসে আছি।আমার সামনে বসে কয়েকজন ছেলে মেয়ে।তুমি ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলে।আমি যে তোমাকে খেয়াল করছি না -সেটাও আমি জানতাম না।খেয়াল না করলে কি জানা যায় যে খেয়াল করছি না! আমার বেখেয়ালকে তুমি হয়তো খেয়াল করছিলে। অগত্যা নিজে থেকেই বোল্লে:বোসবো?।
আমি বোল্লাম : কেনো নয়! নিশ্চয়ই
তুমি বসলে।
ঠিক সেই থেকেই কি শুরু!
এতো বছর পর আমার ঠিক মনে নেই।তবে মনে পড়ে- কলেজে আসার সময় সেই জলডাঙা থেকে তুমি আমাকে এসএমএস করতে করতে আসতে- যাবার বেলায়ও তাই- এসএমএস করতে করতে যেতে।
এতোটা দীর্ঘ পথ তখোন তোমাকে আসতে হতো হেঁটে হেঁটে! প্রায় কতো কিলো হবে? কিলোটিলো মনে নেই তবে পথটা ছিলো দারুণ দীর্ঘ যেনো অফুরন্ত পথ পড়ে আছে বিছিয়ে থাকা রোদ্দুরের মতো।ভেবে কষ্ট হতো যে অতোটা পথ তোমাকে হেঁটেই আসতে হতো।
এসএমএস -এর আগে যেভাবে শুরু হয়েছিলো: একদিন সন্ধেবেলা আমি বসে আছি মডেল প্রাইমারি বিদ্যালয়ের মাঠে। আমার সামনে একজন বসে ছিলো।নাম বোল্লে তুমি চিনবে না তাই নামটা অনুল্লেখ রয়ে গেলো।এমন সময় টুংটাং করে বেজে উঠলো আমার সেলফোন।” হ্যালো” বোলতেই একটি মেয়ে কন্ঠ বোল্লো: “কি করছেন….”। আমার সামনে নাম উল্লেখ না করা ছেলেটি বসে ছিলো বোলে আমি স্বাবলীলভাবে কথা বোলতে পারছিলম না।আমি তখনও তোমার নাম জানি না।চিনতে চেষ্টা করছিলাম – কে তুমি।কাউকে নাম জিজ্ঞেস করার অভ্যাস আমার নেই,তাই জিজ্ঞেস করি নি।দুই- এক মিনিট পর কথা ফুরালো আমাদের।
তারপর একদিন রাতের বেলা প্রথম এসএমএস শুরু হলো।শুরুটা কে করেছিলো – ‘তুমি’ না ‘ আমি’?মনে নেই আমার।তোমার কি আছে,?এইভাবে রাতের পর রাত চলছিলো এসএমএস খেলা।এসএমএস -এ তুমি ” জরি” আর আমি ” নীল”।যেমন,আমি লিখতাম: নীল বোল্লো- এই জরি,কি করছো তুমি? তুমি লিখতে: জরি বোল্লো- দুই নয়নে দেখছি তোমায়।
মনে পড়ে একদিন সারারাত এসএমএস খেলার পর শেষ রাতের দিকে তুমি ফোন করলে।কিছুক্ষণ কথা বলার পর বোল্লে:একটা কথা বোলবো?
– বলো
আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে তুমি ইংরেজিতে বোলেছিলে:I love you.
শুনে আমি বিচলিত হয়েছিলাম? পুলকিত হয়েছিলাম? স্বাভাবিক ছিলাম? তবে I love you বোলে যে তুমি আমার বন্ধ্যাত্ব দূর করেছিলে- সেটা ভেবে আজও খুব বেশি পুলকিত হই।
কলেজ ফাইনাল শেষ হয়ে গেলো।তুমি পাশ করে যথারীতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে।মাঝে মধ্যে কথা হতো।এসএমএস তখোনও চলছিলো তবে আগের চেয়ে অনেকটাই কম।
একদিন তুমি বোল্লে: তোমার মন খুব খারাপ
আমি জানতে চাইলাম- কেনো?
:আমার এক বন্ধু আমার সঙ্গে রাগ করে
কথা বোলছে না,ফোনও রিসিভ করছে না
আমি বোল্লাম :অপেক্ষা করো,নিশ্চয়ই ধরবে।
তোমার সেই বন্ধুকে আমি শুধুই বন্ধু ভেবেছিলাম
এক সময় তুমি আমাকে জানালে- সেই বন্ধুর সঙ্গে তোমার প্রেম হয়ে গেছে।
বোল্লাম:কীভাবে হলো?
:এটা কি ব্যাখ্যা করা যায়! এটা তো এমনি এমনিই হয়ে যায়।
তোমার ব্যাখ্যা আমাকে মোটেই প্রশ্নবিদ্ধ করে নি।তবে বুঝতে পেরেছিলাম- ওটা আসলে
ব্যাখ্যাকে এড়িয়ে যাবার ব্যাখ্যা কিংবা
ধরে নিয়েছিলাম – ব্যাখ্যাটা তোমার জানা নেই
তাই ওভাবে বোলেছিলে।আর বুঝতে পেরেছিলাম- এসএমএস খেলার দিন শেষ হয়ে গেছে।
শেষ হয়ে গেছে জরি শেষ হয়ে গেছে নীল।
তারপর দীর্ঘ বিরতি—
৪ বছর পর আকস্মিকভাবে একদিন তোমার প্রেমিক পুরুষটির সঙ্গে আমার দেখা- কলেজ ক্যাম্পাসে।সে আমাকে সংক্ষিপ্তভাবে জানালো : তোমার সঙ্গে ৪ বছর গভীর গভীরতম
সম্পর্কের পর এখন সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে!
পরে জানতে পেরেছিলাম – ছিন্ন হবার কারণ হলো – সে তোমাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছিলো।তার ভাষ্য – তুমি অন্য ছেলেদের সঙ্গেও কথা বোলতে যা সে মেনে নিতে পারে নি।
সেই অন্য ছেলেরা ছিলো আসলে তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু যাদের সঙ্গে তোমার ছিলো কেবলি প্রাসংগিক বা সহজভাষায় লেখাপড়া নোটস ক্লাস – এসব বিষয়ে কথা বলার সম্পর্ক।-
এর বাইরে আর কিছুই নয়।এই স্বাভাবিক ঘটনাটিও সে মেনে নিতে পারে নি।খুব সাধরণ একটি বিষয় নিয়েই তোমাদের নিবিড় নিবিড়তম সম্পর্ক ভেঙে গেলো- কী অদ্ভূত, তাইনা!
আমি অবাক হই নি আনন্দিত বা দুঃখবোধেও হইনি ম্রিয়মাণ কারণ আমি জানি এরকম হয়েই আসছে বরাবর- এসব নতুন কিছু নয় – যা খুব স্বাভাবিকভাবেই মনে করিয়ে দেয় শেক্সপিয়রের “ওথেলো”।বিশ্বাসের ঘরে ঈর্ষা ঢুকে গেলে
মানুষ পালিয়ে যায়- ঢুকে পড়ে বাঁদর আর মহামারী।
তোমার সঙ্গে আমার হয়তো আর দেখাই হতো না। কিন্তু হয়ে গেলো যেদিন তোমার প্রেমিক( প্রাক্তন?) পুরুষটির বিয়ের দাওয়াতে এসেছিলে।আমিও গিয়েছিলাম। বিয়ের পর তোমার প্রেমিক আমাকে জানিয়েছিলো:তুমি নাকি বিয়ের দিন তার হাত ধরে অনেক কান্না করেছিলে।- এ কথার সত্যতা আমি কোনোদিন যাচাই করে দেখি নি কেননা
যাচাই করাটা আমার কাছে অপ্রাসঙ্গিক এবং হীনমন্যতা মনে হয়েছিলো।সম্ভবত আমি অতটা হীনমন্য নই।
কিছুদিন পর তোমার আর তোমার প্রেমিক পুরুষের এক কমন বন্ধু বিদেশ চলে যাবে।তাকে তুমি আর তোমার এক বন্ধু see off জানিয়ে ফিরে আসছিলে নতুন এয়ারপোর্ট থেকে।পথে তোমার বন্ধুর মোবাইল থেকে ফোন দিয়ে তোমার অই বন্ধুটি আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিলো তোমার সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশে।আমরা কথা বোল্লাম আধা মিনিট কিংবা তার চেয়ে কম।সেদিনই হয়তো শেষ কথা- ধরে নিয়েছিলাম।কিন্তু একদিন তুমি ফোন করে তোমার সঙ্গে দেখা করতে বোল্লে।আমি হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিয়েছিলাম।তুমি বোলেছিলে- যতোটুকু মনে পড়ে এরকম কিছু: MBA করতে তুমি সিংগাপুরে চলে যাবে।তবে বিয়ে হয়ে গেলে যাওয়া হবে না আর।
সেই যে কথা হলো, তার এক মাস পর আমি তোমাকে ফোন দিয়েছিলাম তোমার সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশে।
বোল্লাম:তুমি এখন কোথায়?
বোল্লে:শ্বশুর বাড়ি।
বোল্লাম :তোমার বিয়ে হলো কবে?
:এই তো কিছুদিন আগে
আমি কী বোলবো বুঝতে পারছিলাম না।তবে বুঝতে তো পারছিলামই -দেখা করা আর সম্ভব নয়।তাই তোমাকে বলিনি আমি তোমাকে কেনো ফোন দিয়েছিলাম।আমাকে তুমি ফোন করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে কথা শেষ করে দিয়েছিলে।-
সেই তোমার সঙ্গে আমার সত্যিকারের শেষ বারের মতো কথা বলা।আমি তোমাকে ফোন দেই নি আর কোনোদিন।তুমিও দাওনি আমাকে।
তুমি কোনোদিন জানবেও না- তোমার একটি ফোনের জন্য আমি আজও অপেক্ষা করে থাকি।অপেক্ষা করে যাবো আজীবন যেমন অপেক্ষা করছি আজ রাতে – ৫ এপ্রিল ২০২০ – যখোন পৃথিবীতে covid 19- এ মরে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ।এইসব মৃত্যুকে উপেক্ষা করে আজ রাতেও আমি তোমার কথাই ভাবছি এমন একটি নির্জন আর অন্ধকার রাত্রিও- মৃত্যুকে নয়, জীবনকেও নয়- জরি,আমি তোমাকেই দিয়ে দিলাম।কী আশ্চর্য , তাইনা!
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন