কলাগাছের ভেলা
কলাগাছের ভেলা
মানব মন্ডল

গল্প - কলাগাছের ভেলা

মানব মন্ডল
বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫ অন্যান, জীবনবাদী

রবিবার সকাল থেকে বিলের জল বড় ছিল দেখে ছোট শাশ্বত বেশ খুশি হচ্ছিলো। সে ঠিক করেছিল এই বৃষ্টিতে সোমবার আর স্কুলে যাবে না।  বৃষ্টি  ধরবে আনেক আর সারাদিন ওর তৈরি কলা গাছের ভেলায় ঘুড়ে বেড়াবে বিল ময়। কিন্তু কয়েকটি ঘন্টায় সব কিছু বদলে গেলো।টিভিতে আবার বন্যার থৈ থৈ জলে ডুবে যাওয়া কোনো দুর্গত গ্রামের ছবি ও দেখেছে। হাটু জলে স্যাঁতার কেটে টিআরপি বাড়ানো রিপোটারকে ও দেখছে। কিন্তু ও প্রথম গ্রামকে গ্রাম ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া জলের স্রোতে অনিশ্চিত জীবনের মুখমুখি প্রথম হলো।

যে স্কুলে ও যেতে চাইছিলো না সেই স্কুলে ওর আশ্রয় নিতে হলো। সেইদিন কলার ভেলাটা বানানো নিয়ে ওকে ওর বাবার হাতে মার খেতে হয়েছিল। মৌলবী সাহেব ওর বাবাকে  অভিযোগ করেছিলো কলা গাছ গুলো নাকি ওরা বাজারে বেচতো থোর হিসাবে শাশ্বত ও গুলো নিয়ে ভেলা বানানোতে ওদের ক্ষতি হয়ে গেছে। কিন্তু আজ ওই ভেলাটা মৌলবী সাহেবের বুড়িমা স্কুল অবধি নিয়ে আসতে ওরা নিরাপদে।
মৌলবী সাহবের মেয়ে সারার অহঙ্কার মাটিতে পা পরে না। দোতলা বাড়ি ওদের ওরা ভেবেছিলো ওদের কিছু হবে না। কিন্তু রান্না ঘরটা ডুবে গেলো হঠাৎ টি। রান্না করবে কোথায়। স্কুল তবুও সাহায্য আসবে। মাস্টার মশাই মজিদ গিয়ে ঘোষণা করিয়েছে  সকলকে স্কুলে আসতে। স্কুলের মজুত থাকা চালডাল দিয়ে এখনো দশবারো দিন চলে যাবে। কিন্তু তাই বা আসবে কোন পথে। রেল বন্ধ, সড়ক বন্ধ, চারদিকে অথৈ জল।রিলিফ এলে স্কুল বাড়ি অবধি আসবে।
ওর ভালো লাগলো নিরু মাষ্টার কথা আজ সবাই শুনছে। নয়তো ঐ মৌলবীর আর প্রধানের কথা শেষ কথা। কয়েক আগের বছর যখন সুন্দর বন জলে ভাসছিলো, তখন প্রধান রাম দার চায়ের দোকানে বসে বলছিলো ” আমার কপাল খারাপ রে রাম, এদিকে যদি বন্যা হতো। ত্রিপল বেচে বাড়িটা দোতলা করে নিতাম। আমার খালাতো ভাই দেখ নতুন ঘর করেছে ছবি পাঠিয়েছে। ”
সত্যি তো ২০০০ সালের পর এমন বন্যার মুখোমুখি হতে হবে, এ কল্পনাও করতে পারেনি  নদীয়া বাসিন্দারা। আসলে বাওর গুলো পরিস্কার হয় নি। রাস্তা তৈরি হয়ছে মাঠের মাঝখানে দিয়ে অথচ কোন নিকাশি ব্যবস্থা । রামু কাকা তাকিয়ে রয়েছে ডুবে ডুবে যাওয়া মাঠটার দিকে। বেশি ভাগ লোক এখন গ্রাম ছেড়ে কাজ করতে যায় বাইরে। ওর চায়ের দোকান তেমন চলছে না। মরসুমের শুরুতে ধারদেনা করে চাষ করে সবে মাত্র সামান্য সবজী তুলেছে ও। ফলে চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়েছে ওর মতো চাষিদের।  
বেশি বকবক করছে না আজ পঞ্চায়েত প্রধান । আজ প্রধান চুপ করে বসে আছে।ভিজছে খুব ও। ভিজে শরীর সেঁধিয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। বামুন ঠাকুর নামবলি দিয়ে ওর মাথা মুছিয়ে দিচ্ছে। প্রধানের ধর্ম মুসলিম  উনি ভুলে গেছেন আজ।  একবছর ওদের কথা বন্ধ ছিলো ,আগের দূর্গা পূজা নিয়ে কত কুট ওরা উক্তি করলো, উনি সব ভুলে গেছে আজ।উত্তর বঙ্গ বন্যা যখন ভাসছিলো তখন কলকাতা শহরে উৎসব চলছিলো। এখন বন্যা হলে রিলিফ পাঠানোর বদলে বড় বড় নেতারা একে ওকে দোষ দেয়। রিলিফ পাঠানোর কথা ভাবে না।  কিন্তু কে দায়ী এই বানভাসির জন্য কিন্তু প্রকৃতি কি দায়ী এই বন্যা গুলোর জন্য?? সুন্দরবনের বন্যার প্রধান কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। আর এই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তো দায়ী মানুষের দুষণ।
বাপ্পাদা সেই দিন বলছিলো উত্তর বঙ্গে বন্যা হলে অবস্থা খুব খারাপ হবে। দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলের অসুখটা খুব পুরোনো। মাটি ক্ষয়ে যাওয়া এবং ধস, ব্রিটিশ সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল এক সময়। ১৯০৯ থেকে ১৯১৩-র মধ্যে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কিছু কমিটি গঠন করেছিলেন বনধ্বংস বা ডিফরেস্টেশনের প্রভাব বুঝতে। তারা ধসের পিছনে দায়ী পাহাড়ের সাধারণ মানুষের পশুচারণ। তার চেয়েও আরও বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হলো পাহাড়িদের পানিক্ষেত। অর্থাৎ, যে চাষে জল বা পানি বেশি লাগে যেমন, ধান ও বড় এলাচ। সমস্যার সমাধান ক্ষেতের মাঝে নতুন করে গাছের বাগিচা বা প্ল্যান্টেশন করার কথা। সবাই জানতো সাধারণ মানুষের চাষ আদৌ সমস্যা নয়। কিন্তু তাকে দোষী সাব্যস্ত না করলে তাদের বাগিচা শিল্প বা প্ল্যান্টেশন ইন্ডাস্ট্রি গড়েই উঠত না।
ব্রিটিশ ভারত থেকে আজকের দিন পর্যন্ত, পাহাড়ি ঢালে যত চা বাগিচা হয়েছে, বনধ্বংস বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। সেই সঙ্গে পাহাড় কেটে বড় নির্মাণ, রাস্তা বানানো, বাঁধ ইত্যাদি, আরো বনধংস। ফলে, পাহাড়বাসীর কাছে ধস এখন নিত্যদিনের বিপদ। আগ ভুমি ক্ষয় জন্য নদী গুলো নব্যতা গেছে। তাই বেশি বৃষ্টি হলেই বন্যা হবেই।

পরশু থেকে আজ অবধি বাপ্পা দা তার ঠাকুর দার আমলের ভাঙা নৌকায় কতবার যে কত জায়গায় খেপ মেরে লোক তুলে এনেছে ঠিক নেই। ওর চেহারায় ক্লান্তিহীন হাসি। কিন্তু শরীর নেতিয়ে পড়ছে, হাত চলতে চাইছিলো না। শাশ্বত মাথাও তো ঝিমঝিম করছে। বাপ্পাদা একটু কিছু খেতে চাইছিলো। বাপ্পাদার দোষ কোথায়। কিন্তু মাস্টার মশাই জানালো মোল্লা পাড়ায় সাবানাদের আনতে হবে। ও আবার ছুটলো। শাশ্বত কলার ভেলাটা নিয়ে অপেক্ষা করছিলো পরের ফোন কলটার জন্য। মাধবী দিদি ভাই দের আনার দায়িত্ব পড়লো ওর। ইস ওকে বাপ্পাদা আনতে গেলে ভালো হতো।

মাধবী দিদিভাই  ভয় পাচ্ছিলো ওর কলার ভেলায় ওঠতে। পরে ওঠলো। একটা বিস্কুট এগিয়ে দিয়ে বললো কিছু খেয়েছিস। নে বিস্কুট খা। ও এই সুযোগটা খুজছিল, এটার ও বললো ” ওটা বরং বাপ্পাদার জন্য রেখে দাও ও তো কাল থেকে কিছু খায় নি। ”
মাধরী দিদিভাই চোখে জল। ওদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে কিছু দিন আগে। বাপ্পাদার দোষ বেশি পড়াশোনা তো করেছে শহর গিয়ে কাজ করতে পারে। এখানে টিউশনি করে ক টাকা রোজগার হয়। বিয়ে থা করতে হবে না ওদের এই নিয়ে ঝগড়া হয়েছে প্রতি বারে মতো। কিন্তু এবারের টা বাড়াবাড়ি হয়েছে। এ গ্রামের ঘটক শ্যামলদা খুব আসা যাওয়া করছে ওদের বাড়ি।
মাধুবি দিদিভাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে বললো
” তুই বেশি পাকামি না করে খেয়ে নে।  ওর ব্যাপারটা দেখছি। আমি চিরে কলা নিতেই বাড়ীতে এসেছিলাম। ওকে আমি কিছু খাইয়ে দেবো। ”
শাশ্বত ভাবলো ওর ছোট ভেলাটা কোন মানুষের প্রান বাঁচাতে পারলো কিনা ও জানে না কিন্তু মাধবী দিদিভাই আর বাপ্পাদার ভালোবাসার গল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলো।

,,,

পরে পড়বো
৪৩
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন