পিউ হঠাৎ করে, আশিষের হাতে ক্যামেরাটা দিয়ে বললো। ” প্লীজ এই গ্রুপের ফোট গুলো তুই মেনেজ কর। আমি জল খেয়ে আসি”
বলেই ফ্রেম থেকে আউট হয়ে গেলো। পিঊ কিন্তু ওয়েডিং ফোটোগ্রাফার হিসেবে নিউকামার ওর এরকম ব্যবহার আমার ঠিক পচ্ছন্দ হলো না। এখন এই পেশাটায় অনেক প্রতিযোগীতা অনেক লড়াই। এই বৌ ফুল সজ্জায় ঘরে ঢোকা পর্যন্ত আমাদের ছুটি নেই।
আগে বিয়েতে বাড়ির মানে, আমাদের বাড়ির, মামা,কাকা, দাদাদের ক্যামের গলায় ঝুলিয়ে দেখা যেতো বিয়ে বাড়িময় ঘুরে ঘুরে ছবি তুলতেন। সেই একটা দিনের জন্য যার গলায় ক্যামেরা সে বেশ ঘ্যামও নিতেন। ফোট তুলতেন তিনি নিজের ইচ্ছা মতো।
এর পর এল একটা সময় যখন ক্যামেরা ম্যান ভাড়া করা শুরু হলো। সেই সময় যখন বিয়ে বাড়িতে খেতে বসেছেন তখন , হঠাৎ মুখের ক্যামেরামানের জোরালো আলো পরলো । ভিডিও তৈরি হলো। তারপর সেই ভিডিও কিছু বাঙলা, কিছু হিন্দি গান মিলিয়ে তৈরি হতো বিয়ের ভিডিও।
এখন সময়ের সঙ্গে তাল রেখে সব কিছু বদলেছে। এসে গিয়েছে ওয়েডিং ফোটোগ্রাফি। বিয়ের দিনটা সবার কাছে একটা বিশেষ দিন। এর স্মৃতি সুন্দর করে ধরে রাখতে চান সকলেই। তাই সময়ের দাবি মেনে এসেছে বিভিন্ন কনসেপ্ট। ক্যানডিড, ক্রিয়েটিভ, রয়্যাল, রোমান্টিক, পোর্ট্রেট কতো রকম কনসেপ্টে ওয়েডিং ফোটোগ্রাফি করা হয়। চাইলে গোটা বিয়েতে এক ধরনের কনসেপ্ট রাখতে পারেন। আবার আইবুড়ো ভাত, বিয়ে, বউভাত, ককটেল পার্টি প্রতি দিন বেছে নিতে পারেন বিভিন্ন স্টাইল।
পিউকে আমি বারবার বলে ছিলাম এই পেশাটা ওর নয়। ঘরে বসে ইডিটিং শুধু করলেই পারতো। কিন্তু ওয়েডিং ফোটোগ্রাফার হবে, বাজার এ চাহিদা বেশি বলে। ওয়েডিং ফটোগ্রাফি কি মুখের কথা। এটা ছবি তোলার শিল্প। এটা আজকাল বিয়ে বাড়ির একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একজন পেশাদার ফটোগ্রাফাররা বিয়ের অনুষ্ঠানের আবেগ, মুহূর্ত এবং স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ক্যামেরা আর বিশেষ সরঞ্জাম আর কৌশল ব্যবহার করেন না শুধুমাত্র ব্যবহার করেন তাদের অভিজ্ঞতা কে। একজন ফটোগ্রাফারের পোর্টফোলিও দেখে তার কাজের ধরণ এবং মান সম্পর্কে ধারণা করেই ফোটোগ্রাফার নির্বাচন করেন। ওকে সেটাই করতে হবে। জল কেন ওয়াস রুমেও যাওয়া চলবে না বিয়ে বাড়ি চলাকালীন।
এই গ্রুপটা বড় বিরক্তিকর প্রায় ছয় সাতটা ছবি সুট করতে হলো। ভদ্র লোকটি ঠিক মত দাঁড়াছেই না, কখনো বেঁকে যাচ্ছে, কখনো দাঁতটা দেখাচ্ছে বেশি করে। আমি পারফেক্ট ছবি তুলেতেই পারলাম না। বর বাবাজি বলেন। ঠিক আছে যা তুলেছেন তার মধ্যে একটা ভালো বেছে দেবো ছাড়ুন দাদা অনেক হয়েছে।
পরে বুঝলাম লোকটা মানসিক প্রতিবন্ধী। উত্তেজিত হয়ে বললেন ” নতুন বৌ কেন আমাদের ফোট তুললো না, ও ভালো ফোট তলে। ও আমাকে ভালোবাসে না, আমাকে দুদু দেয় না, আমার ফোট তোলে না।”
ওনার সাথে আসা মহিলা লোকটাকে বললো ” তুমি এমন করলে আমি তোমাকে এখনি নিয়ে যাবো কিন্তু বাবানকে ফোন করবো, ও কিন্তু তোমাকে মারবে। দাদা তুমি চল এখন থেকে তুমি মাংস, রসগোল্লা, খাবে না কত খাবার হয়েছে চলো আমি খাইয়ে দেবো। নতুন বৌ আমাদের কেউ না, ওর নাম নিলেই তোমাকে এখুনি বাড়ি নিয়ে যাবো। ”
বাবান নামটা শুনে বুঝতে পারলাম, হঠাৎ পিউ কেন ফ্রেম থেকে আউট হয়ে গেছিলো। এ বিয়ের ফোটোগ্রাফার হয়ে কাজ করতে এসে।বিয়ের বাড়ির স্মৃতি কথা ক্যামেরা বন্দী করতে করতে ও নিজের স্মৃতি মুখমুখি হয় গেছে। ওর চোখে এক বিন্দু জল নেই। মুখে হাসি নিয়ে আবার ও ফোটোগ্রাফি শুরু করে দিলো।
ওর ঘটনা শুনে বলবেন ও তো ‘লভ বম্বিং’ এর শিকার। এই শব্দটা কিছুটা নতুন হলেও, হাল আমলে ‘জেন- জি’দের মুখে অনেক সময়ই শোনা যায় শব্দটি। কখনও কখনও, যে ভালোবাসা এক সময় এত মিষ্টি মনে হয় , তা চাপ এবং নিয়ন্ত্রণের কৌশলে পরিণত হয় – যাকে আজকাল ‘লভ বম্বিং’ বলে । এই সময়ে ‘লভ বম্বিং’ আজকাল একটা খুব সাধারণ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। প্রথমে একে অপরকে তাদের সর্বস্ব দান করে, কিছু সময় যেতে না যেতে, সম্পর্কের সমীকরণ বদলে যায়। বাবান পিউ গল্পটা সেই রকমই।
বর কথায় খেতে গেলাম আমরা। পিউ বোধহয় খুব খিদে পেয়েছে ও তারাতারি পেল্ট ভরে খাবার তুলে নিলো। আগেকার বিয়ে বাড়ি লোকজন খেতে বসলে বড় কর্তা এসে বলতো ” দাদা এত লজ্জা করছেন কেন?? এ রকম করলে কি চলে। এই এ দিকে দুই পিস মাছ দিয়ে যা আরো। আর আজকাল ক্যাটারিং সিস্টেম। কে খেলো না খেলো দেখার নেই।
ঐ প্রতিবন্ধী ভদ্রলোকটাকে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু মহিলাটা পিউকে চোখে চোখে রেখেছে দেখলাম। কাকে শুনিয়ে বললেন ” কোথা থেকে হাভাতে গুলো আসে কে জানে ভদ্র ভাবে খেতেও জানে না।”
পিউ খাবার ফেলে দিলো। ওর চোখে জলটা রুমাল দিয়ে মুছে নিলো গোপনে। ওর গত জীবনের স্মৃতি গুলো যদিও ও মুছতে পারতো, খুব ভালো হতো। বাবানকে বিয়ে করা জন্য পিউ পাগল ছিলো। বিয়ের কার্ড থেকে বিয়ের তত্ত্ব সুচি নির্বাচন। বাড়ি, গাড়ি ভাড়া ঠিক করা থেকে ক্যাটারিং ঠিক করা, বিয়ের বাজার থেকে তত্ত্ব বাজার সব কিছু ঠিক করেছিলো ও একা। খুব খুশি ছিলো বিয়ের প্রথম প্রথম।
বাবানের প্রতিবন্ধী দাদা , বয়স্ক বাবাকে দেখার জন্য ও ওর চাকরিটা ছেড়ে ছিলো। ওর ননদের ডিভোর্স হলো। বাপের বাড়ি ফিরে এলো, সে কিন্তু এদের দায়িত্ব নিলো না, চাকরি বাকরি বন্ধু বান্ধব নিয়ে ব্যাস্ত থাকলো। ও তবুও মুখ বুঝে, হাসি মুখে কাজ করতো সব। তাও সংসার টিকলো না ওর।
না ওর দোষ ছিলো। বাবানদের বাড়ির পুরোনো হয়েছিল, বাড়িটা মেন্টেন করার ক্ষমতা ওদের ছিলো না। ও প্রোমোটারকে বাড়িটা দিতে বলছিলো। এই নিয়ে চরম অশান্তি হলো ওদের। ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিলো বাবান। বাপ ঠাকুরদার স্মৃতি বিক্রি করবে না বলেও , পরে ঠিক ওরা বাড়িটা একটা প্রোমোটারকে দিলো। ওরা ফ্লাট পেলো। তিন বড় বড় ঘর, কিন্তু সে ঘরে পিউর জায়গা হলো না। আসলে বাবান আবার বাবা দাদা বোনের দায়িত্ব নেবে না বলে, ব্যাঙ্গালোর সেট হয়ে গেলো। পিউ জীবনটা শুধু সেট হলো না। ওর বিয়ের ফুলটা ফুটলেও শুকিয়ে গেলো।

মন্তব্য করতে ক্লিক করুন