একটি শহর কতটা বড়, তা এর দৈর্ঘ্য কিংবা প্রস্থ দিয়ে পরিমাপ করা যায় না, বরং তা পরিমাণ করতে হয় সেখানকার লোকদের স্বপ্ন দিয়ে, ইচ্ছা দিয়ে, জীবন যাপনের ধরণ এর মধ্য দিয়ে। তবে এই শহরে থাকার ইচ্ছাটা আমার হারিয়ে গেছে।তবে এই শহরেই হারিয়ে ছিলাম আমি নিজেকে, আর নিজেকে হারিয়ে পেয়েছিলাম তোমাকে, আজ তুমিও নেই আমার পাশে, তাই আমি ফিরে এসেছি এই শহরেরই খুব চেনা গলিতে, তোমার আবার প্রথমবারের মত ফিরে পাওয়ার আশা নিয়ে।তুমি ফিরবে না জানি।
তবে ভীষণ অবাক লাগে যখন এই শহর নিজেকে একা লাগে। আসলে এত মানুষ থাকার পরও শহরে থাকা মানুষের একাকীত্ব কখনোই দূর হবে না, কারণ তারা নিজের জন্য সময় বের করে না, অন্যের জন্যও সময় বের করতে অক্ষম, ফলে আশেপাশে সবাই থাকা সত্ত্বেও তারা একা। তবে ভবিষ্যতে এ শহরটা বোধহয় আরো অচেনা হয়ে যাবে। মাটির নিচে চাপা পড়েছে স্মৃতি, দূরের আকাশ সাক্ষী, সত্য নাকি মিথ্যা জানিনা সে একদিন হলেও বলেছিল “ভালোবাসি” এখন সেই তুমি একই মুখে কাকে বলো “ভালোবাসি” ?
গত দশ বছরে শহরটা অনেক বদলে গেছে। জেনরেশন জ্যেডের দখলে শহরটা, এ শহরের ভবিষ্যৎ কি জানি না??মনে আছে তোমার আমাদের বিচ্ছেদ কেন হয়ছিল! তখন ব্যাপ্যারটা অনেক বড় ব্যাপার হলেও আজকাল ওটা তুচ্ছ ঘটনা। তাই আসলে এমন করে জিজ্ঞাসা করছি। তখন আসলে চোখ লজ্জা বলে একটা শব্দ ছিল। এখন তো সব হারিয়ে গেছে।এ শহরে আগের মতো মানুষ থাকলেও তাদের মধ্যে ভালোবাসা বা আন্তরিকতা তেমন একটা থাকে না, থাকে শুধু কর্ম ব্যস্ততার মধ্যে থাকা এক একটা রোবট।
সবে সবে আমরা স্মার্ট ফোন ব্যবহার করা শিখেছি তাই ফ্রিতে হোইফাই পেলেই আমরা ভিডিও কল করতাম। কল ধরতে চাইছিলে না তুমি, বলছিলে “অফিসে আজও।”
“রবিবার আর কিসের অফিস।”আমি প্রশ্ন করেছিলাম।
তুমি বললে “স্পেশাল ইভেন্ট”
জোর করে কল করলাম। তুমি বাথরুমে এসে কথা বললে। বথারূমটা আমার খুব চেনা। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি সন্দেহ করি নি তোমাকে একটুও। অথচ গত পোনেরো দিন ধরে আমি ঐ বাথরুমে করছিলাম। কিন্তু ঈশ্বরে ইচ্ছা ছিলো হয়তো আমাদের সম্পর্ক টা তাই লাঞ্চ টা আমি সার্ভিস করতে গেলাম। বিবস্ত্র তুমি সাদা বিছানায় সাদা চাদর জরিয়ে দারুণ মায়াবী লাগছিলো তোমায়। আমাকে রুম বয়ের পোশাক দেখা ও চিনতে পেরেছিলে। তাই চোখ জ্বলে ওঠে ছিলো অজানা ভয়।
তারপর এক মাস পর বাড়িতে ফিরলাম। তোমার একটা চিঠি আর সই করা ডিভোর্স ফর্ম। কেন আমাদের ডিভোর্স হচ্ছে কেউ জানতে পারলো না। আমি কিভাবে লোক জনকে জানাতাম আমি রুম বয় কাজ করছি।
ও তোমাকে তো বলি নি সে কথাটা যে আমি হোটেলে কাজ করছি। আমি যে আজ বিদেশে চাকরি পেয়েছি। তার জন্য দুই লাখ টাকা দিতে হয়েছে সার্ভিস চার্জ হিসাবে। রুম বয়ের কাজ। কিন্তু কিভাবে ক্লিনিং করতে হয়, কিভাবে বেড বানাতে হয়। কিছুই জানি না। তাই রাহুল দাই পার্ক স্ট্রিট এর হোটেল কাজ দিয়ে ছিলো। বলেছিলো এক মাস কাজ করলেই সব শিখে যাবি। আমি তোমাকে তাই ও কথা বল নি। বলেছিলাম মুম্বাই যাচ্ছি চাকরি খুজতে। অথচ শহরে ছিলাম।
সত্যি টা জানলে তুমি কি আমাকে হোটেলে কাজ করতে দিতে। তুমি বলতে একটা ক্যামেরা কেনো, ওয়াইড ফটোগ্রাফি করো। তোমার কথায় কারণ ছবি টা নাকি আমি আমি ভালো তুলি। রঙীন শহর আমার প্রতিযোগী প্রচারের ভীষন চোখ ধাঁধানো আলোয়, এ শহরে আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার আর হয়ে যাচ্ছিলো। ।ব্যস্ত শহর, একলা আমি, ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল আমার দুচোখ, স্বপ্নগুলো আমার অনেক দামি মনে হচ্ছিল। তাই আপোষ করলাম। গলা টিপে মেরে ফেললাম ফটোগ্রাফার হবার স্বপ্নটাকে। বিয়ের বাড়িতে ফটোগ্রাফি করতে গেলে তখন আরো পাঁচ লাখ টাকা লাগতো। তাই পুরোনো ক্যামেরাটা বেচে আর কিছু লোন করেই বিদেশে চাকরি করতে যেতে চেয়েছিলাম। আমি চাইতাম তুমি পড়াশোনা চালিয়ে যাও। কিন্তু মরে গেছে আজ দুই জনের স্বপ্ন। এটাই হয়তো ভাগ্যলিখন।
বললতো শহরে এতো হোটেল থাকতে তোমার বস ঐ হোটেলে কেন নিয়ে গেলো। আমি সত্যিই বলছি তোমার ওপর সে দিন রাগ করি নি। তোমার সব বন্ধুরা দামি দামি পোশাক পরে, দামি দামি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, ওইক এন্ড রেস্টুরেন্ট খেয়ে ছবি পোস্ট করে। আমি তো তোমাকে কিছু দিতে পারি নি। তাই তোমার চাকরি উন্নতির জন্য ওসব করাটা প্রয়োজনীয় ছিল।
আজকাল এ গুলো ছোট খাটো ব্যাপার। জানো স্বেতার বুক টাও ঠিক তোমার মতো ফর্সা। লাল নিপিল, আর একটা তিল আছে ঠিক তোমার মতো বিভাজিকায়। সেইদিন লাভ বাইট দোওয়ায় লাল হয়ে গিয়েছিলো বুকটা। আমি ওকে ছাড়া আধা ঘণ্টা পর ওর বড় ফিরে এসেছে বাড়িতে। ওর কথায় ওর শোবার ঘরটা নাকি এক রকম কশাই খানা। ও একটু ভয় পেয়েছিলো। উনাকে বোধহয় উনার ভাই খবর দিয়েছে আমরা নাইট ক্লাবে ছিলাম। কিন্তু পরে জানলাম সব কিছু ঠিক আছে। তবে এ সপ্তাহে ওর দেওর সাথে ওকে নাইট ক্লাবে যেতে হবে। ও বললো ” ও বললেও, মিষ্টার বোস আমাকে কখনো ডিভোর্স দেবে না। কিন্তু উনার ভাইকে আমার বাপিকে আমার ভালো লাগে। রেগুলার জিমে যায়। আশা করি মজা দেবে। ”
আমার ওর কথা শুনে কষ্ট হবার কথা। কিন্তু সত্যিকারে বোধহয় আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা শারীরিক। ভালোবাসা নেই।তাই আমি ও অর্পিতা সাথে চ্যাটে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। এ শনিবার স্বেতা থাকবে না। কিন্তু শহরে রঙীন রাত আসবে, রাতটাও জেগে থাথাকে। আজকাল ৎব্যস্ত শহর জেগে থাকে, সন্ধ্যে রাতের হলদে বাতির আলোয়, ফুটপাথ, খোলা সড়ক, রাত জেগে থাকে , চাপা কোলাহলে বেঁচে থাকে। এই শহরে কোথাও স্বপ্ন নেই, বিশ্রাম নেবার মতো অন্ধকার নেই, ভালবাসা নেই। এই শহরে দিন দুপুরেও শোনা যায় মৃত মানুষের হাহাকার। আবর্জনা আর কোলাহলে ভরপুর এই শহর।ধুলোবালির এই শহরে কিছুই ভাল্লাগে না, পেটের দায়ে এই শহরের সময় শুধু ছুটে চলেছে। এই শহরের আকাশ ধূসর— যান্ত্রিকতায় ভরা জীবন, হাসি নেই ঠেঁটে। হাসি হিসেবে যেটা দেখো সেটা শুধুমাত্র অভিনয়। এই শহরে ভালোবাসা নেই, যা আছে, তা হলো মিথ্যা অভিনয়।
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন