শংকর ব্রহ্ম

গল্প - খট্টাঙ্গ পুরাণ

লেখক: শংকর ব্রহ্ম
প্রকাশ - মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই ২০২৪ ধরণ: অন্যান

খট্টাঙ্গ পুরাণ
শংকর ব্রহ্ম

নবাব বাদশাহদের খেয়াল খুশির অন্ত থাকে না। একবার মুর্শিদাবাদের নবাবের খেয়াল হলো – মাটির নীচে কি আছে তা জ্যোতিষী পণ্ডিত দ্বারা গণনা করিয়ে জানতে হবে।
মাটির নীচে কি আছে সঠিকভাবে বলে দিতে পারলে- নবাব প্রত্যেক পণ্ডিতকে একমত করে স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার দেবেন। আর না বলতে পারলে তার হবে আজীবন কারাবাস।
এই বার্তা লোক মারফৎ রাজা মহারাজাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হলো।
আর গণনা সত্য কি মিথ্যা তা তো সঙ্গে সঙ্গে কিছু মাটি খুঁড়েই বোঝা যাবে।
এই বার্তা পেয়ে কৃষ্ণনগরের মহারাজ কিছু দরিদ্র জ্যোতিষী পণ্ডিতকে নবাবের দরবারে পাঠিয়ে দিলেন- তারা কেউ মাটির নীচে কি আছে বলতে না পারায় সকলেই কারাগারে গেলেন। এমন খবর পেয়ে স্বভাবতঃই রাজা বিষণ্ণ মুখে বসেছিলেন, তিনি ভাবছিলেন একমাত্র তাঁরই দোষে এতগুলো ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে নবাবের কারাগারে পঁচে মরতে হচ্ছে।
গোপাল মহারাজের মুখ দেখে বলল-
মহারাজ, অমন গোমরামুখ করে বসে আছেন কেন?
মহারাজ গোপালের কাছে সব খুলে বলেলেন। গোপাল শুনে বলল – এর জন্য ভাবনা কি? আপনি নবাবের কাছে একটি চিঠি দিন যে, একজন বড় জ্যোতিষী পাঠালাম, যিনি অনায়াসে মাটির নীচে কি আছে গণনা করে বলে দিতে পারেন।
মহারাজ অবাক হয়ে বললেন- গোপাল, তুমি গণনা করতে পারবে?
কি করব জানি না। তবে নিজেও বেঁচে আসব, আর দরিদ্র ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণকে নবাবের কারাগার থেকে মুক্ত করে আনবো, তাছাড়া আপনার সম্মানও বজায় রাখব।
মন্ত্রী বললেন – এ অসম্ভব।
গোপাল বলল – মহারাজ আপনি আমার ওপর আস্থা রাখতে পারেন। আমি কার্যসিদ্ধি করে ফিরে আসব।
মহারাজ বললেন – তুমি যদি দরিদ্র জ্যোতিষী পণ্ডিতদের নবাবের কারাগার থেকে মুক্ত করে আনতে পার – আমি তোমাকে হাজার স্রৌপ্যমুদ্রা পুরস্কার দেব।
গোপাল বাড়ি ফিরে গিয়ে ভাঙা খাটের একটা ভাঙা পায়াকে চৌদ্দ পর্দা লাল শালুর কাপড় দিয়ে বেশ ভালভাবে জড়িয়ে নিল। গরদের কাপড়, গরদের চাদর, কাঁধে নামাবলী, মাথায় লম্বা টিকি ঝুলিয়ে এবং চৌদ্দ পর্দা কাপড়ে জড়ানো খাটের পায়াখানা হাতে নিয়ে নবাবের-দরবারে গিয়ে উপস্থিত হলো।
নবাবকে যথোচিত সেলাম জানিয়ে বলল- খোদাবন্দ, আমাকে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আপনার দরবারে পাঠিয়েছেন। মাটির নীচে কি আছে – আমি তা অনায়াসেই গণনা করে বলে দিতে পারি।
গোপালের কথা শুনে নবাব খুব সন্তুষ্ট হয়ে বললেন- আপনার চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছি – আপনি একজন মহান পণ্ডিত মানুষ। আপনি আসন গ্রহণ করুন এবং একটু বিশ্রাম করে বলুন – মাটির নীচে কি আছে?
গোপাল নির্দিষ্ট আসনে বসে – চৌদ্দ পর্দা জড়ানো খাটের পায়ার তিন পর্দা সরিয়ে মন্ত্র পড়বার ভাণ করে, নবাবকে বলল – হুজুর, সর্বং সারং খট্টাঙ্গ পুরাণম্। হিন্দু পণ্ডিত গণ শক্যং ভূতলগণনম্।
নবাব বললেন – পণ্ডিতমশাই, আপনার এ শ্লোকের অর্থ কি?
গোপাল মুচকি হেসে বলল – হুজুর, অষ্টাদশ পুরাণের সারকথা আছে এই খট্টাঙ্গ পুরাণে। এতে বলছে, মাটির নীচে কি আছে – তা কোন হিন্দু পণ্ডিতই গণনা করে বলতে পারবে না।
গোপালের কথা শুনে নবাব বললেন – তবে কারা এরূপ গণনা করতে পারবে মহাশয়?
গোপাল বলল – সেকথাও উল্লেখ আছে নবাব । যবন বা ম্লেচ্ছং ভূতলগনং শক্যং। হিন্দু পণ্ডিতং তদূর্ধ্বং। অর্থাৎ যবন বা ম্লেচ্ছগণকে মরবার পরে মাটির নীচে কবর দেওয়া হয়। অতএব যবন বা ম্লেচ্ছ পণ্ডিতগণ ভূতলের নীচে কি আছে তা তারা অনায়াসে গণনা করে বলে দিতে পারবে। আর যেহেতু হিন্দু পণ্ডিতগণ মরবার পর তাদের দাহ করা হয়, অতএব হিন্দু পণ্ডিতগণ অনায়াসে মাটির উপরে আকাশে কি আছে সহজেই গণনা করে বলে দিতে পারবে। আপনি অনর্থক কতগুলো হিন্দু পণ্ডিতকে কারাগারে আটকে রেখে কষ্ট দিচ্ছেন হুজুর।
গোপালের যুক্তিপূর্ণ কথা ও শাস্ত্রবচন নবাবের খুব মনঃপূত হলো, তিনি সমস্ত হিন্দু পণ্ডিতকে মুক্ত করে দিলেন এবং প্রত্যেককে এতদিন বন্দী করে রাখার জন্য একশো স্বর্ণ মুদ্রা করে পারিতোষিক দিলেন।
তারপর গোপালের হাতে পাঁচশো স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে বললেন – আপনি যথার্থ কথা বলেছেন পণ্ডিতমশাই। আপনি না বললে আমি অনেক হিন্দু পণ্ডিতকে অনর্থক কষ্ট দিতুম। এই সামান্য কিছু নিন। আমি এক্ষুণি যবন পণ্ডিতদের ডেকে এনে মাটির নীচে কি আছে তা গণনা করাচ্ছি।
নবাবের কাছ থেকে পাঁচশত স্বর্ণ মুদ্রা পুরস্কার পেয়ে, খট্টাঙ্গ পুরাণখানা হাতে নিয়ে গোপাল খুশিতে নাচতে-নাচতে মহারাজের রাজসভায় এসে উপস্থিত হলো।
নবাবের কারাগার থেকে যেসব জ্যোতিষী পণ্ডিত মুক্ত হয়েছিল – তারাও এসে সকলেই মহারাজের সভায় উপস্থিত হলো।
গোপালের মুখে সব ঘটনা শুনে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও সভার সকলেই জয়ধ্বনি করে উঠল – জয় গোপালের জয়। জয় খট্টাঙ্গ পুরাণের জয়।
মহারাজ গোপালকে প্রতিশ্রুতিমত এক হাজার রৌপ্যমুদ্রা পুরস্কার দিয়ে বললেন – তোমার খট্টাঙ্গ পুরাণখানা একবার দেখাও তো।
গোপাল পুরস্কারের টাকা ট্যাঁকে গুঁজে খট্টাঙ্গ পুরাণের ওপরে জড়ানো চৌদ্দ পর্দা কাপড় সরিয়ে ফেলতেই খাটের একটি ভাঙা পায়া বেরিয়ে পড়ল। মহারাজের রাজসভায় তুমুল হাসির কলরোল উঠল।

১৩৩
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন