মোঃ রাশেদুল ইসলাম (অরণ্য)

আলোচনা - নব্য সভ্যতার ছায়ায় মানবিকতার বিলুপ্তি

মোঃ রাশেদুল ইসলাম (অরণ্য)
শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

এক সময় পৃথিবীটা উর্বর ছিল। শুধু মাটির দিক দিয়ে নয়, মানুষের হৃদয়ও ছিল কোমল, প্রাণবন্ত ও মানবিকতাপূর্ণ। তখন শিশুর জন্ম কেবল একটি জীবনের সূচনাই ছিলনা, বরং ছিল আশা, সম্ভাবনা আর ভবিষ্যতের এক স্বপ্নময় আলো। কিন্তু সময় বদলেছে, বদলেছে সভ্যতার সংজ্ঞা। বদলে গেছে ‘জন্ম’ নামক পবিত্র অভিজ্ঞতার অর্থ। আজ জন্ম মানে একটি পণ্যের উন্মোচন। পুঁজিবাদ আর প্রযুক্তির সম্মিলিত মঞ্চে শিশু আজ এক ‘টার্গেট মার্কেট’, যার কান্না এখন আর কারো মনে মায়া জাগায় না, বরং হয়ে ওঠে বিরক্তির শব্দ।

মায়ের গর্ভে শিশুর জন্ম হয় না—সে গলে যায় বিজ্ঞাপনের স্লোগানে। কিংবা কর্পোরেট হসপিটালের বিলবোর্ডে, টার্গেটেড ক্যাম্পেইনের মাতৃত্ববিক্রির মধ্যে। চিকিৎসা সনদে, আদালতের রায়ে, কিংবা ক্লিনিকের ডেস্কে নির্ধারিত হয়, কে বাঁচবে আর কে মরবেবে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই। এমনকি সেই সিদ্ধান্তের পেছনে থাকে দুর্নীতির কলঙ্কিত ছায়া। যেখানে এক ঘুষখোর কর্মকর্তার অস্বচ্ছ কলমে ঝরে পড়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিয়তি।

আমরা চোখ মেলি, কিন্তু কিছু দেখি না। যেন আমরা অন্ধত্বকে গ্রহণ করেছি নিজেদের অজান্তেই। আমাদের চোখে এখন কেবল স্ক্রিনের নীল আলো। মানবিকতার উষ্ণতা সেখানে প্রতিফলিত হয় না। সত্য এখন ট্রেন্ডিং টপিক নয়, তাই তাকে কেউ আর সত্য বলে না। কারণ? কারণ সত্য বললে বিজ্ঞাপন হারায়, মার্কেট কমে যায়। আর সভ্যতা! সে তো এখন মূলত এক কর্পোরেট প্যাকেজ।‘স্বয়ংক্রিয় মানুষ’ তৈরির নিরব প্রকল্প।

তবু, স্মৃতির এক কোণে জেগে থাকে হারিয়ে যাওয়া কিছু মুহূর্ত। যেখানে এক কিশোর কুকুরকে পানি খাওয়াচ্ছে, এক মেয়ে রিকশাওয়ালার মাথার উপর ছাতা ধরছে, এক মা অপরের অনাথ শিশুকে বুকের দুধ দিচ্ছে। এইসব ঘটনাই এককালে ‘মানবিকতা’ নামে পরিচিত ছিল। আজ সেগুলো শুধুই ব্যতিক্রম। পুরনো ক্যালেন্ডারে দাগ দেওয়া দিনের মতো হারিয়ে যাচ্ছে।

মানুষ এখন আধুনিক, কিন্তু তার মন? তার মনতো মরচে ধরা এক যন্ত্র, যা অনুভব করতে ভুলে গেছে বহু কাল আগে। সমাজের প্রতিটি স্তরে—শিক্ষায়, চিকিৎসায়, বিচারব্যবস্থায় এমনকি সাহায্যের হাতেও আজ দুর্নীতির ছায়া লেগে আছে। এখন নীতির সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়েছে। সেখানে মানবতা নেই৷ যা আছে তা হলো স্বার্থ, মুনাফা আর এক বিকৃত আধুনিকতা।

শিশুর কান্না যেখানে অসহায়তার প্রতীক ছিল, এখন তা হয়ে গেছে বিরক্তিকর ‘নয়েজ’। শিশুরা আজ জন্মের আগেই বুঝে যায়—এই দুনিয়া তার জন্য নয়। তারা শান্তি খুঁজে পায় মাতৃগর্ভের অন্ধকারেই। যেখানে কোলাহল নেই, নেই এই ভাঙা সভ্যতার নিষ্ঠুর হাসি।

আমরা যদি এই পথেই চলতে থাকি, তাহলে আর মানবিকতা নয়, থাকবে শুধু মানুষের মতো দেখতে যন্ত্র, ভালোবাসার মতো শূন্য শব্দ আর সভ্যতা নামক এক ভুয়ো প্রহসন। আমাদের এখন দরকার সেই মায়াবতী মানবিকতাকে পুনরায় খুঁজে আনা, যাকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি এক কিশোরের চোখে, এক বৃদ্ধার ক্ষুধায় কিংবা এক অনাথ নববধূর কাঁধে হাত রেখে বলা কথা, “আয়, আমরা কিছুক্ষণ মা-মেয়ে হই”।

মানুষ না হয় আধুনিক হোক, প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকুক। কিন্তু মনটাকে যেন হারিয়ে না ফেলে। কারণ একটি অনুভবশীল মনই পারে সমাজকে বদলাতে। আর যেদিন এই মন একেবারেই অনুভূতিশূন্য হয়ে যাবে, সেদিন হয়তো মানুষ বেঁচে থাকবে, কিন্তু মানবতা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে—একটি হারিয়ে যাওয়া গল্পের মতো।

©_অরণ্য
#অনিকেত_কান্তা

১২৬
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন