সমরেশ মজুমদার

গল্প - হে বৃক্ষনাথ

লেখক: সমরেশ মজুমদার | গ্রন্থ - মন ধোয়া যায় না
প্রকাশ - রবিবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ ধরণ: অন্যান

‘জয় বৃক্ষনাথ, তোমার দয়ায় এই পৃথিবী এখনও সন্তান প্রসব করে যেতে পারছে। তোমাকে শত কোটি প্রণাম।’ ভোররাতে ঘুম ভাঙার পর, সেই ঘর— যা পঁচিশ বছর আগে কোনোরকমে মাথা গোঁজার জন্য বানিয়েছিলেন শ্রীপতি, বেরিয়ে এসে সমস্ত শরীর মাটিতে বিছিয়ে প্রণাম করার সময়, মন্ত্র উচ্চচারণের মন নিয়ে শব্দগুলো চারপাশে ছড়িয়ে দিলেন। তখন কয়েকশো পাখি দিন ফোটার আনন্দে লক্ষ লক্ষ গাছের ডাল থেকে ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে আনন্দের চিৎকার করে চলেছে। শ্রীপতি খুশি হলেন। ওই পাখিরাও তাঁকে নকল করে বলে চলেছে, ‘জয় বৃক্ষনাথ, জয় বৃক্ষনাথ!’

বৃক্ষের কোনো লিঙ্গ নেই। তাঁর ইচ্ছেমতো তিনি পিতা হতে পারেন, ইচ্ছে বদলে গেলে, মাতা। তিনি ভগবান! তিনি ফুল দেন, ফল দেন। পাতা, ডাল থেকে শেকড় —সবই তাঁর দান, যা পাখি থেকে মানুষকে সমৃদ্ধ করে। তাঁর শরীর থেকে নির্যাস বের করে মানুষ নিজের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে মজবুত করে। এখন শ্রীপতির সামনে—পিছনে তিন লক্ষ বৃক্ষ আর তরু। আহা, সব তরু যদি বৃক্ষ হয়ে উঠতে পারত!

পঁচিশ বছর আগে এই ভূখণ্ড ছিল পাথুরে। মাটি খুঁজতে পাথর সরাতে হত। টাটা থেকে বান্দোয়ান হয়ে গালুডি যাওয়ার পথে এক দুপুরে মনে হয়েছিল, এখানকার পৃথিবী বড় খাঁ—খাঁ। মানুষ নেই কোথাও। তাদের গ্রাম অনেক দূরে। এই সরু পিচের রাস্তার দু’পাশে আদিম কাল যেন অভুক্ত হয়ে নেতিয়ে রয়েছে। কীরকম মায়া লেগে গেল মনে। ঘোরও লাগল। জমির দাম কত? জলের চেয়ে সস্তা। বছরে মাস দেড়েক ছিঁটেফোঁটা ছাড়া বাকি সময় এখানকার আকাশ বাঁজা হয়ে থাকে যে! জল চাও তো হাঁটো তিন ক্রোশ পথ। সেখানে সরকার বাহাদুর দু’—দুটো চাপাকল বসিয়েছে। লাইনে দাঁড়ালে ঘণ্টা দেড়েক পরে জল তো পাবেই। তাই জল বড় মূল্যবান। অন্তত জমির যিনি মালিক তিনি তাঁকে পাগল ভাবছেন। পঁয়তাল্লিশ বছরের আইবুড়ো বোন, যার বিয়ে হয়নি চোখে দেখে না বলে, সংসারের কোনো কাজে না—লাগলেও যাকে অন্তত ভাত আর আলুসেদ্ধ দিতে হয়, তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে যদি কেউ আসে তা হলে লোকটাকে পাগল ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায়? দশ বিঘে জমির মালিক হতে কুড়ি হাজার টাকা দিতে হল। টাটা কোম্পানির চাকরির সুবাদে কিছু টাকা জমানো ছিল, সেটাই কাজে লেগে গেল। তারপরেই একটা টালির ঘর, ইট সাজিয়ে তার ওপর সিমেন্ট ঢেলে সেই ঘরের মেঝের সঙ্গে টাটা থেকে লোক নিয়ে গিয়ে, পাথর সরিয়ে একশো পঁচিশ ফুট নিচে নামতেই পাইপ দিয়ে গলগলিয়ে জল বেরিয়ে এল ওপরে। সেই জলের উচ্ছ্বাস যখন পাথরের ওপর দিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছিল তখন অদ্ভুত দৃশ্যটা দেখতে পেলেন শ্রীপতি। পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে পোকাগুলো। জলের স্রোতে নাকানিচোবানি খাচ্ছে। জীবনে কোনোদিন এমন জলের স্রোত শুধু ওরা কেন, ওদের চোদ্দোশো পুরুষও দেখেনি! এটা মনে আসতেই শ্রীপতি থমকেছিলেন। তাঁর মনে পুরুষ শব্দটি কেন এল? চোদ্দোশো নারী না—থাকলে ওরা এখন কী করে সাঁতার শিখত?

বিপদ বাড়ল। ভোর হতে না—হতেই জায়গাটা যেন বাজার। কাছাকাছি গ্রাম থেকে মানুষের ঢল নামল তাঁর টালির ঘরের সামনে—জল চাই, জল দাও। তুমি একা মানুষ তোমার এত আছে, আমরা অনেক, আমাদের এক ফোঁটাও নেই। শ্রীপতিরও তাই মনে হল। যেখানে গাছ আছে, শ’য়ে শ’য়ে গাছ, তারা মাটির নিচের জল শেকড় দিয়ে শরীরে টানে। ওই জলের মালিকানা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।

শ্রীপতি রাজি হলেন। কিন্তু বললেন, ‘জল যেখান থেকে উঠে আসছে তার ওপর পাথরের চাপ পড়ছে। আপনারা রোজ একটু একটু করে পাথর সরিয়ে দিন। আমি এখানে গাছ লাগাব!’

এক কথায় সবাই রাজি। কিন্তু গাছ? এখানে গাছ! ওরা এতকাল পাহাড়ের কোলে যে—সব গুল্ম দেখে এসেছে তাকেই গাছ ভেবে নিয়েছে। এখানে গাছ হবে?

শ্রীপতি স্বপ্ন দেখলেন এবং দেখালেন, ‘হবে, হবে। বড় বড় বৃক্ষ হবে। তার পাতার ছায়া মাটিতে পড়বে। দূরদূরান্ত থেকে পাখিরা উড়ে এসে আর ফিরে যাবে না। তারপর সেই গাছগুলোর আকর্ষণে শুকনো আকাশ একটু একটু করে ভিজে হয়ে উঠবে। সেই ভেজা আকাশ থেকে জল ঝরবে মাটিতে।’

দু’বেলা জল ভরে নিয়ে অকৃতজ্ঞ হয়নি মানুষরা। শ্রীপতি দেখলেন, তাঁর দশ বিঘে জমির ওপর থেকে ওরা সমস্ত পাথর তুলে সামনের রাস্তায় সুন্দর করে বিছিয়ে দিয়েছে। তারপর সময় পেলেই চাপাকলের হাতল টেপা আর জলের ধারা জমির সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ চলল। কয়েকদিন পর ভোর ভোর নাকে গন্ধটা লাগল। সোঁদা গন্ধ। শ্রীপতি হাসলেন। বুঝলেন, তাঁর জমির মাটি ঋতুমতী হয়েছে!

টাটা থেকে এল, ঘাটশিলা থেকেও। প্রভিডেন্ট ফান্ডের অনেকটা লেগে গেল সেসব করতে। দশ ভাগ চারা নেতিয়ে গেলেও নব্বই ভাগ তরতর করে মাথা তুলতে লাগল। আর সেই সময় লোকটা এল একটি বালককে নিয়ে। এই জমি একদা যার ছিল তার ভাই ওই লোকটা। বলল, ‘বাবু, আমি সংসার ছেড়ে চলে যাচ্ছি। হিমালয় আমাকে ডাকছে।’

শ্রীপতি অবাক হলেন, ‘সে কী! কী করে বুঝলে?’

‘শয়নে, স্বপনে, জাগরণে ভগবান যেন বলেন, আয় হরিদ্বারে আয়। আমার জমিজমা, ঘরবাড়ি নেই। বউ ছিল, সে—ও মরেছে গলায় দড়ি দিয়ে। দাদার আশ্রয়ে লাথিঝেঁটা খেয়ে ছিলাম। আর নয়, এবার হরিদ্বারে চলে যেতে চাই।’ লোকটা বলল।

‘তা আমার কাছে এলে কেন, কী করব আমি?’

‘বাবু, এটা আমার ছেলে। ওর মা নাম রেখেছিল দুখী। দুখীরাম। ওর জেঠি ওকে সহ্য করতে পারে না। ওর দোষ হল, কথা বলতে পারে না। আপনি যদি ওকে আশ্রয় দেন, আপনার সব কাজ ও হাতে হাতে করে দেবে, বড় নরম মন ওর। ওকে আপনি আশ্রয় দিলে আমি নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারি।’ লোকটা বলল।

শ্রীপতি তাকালেন ছেলেটির দিকে। বছর ছয়েক বয়স। ছেঁড়া খাকি হাফপ্যান্ট, পাঁজর বের করা খালি গা। তার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। সব স্থির হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। বললেন, ‘এই ছেলে, ওই পলাশ গাছের পাশে গিয়ে দাঁড়া দেখি। কে বেশি লম্বা, তুই না ওটা?’

ছেলেটা ঘাবড়ে গেল। এরকম আদেশ কেউ তাকে কখনও করেনি। তার বাবা বলল, ‘যা, ওঁর কথামতো কাজ কর।’

ছেলেটা হেঁটে গেল পলাশ গাছের চারার পাশে।

শ্রীপতি হাসলেন, ‘বাঃ, একদম মাথায় মাথায়। গাছ যেমন লম্বা হবে তোকেও তার সঙ্গে তাল রেখে লম্বা হতে হবে বুঝলি!’

লোকটা বলল, ‘হে হে, মানুষ কি গাছের সঙ্গে পারে!’

মাথা নাড়লেন শ্রীপতি, ‘বেশ, থাক। যতদিন কথা শুনবে ততদিন থাকতে পারবে। তবে হ্যাঁ, ওই নাম এখানে চলবে না। দুখী নয়, এখানে থাকতে হলে ওর নাম হবে সুখী, সুখরাম…’ বলে তাকালেন ছেলেটির দিকে। সুখী তখন পলাশ চারার কচি পাতায় আঙুল বোলাচ্ছে আলতো করে। শ্রীপতির মনে হল, এ থাকবে।

এক বছরের মধ্যে জমির চারপাশের গাছগুলো যেন বৃক্ষ হওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠল। এক বিকেলে কোথা থেকে দুটো ঘুঘু এসে বসল আমগাছের ডালে। বসে অদ্ভুত গলায় ডাকতে লাগল। সুখী ছুটে এল শ্রীপতির কাছে। হাত ধরে টেনে নিয়ে আঙুল তুলে গাছের ডালে প্রায় গায়ে গা মিশিয়ে থাকা পাখিদুটোকে দেখাল। খুশি হলেন শ্রীপতি। বললেন, ‘তোমরা কোন কানন থেকে এলে গো!’ তারপরেই শব্দ করে হেসে উঠলেন। সুখী অবাক হয়ে তাকাল। হাসির কারণ কী? শ্রীপতি যেন নিজের সঙ্গে কথা বললেন, ‘লোকে বলে, সর্বস্বান্ত হলে ভিটেয় ঘুঘু চরে। এত পাখি থাকতে তোরাই নন্দ ঘোষ হয়ে গেলি!’

সুখী শব্দ করল। ও যখন প্রবলভাবে কিছু বলতে চায় তখন গলা থেকে ওই রকম শব্দ বের হয়। সেটা শোনার পর শ্রীপতি ছেলেটার সামনে হাঁটু মুড়ে বসলেন, ‘ঠিক আছে, এভাবেই বল, অ।’

সুখী তাকাল। তৃতীয়বার বলার পর সে শব্দ বের করল কিন্তু সেটা অ—এর ধারে কাছে গেল না। তবে শ্রীপতি ছাড়ার পাত্র নন। দশ মিনিট ধরে চেষ্টা করে করে গলার শিরা ফুলে উঠছে দেখে, ছেলেটাকে ছেড়ে দিলেন। বেচারা কোনোদিন অ—আ—ই—ঈ বলতে পারবে না? কোনোদিন অক্ষর চিনবে না? আর তখনই শব্দটা ছিটকে বের হল সুখীর মুখ থেকে, ‘অ! অ!’

সুখী তাকিয়ে রয়েছে তাঁর পিছন দিকে। ওর চোখ বিস্ফারিত। দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকালেন শ্রীপতি। তিন ফুট লম্বা হয়ে ফণা তুলেছে কেউটে সাপ। আর—একটু এগোলেই সে শ্রীপতির শরীরে বিষ ঢেলে দিতে পারবে। চকিতে সরে আসতে আসতে দেখলেন সুখী জোরে জোরে হাততালি দিতে দিতে লাফাচ্ছে আর তার মুখে শব্দ ছিটকে আসছে, ‘অ, অ, অ!’

সেদিনই মাথায় এসেছিল ভাবনাটা। এখানে স্কুল বলতে সেই বান্দোয়ান আর গালুডিতে। দশ থেকে বিশ মাইল হেঁটে বাচ্চচাদের পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই অনন্তকাল থেকে একে পর এক জন্মে যাওয়া এখানকার শিশুরা হিন্দি, বাংলা অক্ষর চেনে না, ইংরেজি তো স্বপ্নের বাইরে। এরা বড় হয় প্রাকৃতিক নিয়মে। শরীরে শক্তি যতদিন থাকে ততদিন তার বিনিময়ে খাদ্য সংগ্রহ করে। কেউ দু’মাসের চাষবাস থেকে ফসল তুলে সারাবছর আধপেটা খেয়ে থাকে, দলে দলে চলে যায় বাইরে, কাজের সন্ধানে। গিয়ে ভাবে, শহরের বাবুরা কী আরামে আছে। সেই আরামের কণামাত্র তাদের গ্রামে পৌঁছায়নি। আগের প্রজন্ম এটাকে স্বাভাবিক ভেবে নিয়েছিল, এখন গুমরে উঠলেও এরাও একই পথে হাঁটছে। শ্রীপতির মনে হল, এত গাছ তিনি পুঁতেছেন, গাছগুলো একটু একটু করে বৃক্ষ হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সুখীরামের মতো বাচ্চচাগুলোকে যদি অক্ষর চেনাতে পারতেন, অক্ষর থেকে বাক্য। সেই বাক্য উপুড় হয়ে স্লেটে লিখত আর মুছত। তাই করতে করতে ওদের কেউ সাইকেল চালিয়ে বান্দোয়ানের স্কুলে, সেখান থেকে কলেজে গিয়ে এক—একজন এক—একটা বৃক্ষ হয়ে নতুন পথ দেখাতে পারত। এই পারাটাকে ভাবনায় না—রেখে বাস্তবে নিয়ে এলে কেমন হয়!

জমির একপাশে বড় একচালা ঘর তৈরি হবে। একা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় তাই টাটানগরের কর্মক্ষেত্রে ফিরে গিয়ে আইনসম্মতভাবে অবসর নিয়ে কিছু ভাতা হাতে পেলেন। তারপর বন্ধু বা পরিচিতদের কাছে হাত পাতলেন। কেউ দিলেন, দিলেন না অনেকেই। কিন্তু খবর ছড়িয়ে গেল। টাটানগরের ভালো চাকরি ছেড়ে দিয়ে শ্রীপতি জঙ্গলমহলের শিশুদের অক্ষর চেনাতে স্কুল খুলতে চান।

চালাঘর তৈরি হওয়ার পর টাটানগর থেকে একটা গাড়ি এল। নামী বহুজাতিক কোম্পানির অফিসাররা গাড়ি থেকে নেমে ঘুরে ঘুরে দেখলেন। শ্রীপতির সঙ্গে কথা বললেন। তাঁরা ফিরে যাওয়ার তিনদিন পরে চিঠি এল। সেই কোম্পানি এই সংস্থার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট জানতে চেয়েছে। সংস্থা নেই। তাই টাটানগরের প্রিয় বন্ধুদের নিয়ে একটা সংস্থা তৈরি করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হল। তারপর সেই কোম্পানির চেক এল। এক লক্ষ এক টাকা অনুদান দিলেন তাঁরা। শ্রীপতি তাঁর গাছেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জয় বৃক্ষনাথ! সবই তোমার কৃপা।’

প্রথমে অনেক অনুরোধের পর, আটটা শিশু এল যাদের পায়ে একটা আধছেঁড়া চটিও নেই। পেট—পিঠ এক হয়ে গেছে!

আটজনকে নিয়ে এসেছিল তাদের বুড়োবুড়ি অভিভাবকরা। তাদের বিদায় করতে চাইলেও তারা বেশি দূরে গেল না। শিশুগুলোকে প্যান্ট খুলিয়ে দাঁড় করালেন শ্রীপতি। তারপর চাপাকলের মুখে প্লাস্টিকের পাইপ ঢুকিয়ে তাদের স্নান করালেন। স্নানের এমন আনন্দ ওরা বোধ হয় কখনও পায়নি। আবার প্যান্ট পরিয়ে লাইন দিয়ে বসিয়ে সুখীকে ইশারা করলেন। ভোর ভোর ফেনাভাত আর আলুসেদ্ধ করা ছিল, সুখী শিশুদের সামনে প্লাস্টিকের থালায় তা ধরে দিতে ওরা তখন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সম্বিৎ ফিরতেই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ল থালার ওপর। শ্রীপতি চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেলার শব্দ শুনলেন। খাওয়ার পর হাতমুখ ধুইয়ে সুখীকে বললেন ওদের একচালার নিচে নিয়ে যেতে। স্নান সেরে খাওয়া হয়েছে, এখন পড়াশোনা আরম্ভ হবে। নিজের টালির ঘর থেকে বড় স্লেট আর চক নিয়ে চালাঘরের কাছে পৌঁছে শ্রীপতি দৃশ্যটা দেখলেন। আটটি শিশু চালাঘরের নিচে পাটির ওপর পড়ে আছে। প্রত্যেকের চোখ বন্ধ, এর মধ্যেই ঘুমে কাদা হয়ে গেছে সবাই। হয়তো জীবনে এই প্রথমবার পেটভর্তি ভাতের আরাম ওদের শরীর শিথিল করে দিয়েছে। শ্রীপতি দেখলেন, খানিকটা দূরে বসে সুখী ঘুমন্ত শিশুদের দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রীপতি ঠিক করলেন, ওরা আজ ঘুমোক। কাল থেকে পড়াশোনার পথ বের করতে হবে।

জয় বৃক্ষনাথ! মানুষ নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মারছে কারণ তাদের কৃতজ্ঞতাবোধ নেই। বৃক্ষনাথ, তুমি না—থাকলে মানুষ পৃথিবী থেকে ধ্বংস হয়ে যেত। মুখ তুলে তাকালেন তিনি। এই পঁচিশ বছরে লক্ষ গাছ আরও লক্ষ গাছের জন্ম দিয়েছে এখানে। তাদের জায়গা দিতে জমি কিনতে হয়েছে শ্রীপতিকে। সন্তানের সংখ্যা বেড়ে গেলে বাড়িতে তো ঘর বানাতেই হয়। সেইসব চারাগাছগুলো এখন বিশাল বৃক্ষ। সেই দুটো পাখি কোথায় হারিয়ে গেছে, এখন নানা জাতের পাখির ভিড় এখানে, কাঠবিড়ালিরা সাহসী হয়ে দৌড়ে বেড়ায় চারধারে। চালাঘরটা নেই। তার জায়গায় দোতলা স্কুলবাড়ি হয়ে গেছে। টাটা থেকে কয়েকজন সব ছেড়ে চলে এসেছেন বাচ্চচাদের পড়াশোনা শেখাবেন বলে। তাঁদের থাকার জন্যে ঘর বানাতে হয়েছে। বিশাল উনুন দিনরাত জ্বলে খাবার তৈরি করার জন্যে। ব্যাঙ্ক বাস দিয়েছে। সেই বাস ভোরের অন্ধকার থাকতে বেরিয়ে যায় পাহাড়ি গ্রাম থেকে বাচ্চচাদের নিয়ে আসতে। তাদের অঙ্গে এখন স্কুলের ইউনিফর্ম। বাস থেকে নেমে গেট দিয়ে লাইন করে ঢোকার সময় তারা কচি গলায় বলে, ‘গুড মর্নিং স্যার।’

কী করে কোথা থেকে কী হয়ে গেল! পঁচিশ বছর আগে যা ভাবতে পারেননি, তা সম্ভব হল মানুষের ভালোবাসায়। এই যে কালো শিশুরা এসে অ—আ শিখছে, নামতা পড়ছে, বাক্য লিখতে পারছে, কলকাতার এক রিপোর্টার এই এলাকার মাওবাদীদের ইন্টারভিউ করতে এসে জেনে ফেললেন সেকথা। জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনারা সব ভাঙছেন, জ্বালিয়ে দিচ্ছেন, মানুষ মারছেন কিন্তু ওই বৃক্ষনাথের স্কুলকে কিছু বলছেন না কেন? সঙ্গে সঙ্গে কপালে আঙুল ছুঁইয়ে মাওবাদী নেতা বলেছিলেন, ‘আমরা জন্ম দিয়েছি। আমাদের যেমন জন্ম দেওয়া হয়েছিল। আমাদের কেউ মানুষ করার চেষ্টা করেনি। আমাদের বাচ্চচাদের উনি মানুষ করার চেষ্টা করছেন। ওঁর ক্ষতি মানে তো আমাদের বাচ্চচাদের ক্ষতি!’ ব্যস। পরের দিনের কলকাতার নামী কাগজ ছেপে দিল খবরটা। বারুদের বিপরীতে গোলাপ।

যখন বন্দুকের যুদ্ধে সরকার জিতে গেল, বুকে জ্বলুনি মেটার সুযোগ না—পেয়ে জঙ্গলমহল শান্ত হতে বাধ্য হল, তখন শহরের মানুষ আসতে লাগল নিজের চোখে দেখতে। কেউ কেউ আবেগে আক্রান্ত হয়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিল খবরটা। নিঃসম্বল হয়েও মানুষ গড়ে চলেছেন শ্রীপতি। একটু একটু করে সাহায্য আসতে লাগল। শুধু দেশ থেকে নয়, বিদেশ থেকেও বাঙালি টাকা পাঠাচ্ছে এই ভেবে, একটু ভালো কাজ করা যাক।

শ্রীপতির পক্ষে এখন এসব ঝক্কি সামলানো সম্ভব নয়। তার জন্যে কয়েকজন আছেন। কিন্তু এসব নিয়ে যখনই ভাবেন তখন শ্রীপতির মনে হয়, কিছুই তো করা হল না। সেই যে আট শিশু, যাদের তিনি প্রথম দিনে স্নান করিয়েছিলেন তারা এখন কোথায়? ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে দু’জন গিয়েছিল বান্দোয়ানে নাইনে ভর্তি হতে। বাকিরা হয় অটো চালায় নয়তো পানবিড়ি অথবা মুদির দোকান করেছে। এখনও অবধি কোনো ছেলে বা মেয়ে এসে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেনি, ‘আপনি কেন আমাকে অক্ষর চিনিয়েছেন? কেন প্রতিদিন আমাকে গুড মর্নিং বলতে শিখিয়েছিলেন? এমন শিখে আমার কী উপকার হল? যে শেখেনি সে যেমন অটো চালাচ্ছে, আমিও তো তাই চালাচ্ছি! উত্তর দিন!’

না। কেউ প্রশ্নটা করেনি। একজন সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এই যে বাচ্চচারা এখানে পড়তে এলে আপনি ফেনাভাত, সেদ্ধ বা তরকারি খাওয়ান, এটা এক ধরনের ঘুষ দেওয়া নয় কি?’

‘মানে!’ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন শ্রীপতি।

‘ওরা খাওয়ার লোভে আসে। পড়াশোনার টানে নয়। বাড়িতে হয়তো সকালে কিছুই খেতে পায় না তাই এখানে কামাই করে না। দু’দিন খাবার বন্ধ করে দেখুন তো হাজিরার সংখ্যা ঠিক থাকে কিনা!’ সাংবাদিক বলেছিলেন।

মাথা নেড়েছিলেন শ্রীপতি, ‘আমি এভাবে ভাবি না। একটা গাছের চারাকে বড় করতে হলে রোজ জল দিতে হয়। সেই জল ওরা বাড়িতে ঠিকঠাক পায় না, তাই আমি চেয়েচিন্তে ভিক্ষে করে আনি ওদের জন্যে। এর বেশি কিছু নয়।’

জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে সুখীর শরীরটা এগিয়ে এল তাঁর সামনে। বছর বত্রিশের যৌবন ওর শরীরে। যে—পলাশ গাছের পাশে দাঁড় করিয়ে ওর দৈর্ঘ্য তিনি জরিপ করেছিলেন, সেই পলাশ এখন আকাশছোঁয়া। হাসলেন শ্রীপতি, সেই সুখী—ই বা কম কীসে! অন্তত ছ’ফুট হয়ে গেছে ওর শরীর।

‘কিছু বলবি?’ শ্রীপতি জিজ্ঞেস করলেন।

মাথা নাড়ল সুখী, তারপর ইশারা করল অনুসরণ করতে। ওপাশের স্কুলবাড়ি আজ চুপচাপ। রবিবারে এদিকে পাখিরা চলে আসে। উলটোদিকের দোতলার ওপরের ঘরদুটো গেস্টরুম। খাওয়া—থাকা সমেত দিনে ছ’শো টাকা। দোতলার পিছনে প্রচুর গাছগাছালি। সেখানে পৌঁছে সুখী ঘাসের বুকে পড়ে থাকা বোতলটাকে দেখাল। মদের বোতল। মুখ তুললেন শ্রীপতি। কোন ঘরের জানালা দিয়ে এটা ছোঁড়া হয়েছে বুঝতে না পেরে বললেন, ‘ওপরে চল।’

আজকাল সিঁড়ি ভাঙার সময় হাঁটু জানান দেয়। দুটো ঘরের দরজাই ভেতর থেকে বন্ধ। কড়া নাড়লেন তিনি প্রথম দরজার। কোনো সাড়া নেই। তৃতীয়বারে যে দরজা খুলল, তার একমুখ দাড়ি, রুক্ষ চেহারা। খেঁকিয়ে বলল, ‘কেন বিরক্ত করছেন?’

‘বাধ্য হয়ে করছি। আপনারা কি মদ্যপান করে জানালা দিয়ে বাইরে বোতল ছুড়ে ফেলেছেন?’ শ্রীপতি জিজ্ঞেস করলেন।

‘আমরা এখানে মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করতে আসিনি। যারা করছে তাদের বলুন। আর হ্যাঁ, এভাবে হুটহাট বিরক্ত করতে আসবেন না।’ ছেলেটা মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল। তারই ফাঁকে শ্রীপতি দেখলেন, ঘরে যে—দ্বিতীয় ছেলেটি খাটের ওপর বসে আছে, সে যেন ভয়ংকর ভয় পেয়েছে। এরা কারা? গতকাল যখন এসেছিল তখন বলেছিল, আদিবাসীদের সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার কাজ করতে এসেছে। ততক্ষণে দ্বিতীয় দরজার কড়া নেড়েছে সুখী। কোনো সাড়া নেই। তৃতীয়বারেও যখন দরজা খুলল না তখন শ্রীপতি বললেন, ‘দরজা ভেঙে ফেল।’

দু’মিনিটে কাজটা করে ফেলল সুখী। ঘরে ঢুকে নাকে আঙুল চাপলেন শ্রীপতি। মদ এবং গাঁজার কটু গন্ধ যেন চাপ হয়ে রয়েছে। সামনে বিছানার ওপর দুটো শরীর পড়ে আছে। দু’জনের পরনে হাফপ্যান্ট, ছেলেটির ঊর্ধ্বাঙ্গে কিছু নেই, মেয়েটির আঁটোসাঁটো গেঞ্জি। দু’জনের চোখ খোলা, হাতে হাত, পায়ের ওপর পা। শ্রীপতি এগিয়ে গিয়ে কয়েকবার ডাকলেন। কোনো হুঁশ নেই। তারপর নাকের নিচে আঙুল রাখলেন দু’জনের। না, মারা যায়নি।

এখানে মোবাইলের লাইন পাওয়ার চেয়ে লটারির পুরস্কার পাওয়া সহজ। একটা কাগজে কয়েকটা লাইন লিখে সুখীকে পাঠিয়েছিলেন বিএসএফের ক্যাম্পে। আধমাইল দূরের সেই ক্যাম্পের ইনচার্জ শ্রীপতির গুণমুগ্ধ। সাইকেলে তাঁকে চিঠি পৌঁছে দেওয়ামাত্র তিনি লোকজন নিয়ে হাজির হলেন দুটো গাড়ি নিয়ে। জ্ঞানহীন শরীরদুটো নিয়ে একটা গাড়ি ছুটল বান্দোয়ানের হেলথ সেন্টারে। ওরা সম্পর্ক লিখিয়েছিল স্বামী—স্ত্রীর, পকেটে যে—আইডেন্টি কার্ড পাওয়া গেল তার সঙ্গে ছেলেটি যে—নাম এখানে ঢোকার সময় বলেছিল তা মিলছে না।

দ্বিতীয় ঘরের দরজা খুলছিল না। যখন ভাঙার চেষ্টা হল তখন বিকট শব্দে বোমা ফাটল। ভেতর থেকে গুলি ছোড়া শুরু হতেই, বিএসএফের জোয়ানরা পালটা আক্রমণ করলেন। দশমিনিট পরে সব শান্ত হলে ওঁরা মৃতদেহ দুটোর সঙ্গে এক বাক্স অস্ত্র নিচে নামিয়ে আনলেন। শ্রীপতি দেখলেন, সেই দাড়িওয়ালা ছেলেটিকে। মুখের সেই রুক্ষতা এখন এক ফোঁটাও নেই। বান্দোয়ান থানা থেকে পুলিশ এল। সব শোনার পর মৃতদেহ দুটো নিয়ে চলে গেল ওরা।

সবাই চলে যাওয়ার পর শ্রীপতি তাঁর সহকর্মীদের ডাকলেন। বললেন, ‘অচেনা অজানা কাউকে আর ঘর ভাড়া দেওয়া হবে না। তাতে যদি অভাব বাড়ে তাও সহ্য করতে হবে।’

সবাই একমত হল। যিনি টাকাপয়সার দায়িত্বে আছেন তিনি বেশ কুণ্ঠার সঙ্গে জানালেন, ‘এই মাসে অনুদানের পরিমাণ খুব কম। কীভাবে সব খরচ চালানো যাবে তা বুঝছি না। খরচ অনেক কমিয়েও সামলানো সম্ভব হয়তো হবে না।’

দ্বিতীয়জন বলল, ‘আচ্ছা, আমাদের তো অনেক গাছ। তাদের একটা কেটে বিক্রি করলে তো মাসের খরচ উঠে যাবে। আমরা একটা গাছের বদলে দুটো গাছ লাগিয়ে দেব।’

কথাটা সবার মনে ধরলেও শ্রীমতির মুখ দেখে তাঁর মনের কথা কেউ বুঝতে পারল না। ওরা চলে গেলে সুখী এগিয়ে এসে শ্রীপতির সামনে বসে দু’পাশে মাথা নাড়ল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে শ্রীপতির হাত ধরে হাঁটতে লাগল। গাছের পর গাছ, শ্রীপতি যাদের পঁচিশ বছর আগে লাগিয়েছেন, বড় করেছেন, তাদের ভেতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে সুখী সেই গাছটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গত ঝড়ে যে খুব নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। শেকড় উপড়ে গিয়েছিল অনেকটা। একটু কাত হয়ে রয়েছে বিশাল গাছটা। সুখী আঙুল তুলে সেই গাছটাকে দেখাল।

মাথা নাড়লেন শ্রীপতি। তারপর এগিয়ে গিয়ে গাছটার শরীরে হাত বোলালেন। ছেলেমেয়েদের বাপ—মা অনেক কষ্ট করে বড় করে, শিক্ষিত করে। বাপ—মা বৃদ্ধ হলে সেই ছেলেমেয়েরা যদি পাশে দাঁড়ায় তো ভালো, না দাঁড়ালে এখন অনেকেই আপশোস করেন না। স্বাভাবিক ভেবে নেন। এইসব গাছ তাঁর সন্তানের মতো। এদের কেউ কেউ যদি আত্মদান করতে প্রাকৃতিক কারণে বাধ্য হয় তা হলে বৃদ্ধ পিতার মতো তিনি উপকৃত হবেন।

চোখ বন্ধ করলেন শ্রীপতি। নিঃশব্দে বলতে লাগলেন, ‘হে বৃক্ষনাথ, তুমি আমার সহায় হও। এখনও তো ওই বৃক্ষের পাতা সবুজ, এখনও পাখিরা ওর ডালে এসে বসছে। আমি কী করব? যেহেতু আমি মানুষ, প্রয়োজনের সময় আমি যদি চোখ বন্ধ করে থাকি তা হলে আমার বিবেক ঘুমিয়ে থাকবে। হে বৃক্ষনাথ, আমায় তুমি ক্ষমা করো।’

এখন পর্যন্ত লেখাটি পড়া হয়েছে ২১ বার
যদি লেখাটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন