ওর বাবার অফিসে ডিভোর্সি এক মহিলা আসতেন। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় ওর বাবার। একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে তাঁকে নিয়ে চলে যায়। তখন ওর মাকে নিয়ে যে কী অসম্ভব লড়াই করতে হয়েছিল সেটা আমি নিজে দেখেছি, এখন ভাবলে নিজেরই অবাক লাগে। তার পর হঠাৎ একদিন ওর বাবা ফিরে এল। ক্ষমা চেয়ে ওদের সঙ্গে থাকতে চাইল। মাথাটা রাগে জ্বলে ওর গিয়েছিল।ও আর ওর দু’জনেই ওকে চলে যেতে বলেছিলো।
কিন্তু ওর মা পরে ওর বাবা ক্ষমা করে দেয়। এতেই সেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে ও। বাড়ি ছেড়ে দেয় ও। ও ভালো পড়াশোনা ছিলো তাই চাকরি বাকরী অসুবিধা হয়নি। একটা ঘর ভাড়া নিয়ে , একাই থাকতে শুরু করে, কিন্তু কোন বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজনদের সাথে যোগাযোগ রাখে নি ও আর। এক প্রকার সেচ্ছায় নিখোঁজ হয় সবার থেকে।
কেউ হারিয়ে যান স্বেচ্ছায়। কাউকে হারিয়ে ফেলা হয়। হারানোর কাহিনিগুলো বিচিত্র , অলিগলি, রাজপথের গল্প। ওর সাথেই সাগরমেলার গেলাম থিকথিকে ভিড়। আমরা সাংবাদিক জানতে পেরে আমার কব্জিটা চেপে ধরে কেঁদে ফেললেন ঘোলাটে চোখ আর ঝুলঝুলে চামড়ার এক বৃদ্ধা হোগলাপাতার ছাউনি ঘেরা জলসত্রের পাশে আশি ছুঁইছুঁই রত্না দেবীকে বসিয়ে তাঁর ছেলে বলেছিলেন “ইঁয়াহা বৈঠো তনিক, হম অভি আতে হ্যাঁয়।” এখানে একটুখানি বসো, আমি এখনই আসছি। চার দিন ছেলে আর ফেরেনি!
মহিলা ঠিকানা বলতে পারলো না। তাই ও নিজের বাড়িতে নিয়ে এলো উনাকে। কিছু দিন মধ্যে একজন সেচ্ছায় নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষ আর ইচ্ছাকৃত নিখোঁজ করে দেওয়া মানুষের মধ্যে আত্মীয়তা গড়ে ওঠলো। এখন দুই জন একটা পরিবারের মতো থাকছে। রত্না দেবী বাংলা শিখে গেছে। ও হিন্দিটা শিখে নিয়েছে। দুইজনের মধ্যে ঝগড়া দেখতে ভালো লাগে আমার খুব।
ও আমি ভালো বন্ধু। আমরা দুজন একই পাড়ায় থাকতাম, ওর চাকরিটা আমি করে দিয়েছি আমার অফিসে। রত্না দেবী আসার আগে ,আমরা দুজন মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়তাম শহর থেকে কিছুটা দূরে এবং অপেক্ষাকৃত নির্জন স্থানে ঘোরাঘুরি করতে।
সেদিনও দুই বন্ধু হাটছিলাম।ও একটু গান পাগল মেয়ে । ও সময় গান গায় আপন মনে।আমি প্রকৃতি পাগল । চারপাশের প্রকৃতি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম আর ওর সঙ্গে কথা বলছে। ও কিছু বলছিলাম, যদিও আমি ওর কোন কথায় স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলানা, তবুই যেটুকু বুঝতে পারছিলাম ও তখন বোধহয় জীবনানন্দ দাশ কবিতা আবৃত্তি করছিলো।
ওর আমার অচেনা অজানা পথে বাইক রাইড করতে ভালো লাগে। আমার নতুন পথ খুঁজেতে আমার খুব ভালো লাগে। ও কিন্তু এই পথ হারিয়ে যেতে চায়।
সেইদিন যেখানে গিয়ে ছিলাম জায়গাটা খুব সুন্দর,নদীর ছোট ছোট নৌকা চলছে,আবার কেউ মাছ মিন ধরতে জাল নিয়ে ঘুরছে। আবার জমিতে ধানের গাছগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছে। মনে হয়ছিলো কেউ যেন সবুজ রং,ছড়িয়ে দিয়েছে। আরও দূরে ইটের ভাটার চিমনিগুলো যেন এক-একটা দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে ছিলো আর মুখ দিয়ে অলস ভাবে ধোঁয়া ছড়া ছিলো।
সব কিছু দেখতে এভাবে কিছু সময় পেরিয়ে যাবার পর হঠাৎ ওর কোনো কথা শোনতে পেলাম না। পিছনে ফিরে দেখি ও নেই। কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম । কোথায় গেল ও! খবরে কাগজে প্রতি দিন নিখোঁজ হয় কত মেয়ে। পরে উদ্ধার হয়, তাদের ধর্ষিত দেহ অথবা হারিয়ে যায় মেয়ে গুলো অন্ধকার গলিতে। আমি উদ্ভান্তের মতো ওকে খুজলাম।
পরে আবিষ্কার করলাম, একটা ছাগল ছানার পিছনে দৌড়তে দৌড়াতে গ্রামের ভিতর ধুকে গেছে। কেউ যাতে ফোন করে ঘোরাঘুরিতে ডিসট্রাব না করতে তাই ফোন টা অফ করে রেখেছিল। ওকে দেখতে চেয়ে আমি খুব চ্যাচামেছি করলাম। ও হারিয়ে গেছে ভেবে যে আমি ভয় পেয়ে গেছি সেটা ও বুঝতে পেরে গেছিলো। ও আমাকে জরিয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলো। “তুই আমাকে খুব ভালোবাসি না?? ”
প্রশ্নটা উত্তর খোজা হয় নি কখনো মনের কাছে। প্রশ্ন টাও নিখোঁজ হয়ে গেলো দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততায়। আসলে ও এ বিষয়ে মাথা ঘামাই নি আর। আসলে ওতো পুরুষদের ঘৃণা করে। ওর জীবনে একটা প্রেম এসেছিলো। কিন্তু বিপদের সময় ওর পেশে যখন ওর প্রিয় মানুষটিকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলো ,তখনই ওর প্রিয় মানুষটি ইচ্ছা করে নিখোঁজ হয়ে যায়।
নিখোঁজ মানুষকে খুঁজে পাওয়া অনেক সময় জানেন আনন্দের হয় না। আমাদের মামা বাড়িতে আশ্রিত ছিল রমেশ। ওর মামার সাথে বাংলাদেশে থেকে এসেছিল ও। মামারা ওকে পড়াশোনা শেখালো। ওর সাথে আমার মামাতো বোনের বিয়ে ঠিক ঠাক। ওরা মুর্শিদাবাদ ঘুড়তে গিয়ে খুঁজে পেলো রমেশের মাকে। আমরা খুঁজে পেলাম রমেশের পিতৃপরিচয়। সমাজ যতো আধুনিক হোক জাতপাত মানে তারা মনে মনে। বিয়ে ভেঙে দিতে চাইলো সবাই। আমার বোন রমেশের সাথে নিখোঁজ হলো এ শহরের ব্যাস্ততায়।
আমি মাঝে মাঝেই ভাবনার মধ্যে নিখোঁজ হয়ে যাই। হঠাৎ একটা জলের ঝাপটা আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলো। এ অফিসের মালিক অশিস বাবুও কখনো আমার ওপর উচুঁ গলায় কথা বললেন না। কারণ একটা বন্ধ হতে যাওয়া পত্রিকাকে , নিজে দায়িত্ব নিয়ে বাজারে সেরা পত্রিকা গুলোর মধ্যে একটা পত্রিকা বানিয়েছি আমি। এখন এটা বড় প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা সংস্থাও।
কিন্তু ববিতা আমার কলেজ বন্ধু। পুরাতন একটা ঝামেলাকে এখনো মনে রেখেছে। ও এইদিনটার সুযোগ খুঁজছিল। কাল সারারাত কাজ করেছি। বাড়ি যাই নি। তাই নানা কিছু ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ও সেটা নিয়ে খুব অশান্তি করলো।
আমি চাকরি ছাড়ালাম। ও আর বাপন চাকরি ছাঁড়ালো। আমাদের টিম ছাড়া আর সাতদিনের মধ্যে শারদীয়া সংখ্যা কেউ বেড় করতে পারবে না। ববিতার আত্ম অহমিকায় আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠানটি হারিয়ে যাবে হয়তো। কারণ বাজারে চাকরি অভাব যেমন আছে, তেমন অভাব আছে দক্ষ শ্রমিকের ও। মালিক শ্রেনীরা সেকথা ভুলে যায় সব সময়।
কিন্তু মুস্কিল কি জানেন এ সমাজে ধনীরা অতিধনী তাই ওদের এক দুই মাস আয় বন্ধ থাকলেও, ওরা চালিয়ে নিতে পারেন জীবন কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষের একটা দিন আয় না করলে চলে না। তাই আমাদের অনেক কিছু অন্যায় মেনে নিতে হয়। নয়তো নিখোঁজ হতে হয় জীবন পুরের মেলায়।

মন্তব্য করতে ক্লিক করুন