সমরেশ মজুমদার

গল্প - কুসুম আমি জানি তুমি ভালো নেই

লেখক: সমরেশ মজুমদার
প্রকাশ - রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ধরণ: বিরহ

এক চৈত্রের দুপুরে জনমানবহীন ছোটনাগপুরের মালভূমিতে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিলাম। মাথার ওপর আগুন, পায়ের তলা পুড়ছে। যেদিকে তাকাই খাঁ-খাঁ শূন্যতা। সবুজের চিহ্ন নেই। প্রকৃতি যে কত রুক্ষ হতে পারে তার একটা ধারণা হয়েছিল তখন। তোমায় দেখে আজ সেই ছবিটাই মনে এল। কুসুম, তুমি এত নিরাসক্ত হয়ে গেলে কি করে? বর্ষার মেঘে তা থইথই আকাশে যৌবনের যে আনন্দ তা কি করে হারিয়ে যায় চৈত্রের শুষ্কতায়? আজ এতকাল পরে তোমাকে দেখেই বুঝলাম, কুসুম, তুমি ভালো নেই। পাহাড়ি স্টেশনে নেমে চারধারে তাকানোর পর নিজেকেই আগন্তুক বলে মনে হয়েছিল আমার! অথচ সেই বাল্যকালে, আমাদের চোখের সামনে রেললাইন পাতা হয়েছিল, ট্রেন এসেছিল মালা পরে। দিনে দুবার তার যাওয়া আসা। স্টেশনের বাইরে চালাঘরে হরিপদকাকা চায়ের দোকান খুলেছিল। দুবারের ট্রেনে কি আর বিক্রি হত তার। প্রথম স্টেশন মাস্টারের নাম ছিল ঘনশ্যাম ধাড়া। তাঁকে নিয়ে কত হাসাহাসি। চেহারার সঙ্গে নামের এমন রাজযোটক মিল বড় একটা চোখে পড়ে না। লাগোয়া রেল আবাসে ঘনশ্যাম ধাড়া

একাই থাকতেন। টিকিট বিক্রি থেকে ট্রেনকে পতাকা দেখাতে কি আর সময় ব্যয় হত। সারাটা দুপুর আমগাছের নিচে বসে তিনি হরিপদকাকার সঙ্গে ফিস খেলতেন। তারপর আরও একজন বাড়লে, টোয়েন্টি নাইন।

আজ আমার মনে ছবিগুলো এল। কিন্তু হরিপদকাকার দোকানটা বেশ বড় হয়ে গেছে। তার জায়গায় আরও দশটা দোকান। রিকশার ভেঁপু, কুলিদের হইচই। শুনলাম দিনে দশবার ট্রেন দাঁড়ায় স্টেশনে। এখনকার স্টেশন মাস্টার ছিপছিপে সুদর্শন। কথা বলে শুনলাম, ইংরেজি শব্দ বেশি ব্যবহার করেন।

কুসুম, তুমি আর আমি প্রথম দিনের ট্রেন দেখতে এসেছিলাম এখানে। অবশ্য তখন স্টেশনটা তখনকার আমাদের মতো ছিল। এখনকার সব শহরের মতো, তখন আমাদের অনেকের বাড়িতে রেডিও ছিল না। টিভির কথা কেউ শোনেনি। কিন্তু তখন আমাদের আনন্দের অভাব ছিল না।

কুসুম, তখন তোমার বয়স আট, আমি এগারো। প্রথম যেদিন ট্রেন আসবে, আমাদের স্টেশনে সেদিন মফসসল শহরটা প্রায় খাঁ-খাঁ করছিল। সবাই এসে ভিড় করেছে স্টেশনে দু-পাশে। দুটো লাইন সমান্তরাল ওই দিগন্ত থেকে ছুটে এসে অন্য দিগন্তে উধাও হয়ে গিয়েছে। নতুন কোট প্যান্ট, মাথার টুপি, হাতে ফ্লাগ নিয়ে ঘনশ্যামবাবু উদ্বিগ্ন হয়ে পায়চারি করছেন। বড়রা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে বলছেন, সময় নেই, মাঝে-মাঝে ধমকাচ্ছেন, ট্রেন লাইনে যেন কেউ এসে না দাঁড়ায়। হরিপদকাকা চা বিক্রি করে কূল পাচ্ছে না। এই সময় ঝমঝম করে ট্রেন এল। ইঞ্জিনের গায়ে আগের স্টেশনগুলোয় গাঁদা ফুলের মালা পরিয়ে দিয়েছে। এখানকার বড়রাও পরালেন। ঘনশ্যামবাবু গার্ডের সঙ্গে কথা বললেন। তারপর ট্রেন ছাড়ল। ঠিক তখনই কুসুম, তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে, এই ট্রেন কোথায় যাচ্ছে?

কি জানি?

অনেক অনেক দূরে?

হ্যাঁ। লন্ডন দিল্লি–। আমার যা মনে পড়েছিল তাই বলেছিলাম।

যাবে? যাবে একদিন? তুমি বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিল।

ধেত। বাড়ি থেকে ছাড়বে না। টাকা লাগবে, কোথায় পাবি।

তুমি আর কোনও কথা বলনি!

রিকশায় উঠলাম। বিহারি রিকশাওয়ালা। জিজ্ঞাসা করে জানলাম লোকটা কাজের ধান্দায় এখানে এসেছিল দশ বছর আগে। এসেই রিকশা চালাচ্ছে। লোকটা জিজ্ঞাসা করল আমি। কোথায় যাব? সেটা আমিও ভাবছিলাম। আমাদের বাল্যকালে এই মফসসল শহরে কোনও হোটেল ছিল না। রামলাল আগরওয়ালা একটা ধর্মশালা বানিয়েছিলেন কিন্তু সেখানে অবাঙালি ব্যবসায়ীরাই উঠত। ভেবেছিলাম সেখানেই যেতে হবে। কিন্তু স্টেশন চত্বরের এত পরিবর্তন। দেখে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে ভালো হোটেল হয়েছে?

হ্যাঁ বাবু। চারটে ভালো হোটেল, একটা খুব ভালো হোটেল।

খুব ভালোটায় নিয়ে চলো।

একটু বাদেই যে শহরটাকে আমি দেখতে পেলাম তা আমার অচেনা, দারুণ-দারুণ দোকান, নতুন বাড়ি, বিউটি পার্লার থেকে এ টি এম, টিভির শোরুম থেকে পিজার দোকান, যা আছে সব আধুনিক শহরে এখানে তা পাশাপাশি সাজানো, রাস্তাগুলো অনেক চওড়া হয়েছে। যেন আলাদিনের দৈত্য এসে বদলে দিয়ে গেছে সব। আর তখনই আমার ভয় করতে লাগল, কুসুম, তুমি আছ তো, এই শহরে?

খুব ভালো হোটেলের সামনে এসে অবাক হয়ে গেলাম। ইন এবং আউট লেখা দুটো গেট, মাঝখানে অনেকটা সুন্দর লন, ওপাশে ঝকঝকে পাঁচতলা বাড়িটার ওপর লেখা আছে ডে অ্যান্ড নাইট। এত বড় বাড়ি তখন কেউ এখানে চোখে দেখেনি। রিকশাওয়ালাকে ছেড়ে দিয়ে সুটকেশ নিয়ে কাঁচের দরজা ঠেলে পা বাড়াতেই ঠান্ডা লাগল বেশ। বুঝলাম ঠান্ডা মেশিন চলছে। রিসেপশনিস্ট মিষ্টি হেসে বলল, ইয়েস!

প্রতিদিন থাকার জন্যে আড়াই হাজার দিতে হবে। সেসময় কোনও-কোনও বাড়ির কর্তা ওই মাইনের চাকরি করতেন। লিফটে উঠলাম তিনতলায়। প্ল্যাস্টিকের কার্ড ঢুকিয়ে দরজা খুললাম।

যে কোনও ফোর স্টার হোটেলে এরকম ঘর দেখতে পেতাম। মনে পড়ল ছেলেবেলায় আমরা একটা হ্যারিকেনকে ঘিরে তিনভাই বোন পড়তে বসতাম। এই শহরেই। না। আমি ঠিক করলাম, আর অবাক হব না।

দারুণ বিছানায় জুতো সুদ্ধ শুয়ে পড়লাম। কতদিন?কতদিন পরে আমি এই শহরে এলাম? চল্লিশ। হ্যাঁ ঠিক চল্লিশ বছর পরে। এই বছরগুলোয় আমি অনেক লড়াই করেছি কলকাতায়, তারপর লন্ডন, নিউইয়র্কে ঘুরেছি নিয়মিত। এখন যাকে বলে সচ্ছল, আমি তাই। এখানে আমার কথা ছিল না আসার। মনেই ছিল না।

গত সপ্তাহে বাংলাদেশিদের আমন্ত্রণে কানাডার টরেন্টো শহরে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানে ভিড় হয়েছিল বেশ। বক্তৃতা ছাড়াও আমাকে অনুগল্প পড়তে হয়েছিল কয়েকটা। সবাই খুশি। হয়েছিল। অনুষ্ঠানের শেষে অটোগ্রাফ দিতে-দিতে হাত ব্যথা। হঠাৎ চোখ তুলে দেখলাম তুমি। সঙ্গে-সঙ্গে চমকে উঠলাম। চল্লিশ বছর আগের সব স্মৃতি ঝাঁপিয়ে পড়ল একসঙ্গে। একটি বাইশ বছরের মেয়ের মধ্যে তুমি আসো কি করে? সেই নাক, চিবুক এবং চোখ। কিন্তু কোথায় শেষবার দেখেছিলাম যখন তুমি বারো। বারো বছরের মুখটাই যেন একটু পরিণত হয়েছে বাইশে।

আমাকে অবাক হতে দেখে সেই মেয়ে হাসল;

কি হল?

তোমার নাম কী?

ফুল।

বাঃ। চমৎকার। কি করো এখানে?

মাস্টার্স করেছি। সামনের সপ্তাহে চাকরি শুরু করব। আপনার অনেক গল্প আমার পড়া। খুব ভালো লাগে। ফুল হাসতেই আবার তোমাকে দেখলাম আমি,

অনেক ধন্যবান।

আপনি আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন কেন? আমি কত ছোট। তা ছাড়া, আমি আপনি যে শহরে ছিলেন সেখানে জন্মেছি। ফুল বলল।

কোন শহরে?

বাঃ। আপনার মনে নেই? আপনার অনেক বইতে বারবার যে শহরটার কথা লিখেছেন, ভুলে গেছেন?

ও। তাই বুঝি? কোথায়, কোন পাড়ায় তোমার বাড়ি।

আমার পিসির নাম কুসুম। কুসুমকুমারী। আচমকা হৃৎপিন্ড উপড়ে এল গলায়, কথা আটকে গেল।

জানেন, এই যে আমি এখানে পড়তে এসেছি তা শুধু পিসির জন্যে। আমরা তিন ভাইবোন। বাবার ক্ষমতা ছিল না এখানে এতদূরে পড়তে পাঠাবার। পিসি আমাকে খুব ভালোবাসে। আমার দায়িত্ব ছেলেবেলা থেকে পিসি নিয়ে নিয়েছিল।

ও।

আপনার অনেক লেখায় পিসি আছে, না?

হয়তো।

আপনি কীরকম এড়িয়ে যাচ্ছেন। পিসিকে জিজ্ঞাসা করলেও এড়িয়ে যেত।

তোমার পিসি এখন কোথায়?

পিসি তো বাড়িতেই আছে। স্কুলে পড়ায়।

তোমাদের বাড়িতে? মানে আগের বাড়িতে?

হ্যাঁ। পিসি বিয়ে করেনি। দাদু মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল তো। আমি ভাবছি, এবার পিসিকে আমার কাছে নিয়ে আসব।

সেদিন ফুল আমাকে লাঞ্চ খাইয়ে দিল। তোমার কথা আর ও বলেনি, এমনকী এই শহরটা যে এখন বদলে গিয়েছে সেই কথাও না। ও শুধু বলেছে, এখানে ওর আজকাল খুব একা লাগে। জিজ্ঞাসা করাতে মাথা নেড়ে বলেছে, কোনও ছেলের সঙ্গে ওর অ্যাফেয়ার হয়নি। অনেকেই অ্যাপ্রোচ করেছে কিন্তু ওর খুব ভয় করে। ছেলেদের ও বিশ্বাস করতে পারে না। শুনতে ভালো না লাগলেও আমি চুপচাপ ছিলাম।

তারপর থেকেই আমি কোনও কাজে মন দিতে পারছি না। বারংবার মনে পড়েছে কুসুম তোমার কথা। আচ্ছা, আমি যখন পনেরো বছর বয়সে ওই শহর ছেড়ে এসেছিলাম তখন তুমি বারো। আমি কি তোমাকে ভালোবাসার কথা বলেছিলাম তখন? তুমি যখন কিছু বলতে আমি মানে। বুঝতাম না। আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট তুমি তবু কীরকম রহস্যময় ছিল তোমার কথা। আমাদের শহরের প্রান্তে রাজবাড়ির দিঘির পাড়ে নিয়ে তুমি বলেছিলে, দ্যাখো, দিঘির জল দ্যাখো। আমি দেখেছিলাম। তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে, বলো তো দিঘি কার বন্ধু?

ধ্যাত। আমি বলেছিলাম, দিঘি কি মানুষ যে কারও বন্ধু হবে।

তুমি হেসেছিলে, না দিঘি আকাশের বন্ধু। তাকিয়ে দ্যাখো, দিঘিতে আকাশের ছায়া পড়েছে। আকাশের সব রং দিঘিতে।

কুসুম, এগুলো কি ভালোবাসার কথা?তখন বুঝিনি। আজ আমি বুঝতে এলাম। কলকাতায় ফিরে এসেই স্থির করলাম, তোমার মুখোমুখি হব। এই দেখা না হওয়া পর্যন্ত যেন আমার শান্তি নেই।

বিকেল চারটে বাজল।

তৈরি হয়ে নিলাম। তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই দিনের আলোয়। রাত নামলে নয়।

হোটেলের রিসেপশনে যারা সদাজাগ্রত তাদের কারও আমাকে চেনার কথা নয়। একজন। জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি যদি দূরে কোথাও যান তাহলে হোটেলের গাড়ি নিতে পারেন।

মাথা নেড়ে বললাম, দূরে যাব না। তারপর কৌতূহল হওয়ায় জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি নিশ্চয়ই এই শহরের মানুষ নন? চাকরির সুবাদে এসেছেন?

–না, আমার বাড়ি এখানেই।

আচ্ছা! কোন পাড়ায়? এরকম বলিয়ে কইয়ে এরকম নব্য চেহারার মহিলা আমাদের সময়ে এই শহরে ছিল না।

মহিলা বললেন, টেম্পল রোডে আমার বাবা থাকতেন। এখন আমরা থাকি নবাব পাড়ায়।

টেম্পল রোড! খালের পাশের সেই সরু পথটা। যেখানে কালীবাড়ি ছিল বলে ওই নামের রাস্তা হয়েছে। ওখানকার অনেককেই চিনতাম বলে ওঁর বাবার নাম জিজ্ঞাসা করলাম, একটা টেলিফোন অ্যাটেন্ড করে আসার সময় দিলেন মহিলা নিখিলচন্দ্র মিত্র।

অ্যাঁ। নিখিলের মেয়ে?

আপনি আমার বাবাকে চেনেন?

চিনতাম। খুব ভালো লাগল। ওকে আমার কথা বললে নিশ্চয়ই চিনতে পারবে। বাইরে বেরিয়ে এসেও ঘোর কাটল না। নিখিল আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে শান্ত এবং সুদর্শন ছিল। কিন্তু ওর সৌন্দর্যে মেয়েলি ভাবটার বাড়াবাড়ি ছিল। কথাও বলত একটু মেয়েলি ঢঙে। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ যারা পেত না তারা ওর সঙ্গে ভাব করে বেশ মজা পেত। জনার্দন তো ঘোষণাই করেছিল সে কোনও মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবে না। নিখিলই ওর প্রেমিকা। ওর সঙ্গেই সারাজীবন থাকবে।

সেই নিখিলের এত স্মার্ট মেয়ে ভাবতেই পারছি না। নিখিল কি তার স্বভাব এখন বদলে ফেলেছে? জনার্দনের সঙ্গে কি ওর সম্পর্ক এখনও আছে? এসব প্রশ্ন মাথায় পাক খাচ্ছে তখন। একটা রিকশাওয়ালা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে হর্ন বাজাল। রিকশায় উঠলাম। তোমার বাড়িতে যেতে হলে শহরের অনেকটা ডিঙিয়ে যেতে হবে।

তখন ছিল সরু রাস্তা, এখন সেটা বেশ চওড়া হয়েছে। বাঁ-দিকে গুপ্তদের পুকুরটা চোখে পড়তেই জায়গাটাকে চিনতে পারলাম। পুকুরটা এখনও আগের মতো রয়েছে। অল্প জল। হয়তো। সরকারের আইন পুকুরটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে প্রোমোটারদের হাত থেকে। কিন্তু এই রাস্তার দুধারে অনেক ছোট-ছোট দোকান ছিল, তারা কোথায় গেল। এখন সাইবার কাফে, বিউটি পার্লার, আধুনিক ফাস্ট ফুডের দোকান পরপর দারুণভাবে সাজান, মোড়ের মাথায় এসে মনে পড়ল যতীনকাকার কথা। ওর ভাইপো বুলু আমাদের সঙ্গে পড়ত, তখন শহরের একমাত্র বই পত্রিকার দোকানটা ছিল যতীনকাকার। দোকানটা ভেঙে রাস্তা হলেও পাশের দোতলা বাড়ির একতলায় সাইনবোর্ডটা দেখতে পেলাম, বইটই।

হ্যাঁ, ওই নামটাই ছিল তখন কিন্তু আমরা বলতাম যতীনকাকার দোকান। রিকশাওয়ালাকে দাঁড়াতে বলে নিচে নামলাম। বাইরে থেকে বুঝিনি, ভেতরে বেশ ভিড়। আর দোকানটাও ঢের বড়। আগে যা ছিল তাঁর তিনগুণ। চারটি যুবক খদ্দের সামলাচ্ছে। ভেতরের ক্যাশ কাউন্টারে বসে আছেন যে বৃদ্ধ তার ভুরুর চুল সাদা, চুলের কোথাও কালো নেই। আমার মনে যতীনকাকার যে চেহারাটা ভাসছে তার সঙ্গে অনেক তফাত, মনের ছবির মুখে কিছু বলিরেখা, চুল ভুরু সাদা। করে দিতেই এই মুখটি তৈরি হল।

কি বই দেব?

বই চাই না, ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই। চোখের ইশারায় যতীনকাকাকে দেখলাম।

যুবক যতীনকাকাকে জানাতে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে চিনতে চেষ্টা করেও না পেরে উঠলেন। এখনও পাজামা-পাঞ্জাবি পরেন দেখছি।

কাউন্টারের ধারে এসে বললেন, বলুন।

আপনি কী যতীনকাকা?

সঙ্গে-সঙ্গে কপালে ভাঁজ পড়ল, এখন আমাকে সবাই দাদু বলে। আপনি কি আমার ভাইপোর বন্ধুদের কেউ? দাঁড়াও, চোখ বন্ধ করলেন যতীনকাকা, শম্ভু? শম্ভুনাথ?

না। নিজের নাম বললাম।

ওহে। হ্যাঁ, তাইতো, তোমার ছবি তো বই-এর পেছনে প্রায়ই দেখি। তা ছাড়া তোমার মুখাবয়বের তেমন পরিবর্তন হয়নি, এসো, ভেতরে এসো। ভেতরে ঢুকলাম। আদর করে বসতে বললেন। বললাম, আপনার দোকানও বেশ বড় হয়েছে।

তা হয়েছে। তবে সেটা স্কুলবই-এর কল্যাণে। তুমি এখন বিখ্যাত লেখক হয়েছ, এই আমার দোকানেই তোমার প্রচুর বই। স্কুলের প্রাইজ হিসেবে তোমার বই-এর চাহিদা আছে। এই তো দ্যাখো, সামনের সপ্তাহে গার্লস স্কুলের প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন, লিস্টে তোমার অনেক বই আছে। কথা শেষ করে একজনকে ডাকলেন, গার্লস স্কুলের কুসুমদিদিমণি যে লিস্টটা দিয়ে গেছেন ওটা আন তো।

লিস্ট এল, এটা কি তোমার হাতের লেখা। তোমার হাতের লেখাতে কি তখন এমন মুক্তো ঝরত? যতীনকাকা দেখালেন, আমার আঠারোটা বই ওই তালিকায় রয়েছে।

কিছুক্ষণ কথা বলার মধ্যেই প্রচারিত হয়ে গেল আমি কে! একজন ক্রেতা আমার বই কিনে এগিয়ে দিলেন অটোগ্রাফের জন্য।

অটোগ্রাফটা দেওয়ার পর যতীনকাকা জিজ্ঞাসা করলেন, কতদিন আছ?

ঠিক নেই কিছু।

তুমি এই শহরের ছেলে, এখানে ফিরে এসেছ এটা সবার জানা দরকার। একটু প্রচার করলেই দেখবে লোকজন চলে আসবে। তাহলে কাল বিকেলে আমার দোকানে তুমি থাকছ এটাই বলার ব্যবস্থা করি। কুলুর সঙ্গে যোগাযোগ আছে?

না। ও কোথায়?

অস্ট্রেলিয়ায়। যোগাযোগ দূরের কথা, একটা চিঠি লেখে না।

আমি উঠলাম। যতীনকাকু বারংবার বললেন কাল ওখানে যাওয়ার জন্য, রিকশায় বসে ভাবলাম, হয়তো লোকজন আসবে, আমার বই কিনে অটোগ্রাফ নেবে। অর্থাৎ আমাকে দেখিয়ে কাল কিছু লাভ করতে চান যতীনকাকু। এখন তাঁর ব্যাবসা এমনিতেই ভালো। তবুও। আমি সেই ছোট্ট দোকানটায় বসে উনি যখন সারাদিনে তিন-চার জনের বেশি খদ্দের পেতেন না তখনও ওঁকে অন্যরকম লাগত আমাদের। দোকানে গেলেই বললেন, সুকুমার রায় আর অবনীন্দ্রনাথ পড়ো। না পড়লে জীবনটাকে দেখার চোখ তৈরি হবে না।

কুসুম। ভাবতে পারো এই শহরের যে কেউ ছিল না, বয়সে ছোট হওয়া সত্বেও তুমি যা বলতে তা বুঝতে যার অনেক সময় লাগত তাকে অটোগ্রাফ দিতে হবে এখানেই। আমার মোটেই ইচ্ছে করছে না।

ইচ্ছে করেই রিকশাওয়ালাকে বললাম টেম্পল রোড হয়ে যেতে। দেখলাম, ক্যানাল বেশ চওড়া, নৌকো ভাসছে। দু-তিনটে ভাসমান রেস্টুরেন্টও চোখে পড়ল। টেম্পল রোড চওড়া হয়ে গেছে। নিখিলদের বাড়িটাকে ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না। একদিকে ক্যানাল অন্যদিকে সারি-সারি নতুন দোতলা বাড়ি। একটু বেশি আস্থা রেখেছিলাম নিজের ওপর। নিখিলের মেয়ের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে আসা উচিত ছিল।

খোঁজাখুঁজি করলে হয়তো পাওয়া যেত নিখিলকে কিন্তু তাতে দিনের আলো নিভে যেত। রিকশাওয়ালাকে বললাম তোমার পাড়ায় নিয়ে যেতে।

নদীর ধারে তোমাদের বাড়ি। আমার ফুলমাসি থাকতেন ঠিক তোমাদের পাশের বাড়িতে। আমরা তখন খুব ছোট। ফুলমাসির বাড়িতে গেলেই তুমি চলে আসতে। তোমার যখন ছয় বছর বয়স তখন দারুণ ক্যারাম খেলতে। পরপর পাঁচটা গুটি গর্তে ফেলতে অনায়াসে।

দেখলাম অনেক নতুন বাড়ি হয়েছে ওই পাড়ায়। তারপর বাঁধটার কাছে এলাম। বাঁধের গায়ে রাস্তা। রিকশাওয়ালা জানালো নদীকে বাঁধা হয়েছে যাতে পাড়া ভাসিয়ে দিতে না পারে। শেষপর্যন্ত তোমাদের বাড়ি। না টিনের চালটা নেই, একতলা সিমেন্টের সুন্দর ছিমছাম বাড়ি, বাইরে বারান্দা। পাশের ফুলমাসিদেরটা দোতলা হয়েছে। মেসো মারা যাওয়ার পর ফুলমাসি বাড়ি বিক্রি করে চলে গেছেন কলকাতায়, ছেলের কাছে।

ভাড়া না মিটিয়ে রিকশাওয়ালাকে অপেক্ষা করতে বলে গেট খুলে ভেতরে ঢুকলাম। একটি কিশোর বারান্দায় এসে দাঁড়াল। আমাকে জিজ্ঞাসা করল, কাকে চাইছেন?

একটু অস্বস্তি হল। তোমার নাম বললে কি প্রতিক্রিয়া হবে? ছেলেবেলায় এই শহরে কোনও অবিবাহিতা মহিলার কাছে কোনও পুরুষ আসত না। নাম করা দূরের কথা।

হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম কী?

অনুপম।

বাঃ। খুব সুন্দর নাম। কে দিয়েছে?

পিসিমণি।

তাই বলো, তিনি আছেন?

আছেন। আপনি কি পিসিমণিকে চাইছেন?

থম ধরল বুকে। কুসুম; আমরা কি কেউ কাউকে কখনও দেখেছি?

ওঁর সঙ্গে দেখা করতে এলাম।

এখন তো দেখা পাবেন না।

কেন?

বিকেল হলেই পিসিমণির মন খারাপ হয়ে যায়। কারও সঙ্গে কথা বলে না। বিছানায় শুয়ে গীতবিতান পড়ে চুপচাপ।

কিশোরের কথার মধ্যেই একজন মধ্যবয়সি মহিলা দরজায় এলেন, আপনি কোত্থেকে এসেছেন?

আমি নাম বললাম।

আপনি কি লেখক?

হ্যাঁ। ওই আর কি!

ওহো। বসুন প্লিজ। বারান্দায় সাজিয়ে রাখা চেয়ার দেখিয়ে এগিয়ে এলেন মহিলা,

আমরা আপনার লেখার খুব ভক্ত। আমার মেয়ে–!

ফুল?

হ্যাঁ। আপনি জানলেন কি করে?

ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমেরিকায়।

আচ্ছা! দেখুন তো গতকাল ফোন করেছিলাম অথচ একবারও বলেনি। ও আপনার প্রায় সব লেখাই পড়েছে। বসুন। মহিলা আন্তরিক।

বসলাম।

আপনার মতো একজন মানুষ আমাদের বাড়িতে এসেছেন ভাবতেই ভালো লাগছে। আপনার বাড়িও তো এই শহরে ছিল, তাই না?

হ্যাঁ। এখানেই আমি জন্মেছি।

এই নিয়ে খুব গর্ব আমাদের। যখনই এই শহরের কথা লেখেন তখন সবাই খোঁজে, পরিচিত কে আপনার লেখায় এল। আপনি বসুন, দিদিকে ডেকে দিচ্ছি।

যদি ও ব্যস্ত থাকে তাহলে বিরক্ত করার দরকার নেই।

মহিলা হাসলেন, দিদি স্কুল থেকে ফিরে একটু আরাম করে বলেই ওদের বোঝানো হয়েছে মন খারাপ তাই কথা বলবে না, নইলে এ তো বকবক করে মাথা ধরিয়ে দেয়। আপনি চায়ে চিনি। দুধ-খান?

ওই। হ্যাঁ আমি নর্মাল চা খাই।

মহিলা ভেতরে চলে গেলে অনুপম জিজ্ঞাসা করল, আপনি দিদিকে কীরকম দেখলেন?

মোটা না রোগা?

কোনওটাই নয়। খুব সুন্দর।

এই সময় ভেতর থেকে তার মায়ের গলা ভেসে আসতেই সে বলল, চলি!

বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে দেখলাম বাঁধের ওপর ধীরে-ধীরে সন্ধ্যা নামছে। এখানে বসলে আর নদী দেখা যায় না।

এই সময় তুমি এলে। এসে দরজায় দাঁড়ালে। পরনে অফ-হোয়াইট শাড়ি। চুল হাত খোঁপায় জড়ানো। চোখে চশমা। না। একটুও ভারি হয়নি শরীর, তেমন রোগাও নয়। ঈষৎ হাসলে, এগিয়ে এলে কাছে, হঠাৎ?।

এই ঠ-এর উচ্চারণ তুমি ঠিকঠ-এর মতোই করতে। সুচিত্রা মিত্র যেমন গান গাইবার সময় করেন। কখনই ঠট হয় না।

উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, চলে এলাম।

বোসো। এমন গলায় সে বলল যেন কাল বিকেলেও আমাদের দেখা হয়েছিল।

বসলাম। তুমি বললে, শুনলাম, আমেরিকায় গিয়ে ফুলের দেখা পেয়েছিলে?

হ্যাঁ অনেক ফুল, তবে টিউলিপটা ওই সময় ফোটেনি।

তাই? তুমি তাকালে?

হ্যাঁ। ও নিজেই আলাপ করল। আমি ওকে দেখে অবাক হয়েছিলাম। একেবারে পিসির মুখ বসাননা। খুব সপ্রতিভ কথাবার্তা। বলল তুমিই ওর সবকিছু।

তাই এলে?

মানে?

ফুলের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমার কথা মনে এল?

মনে এল নয়। মনে ছিল। ফুল সেটাকে নাড়িয়ে দিল বলতে পারো। ফুল বলল, আপনার সব লেখায় পিসি আছে, না?

বলল?

হ্যাঁ, তা থেকে প্রমাণিত হয় মনে ছিলই।

প্রমাণ তো কেউ চায়নি। তবে হ্যাঁ, তুমি এই কয় বছরে আমাকে কেবলই অস্বস্তিতে ফেলে গেছ।

আমি কি তেমন অন্যায় করেছি?

অস্বস্তিতে ফেলেছি?কীরকম?

এই শহরের যে-কোনও নারী চরিত্র তোমার গল্প-উপন্যাসে এলেই সবাই মনে করে সেটা নাকি আমি? আমার কথা বলার ধরন নাকি তাদের মধ্যেও। স্কুলের অন্য শিক্ষিকারা রঙ্গ করে বলেন, তোমার উচিত ভদ্রলোকের কাছে লেখার অর্ধেক টাকা ডিমান্ড করা। মেয়ে চরিত্র হলেই তার মধ্যে তোমাকে মিশিয়ে দিচ্ছেন? গম্ভীর হয়ে গেল কুসুম, আমি, যত সামান্যই হই, আমিই।

আমি কারও মধ্যে যেতে চাই না। আমাকে কেন আমার মতো একা থাকতে দেওয়া হচ্ছে না তা বুঝতে পারছি না।

আমি তোমার মুখের দিকে তাকাতেই তুমি মুখ ফেরালে। যেন যা বলার বলা হয়ে গেছে আর এ নিয়ে কথা বাড়াতে চাও না।

এই সময় সেই মহিলা চা নিয়ে এলেন। সঙ্গে কিছু খাবার।

কুসুম বলল, ওর নাম দীপা, দীপাবলী। আমার ভাই-এর বউ।

মহিলা বললেন, আমি কিন্তু আপনার দীপাবলীর নামের যোগ্য নই।

কুসুম বলল, ওই এক কথা! দীপাবলী একটা বানানো চরিত্র, তুমি বানান হবে কেন? তুমি তোমার মতো।

বানানো বললেই হল, তাহলে সবাই দীপাবলীর প্রশংসা করে কেন? মহিলা বললেন–

ওটাই লেখকের কৃতিত্ব। যারা প্রশংসা করে তাদের জীবনটা ওই রকম হলে বুঝতে পারত। কাজের অছিলায় মহিলা ভেতরে চলে গেলেন। এবং তখনই আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কুসুম, তুমি কেমন আছ?

সে চোখ ঘোরাল। চশমা খুলে আঁচলে মুছল,

কেমন দেখছ?

বললাম, তুমি ভালো নেই।

এই ভঙ্গিতে তুমি কথা বলতে না।

তুমি যখন আমার কথা বলতে শুনেছ তারপর চল্লিশটা বছর চলে গিয়েছে। একমাত্র আকাশ ছাড়া এত বছরে সবকিছু বদলে যেতে পারে। আমি আকাশনই। পরিবর্তন তাই স্বাভাবিক, পরিবর্তিত হওয়া মানে খারাপ থাকা নয়। কুসুম বলল। কথাগুলো সে বলছিল বটে কিন্তু মনে মনে জানলাম সে ভালো নেই।

কুসুম জিজ্ঞাসা করল, তুমি কেমন আছ জিজ্ঞাসা করব না।

কেন?

ভালো না থাকলে কেউ এত লেখা লিখতে পারে না।

এটা তো একটা অভ্যেস। লোকে যে অভ্যেসে চাকরি করে।

হয়তো। কি জানি। তারপর তাকাল সে আমার দিকে, কেন এলে?

কোথায়? এই শহরে?

হ্যাঁ। এখানে তো তোমার কোনও কাজ নেই।

আমি কোনও প্রয়োজনে আসিনি। এসেছি টানে। এসে দেখলাম শহরটা একদম বদলে গিয়েছে। যে হোটেলে উঠেছি সেসময় এমন হোটেল এখানে কল্পনাও করতে পারতাম না। যতীনকাকার বই-এর দোকানটাও বদলে গেছে। ফিরে গিয়ে যে লেখাই লিখব আমার ছেলেবেলার শহরটার ছবি আর আসবে না।

কোন হোটেলে উঠেছ?

বললাম। সে বলল, বাব্বাঃ। খুব দামি হোটেল।

এই শহরে এসে কোনও হোটেলে উঠব তাই ভাবতে পারিনি আগে। ওঠার পর মনে হয়েছে ঠিক করেছি। হাজার হোক, হোটেলের ঘরগুলো পৃথিবীর সবদেশেই মোটামুটি একই চেহারার। অনাত্মীয় বলে মনে হয় না।

চা শেষ করলাম। মনে হওয়াতে প্রশ্ন করলাম, তোমার ভাই?

ও বড় ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় গিয়েছে।

তাহলে আজ উঠি?

কদিন থাকছ?

থাকার তো আর কারণ নেই। কালই ফিরে যাব।

ফিরে যাবে। হাসল সে, যাও।

উঠে দাঁড়াতেই মহিলা এবং কিশোর চলে এলেন। মহিলা বললেন, কাল ছুটির দিন। দুপুরে এখানেই খাবেন।

কুসুম বলল, উনি কাল সকালেই চলে যাচ্ছেন।

সেকি? কবে এসেছেন?

বোধহয় আজকেই। তাই তো? কুসুম আমার দিকে তাকাল।

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।

আহা! আর একটা দিন থেকে যান না। পরিচিত সবার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

হেসে বললাম, শহরটা এমন বদলে গেছে যে পরিচিতরা কে কোথায় আছে খুঁজে পাব না। তা ছাড়া চল্লিশ বছর বাদে দেখা হলে এতকালের জমে থাকা স্মৃতি যে হোঁচট খাবেই তা আগে বুঝতে পারিনি। চলি!

কুসুম বলল, চলুন, আপনাকে এগিয়ে দিই।

কিশোর জিজ্ঞাসা করল, পিসি, আমি তোমার সঙ্গে যাব?

তার মা ধমক দিল, তুমি যাও, পড়তে বোসো, সন্ধে হয়ে গিয়েছে।

নিচে নেমে বললাম, এগিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। সামনেই রিকশা রয়েছে।

থাক না। ও নিচের রাস্তা দিয়ে বাঁধের শেষে যাক, আমরা বাঁধের ওপর দিয়ে হেঁটে ওখানে পৌঁছে গেলে আপনি চলে যাবেন।

রিকশাওয়ালাকে তাই বলা হল।

ধাপে-ধাপে পা ফেলে যখন বাঁধের ওপর উঠে এলাম তখন নদীর জল আরও কালো হয়েছে। বললাম বাঁধ দিয়ে বন্যা বন্ধ হয়ে গেছে?

হ্যাঁ। বাঁধটা সেইজন্যেই দেওয়া। কুসুম বলল। চারপাশ এখন পাতলা অন্ধকার। একটু হালকা বাতাস বয়ে গেল।

আমরা নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিলাম, বললাম। কুসুম তুমি সংসারী হলে না কেন? সেকি! এতকাল তো সংসারই করছি। হাসল সে, বলো বিয়ে করিনি কেন?

বেশ, তাই।

বিয়ের বয়স যখন হল তখনই বাবা চলে গেলেন। সবে স্কুলে পড়াতে ঢুকেছি, ভাই ছোট। দায়িত্ব নিতে হল। তারপর, একটা বর খুঁজে আনবে তেমন কেউ পাশে ছিল না।

কথাটা কি বিশ্বাস্য? সেটা তুমি যেমন ভাবো। মিথ্যে নয়, স্কুলের সহকর্মীরা চেয়েছিলেন শহরের কাউকে বিয়ে করি যাতে স্কুলের চাকরিটা থাকে। উদ্যোগীও হয়েছিলেন কেউ-কেউ। আমি রাজি হইনি এই শহরের কাউকে বিয়ে করতে।

কেন?

তোমার প্রথম গল্প, যেটা দেশ পত্রিকায় বেরিয়েছিল, সেটা পড়ার পর মনে হয়েছিল এই শহরের কাউকে বিয়ে করাটা ভুল হবে।

কিন্তু কেন?

ব্যাখ্যা করতে পারব না।

কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়নি?

বন্ধুত্ব মানেই তাকে স্বামী হিসেবে ভেবে নেওয়া নয়। তুমি হয়তো জানোনা, এখানকার সবাই জানে তোমার সঙ্গে আমার গভীর প্রেম আছে। ওরা ভুলে যায় তুমি পনেরো আর আমি বারো, সেই আমাদের শেষ দেখা। আসলে লিখে-লিখে তুমি এই ভাবনাটা ওদের মনে ঢুকিয়েছ। তাতে তুমি হয়তো বিখ্যাত হয়েছ কিন্তু আমার চারপাশে একটার-পর-একটা পাঁচিল উঠেছে। বিষণ্ণ গলায় বলল সে।

কিন্তু আমি তোমাকে আহত করতে কোনও লেখা লিখিনি। তোমার নাম বা তোমাকে চিনতে পারা যাবে এমন কোনও সূত্র আমার লেখায় ছিল না।

কি ছিল সেটা তুমি ভালো করে জানো। হাঁটতে শুরু করল কুসুম। তারপরেই হেসে ফেলল। আলতো শব্দ করে তুমি ভেবো না আমি কোনও অভিযোগ করছি। কেউ একজন বহুদূরে থেকে আমায় কীভাবে দেখছে, আমায় নিয়ে কী ভাবছে তা আবিষ্কারের মধ্যে অদ্ভুত আনন্দ তো আছে।

কি করব বললো। আমি তোমাকে ছাড়া ভাবতে গেলেই অসাড় হয়ে যাই।

তাই যে চরিত্র আমার নয় তার মধ্যেও আমাকে মিশিয়েছ?

হ্যাঁ। স্বীকার করলাম।

এই ভাবনা, আমাকে নিয়ে ভাবনা, তোমার মনে কবে এসেছে?

সেই প্রথম লেখা থেকে। তোমার সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার অন্তত আট বছর পরে।

ততদিনে তুমি বিবাহিত।

না। তারও তিন বছর পরে।

তিনি জানেন?

জানি না।

শুনেছি তুমি এখন একা থাকো!

হ্যাঁ!

সে আর কথা বলল না। আমরা বাঁশের শেষে চলে এসেছিলাম। কুসুম বলল; এবার ফিরে গিয়ে যা লিখবে সেখানে নিশ্চয়ই আমি থাকব না।

কারণ?

যে-আমাকে এতকাল মনে রেখেছিল তার সঙ্গে এই আমার কোনও মিল দেখতে পেলে না। আর যাই হোক, এই-আমাকে নিয়ে তো লেখা যায় না।

কথা না বলে হাসলাম আমি।

হঠাৎ সে নদীর দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি তো এত লেখ, বলো তো, নদী কার বন্ধু?

আকাশের। জবাব দিলাম।

ঠিক। কিন্তু আকাশ যখন অন্ধকারে তখন নদীও কালো। দুজনের কোনও যোগাযোগ থাকে না। যে যার নিজের মতো। সে যেন নিজের সঙ্গে কথা বলল।

তখন, আবার জিজ্ঞাসা করলাম, কুসুম তুমি কেমন আছ?

সে তাকাল, কি মনে হয়?

কুসুম, আমি জানি তুমি ভালো নেই।

এবার শব্দ করে হেসে উঠল সে, দূর! চমৎকার আছি, তোমার এত উপন্যাসের নায়িকাদের মধ্যে ছড়িয়ে আছি আমি, খারাপ থাকব কি করে! হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল সে, তুমি তো আমাকে নিয়ে এত লেখ, আজ যদি বলি, আমাকে নিয়ে এমন কোথাও চলো যেখানে বাকি জীবনটা আমরা পাশাপাশি থাকতে পারব; পারবে নিয়ে যেতে?

উত্তরটা নিজেই দিল সে, পারবে না। সম্ভব নয়। ঝরনা নদী হয়ে গেলে আর পাহাড়ে ফিরে যেতে পারে না। তার চেয়ে এই ভালো, এই যেমন আছি। এনাফ।

কুসুম ফিরে গেল বাঁধের ওপর দিয়ে। ধীরে-ধীরে অন্ধকার তাকে আড়াল করল। নেমে এলাম রাস্তায়। রিকশায়। হোটেলে ফিরে আসতেই রিসেপশনের নতুন মেয়ে বলল, স্যার, আপনার একটা মেসেজ আছে। টেলিফোনে। ঘরে এসে বোতাম টিপতেই কুসুমের গলা শুনতে পেলাম, শোনো, আমি জানি, তুমিও ভালো নেই।

এখন পর্যন্ত লেখাটি পড়া হয়েছে ৭০ বার
যদি লেখাটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন