‘এম ভি কাউয়ার চর’ ঘাটে এসে ভিড়েছে।সবার আগে উঠলো রহিমা বেগম, সংগে কয়েকজন নেতা তারপর অন্য সবাই।সবশেষে উঠলো ঠাললু এন্ড গং।
জাহাজ চলতে শুরু করেছে।যাত্রীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এক তলায় দোতলায় ছাদে ডেকে।মৃদু আওয়াজে সাউন্ড বক্সে গান বেজে চলেছে।বক্তৃতা-টক্তৃতার কোনো পর্ব নেই।এ যেনো এক অভিনব আয়োজন।লাঞ্চের সময় দেয়া হয়েছে মধ্যদুপুরে।
রহিমা বেগম ঠোঁটে ফুটিয়ে রেখেছে কৃত্রিম হাসির ছটা।নিজের নার্ভাসনেস ঢাকবার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে।হঠাৎ হঠাৎ একটু আনমনা হয়ে যাচ্ছে।কিন্তুর তার এই আনমনা ভাব শুধু একজন ছাড়া আর কেউ টের পাচ্ছে না।সেই একজন হলো দিলু।ঠাললু আর তার লোকজন এক জায়গায় এক সংগে নেই।তারাও আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সময় হলে তারা চলে যাবে জায়গামতো।
রহিমা বেগম দিলুকে ইশারা করলেন।ইশারার কোড হলো- রহিমা বেগম পার্স থেকে টিস্যু নিয়ে ঘাম মোছার ভঙিমায় মুখমন্ডল মুছে নদীর জলে ফেলে দিবেন।তিনি পর পর দুইটি টিস্যু দুইবার ব্যবহার করবেন।
দিলু ইশারা পেয়ে দেবারতিকে বললো – খাবারের ঘোষনা দিতে।দেবারতি মিহিন কণ্ঠে ঘোষণা দিলো: ‘সুপ্রিয় অতিথিবৃন্দ, আনন্দময় ভ্রমণে সকলকে স্বাগতম। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবেশিত হতে যাচ্ছে মধ্যাহ্ন ভোজ।যথা সময়ে অংশগ্রহণের জন্য সকলের প্রতি বিনীত অনুরোধ রইলো। আজকের মনোরম আয়োজনে আমাদের সংগে থাকবার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।’
ভোজ শুরু হয়ে গেছে।একেকজনকে দেখে মনে হচ্ছে যেনো হাজার বছর ধরে উপোস।নাক ডুবিয়ে খাচ্ছে।সবাই দেখছে রহিমা বেগম খেতে না বসে খাবার তদারকি করছেন।কিন্তু রহিমা বেগম ছাড়াও যে আরো কয়েকজন খাবারের টেবিলে অনুপস্থিত তা কেউই খেয়াল করে নি।করবার কথাও নয় কেননা বিষয়টির মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই।সবাই এক সংগে খাবেই- এমন তো কোনো কথা নেই।দু’চারজন অনিবার্য কারণে পরে খেতেই পারে- খুব স্বাভাবিক। তাই এসব কারোরই ভাবনার বিষয় নয়।ভাবনার বিষয় হলো- জাহাজের ক্যাপ্টেন মনে হয় কোনো কিছু আঁচ করতে পেরেছে আর এই বিষয়টি পরিষ্কার টের পাচ্ছে দিলু।দেবারতিকে দিলু বললো- তুমি একটু ক্যাপ্টেনের কক্ষে
গিয়ে ক্যাপ্টেনকে সময় দাও।
ক্যাপ্টেনের কক্ষে কেনো যেতে হবে বুঝতে না পেরে দেবারতি প্রশ্ন করলো – কেনো!
হাতে গোনা কয়েকজনের বাইরে যারা অপারেশন সম্পর্কে কিছুই জানে না দেবারতি তাদের মধ্যে একজন। মেয়েটার জন্য অই মুহুর্তে দিলুর বড্ড মায়া হলো।কিন্তু মায়া করার সময় এখন নয়।ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে হবে খুব দ্রুত যেহেতু অপারেশন প্রায় শুরু হয়ে গেছে।যে যার মতো পজিশন নিয়ে নিয়েছে।মনের মধ্যে কোনো অজানা সন্দেহ উঁকি দিলেও দেবারতি যেনো কথা না বাড়াতে পারে এজন্য দিলু বললো : ম্যাডাম আমাকে বলতে বললো তাই আমি তোমাকে বললাম।কেনো যেতে হবে আমি জানি না।এখন তোমার ইচ্ছা।গেলে যাবে, না গেলে নাই।
ম্যাডামের কথা বললে না যাওয়ার উপায় নেই,অগত্যা দেবারতিকে যেতেই হলো।অল্প কিছুক্ষণ পর দিলু আবিষ্কার করলো চালে ভুল হয়েছে।ক্যাপ্টেন ছোকড়া বড্ড শেয়ানা।দেবারতি কক্ষে প্রবেশ করায় ক্যাপ্টেনের সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়েছে।দিলু ঠাললুকে ফাইনাল সিগনাল দিয়ে দিলো।
দিলুর সিগনাল পেয়ে ঠাললু এন্ড গং ১১ মিনিটের মাথায় জাহাজে পানি ঢুকবার সমস্ত ব্যবস্থা ফাইনাল করে ফেললো।জাহাজে পানি ঢুকা শুরু হয়ে গেছে।আর এক মুহুর্তও দেরি করা যাবে না।দিলু ক্যাপ্টেনের কক্ষে প্রবেশ করে দেবারতিকে ইশারায় চলে যেতে বললো।
দিলুর চেহারায় এমন একটা কিছু ছিলো যা দেখে দেবারতি মনে হয় একটু অপ্রস্তুত হয়েই কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলো।কক্ষে দিলুর প্রবেশ ও দেবারতির প্রস্থান এতো দ্রুত ঘটলো যে ক্যাপ্টেন কিছু বুঝে উঠবার আগেই টের পেলো তার মাথার পেছন দিকটা ছুঁয়ে আছে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের নল।
দিলু বললো- কোনো শব্দ হবে না।জাহাজ চলতে থাকবে মাঝ দরিয়া বরাবর।ক্যাপ্টেন অবাক হচ্ছে এই ভেবে যে, যে-অনুষ্ঠানের জন্য জাহাজ ভাড়া করা হয়েছে এখানে এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটার তো কোনো কারণই নেই।যদি ডাকাত পড়তো তাও যুক্তি ছিলো কিন্তু এরা তো এখানে সবাই দলের লোক।ডাকাত পড়ার তো কোনো প্রসংগই নেই।তাহলে বিষয়টা আসলে কী?জাহাজেই বা পানি ঢুকলো কীভাবে।কিছুক্ষণ পর যাত্রীরাও টের পেয়ে যাবে।জাহাজ দ্রুত তীরে না ভিড়ালে এবং যাত্রীরা যদি স্পিড বোট লাইফ জ্যাকেট বা টায়ারের সাহায্য নিয়ে জাহাজ থেকে সরে যেতে না পারে তাহলে তো সবাই ডুবে মরবে।কী সর্বনাশ!সবাইকে ডুবিয়ে মেরে লাভটাই বা কী কিংবা কার বা কাদের লাভ?ক্যাপ্টেনের মাথা কাজ করছে না।বরং সে একই সংগে প্রচন্ড বিস্মিত ও আতঙ্কিত। সে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুচ্ছে না যেনো তার মুখ জিহ্বা প্যারালাইজড হয়ে গেছে।এখন আল্লাহ ছাড়া হেল্প করার আর কেউই নেই।সে মনে মনে দোয়া দরুদ পড়তে শুরু করলো।
রহিমা বেগম আবার ইশারা করলেন।ইশারার কোড – পানি খেতে গিয়ে একটা কাচের জগ ভেঙে ফেলা।রহিমা কাচের জগ ভাঙতে না ভাঙতেই কোথা থেকে যেনো বা মাটি ফুঁড়ে জল ফুঁড়ে নদীতে জাহাজ ঘেঁষে হাজির হলো দুইটা স্পিড বোট।রহিমাসহ পূর্ব নির্ধারিত ১০ জন বোটে উঠে পড়লো।সবাই ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল। কী ঘটছে কেউ বুঝতে পারছে না শুধু বিস্ময় নিয়ে বোকার মতো তাকিয়ে থেকে রহিমা বেগমদের বোটে করে চলে যাবার দৃশ্য দেখছে আর আতঙ্কে স্থবির হয়ে পড়ছে।
এক সময় সবাই টের পেলো জাহাজ ডুবতে শুরু করেছে।সবাই মিলে ঝিলে চিৎকার শুরু করেছে।দুই চারজন বুদ্ধি করে ক্যাপ্টেনের কক্ষে যেতেই গুলির শব্দ।মানুষগুলি দরোজার কাছেই লুটিয়ে পড়লো।
স্পিডবোটে রহিমা বেগমের মোবাইলে দিলুর ফোন থেকে কল এসে ক্রমগত বেজেই চলেছে কিন্তু রহিমা রিসিভ করছে না।রহিমা রিসিভ করবে না কারণ সে চায় না কেউ তার কাজের সাক্ষী থাকুক।বোটে অন্য যারা আছে তাদের ঘোর এখনো কাটে নি যদিও তারা জানতো যে, দৈবাৎ কোনো সমস্যা হলে স্পিডবোট
রেডি করা আছে,তারা যেনো বোট আসলে সঙ্গে সঙ্গে বোটে উঠে পড়েন কিন্তু বোট যে মাত্র দুইটা আসবে আর পুরো জাহাজই যে তলিয়ে যাবে এ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারনাই ছিলো না।তারা নিজেরাও কনফিউজড যে তারা কি জলে ভেসে আছেন নাকি ব্যাপারটা এরকম যে তারাও জলে তলিয়ে গেছেন কিন্তু তারা বুঝতে পারছেন না।তাদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে রহিমা মজা পাচ্ছেন আর মনে মনে মিটি মিটি হাসছেন।রহিমার সেই রহস্যময় হাসির শব্দ কেউ শুনতে পেলো না।
ঠাললু এন্ড গং- এর সবাই হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাপাটেনের কক্ষের কাছে।গোদা তিল্লি ঠাললুকে দিশেহারা ভঙিমায় প্রশ্ন করলো- বস, আসল খা*ন*কি*র পোলা কোন খা*ন*কি*র পোলায়?
উত্তরে ঠাললু কিছু না বলে দিলুর দিকে পিস্তল তাক করে নিমিষেই দিলুকে ঝাঝরা করে দিলো।সমগ্র জাহাজে কেয়ামত নেমে এসেছে।আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত যাত্রী নিয়ে ‘এম ভি কাউয়ার চর’ তলিয়ে যাবে মাঝ দরিয়ায়। ক্যাপ্টেনের কানে ক্রমাগত বেজে চলেছে Casabianca কবিতার সেই বিখ্যাত লাইন:
‘Speak, father!’ once again he cried,
‘If I may yet be gone!’
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন