শ্রাবণের দিন
শ্রাবণের দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে, ভরা বর্ষা। আকাশে সূর্যের দেখা নেই। মেঘের দাপটে সূর্যের আলো অনেকটা নরম এবং হালকা। বেলা কতখানি তা বোঝার উপায় নেই। তাই ছেলেকে আনতে দেরি হয়ে গেলো। ছেলেটার খিদে পেয়েছিল কিন্তু কিছু কিনে দেবার সামর্থ নেই।মাবাইল বের করে ঘড়িটা দেখে নিলো, দুপুর চারটা বাজতে চলেছে। তবে ও আজ বার বার মোবাইল দেখছে বুবাই কোন মেসেজ ঢুকলো কিনা দেখতে।আকাশ দিকে তাকিয়ে পাশে বসে থাকা ঘুমন্ত ছেলে কে বলে, ‘বাবু দেখ আকাশের মনটা বেজায় খারাপ । কখন থেকে যেন তোর মতো কেঁদেছে বসে বসে।’
ওর ছেলে নিশ্চিতে ঘুমাছে।
ওর চোখে অবসাদগ্রস্ত।
ও সিঙ্গেল মাদার।বাবুইএর কথা শহর কোলকাতা ছেড়ে ও এই ছোট্ট শহরে বাসা নিয়েছে।
এ ছোট শহরের পথের করুণ দশা দেখে ভারি অবাক হয়। একটু বৃষ্টিতে পথঘাটের অবস্থা যেন হাঁটু অবধি জলে ডুবে যায়। সামনে কতগুলো চলন্ত রিকশা প্রায় অর্ধেক ডুবুডুবু ভাব। মনে মনে তার ছোট্ট শহরটার সঙ্গে কলকাতার শহরের বৈসাদৃশ্য দেখে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায়। তার এই ছোটো শহরটাও অপরিষ্কার। কিন্তু বর্ষাতে সেখানে পথঘাটের এমন নাজেহাল দশা হলেও । ছোটো শহরটার কথা একটু আলাদা সাবাই খুব আন্তরিক। ওর ছেলে অদ্রি জ্বর হতে সবাই মিলে ডাক্তার দেখানো থেকে ওষুধ পত্র কিনে দেওয়া সব ব্যবস্থা করেছে। কিছু ধার দেনা হয়েছে ওর কিন্তু কেউ তাগাদা দিচ্ছে না। বুবাই কিছু টাকা পাঠাতে চেয়েছিলো কিন্তু ও নেয় নি। বুবাই ওর কলেজ ফ্রেন্ড। ওকে বিয়ে করতে চায়। আসলে রোহিত সাথে ডিভোর্স হলে তবে তো বিয়ে করবে। রোহিত ওকে সহজে ডিভোর্স দেবে না। সুস্মিতা নিজের জন্য এক টাকাও চায় না। কিন্তু ছেলেটা অধিকার নিয়ে ছাড়বে।আর বুবাই থেকে সে কোন সাহায্য নেবে না। কারণ কোন সাহায্য বিনিময়ে সে কোন সম্পর্ক জরাতে পারবে না।
হঠাৎ বুক চিরে কষ্টের চাপা নিশ্বাস বেরিয়ে আসে সুস্মিতার, মায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তা। এমন এক শ্রাবণে দিনে মায়ের বুকের মাঝে ও শেষ বার পেয়েছিলো।ওর মা কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে শুধু বারবার বলছিলেন, ‘আমার বাচ্চাটাকে নিয়া যাইয়ো না! আমি থাকতে পারব না ওরে ছাড়া!’ কিন্তু টাকা জোরে ওর মা আইনি লড়াইয়ে হেরে যায়।
অশ্রুজলে ডুবে আসে সুস্মিতার চোখ দুটো। মনে পরে যায় এক সন্ধ্যায় অদ্রির ভীষন জ্বর অথচ একটা টাকা দেয় নি রোহিত ওকে । অথচ ভালোবাসার স্বপ্ন বুকের মাঝে আগলে রেখে ও শহর ছেড়ে ছিলো রোহিতের সাথে। তখন ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর ছিলো সে। কে জানতো রোহিত ওর বাবার। টাকা দেখে ওকে বিয়ে করেছিলো। তাই বাবার সাথে ও সব সম্পর্ক ছিন্ন করাতে ওদের সম্পর্কেও ভাঙতে শুরু করলো।
বুবাই ওকে ভালোবাসে। কিন্তু ভালোবাসা শব্দটা সুস্মিতার কাছে এখন কেবলই গৌণ, বড়ো অনাবশ্যক শব্দ। মুখ্য এবং অত্যাবশ্যক শুধুই রোজগার। দুটো টাকা রোজগারের জন্যই তো পাড়ি দিয়েছে ছোট শহরে।
বুবাই সাথে দুই দিন আগে ভীষন ঝগড়া করেছে। তাই বোধহয় দুই দিন ধরে ওর কোন মেসেজ করেছে না। কিন্তু ওকি ওকে আর মেসেজ করবে না। ওকে বোঝে না, ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসে ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধে রাখতে হয়। তবে যা হয়েছে তা ভালোর জন্য হয়েছে।বুবাই বড় বেশি নাক গলাতে শুরু করেছে ওর জীবনে। দুই দিন আগে ওর বাবা এসে হাজির ওর বাড়ি।ওর বাবাকে ওর খোঁজ ঠিকানা দিয়েছে । ওর কথা জালে ওর বাবার মতো অহংকারী মানুষের মন জল হয়ে গেছে। অদ্রি হাবার সময় ওর অবস্থা খারাপ হয়েছিল। রোহিত ওর বাবার কাছে গিয়ে কিছু টাকা সাহায্য চেয়েছিলো। উনি সাহায্য করে নি। বলেছিলো ওনার কাছে ওনার মেয়ে মৃত। আজ বুবাই কথা উনি ওকে নিতে এসেছে বলেই চলে যাবে ও। ও মা । পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী শব্দ হচ্ছে মা। কারো সাহায্য ছাড়া ও ওর ছেলেকে মানুষ করবে এই নিয়ে ঝগড়া করেছে ও বুবাই সাথে। অনেক কথাও শুনিয়েছে।
ভাবনার পর্দায় আচমকা ছেদ পড়ল । ওর বাড়ির সামনে লাল রঙের একটা বড় গাড়ি। গাড়িটা ওর খুব চেনা। ঘরে ঢুকেই ও দেখলো রাহুল ওর মা বাবাকে নিয়ে হাজির হয়েছে। কাকিমা ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু টুম খেয়ে বললো। “এতো কিছু হয়ে গেছে তুই আমাকে বলিস নি কেন মা তোর কাকিমা কাকূ তোর কাছে পর হয়ে গেলো। তুই রোহিত বিয়ে করলি যখন তখন একমাত্র আমি আর তোর কাকু কিন্তু এসেছিলো তোর সাথে দেখা করতে। তুই ভুলে গেলি।”
রাহুল সবাই থামিয়ে বললো ” দেখ সেই ছোট্ট বেলা থেকে আমরা বন্ধু, একে অপরকে পচ্ছন্দ করি। আমি বিদেশে পড়তে গিয়েছিলাম তখন রোহিত রাস্কেল টা ছকবাজি করে তোকে বিয়ে করলো। আসলে প্রেমের সম্পর্ক গুলো এমনি হয় বোধহয়।প্রেম ভালোবাসা নামে আসলে আমরা যোগ্যতম সাথী খুঁজি। তাই দেখতো কোন নিরগুন অসুন্দরী মেয়ে ভালো প্রেমিক পেয়েছে।ভালোবাসা নামে অযোগ্য মানুষ অনেক ভালো সাথী পেয়ে যায়। তারপর গোল বাঁধে।
ও সব ছাড় দেখ আমি এখনো তোর অপেক্ষায় কাউকে বিয়ে করি নি।”
সুস্মিতা চুপচাপ সব কিছু শুনলো। তারপর জিজ্ঞেস করল “কাকিমা তোমাদের আমার ঠিকানা কে দিয়েছে? বাবার সাথে তো তোমাদের ঝামেলা আমার বিয়ের আগে থেকেই। তাই সোসাইটি রঙচঙে মাখি আমার গল্পটা বলে বাবার বদনাম করতেই সেইদিন তোমরা এসেছিলে। শুভেচ্ছা দিতে না..”
রাহুল ঝাঁঝিয়ে বলে উঠলো “মাইন্ড ইয়োর লেগুজ। তুই আমার মা বাবা কে অপমান করছিস। বুবাই বললো তুই বিপদে আছিস।তোকে বিয়ে করতে চাইছি তুই আমার প্রথম ভালোবাসা। আমি আমার প্রথম ভালোবাসা কষ্টে থাকতে দিতে চাই না। বল আমার খাটি না হলে এক ছেলের মা ডিভোর্সী মেয়েকে আমার মতো রেপুটেট ব্যবসায়ী কখনো বিয়ে করতে চায়।”
সুস্মিতা চুপচাপ হাঁসলো। বললো ” কাকিমা আমি নিজে ঠিক মতো খেতে পাই না। তোমাদের ঠিক মতো আপ্যায়ন করতে পারবোনা sorry.. তুমি দেখলে তো তোমাদের দেওয়া চকলেট, খেলনা কিছুই ছুঁলো না। ও বাচ্চা হলেও জানে কোনটা ভালোবাসা, কোনটা দয়া, কোনটা প্রলোভন। আমি ওর মা হয়ে কি ওটা বুঝতে পারবো না।
আর একটা কথা ঘর থেকে বেরিয়ে দেখবে একটা পুরনো ছাতা শুকাতে দেওয়া আছে। ওটা আজ থেকে পোনের বছর আগে এমন একটা শ্রাবণের দিনে বুবাইকে ব্যবহার করতে দিয়েছিলাম। ও এখন বিদেশে চাকরি করে। এই ছোট্ট বাড়িটা ওর জমানো পয়সায় কেনা। এই ঘরে আমি প্রথম ঢুকছি মনে হয় । ঘরে ঢুকে ঐ আলমারিটায় কিছু ব ই আর ছাতাটা পেয়েছিলাম। ও কোন দিন বলেনি ও আমাকে ভালোবাসে। হুঁ এবার বলেছে শুধু তুমি আমাকে তোমার যোগ্য মনে করলে আমাকে বিয়ে করতে পারো। তবে যদি তোমার ছেলে আমাকে বাবা হিসেবে মেনে নেয়। এ ঘরে ও কোন দিন আসে না। বলে এ ঘরটা ও আমাকে দিয়ে দিয়েছে। বলে সময় হলে দাম দিয়ে দিও। সত্যি বলতে আমি ওর সাহায্য দাম দিতে পারবো না। তাই বোধহয় আমার মনের ঘরটা মালিকানা আমি ওর নামেই লিখে দিয়েছি।
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন