ছোটবেলায় সাড়ে চুয়াত্তর আর বসন্ত বিলাপ সিনা তার দেখে মেস বাড়িতে থাকার ইচ্ছাটা জন্মেছিলো। পলিটেকনিক প্রবেশিকা পরীক্ষায় ভালো ফল হলো না। তাই দূরে কলেজ ভর্তি হতে হলো তাই মেস বাড়িতে থাকার সুযোগ হলো। এক কথা মেস বাড়ি হলো স্বাধীনতার এক নাম।
আজকাল দেশের প্রায় সব শহরে, আধাশহরে এখন মেস ব্যবস্থা বর্তমান আছে । এমন কি গ্রামাঞ্চলে, মফস্বলে, যেখানে অফিস, কোর্ট-কাছারি, ইন্ডাস্ট্রি আছে সেখানেও মেস ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে প্রয়োজনের অনুযায়ী।
তবে প্রাচীনকালে এই মেসবাড়ির ব্যবস্থা ছিল না জানেন। সম্ভবত আমাদের দেশে বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মেস ব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল শহরগুলোতে। কারণ তখন অফিস, কোর্ট-কাছারি, শিল্প সবই গড়ে উঠেছিল শহর এবং শহর সংলগ্ন অঞ্চলে। তখনই কলকাতায় গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন মেসবাড়ি। কলকাতায় তখন ছিল মেসবাড়ির এক রমরমা।
কলকাতার মেসবাড়ি পৃথিবী বিখ্যাত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে গ্রামগঞ্জ, বর্তমান বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, বিহার থেকে প্রচুর লোক কাজকর্মের জন্য কলকাতায় আসতে শুরু করেছিল। দিল্লিতে ১৯১১ সালে রাজধানী স্থাপিত করার আগে পর্যন্ত কলকাতাই ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী থাকায় কাজকর্মে সুবিধার জন্য প্রচুর লোক কলকাতায় আসতেন । তখন থেকেই কলকাতায় বিভিন্ন জায়গায় মেসবাড়ি গড়ে উঠেছিল। কলুটোলা স্ট্রীট, কলেজ স্ট্রীট, মুক্তারাম বাবু স্ট্রীট, হ্যারিসন রোড (এখনকার মহাত্মা গান্ধী রোড), শিয়ালদা, মানিকতলা, বউবাজার ছিল মেসবাড়িগুলির প্রধান ঠিকানা।
সেই সময় মেসবাড়ি বলতেই সবাই বুঝতো দোতলা বা তেতলা বড় দালানবাড়ি যেগুলির কোনোটাতে বারান্দা থাকতো, কোনোটাতে থাকত না এবং ঘর জুড়ে পাতা থাকতো তক্তপোশ, আর সেই ঘরে দশ-বারোজন লোক থাকতো। পরবর্তী কালে তক্তপোশগুলি পরিণত হয়েছিল সিঙ্গল বেডে। খেলাধুলা, সাহিত্য, রাজনীতি সবই ছিল এই মেসবাড়িতে। এমন কি ব্রিটিশ আমলে বিপ্লবীদের ঘাঁটিও ছিল এই মেসবাড়ি। সত্তর দশকে দিন বদলের স্বপ্ন দেখা তরুণ দলের অন্যতম ঠিকানাও ছিল এই মেসবাড়ি।
সাহিত্যেও মেসবাড়ির অবদান কম নয়। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ, জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কিংবা শিবরাম চক্রবর্তীর জীবন থেকে মেসবাড়িকে আলাদা করা কোনোদিন যাবে না। তাই শিবরাম চক্রবর্তী বলেন, মুক্তারামে থেকে, তক্তারামে শুয়ে, শুক্তারাম খেয়েই তিনি শিবরাম হয়েছেন।
হবে না কেন মেস বাড়ি মানে স্বাধীনতা। খাওয়া জন্য, স্নান করার জন্য, দেড়িতে ঘুম থেকে ওঠার জন্য চ্যাচামেছি করার কেউ নেই। নেই মার শাশন, বাবা চোখ এড়িয়ে ঘর থেকে বেড়ানো ঘরে ঢোকার ঝামেলা। তাই মেসবাড়ি প্রেমে পড়ছিলাম কলেজ লাইফে। আজ মেসবাড়ি ছাড়তে পারি নি।
অনেক দিন পর বাড়ি ফিরলাম, পথে বড় ঝ্যামেলায়,পরলাম । মেট্রোতে একজন আত্মাহত্যা করেছে। লোকটা মরেও শান্তি পেলো না। যাত্রীর সবাই গালাগালি দিচ্ছিলো। কেউ জানতে চাইলো না লোকটা কেন আত্মহত্যা করেছে।
হঠাৎ চঞ্চলদার ফোন এলো। কে কেন আত্মহত্যা করেছে সেই কৌতূহলটা মিটলো আমার। সন্তূর বাবা আত্মহত্যা করেছে। উনার আত্মহত্যাকে সমর্থন করতে বাধ্য হলাম চঞ্চলদার মুখে ওনার অসুখটার কথা শুনে। মধ্যবিত্ত পরিবারে ঐরকম ভয়াবহ অসুখ মানে পুরো পরিবার শেষ হয়ে যেতো। উনার আত্মহত্যা মুক্তি দিলো পরিবারকে।
স্টিফেন হকিং-এর মতো উনিও অ্যামিওট্রফিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস (ALS) নামক একটি দুরারোগ্য মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এই রোগটি ছিল একটি প্রগতিশীল নিউরোডিজেনারেটিভ ব্যাধি, যা তার শরীরের পেশি কোষগুলোকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে দিত। স্টিফেন হকিং এর ২১ বছর বয়সে তার এই রোগ ধরা পড়ে এবং এটি তাকে চলাফেরা, কথা বলা ও শ্বাস নেওয়া কঠিন করে তোলে।
গত সপ্তাহে সন্তূর সাথে আমার দেখা হয়েছিল। আমি এখনো পোশাক আশাকে দিক থেকে উদাসীন। পোশাক দেখেই মানুষ মানুষের অর্থনৈতিক অবসা, চরিত্র সব কিছু বিচার করে। পোশাক দেখে ও হয়তো ধরে নিলো আমি এখনো বেকার ভালো কাজকর্ম করি না।
ও সুগি নামক একটি সংস্থার ডেলিভারী বয়। ওর কাজটা স্বাধীন। আমাকে দেখে ও ওর স্কুটি থামিয়ে বললো, ” কিরে আবার চাকরি হারিয়েছিস নিশ্চয়ই। তোর মতো শিক্ষিত ছেলেদের জন্য এ রাজ্যে ভালো চাকরি নেই। আমার মতো কাজ শুরু কর যিনদাস স্বাধীনভাবে চাকরি করবি। ”
আমি বিদেশে চাকরি করি সেটা ভেড়া পিটিয়ে বলতে চাই না সবাইকে। ও বিনা পয়সায় জ্ঞান দিচ্ছে সেটা নিতে অসুবিধা কি। ও বললো ” আমার মতো বাইক নিয়ে কাজ করতে হবে এমন নয়। একটা সাইকেল থাকলেও হবে। তোর এই ফোনটা যথেষ্ট। আরাই হাজার টাকা লাগবে কম্পানি কিড জন্য। তার দিনে আট নয় ঘন্টা কাজ কর। দশ বারো হাজার টাকা ঠিক রোজগার হয়ে যাবে। ”
সব শুনলাম, ও বাবা মা কেমন আছে জানতে চাইলে হয়তো ওর বাবা সাথে একবার দেখা হতো আমার। এমনকি ডোনা কেমন আছে সে খবরটাও নিই আমি। অথচ কিছুদিন আগে পর্যন্ত ফেসবুক ইস্টগ্রাম নামক সোস্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল যৌন পল্লীতে। আমি ডোনার ফলোয়ার ছিলাম। ওর রিল গুলো দেখে ওর শরীরের ওম নিতাম।
ডোনার সাথে আমার আলাপ অনেক দিনের। সে সময় আমি মেসেই থাকি। তখন সবে মোবাইল ফোন চালু হয়েছে। সবার হাতে মোবাইল ফোন আসে নি। হঠাৎ একজন মেয়ে ফোন কাঁদতে কাঁদতে বললো। ” বিকাশ বাবু, দাদাকে একটু বলুন, মাকে গাড়িতে ধাক্কা মেরেছে আমি মাকে নিয়ে কুঁদঘাটের সাস্থ্য কেন্দ্র আছি। ও অন্তত হাজার খানেক টাকা নিয়ে চলে আসুক এখানে। ”
আমি কিছু কথা বলার আগেই , ফোন কেটে দিলো। কলব্যাক করতে দেখি ওটা একটা সেটিডি বুথ। বুথের ছেলেটার বর্ণনা অনুযায়ী ফোন করা হয়েছিল ঢালিপাড়া থেকে। ওটা আমার বাড়ির কাছাকাছি। মনে কু ডাকলো কেউ চেনা জানা হয়তো বিপদে পড়ছে। আপন মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে হয়তো টাকার জন্য। টিউশানি করে মায়ের জন্য হাজার খানেক টাকা জমিয়ে রেখেছিলাম। সেটা হাজির হলাম।
কুঁদঘাট স্বাস্থ্য কেন্দ্র তেমন ভিড় হয় না। ডোনা আগে থেকেই আমাকে চিনতো সন্তূ আমার সহপাঠী ছিলো। ও ভেবেছিলো ওর দাদা আমাকে পাঠিয়ে ছিলো। পরে জানতে পরলো রং নম্বরের গল্পটা। রং নম্বরের গল্পটা আমার জীবনে রং অনতে পারতো। কিন্তু আমি বেশি সময় দিতে পারি নি ডোনাকে। তাই ডোনা আমার ওপর দুর্বল হলেও আমাদের গল্পটা পরিনতি পায় নি।
চঞ্চল দা বললো, ডোনা লোক জনের কথা শুনেই কোটি পতি হবার স্বপ্ন দেখে ঐ ফেসবুক টুক করছিলো। ওর বাবার সেটা জানতে পেরে ওর মোবাইল ভেঙে দেয়। এবং গলায় দড়ি দিতে গেছিলো। তারজন্য ও এসব করা ছেড়ে দিয়ে এখন একটা বিউটি পার্লার কাজ নিয়েছে।
ওর বিউটি পার্লার ঠিকানা জোগাড় করতে অসুবিধা হলো না। হাজির হলাম ওর বিউটি পার্লার সামনে। প্রথম দুই দিন কথা বলতেই চাইলো না। তৃতীয় দিন বললো ওর করোর সহানুভূতি প্রয়োজন নেই। আমি শেষ মেশ বোঝাতে সক্ষম হলাম, সহানুভূতি নয়, আমি নিজেই ওর আশ্রয় বাকি জীবনটা কাটাতে চাই।
ওর উত্তর বদলে ও একটা প্রশ্ন করলো, নিজের ঘর বাড়ি থাকতে মেসবাড়ি থাকছি। নিজের আপনজনেরকে আপন করতে পারে নি যে মানুষ সে মানুষকে সে ভরসা করে কি করে। ডোনাকে পাবার আশায়। মেসবাড়ি ছাড়া সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ স্বাধীনতাটা একটা সময় অসুখের মতো হয়ে যায়। তাই পরিবারের বন্ধনের পরাধীনতা মেনে নিতে রাজী হয়ে গেলাম।

মন্তব্য করতে ক্লিক করুন