সলিল চৌধুরী

আমাকে দেখতে ঠিক আমার মতো নয়
ওদের আমি বলেছিলুম
ওরা কেউ বিশ্বাস করে নি, তুমিও করো নি।
তাই একদিন সকালে
আমি একটা বিরাট গাছ হয়ে
নদীর ধারে দাঁড়িয়ে রইলুম।
একঝাঁক পাখিকে ডেকে পাঠালুম,
ওরা আমার ডালে বসে
‘সিম্ফনি’ বাজাবে বলে।
তুমি যখন চান করতে আসবে
তোমাকে শোনাব বলে।

তুমি এলে
আমার ছায়ায় খানিক
অন্যমনস্ক বসে রইলে
ওরা সবাই গাইল
আমি কত সির সির করে
পাতা নাড়লুম, ফুল ঝরালুম
তুমি জল ভরে চলে গেলে
আমাকেই চিনতে পারলে না
হায়রে দুঃখ!

ওই যে আয়নার সামনে
চুল আঁচড়াচ্ছে নিজেকে দেখছে
দাঁড়িয়েনাকের উপর একটা খিমচানো কালো দাগকে
ঘসে ঘসে তোলার চেষ্টা করছে
গোঁফের কয়েকটা সাদা চুলকে
কাঁচি দিয়ে কেটে কেটে
বয়সকে ব্যাক গিয়ারে নেবার চেষ্টা করছে
ও লোকটা যে আমি নই
একথা কাউকো বোঝাতো পারলুম না

তাই একদিন আমি
একটা কালো চাদর হয়ে
বিছানায় তোমার পায়ের কাছে পড়ে রইলুম
তোমার ঘুমন্ত পায়ে চুমু খেলুম
ভোরের সিরসিরে হাওয়ায়
যখন আমাকে বুকে টেনে নিলে
তোমাকে জড়িয়ে জড়িয়ে
কত আদর করলুম
. খস খস করে কথা বললুম,
তুমি টেরই পেলে না—
তুমি চোখ বুজিয়ে তখন
সেই লোকটা কথাই ভাবতে থাকলে
যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে
গোঁফ ছাঁটে চুল আঁচড়ায়
কপালে বয়সের লাথির দাগকে
পাউডার ঘসে মুছে ফেলে
স্থান কালের গণ্ডীতে বাঁধা থেকেও
সময়কে যে হারাবার বৃথা চেষ্টা করে
যে লোকটাকে সবাই আমি
. বলে ভুল করে
একটা নাম ধরে ডাকে
সেটা নাকি আমারই নাম
. হায়রে কষ্ট!!

ইতালির জঙ্গল থেকে
একটা গাছ কেটে তক্তা বানিয়ে
একটা কাঠুরে
‘ট্যাডিভারিয়াম’ বলে একটা লোককে
বিক্রি করেছিল—
একটা বেহালা বানিয়ে
পাগাজিনি বলে একটা
পাগলকে দিয়েছিল
লোকটা ছড়ির টান দিয়ে
যখন সেটা বাজাতো
যে আদি রসের পুষ্টিতে ওই গাছটা বেঁচেছিল
সেদ রস রক্ত হয়ে
ফোঁটা ফোঁটা করে পড়ত
কেউ দেখতে পেত না
শুধু একটা লোক
. একটা বোতল ভরে
সেই রক্তটাকে মদ বলে বিক্রি করতো—
যেই সেটা খোত
সে আস্তে আস্তে একটা গাছ
গাছ থেকে তক্তা
তক্তা থেকে বেহালা হয়ে গিয়ে
টান টান শিরার তারে
বাঁধা হয়ে যেত
তোমাকে বলেছিলুম
তুমি বিশ্বাস করো নি

তাই একদিন আমি চুপচাপ
সেই মদ খেয়ে
বেহালা বনে গিয়ে
একটা বাক্সে লুকিয়ে রইলাম
তুমি যখন কনসার্ট শুনতে গেলে
আমি তখন ইহুদি মেনুহিনের হাতে
নানান সুরে নানা ভাবে
হাসলুম গাইলুম কাঁদলুম
তুমি আমাকে বুঝতেই পারলে না
. হায়রে ভ্রম!

যে মানুষটার মধ্যে আমি থাকি
তার খিদে পায় ঘুম পায়
ব্যাথা লাগে কষ্ট হয়
বয়স বাড়ে বৃদ্ধ হয়
তোমার নারীদেহের মধ্যে
যে তুমি থাকো
তার চেয়ে বেশি করে
তোমার দেহকে তার প্রয়োজন হয়
সে মানুষটার উপর আমার বড়ো মায়া
তাকে আমি সাবান মাখিয়ে চান করাই
খাবার দিয়ে খিদে মোটাই
ভালো জামাকাপড় পরাই
সাজাই গোছাই
তার আনন্দে আমি হাসি
তার ব্যর্থতায় ব্যথা পাই
কিন্তু তোমার মতো তাকেও
আমি কিছুতেই বোঝাতে পারলুম না
যে — সে আমি নই
তার মতো করে
আমার জন্ম হয় না মৃত্যু হয় না
বয়স বাড়ে না বৃদ্ধ হই না
তার মতো করে
আমার শরীর আবরণ দিয়ে
লজ্জা ঢাকতে হয় না
তার মতো করে
আমার সময় ঘড়ির কাঁটায় ধড়া পড়ে না
বছর মাস দিন দিয়ে
গোনা যায় না
আমার কখনো শেষ হয় না
তার কারণ
আমার কখনো শুরুই হয় নি
শুরু আর শেষের যে অঙ্ক
তার হিসাব আছে
সেটা আমার
ধারাপাতে নেই
কারণ আমার ধারাপতই নেই।

তবু তার সমাপ্তির আশঙ্কায়

৪৬২
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন