প্রসূন গোস্বামী

কবিতা - রক্তে ভেজা মাটি, কান্নার নদী

প্রসূন গোস্বামী

আমি পলাশপুরের অঞ্জলি,
ছেঁড়ে আইছি সেই গেরাম থাইক্যা,
যেখানে পাখির গান হুনতাম,
নদীর ঢেউয়ের নাচন দেখতাম।
বাপ-দাদার ভিটা আছিল—
পদ্মাপাড়ের নরম মাটিত—
এহন এই ফ্যাক্টরির ঘিনঘিনে আওয়াজ—
আমার কানের পোকা।

মেশিনের ক্যাঁচক্যাঁচানি—
সুইয়ের গ্যাঁজগ্যাঁজানি—
সব মিশ্যা এক দমবন্ধ করা চ্যাঁচানি।
আর বুকের ভিতরে জমাট বান্ধা কান্দনের ঢেউ—
যেন কেউ গলা টিপ্পা ধইরা রাখছে।

কাগজওয়ালারা মিছা কথা কয়—
বড় বড় কথা কয়—
কয়—
দেশ নাকি আকাশ ছুঁইছে।
টিভিওয়ালারা হাসে—
রংচং মাখা মুখ দিয়া—
ফালতু গল্প দেয়—
নতুন দিনের স্বপন দেখায়।

কিন্তু আমার চোখে তো শুধু জমাট বান্ধা আন্ধার—
যেন শ্রাবণের মেঘে ঢাকা অমাবস্যার রাইত।
সেই রাইতের লাহান কালো—
যে রাইতে কিছু দেখা যায় না—
শুধু ভয়—
আর অজানা ডর ঘোরে।

এলাকার মাতব্বররা—
ছোট নেতারা—
সব মিশ্যা চ্যাঁচায়—
ক্ষমতার গরম দেখায়—
তাদের খ্যাঁখ্যাঁনিতে—
আমার ছোট্ট কুঁড়েঘরডাও কাঁপে।
আমাদের বস্তিত শুধু ডর—
আর ফিসফিসানি—
যেন মরণের ঠান্ডা নিশ্বাস ঘোরে—
আন্ধারে হাত বাড়ালেই ধরা যায়।

সকালে যখন গার্মেন্টসের লাইন-ম্যান আসে—
ভাঙ্গা গেটখান ক্যাঁচক্যাঁচ কইরা খোলে—
পুরোনো লোহার কান্দনের লাহান—
তখন আমার কলিজা কাঁপে—
পেটের দায়ে তবুও দৌড়াই।

যদি এই কামডাও যায়—
এই মেশিনের পাশে বসনের অধিকারডাও কেড়ে নেয়—
তাইলে খামু কী?
কনে যামু আমি?
এই শহরে তো আমার কেউ নাই—
যেন পায়ের তলার মাটিও সইরা যাইতাছে।

মনে লয়—
দম বন্ধ হইয়া আইতাছে আমার—
আর নিশ্বাস লইতে পারছি না।

এই দেশটা কি তাইলে…
আমার লাহান গরিব মাইনষের লাইগ্যা নরক হইয়া গেল?

এই দেশটা এহন খারাপ মাইনষের হাতে—
যেন ডাকাতের পাল্লায় পড়ছে গেরাম।
যা খুশি তাই করে—
কেউ কিছু কইতে সাহস পায় না—
মুখ খুললেই বিপদ।

মোবারকের দল ঘোরে—
হাতে লাঠি—
মুখে গাইল—
চোখে আগুনের ঝিলিক।
হিন্দু দেখলেই তেড়ে আসে—
যেন আমরা মানুষ না—
অন্য কিছু।

বাপ আমার ডরে কাঁপে—
প্রতি রাইতে ঘুম আসে না চোখে—
শুধু জাগা থাকে—
আর ভগবানের নাম জপে।

একটু ভুল হইলেই মার—
ধর—
নির্যাতন—
নাম দেয় ওরা—
রাজনৈতিক ঝামেলা—
যেন মারধর—
আর রক্তপাতই—
এহনকার রাজনীতি।

আমাদের আজাদির—
যা কিছু আছিল—
যা কিছু সুন্দর আছিল—
সব ভাইঙ্গা চুরমার কইরা দিছে—
যেন শিকড় উপড়াইয়া ফালাইছে—
আমাদের পরিচয়।

এহন এই দেশ পরাধীন—
এক নতুন কইরা বন্দি হইছি আমরা—
দেখা না যাওয়া শিকলে বান্ধা।

চারিদিকে শুধু ভন্ডামির গন্ধ—
ধর্মের নামে পচা বাতাস—
যেন নিশ্বাস লইতেও কষ্ট হয়—
দম আটকাইয়া আসে।

মনে লয়—
এই বাতাস আর বেশি দিন বইলে—
আমরা আর বাঁচুম না।

হিন্দু মাইয়াগো এহন—
বোরখা ছাড়া চলনের উপায় নাই—
যেন নিজের পরিচয় লুকানোই বাঁচন—
না লুকাইলে—
ইজ্জতও বাঁচানো কঠিন।

এক কেমন নিয়ম চলতাছে—
মুখে কেউ কয় না—
কিন্তু চোখের দেখায়—
কাজের চোটে সবাই জানে।

মাইয়ারা সব ঘরে বন্দি—
যেন আকাশ দেখনেরও অধিকার নাই—
দিনের আলোয় বাইর হইলেই ভয় লাগে।

ধর্ষণের বন্যা বইতাছে এই দেশে—
যেন নদীর পানি বাড়তাছে তো বাড়তাছেই—
থামার আর নাম নাই।

কে রাখে হিসাব?
কার কাছে বিচার চাই?
থানায় গেলে উল্টা দোষ দেয় আমাগোরে—
কয়—
সব নাকি আমাগোই ভুল।

অঞ্জলি আমি—
শুধু একটু শান্তিতে নিশ্বাস লইতে চাই—
একটু নিজের লাহান বাঁচতে চাই।

আমার জনম এই সবুজ বাংলায়—
পলাশপুর গেরামে—
শান্ত নদীর ধারে—
যেখানে ডিঙি নাও চলতো—
আর মাছ ধরা পড়তো।

গার্মেন্টসে কাম করি—
সারা দিন মেশিনের ঘড়ঘড়ানিতে—
মাথা ঘোরে—
হাত ব্যথা করে—
তবুও কামাই করি।

কখন যে কাম বন্ধ হইয়া যায়—
মালিকের মন কখন খারাপ হয়—
সেই ডরে তটস্থ থাকি—
যেন এক সুতার উপরে ঝুইল্যা আছি।

সামনে শুধু আন্ধার—
যেন পথ নাই—
দিশা নাই—
শুধু এক গভীর খাদ।

মনে লয়—
আমার দেশটা ধীরে ধীরে মরতাছে—
যেন কেউ বিষ খাওয়াইছে—
আর আমরা সবাই—
সেই বিষের জ্বালায় ছটফট করতাছি।

আর আমিও তার সাথে ডুবতাছি—
যেন এক পাথর বান্ধা পায়ে—
টানতাছে গভীর জলের তলে।

ফ্যাক্টরির টাইম বেল যখন বাজে—
ভোরে আর দুপুরে—
মনে লয়—
ওটা যেন আমার শেষ বিদায়ের ডাক—
কেউ যেন আমার নাম ধইরা ডাকতাছে।

রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশ ঘোরে—
বন্দুক হাতে—
তাদের চোখে সন্দেহ—
আর রাগ—
যেন আমরা সবাই—
চোর ডাকাত।

কেউ হাসে না মন খুইলা—
কেউ কথা কয় না শান্তিতে—
যেন সবার মুখে তালা মারা—
বুকের ভিতরে ভয়।

নিঝুম রাইতে শুধু কান্দনের আওয়াজ ভাসে—
অসহায় মাইনষের চ্যাঁচানি—
আর কুকুরের করুন ডাক—
যেন তারাও জানে—
কিছু খারাপ ঘটতাছে।

আমার মনে লয়—
এই মাটি অভিশাপের বোঝা বইতাছে—
এই মাটিতে আর শান্তি নাই।

আমার মনে স্পষ্ট আছে—
ছোটবেলায় বাপের কাঁধে চড়ে—
বৈশাখী মেলায় যাইতাম—
কত না রংবেরঙের জিনিস দেখতাম—
কত হাসি—
কত আনন্দ আছিল সেই মেলায়।

মা তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালাতো সন্ধ্যায়—
আর বড়দা পুকুরে ডুব দিয়া—
আনতো শাপলা ফুল—
সেই শাপলা দিয়া মা—
কত সুন্দর মালা গাঁথতো।

তখন আকাশটা কত পরিষ্কার আছিল—
মেঘ ছাড়া নীল আকাশ—
আর বাতাস কত ঠান্ডা—
যেন প্রাণ জুড়াইয়া দিত।

এহন সব মনে লয় ধোঁয়া ধোঁয়া—
যেন পুরানো দিনের গল্প—
রূপকথার লাহান।

ফ্যাক্টরির ধুলো—
আর কষ্টের দাগ আমার মনে—
আমার স্বপনে।

মনে লয়—
সেই সুখের দিন—
আর কোনোদিন ফিরব না—
যেন কেউ চুরি কইরা নিয়া গেছে সব।

এই দেশটা যেন পোড়া বাড়ি—
যেখানে আগুন লাগছিল—
আর এহন শুধু ছাই—
আর ভাঙা ইট পইড়া আছে—
আর সেই পোড়া গন্ধ—
আমার নাকে লাগে।

আমার বুকের ভিতরে শুধু কষ্ট—
যেন পাথর চাপা দিছে কেউ—
আর সেই পাথরটা—
ধীরে ধীরে আমার কলিজাটা—
ছিঁড়ে খাইতাছে।

চোখের পানি শুকাইয়া গেছে—
কান্দতে কান্দতে—
আর পানি নাই চোখে—
শুধু একটা শুকনো—
কাঠ ফাটা কান্দন জমা আছে।

আর কান্দনেরও যেন শক্তি নাই—
শরীর অবশ হইয়া গেছে।
শুধু একটা খালি খালি ভাব—
যেন সব কিছু কেড়ে নিছে—
আর ভিতরে কিছু নাই।

মনে লয়—
আমি যেন মরা মানুষ—
যার কোনো আশা নাই—
কোনো ভরসা নাই—
শুধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস—
বুকের ভিতরে ঘোরে।

আমার দেশটা মনে লয়—
নিজের হাতে—
নিজের গলা টিপ্পা মারতাছে—
ধীরে ধীরে শ্বাস বন্ধ কইরা দিতাছে।

আর আমিও তার সাথে—
তলিয়ে যাইতাছি আন্ধারে—
যেন একটা গভীর গর্তে পইড়া যাইতাছি—
আর কেউ হাত ধইরা তোলার নাই।

১৯১
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন