১
হা অদৃষ্ট! —-কবিবর! এই কি তোমার
ছিল হে কপালে ?
মধুসূদনের হায়! (শুনে বুক ফেটে যায়।)
এই পরিণাম বিধি লিখেছিল ভালে ?
২
দিয়াছিল যেই রত্ন ভারতী তোমায়—
অপার্থিব ধন ;
রাজ্য বিনিময়ে, আহা! কেঙ নাহি পায় তাহা
দাতব্য চিকিত্সালয়ে তোমার মরণ ?
৩
কিম্বা কন্টকিত হায়! যে বিধি করিল
গোলাপ, কমল ;
সে বিধি পাষাণ মনে, দহিতে সুকবিগণে,
কবিত্ব-অমৃতে দিল দারিদ্র্য-অনল।
৪
বহু যুদ্ধে না পারিয়া করিতে নির্ব্বাণ
এই হুতাশন ;
প্রাণপত্নী-করে ধরি’, নরলীলা পরিহরি’,
পশিলে মধুসূদন অমর-জীবন।
৫
কৃতঘ্ন, মা বঙ্গভূমি! এত দিন তব
কবিতা-কানন,
যেই পিকবর-কল উছলিল, বনদল
উছলিত, ব্রজে শ্যাম বাঁশরী যেমন |
৬
সে মধু-সখারে আজি পাষাণ পরাণে,
( কি বলিব, হায়! )
অযত্নে মা অনাদরে, বঙ্গকবিকুলেশ্বরে
ভিক্ষুকের বেশে, মাতা, দিয়াছ বিদায়!
৭
মধুর কোকিল কণ্ঠে — অমৃত লহরী —
কে আর এখন,
দেশদেশান্তরে থাকি, কে ‘শ্যামা জন্মদে’ ডাকি’
নূতন নূতন তানে মোহিবে শ্রবণ?
৮
তোমার মানস-খনি করিয়া বিদার,
কাল দুরাচার,
হরিল যে রত্ন, হায়! কত দিনে পুনরায়,
ফলিবে এমন রত্ন? ফলিবে কি আর?
৯
শুণ্য হ’ল আজি বঙ্গ-কবি-সিংহাসন,
মুদিল নয়ন
বঙ্গের অনন্য কবি, কল্পনা-সরোজ-রবি,
বঙ্গের কবিতা-মধু হরিল শমন।
১০
বঙ্গের কবিতে! আজি অনাথা হইলে
মধুর বিহনে ;
আজন্ম শৃঙ্খল ভরে, দীনাক্ষীণা কলেবরে,
বেড়াইতে বঙ্গালয়ে বিরস বদনে।
১১
কল্পনার বলে সেই চরণ-শৃঙ্খল
কাটিয়া যে জনে,
মধুর অমিত্রাক্ষরে, তুলিয়া স্বরগোপরে,
দেখাইল তিলোত্তমা ‘মুকুতা যৌবনে’।
১২
রত্নসৌধকিরীটিনী স্বর্ণ লঙ্কাপুরে,
লইয়া তোমারে ;
মৈথিলী অশোকবনে, প্রমীলা সজ্জিত রণে,
প্রবেশিতে লঙ্কাপুরে বীর-অহঙ্কারে,
১৩
দেখাইল ;—বেড়াইল কল্পনার পক্ষে
লইয়া তোমারে,
স্বর্গমর্ত্ত্যধরাতলে, প্রচণ্ড জলধিতলে ;
শুনাইল “মেঘনাদ” গভীর ঝঙ্কারে।
১৪
“ব্রজাঙ্গণা”, “বীরাঙ্গণা”, নয়নের জলে,
—প্রেম-বিগলিত,—
সাজা’য়ে সুন্দর ডালা, গাঁথিয়া নূতন মালা,
আদরে তোমার অঙ্গ করিল ভূষিত।
১৫
পুণ্যখণ্ড ইউরোপে বসিয়া বিবলে
সেই দিন, হায়!
গাঁথিয়া কল্পন’-করে, পরাইল শ্রদ্ধাভরে,
রত্নময় ‘চতুর্দশ’ লহরী গলায়।
১৬
“কৃষ্ণকুমারীর” দুঃখে কাঁদাইয়া, হায়,—
বঙ্গবাসিগণ ;
বঙ্গনাট্য-রঙ্গাঙ্গণে, মোহিত দর্শকগণে,
“পদ্মাবতী” “শর্মিষ্ঠারে” করিয়া সৃজন।
১৭
বঙ্গভাষা-সুললিত-কুসুম-কাননে
কত লীলা করি’,
কাঁদাইয়া গৌড়জন, সে কবি মধুসূদন
চলিল,—বঙ্গের মধু বঙ্গ পরিহরি’।
১৮
যাও তবে, কবিবর! কীর্ত্তিরথে চড়ি’
বঙ্গ আঁধারিয়া,
যথায় বাল্মীকি, ব্যাস, ভবভূতি, কালিদাস
র’য়েছেন সিংহাসনে তোমার লাগিয়া।
১৯
যে অনন্ত মধুচক্র রেখেছ রচিয়া,
কবিতা-ভাণ্ডারে ;
অনন্ত কালের তরে, গৌড়-মন-মধুকরে
পান করি’, করিবেক যশস্বী তোমারে।

মন্তব্য করতে ক্লিক করুন