‘কবিতা হারাইয়া যায় নিয়মানুবর্তিতায়, অনিয়মে কবিরেই খোঁজে।’–এই লাইনটা ২২ বছর আগে আমার কাছ থিকা ছুঁইটা যাওয়ার পর কালেভদ্রে আসে; আইসা সঙ্গ দেয়, প্রসঙ্গ দেয়, অনুষঙ্গ দেয়; আবার যায়-গা। এইবার আসলো অগ্রহায়ণে। আইসাই শুরু করলো–’ছোটবেলায় তোর “উপরি ভাব” ছিল। যতক্ষণ জাগনা থাকতি ততক্ষণ দেখতি একটা “কালা কুত্তা” তোর দিকে ছুঁইটা আসতেছে–জানলা খোলা থাকলে কইতি, ‘জানলা দিয়া আসতিছে।’ দরোজা খোলা থাকলে কইতি, ‘দরোজা দিয়া আসতিছে…ওই যে, ওই-যে আসতিছে…ওই-যে…”, আর কানতি; কেউ দেখতো না; তুই দেখতি, সন্ধ্যা হইলেই কুত্তাটা তোর নানাবাড়ির সামনের ভুঁইর জোড়া-তালগাছ থিকা মাথা নিচের দিক দিয়া নামতো–আর তোর দিকে ছুঁইটা আসতো, তুই উচ্চস্বরে কানতি, আর কানতে-কানতে-কানতে-কানতে ক্লান্ত হইয়া ঘুমায় যাইতি, এমনভাবে ঘুমাইতি যে, কেউ তোরে কোনোভাবেই জাগাইতে পারতো না; যা দেইখা তোর নানা-সম্পর্কের একজন একদিন তোর মারে বলছিলো, ‘তোর ছাওয়ালের তো কোনো সাড়াশব্দ নাই, মইরে গেল না কি?’…না, তুই মরিস নাই, জাইগা উঠছিলি আবার তোর দিকে “কালা কুত্তা”র ছুঁইটা আসা দেইখা কান্দার জন্য, কাইন্দা ঘুমানোর জন্য, ঘুমাইয়া উইঠা কান্দার জন্য…।
এই “উপরি ভাব” নামাইতে কুফরি-কালাম থিকা শুরু কইরা যে যা কইছে, যে যেইখানে যাইতে কইছে, সেইখানে নিয়া গিয়া ঝাড়ফুক, তাবিজকবজ কত কী-যে করাইছে তোর মা-বাপ!…তোর গলা ভইরা উঠছে তাবিজের মালায় । তোর ডানায়, কোমরে তাগা, তাগায় তাবিজ, জালের কাঠি ।…কিছুতেই কিছু হয় না দেইখা তোর বাপ তার প্র্যাকটিস করা-কোনো-এক-কায়দায় তোরে ঝাড়তে গিয়া কী-যেন-কী পইড়াফইড়া শুকনা হলুদ পোড়াইয়া তোর নাকে ধরতো, আর তুই চিৎকার কইরা কানতি, ক্লান্ত হইতি, ঘুমায় যাইতি।… এতকিছুর পরেও তোর “উপরি ভাব” নামে না দেইখা, এলাকার নামকরা “টোনা ডাক্তার”-এর কাছে তোরে নিয়া দেখানোর পর, তার চিকিৎসায় তুই সুস্থ হইতে শুরু করলি, সুস্থ হইয়া গেলি। টোনা ডাক্তার তোর বাপ-মারে বলছিল, ‘তোগে ছেলে সুস্থ। হইলো ঠিকই, বাঁইচে থাকলি খুব রাগী হবে, কান্নার সময় কানতে পারবে না, চোখ রক্তের মতো লাল হয়ে যাবে…।
এই পর্যন্ত আইসা কবিতা ঘুম-ব্রেক নিতে গেলে Leonard Cohen-এর ‘বেস্ট অফ’ শুনতে ইচ্ছা করলো। শুনতে-শুনতে ‘Darkness’ গানটার মাঝ-বরাবর যখন আমার কান, তখন আবার শুরু করলো, ‘১৪, ১৫, ১৬ বছরের তথাকথিত কয়েকটা ব্যর্থতার সাথে তোর পরিচয় হইলে, তারা তোরে “ধোঁয়া ভোজ” শিখাইলো–তারপর থেকে প্রতিদিনই তোর চোখ টকটকে লাল থাকতো–লোকজন বলা শুরু করলো, “গোল্লায় গেছে”। পল্লীবিদ্যুৎ আসবে-আসছে-শোনা-যাওয়া সেইসব দিনের এক শীতের রাতে প্রতিদিনের মতো “ব্যর্থতা উদযাপন” শেষে “টাউন” থেকে একটার-পর-একটা সিগারেট পোড়াইতে-পোড়াইতে হাঁইটাহাঁইটা তিন/সাড়ে তিন মাইল দূরত্বের বাড়ি ফেরার পথে আর্লি-কৈশোরের স্কুল-লাগা বিশাল জনশূন্য নীলামাঠ পর্যন্ত আইসা দেখলি, জোছনায় থইথই করতেছে নীলামাঠ । তোর সাঁতরাইতে ইচ্ছা করলো, তুই মাঠের মধ্যে নাইমা নানান দিকে দৌড়াইতে থাকলি, দৌড়াইতে-দৌড়াইতে ক্লান্ত হইয়া শিশির-বিছানো ঘাসের উপর হাতপাও ছড়াইয়া দিয়া চিৎ হইয়া শুইয়া পইড়া দেখলি, চাঁদটা নিচের দিকে পড়তেছে–পড়তে-পড়তে তোর মুখের প্রায় একহাত উপরে আইসা থাইমা গিয়া জিজ্ঞেস করলো, “আকাশে যাবি?”… এরপর অনেক মানুষের “ও-তো আমাগে রাসেল, হোসনের ছাওয়াল”, “কোন হোসনে?”, “হোসনে আরা, ছলেমান মোল্লার ভাগ্নি।”, “…এই শীতির মধ্যি এই জায়গায় এইভাবে শুইয়ে রইছে?”, “মইরে গেছে মনে হয়”–জাতীয় নানানরকম উঁচুনিচু-স্বরের কথাবার্তায় কান, চোখ খুলে গেলে দেখলি, টুপি-পরা অনেক মানুষ তোরে ঘিরে আছে, যারা উত্তর দিক থেকে ফজরের নামাজ পড়তে মাঠের দক্ষিণ দিকের মসজিদে শর্টকাটে আড়াআড়ি যাবার সময় তোরে ওইভাবে অসাড় শুইয়া-ঘুমাইয়া থাকতে দ্যাখে। তুই দ্রুত উইঠা, বইসা, দাঁড়াইয়া গিয়া কারো কোনো প্রশ্নের উত্তর বা কৌতূহলের ধার না-ধাইরা যত জোরে পারা যায় তত জোরে হাঁইটা বড় রাস্তায় উইঠা দৌড় দিলি । …সেইদিনই লিখলি “একসদস্যবিশিষ্ট চাঁদ-দেখা কমিটির রিপোর্ট”,–ওই লেখাটা কইরে?
প্রশ্নের উত্তর না-দিয়া ঘুমাইয়া গিয়া ঘুম মচকাইলে দেখি কবিতা নাই, ‘কবিতা ছিল’র একটা পরিবেশ রয়ে গেছে।
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন