রাত তখন তিনটা ছুঁই ছুঁই। পুরো শহর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শুধু জানালার বাইরে একাকী পথবাতিগুলো জেগে আছে, তাদের ক্ষীণ আলোয় ছড়িয়ে পড়ছে নরম হলুদ আভা। ঘরের কোণে বসে আছে ত্রিশা।
জানালার কাঁচের ওপাশে আকাশটা ভারী হয়ে আছে মেঘে। বাতাসের একটা নরম ঝাপটা এসে পর্দার কোণা উল্টে দিচ্ছে। কোথাও একটা রাতজাগা পাখি ডাকছে, আর ত্রিশার সামনে পড়ে থাকা ডায়েরির পাতাগুলো অস্পষ্টভাবে দুলে উঠছে বাতাসের ছোঁয়ায়।
ডায়েরির ধূলিমাখা প্রথম পাতায় চোখ পড়তেই মনে পড়ে গেল সেই পুরোনো অনুভূতিগুলো—
“কেউ একজন এসেছিল… ভালোবাসেনি, তবে অসম্ভব মায়ায় বেঁধে গেছে আমায়।“
ত্রিশার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। হাতের আঙুল ডায়েরির পাতার ওপর ধীরে ধীরে বুলিয়ে নিলো। কিছু স্মৃতি এমন হয়, ভুলতে চাইলেও ভোলা যায় না।
এটা ছিল আরিয়ানের কথা।
সেদিন ছিল শ্রাবণের এক অলস বিকেল। আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা, একটা নরম কুয়াশার আস্তরণ যেন পুরো শহরটাকে ঢেকে রেখেছিল। বাতাস ভারী হয়ে ছিল আসন্ন বৃষ্টির আভাসে। রাস্তায় তখনও মানুষের ভিড়, কোলাহল, গাড়ির হর্ন—সব মিলিয়ে একটা অস্থিরতা।
কিন্তু ক্যাফের ভেতরটা ছিল একেবারে আলাদা।
ত্রিশা তখন এক কোণে বসে, এক কাপ কফির ওপর চোখ রেখে কী যেন ভাবছিল। পাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে দেখা যাচ্ছিল, বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে। কাচের ওপরে জমে থাকা পানির ফোঁটাগুলো ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে নিচের দিকে।
ঠিক তখনই ক্যাফের দরজা ঠেলে ঢুকল আরিয়ান।
চোখে পড়ার মতোই একটি ছেলে। ভিজে চুল, চোখে গভীর এক অন্যমনস্কতা, আর হাতে ধরা একটা মোটা বই। সে ধীর পায়ে কাউন্টারের দিকে গেল, কফির অর্ডার দিল, তারপর চারপাশে তাকাল।
ত্রিশার মনে হলো, এই ছেলেটার চোখের গভীরে এক অদ্ভুত শূন্যতা লুকিয়ে আছে।
সেদিন কিছু অদ্ভুতভাবে ঘটেছিল।
ক্যাফের ভেতর ভিড় ছিল না খুব একটা। আরিয়ান তার কফি নিয়ে এসে ঠিক ত্রিশার উল্টো দিকের টেবিলে বসেছিল। দুজনের মাঝে কোনো কথা হয়নি প্রথমে, কিন্তু ত্রিশা লক্ষ করছিল—ছেলেটা বেশ অন্যরকম।
কিছুক্ষণ পর, অপ্রত্যাশিতভাবে আরিয়ান বলল,
“তুমি কি সবসময় এভাবে চুপচাপ বসে থাকো, নাকি আজ মনটা বেশি ভারী?”
ত্রিশা চমকে গেল। কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলল,
“তুমি কীভাবে বুঝলে?”
আরিয়ান হাসল না, কেবল একগুঁয়েভাবে কফির কাপে চুমুক দিল।
“বেশি চুপচাপ থাকা মানুষদের দেখলে বোঝা যায়।“
ত্রিশা হেসে বলল,
“তাহলে তো তুমিও আমার মতো। তুমিও বেশ চুপচাপ।“
আরিয়ান একটু হাসল এবার,
“সবাই একা, কেউ মানুক বা না মানুক।“
সেদিন কথাগুলো ছোট ছিল, কিন্তু যেন এক গভীর বন্ধনের সূচনা হয়ে গেল।
সময় পেরোতে লাগল, কথার পরিধি বাড়তে লাগল।
“তুমি কী করতে ভালোবাসো?”
“পড়তে। পুরোনো বইগুলোর মধ্যে এমন কিছু লাইন থাকে, যা আমাদের জীবনটাই বদলে দিতে পারে।“
“তুমি কি কখনো কাউকে ভালোবেসেছ?”
“ভালোবাসা জটিল কিছু নয়, তবে এটাকে জটিল বানিয়ে ফেলি আমরা নিজেরাই।“
আরিয়ানের সংলাপগুলো সবসময় ছোট, কিন্তু ভেতরে একটা গভীরতা ছিল।
ত্রিশার অনুভূতি বদলে যাচ্ছিল। সে অপেক্ষা করত আরিয়ানের জন্য। হয়তো এটা ভালোবাসা ছিল, হয়তো কেবল মায়া।
কিন্তু আরিয়ান কখনো বোঝাতে দেয়নি, সে কী অনুভব করে।
একদিন সাহস করে ত্রিশা জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কি কখনো এমন কাউকে পেয়েছ, যাকে ছাড়া জীবন ভাবতে পারো না?”
আরিয়ান একটু চুপ করে থাকল, তারপর শান্ত গলায় বলল,
“পেয়েছিলাম। কিন্তু কিছু মানুষকে চাইলেও ধরে রাখা যায় না।“
ত্রিশার মনে হলো, সে কখনোই এই মানুষটাকে পুরোপুরি বুঝতে পারবে না।
তারপর একদিন হঠাৎ করেই সব বদলে গেল।
এক সন্ধ্যায় ক্যাফেতে দেখা হলো না আরিয়ানের সাথে। পরদিনও না। এক সপ্তাহ কেটে গেল, সে এল না।
ত্রিশা খুঁজতে গেল। শেষ পর্যন্ত, তার পুরোনো ঠিকানায় গিয়ে শুনল,
“সে চলে গেছে। অনেক দূরে।“
ত্রিশার নিঃশ্বাস আটকে আসছিল।
কেন?
কোথায়?
কেউ জানত না।
ত্রিশা আজও জানে না কেন আরিয়ান চলে গেল। হয়তো তার জীবনে এমন কিছু ছিল যা সে কাউকে জানাতে চায়নি। হয়তো সে তার শূন্যতা নিয়েই বাঁচতে চেয়েছিল।
ত্রিশা জানালার ধারে বসে আছে, ডায়েরির পাতায় চোখ রেখে।
সে লিখল—
“কিছু সম্পর্ক কখনো পূর্ণতা পায় না, কিছু প্রশ্নের কোনো উত্তর থাকে না। কিছু মানুষ মায়া হয়ে আসে, অথচ থেকে যায় একটা শূন্যতা হয়ে।“
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন