কালিদাস রায়

কবিতা - ছাত্রধারা

লেখক: কালিদাস রায়

বর্ষে-বর্ষে দলে-দলে আসে বিদ্যামঠতলে,
চলে যায় তারা কলরবে,
কৈশোরের কিশলয় পর্ণে পরিণত হয়
যৌবনের শ্যামল গৌরবে |
ভালোবাসি, কাছে ডাকি, নামও সব জেনে রাখি,
দেখাশোনা হয় নিতি-নিতি,
শাসন-তর্জন করি শিখাই প্রহর ধরি,
থাকেনাকো, হায়, কোনো স্মৃতি!
ক-দিনের এই দেখা— সাগর সৈকতে রেখা
নূতন তরঙ্গে মুছে যায় |
ছোট-ছোট দাগ পার ঘুচে যায় একাকার
নব-নব পদ-তাড়নায় |
জানে না কে কোথা যাবে, জোটে হেথা তাই ভাবে
পাঠশালা,— যেন পান্থশালা,
দু-দিন একত্রে মাতে, মেলে-মেশে, বসে গাঁথে
নীতি-হার আর কথা-মালা |
রাজপথে দেখা হলে কেহ যদি গুরু বলে
হাত তুলে করে নমস্কার,
বলি তবে হাসিমুখে— “বেঁচে-বর্তে থাকো সুখে,”
স্পর্শ করি কেশগুলি তার |
ভাবিতে-ভাবিতে যাই— কি নাম? মনে তো নাই,
ছাত্র ছিল কত দিন আগে ;
স্মৃতি সূত্র ধরি টানি, কৈশোরের মুখখানি
দেখি মনে জাগে কি না জাগে |
ঘন-ঘন আনাগোনা কতদিন দোখাশোনা,
তবু কেন মনে নাহি থাকে?
“ব্যক্তি” ডুবে যায় “দলে”, মালিকা পরিলে গলে
প্রতি ফুলে কে বা মনে রাখে?
এ জীবন ভেঙে-গড়ে শ্যামল-সরস করে
ছাত্রধারা বয়ে চলে যায়,
ফেনিলতা-উচ্ছলতা হয়ে যায় তুচ্ছ কথা,
উত্তালতা সকলি মিলায় |
স্বচ্ছতায় শুধু হেরি আমার জীবন ঘেরি
ভাসে শুধু ম্লান মুখগুলি ;
ভুলে যাই হট্টগোল অট্টহাসি-কলরোল,
ম্লান মুখ কখনো না ভুলি |
কেহ বা ক্ষুধায় ম্লান, কেহ রোগে ম্রিয়মান,
শ্মে কারো চাহনি করুণ,
কেহ বা বেত্রের ডরে বন্দী হয়ে রয় ঘরে,
নেত্র কারো তন্দ্রায় অরুণ |
কেহ বাতায়ন-পাশে চেয়ে রয় নীলাকাশে
যেন বদ্ধ পিঞ্জরের পাখি,
আকাশে হেরিয়া ঘুড়ি মন তার যায় উড়ি,
মুখে কালো ছায়াখানি রাখি |
স্মরিয়া খেলার মাঠ কেউ ভুলে যায় পাঠ,
বুদ্ধিতে বা কারো না কুলায়,
কেহ স্মরে গেহকোণ, স্নেহময় ভাইবোন—
ঘড়ি-পানে ঘন-ঘন চায় |
ডাকিছে উদার বায়ু লয়ে সাস্থ লয়ে আয়ু,
ডাক শোনে বসে রুদ্ধ ঘরে,
হাতে মসী, মুখে মসী, মেঘে ঢাকা শিশু-শশী—
প্রতিবিম্বে মোর স্মৃতি ভরে |
আর সবি গেছি ভুলি, ভুলিনি এ মুখগুলি,
একবার মুদিলে নয়ন
আঁখিপাতা ভারি-ভারি, ম্লান মুখ সারি-সারি
আকুল করিয়া তোলে মন |

এখন পর্যন্ত লেখাটি পড়া হয়েছে ৭৮৯ বার
যদি লেখাটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন