জীবনের প্রথম চুম্বন
নির্মলেন্দু গুণ
আয়নার সমুখে দাঁড়িয়ে আজ রাতে ভালো করে দেখছি নিজেকে।
মাথার ওপর থেকে যে চুল ঊর্ধ্ববাহু,
ছাদ ভেঙে উঠে গেছে আকাশের দিকে তা থেকে পায়ের পাতা
পুরোনো স্যাণ্ডেলে মোড়া অবিকল আমি যা তা-ই,
হুবহু চোখের গর্ত, মাংস কম গালের দু’দিকে সতর্ক প্রহরারত
নেমে আসা গোঁফ অবিকল সেই আমি যেন আজো রয়েছি দাঁড়িয়ে
তোমার গন্তব্যপথে, আনন্দে, উল্লাসে কিংবা ব্যর্থ বিষণ্ণতায়।
দেখে দেখে আমি একা হয়েছি দু’জন, এ-পাশে আমার আমি
অন্যপাশে খুঁতখুঁতে তোমার দু’চোখ।
বড় কোলাহল চতুর্দিকে, অথচ আমি তো জানি কী গভীর
শূন্যতাবোধ তাড়া করে এনেছে আমাকে এই নির্ঘুম রাত্রির
দরোজায়, একটি নতুন চোখ আয়নার কাছাকাছি, মুখোমুখি।
আজ তো আমার দেহ সুশোভিত নয় কোনো নতুন পোশাকে,
ঠোঁটে নেই রক্তাক্ত চুম্বনের কোনো দাগ, চোখে নেই ব্যতিক্রম
স্বপ্ন কিংবা সম্ভাবনার অরুণ-উজ্জ্বল কোনো আভা, বুকে নেই
আলিঙ্গন ফেলে আসা কোনো রমণীর অশ্রুভেজা স্মৃতি।
তেমনি যেমন আমি প্রতিদিন শয্যা ছেড়ে
দরোজায় তালা দিয়ে চলে যাই উদ্দেশ্যবিহীন,
তেমনি তো আজও আমি পর্দার কাপড়ে বানানো
পুরোনো পাঞ্জাবি আর উষ্কখুষ্ক বেয়াদপ চুল
এনেছি মাথায় করে এই হোটেলের সুদৃশ কামরায়।
তবে কেন মনে হলো আমিও সুন্দর,
বড়ো বেশি অনেক সুন্দর?
তবে কেন মনে হলো আমার উদ্ধত নাক
যে কোনো নারীর বুকে সহজে বানাতে পারে
মহাসাগরের মতো রক্তময় একটি কবর, তবে কেন
মনে হলো আমার দু’চোখ থেকে উদ্গত হচ্ছে রশ্মি,
ভস্মীভূত হচ্ছে জনপদ, বিশ-শতকের সমস্ত সভ্যতা,
কবিতার অগ্রগতি, পিকাসোর সমস্ত ম্যুরাল পুড়ে-পুড়ে
জ্বলে যাচ্ছে, আগুন আগুন বলে দৌড়াচ্ছে মানুষগুলো
প্রাগৈতিহাসিক বন্য শ্বাপদসংকুল জনপদে?
তবে কেন মনে হলো আমার কর্ণযুগল বনভূমি
আলো করে হয়ে যাচ্ছে রেশমের কোমল খরগোশ,
বড়ো ক্লান্ত, সারাদিন খেলা করে সারারাত ঘুম যেতে চায়
যে-কোনো নারীর তৃষ্ণা, বুকের লজ্জায়।
আমি তো তেমনি আছি—বেমানান কণ্ঠদেশে অনাবশ্যক
তিলের বিস্তৃতি আর গুটানো আস্তিন থেকে
ভেসে-ওঠা স্ফীত শিরা-উপশিরা নিয়ে, এই মধ্যরাতে।
তবে কি রাত্রি গভীর বলে আমি আজ হয়েছি সুন্দর?
আমি তো মাতাল নই, তবে কেন অর্থহীন অযৌক্তিক
এই পক্ষপাত, এই ভালোবাসা, নিজেকে ঘিরেই জন্ম নেয়?
অর্থহীন অসুন্দর প্রতিটি মুখের আঁকে, শিরায় উপশিরায়,
স্নায়ুর তন্ত্রীতে শুধু ভালোবাসা, কী যে ভালো লাগছে আমাকে!
আমার দু’চোখে আজ বড় বেশি ভালোবাসা, বড় বেশি বেঁচে থাকা
যৌবনের, জীবনের আশা, আমি জানি একা একা ভালোবাসা
হয় না কখনো, আমি জানি ভালোবাসা আসে নি আমাতে।
আমি জানি এ শুধুই অভিমান, ভালোবেসে নিজেকেই হত্যা করা,
অভিনয়ে সাজানো বিনাশ।
আমি জানি, প্রতিদিন তিলে তিলে যৌবনের নামে যে সর্বনাশ
রমণীকে ভালোবেসে করেছি আমার, আত্মপ্রবঞ্চনা দিয়ে তার
কোনো স্মৃতি যাবে না ফেরানো। আমি জানি আমার বয়স হচ্ছে–
আমার বয়স হবে, যৌবন কাঁপবে শীতে, তুমি আসবে না।
তুমি আসতেও পারো, আসতেও পারে কোনো নারী, যেরকম
বহুদিন পরে আজকে হঠাৎ করে আমি ফিরে এসেছি আমাতে।
আজ তাই মনে হলো ভালোবাসা হবে, আমার চঞ্চুর চারপাশে,
আমার চক্ষুর চারপাশে অনেক উদ্ধত ঠোঁট, রমণীর ব্যগ্র বাহু
আলিঙ্গন লোভে তার বাড়িয়েছে দেহ,–স্নেহ আর ভালোবাসা
মুখর দর্পণ উঠেছে লাফিয়ে নগ্ন জীবনের প্রথম চুম্বনে।
মাথার ওপর থেকে যে চুল ঊর্ধ্ববাহু,
ছাদ ভেঙে উঠে গেছে আকাশের দিকে তা থেকে পায়ের পাতা
পুরোনো স্যাণ্ডেলে মোড়া অবিকল আমি যা তা-ই,
হুবহু চোখের গর্ত, মাংস কম গালের দু’দিকে সতর্ক প্রহরারত
নেমে আসা গোঁফ অবিকল সেই আমি যেন আজো রয়েছি দাঁড়িয়ে
তোমার গন্তব্যপথে, আনন্দে, উল্লাসে কিংবা ব্যর্থ বিষণ্ণতায়।
দেখে দেখে আমি একা হয়েছি দু’জন, এ-পাশে আমার আমি
অন্যপাশে খুঁতখুঁতে তোমার দু’চোখ।
বড় কোলাহল চতুর্দিকে, অথচ আমি তো জানি কী গভীর
শূন্যতাবোধ তাড়া করে এনেছে আমাকে এই নির্ঘুম রাত্রির
দরোজায়, একটি নতুন চোখ আয়নার কাছাকাছি, মুখোমুখি।
আজ তো আমার দেহ সুশোভিত নয় কোনো নতুন পোশাকে,
ঠোঁটে নেই রক্তাক্ত চুম্বনের কোনো দাগ, চোখে নেই ব্যতিক্রম
স্বপ্ন কিংবা সম্ভাবনার অরুণ-উজ্জ্বল কোনো আভা, বুকে নেই
আলিঙ্গন ফেলে আসা কোনো রমণীর অশ্রুভেজা স্মৃতি।
তেমনি যেমন আমি প্রতিদিন শয্যা ছেড়ে
দরোজায় তালা দিয়ে চলে যাই উদ্দেশ্যবিহীন,
তেমনি তো আজও আমি পর্দার কাপড়ে বানানো
পুরোনো পাঞ্জাবি আর উষ্কখুষ্ক বেয়াদপ চুল
এনেছি মাথায় করে এই হোটেলের সুদৃশ কামরায়।
তবে কেন মনে হলো আমিও সুন্দর,
বড়ো বেশি অনেক সুন্দর?
তবে কেন মনে হলো আমার উদ্ধত নাক
যে কোনো নারীর বুকে সহজে বানাতে পারে
মহাসাগরের মতো রক্তময় একটি কবর, তবে কেন
মনে হলো আমার দু’চোখ থেকে উদ্গত হচ্ছে রশ্মি,
ভস্মীভূত হচ্ছে জনপদ, বিশ-শতকের সমস্ত সভ্যতা,
কবিতার অগ্রগতি, পিকাসোর সমস্ত ম্যুরাল পুড়ে-পুড়ে
জ্বলে যাচ্ছে, আগুন আগুন বলে দৌড়াচ্ছে মানুষগুলো
প্রাগৈতিহাসিক বন্য শ্বাপদসংকুল জনপদে?
তবে কেন মনে হলো আমার কর্ণযুগল বনভূমি
আলো করে হয়ে যাচ্ছে রেশমের কোমল খরগোশ,
বড়ো ক্লান্ত, সারাদিন খেলা করে সারারাত ঘুম যেতে চায়
যে-কোনো নারীর তৃষ্ণা, বুকের লজ্জায়।
আমি তো তেমনি আছি—বেমানান কণ্ঠদেশে অনাবশ্যক
তিলের বিস্তৃতি আর গুটানো আস্তিন থেকে
ভেসে-ওঠা স্ফীত শিরা-উপশিরা নিয়ে, এই মধ্যরাতে।
তবে কি রাত্রি গভীর বলে আমি আজ হয়েছি সুন্দর?
আমি তো মাতাল নই, তবে কেন অর্থহীন অযৌক্তিক
এই পক্ষপাত, এই ভালোবাসা, নিজেকে ঘিরেই জন্ম নেয়?
অর্থহীন অসুন্দর প্রতিটি মুখের আঁকে, শিরায় উপশিরায়,
স্নায়ুর তন্ত্রীতে শুধু ভালোবাসা, কী যে ভালো লাগছে আমাকে!
আমার দু’চোখে আজ বড় বেশি ভালোবাসা, বড় বেশি বেঁচে থাকা
যৌবনের, জীবনের আশা, আমি জানি একা একা ভালোবাসা
হয় না কখনো, আমি জানি ভালোবাসা আসে নি আমাতে।
আমি জানি এ শুধুই অভিমান, ভালোবেসে নিজেকেই হত্যা করা,
অভিনয়ে সাজানো বিনাশ।
আমি জানি, প্রতিদিন তিলে তিলে যৌবনের নামে যে সর্বনাশ
রমণীকে ভালোবেসে করেছি আমার, আত্মপ্রবঞ্চনা দিয়ে তার
কোনো স্মৃতি যাবে না ফেরানো। আমি জানি আমার বয়স হচ্ছে–
আমার বয়স হবে, যৌবন কাঁপবে শীতে, তুমি আসবে না।
তুমি আসতেও পারো, আসতেও পারে কোনো নারী, যেরকম
বহুদিন পরে আজকে হঠাৎ করে আমি ফিরে এসেছি আমাতে।
আজ তাই মনে হলো ভালোবাসা হবে, আমার চঞ্চুর চারপাশে,
আমার চক্ষুর চারপাশে অনেক উদ্ধত ঠোঁট, রমণীর ব্যগ্র বাহু
আলিঙ্গন লোভে তার বাড়িয়েছে দেহ,–স্নেহ আর ভালোবাসা
মুখর দর্পণ উঠেছে লাফিয়ে নগ্ন জীবনের প্রথম চুম্বনে।
এখন পর্যন্ত কবিতাটি পড়া হয়েছে ১২০ বার
যদি কবিতাটা সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন