অণুগল্প রূপান্তর
রূপান্তর
শংকর ব্রহ্ম
———————————————-
জঙ্গলগড়ে এক সময় এক অত্যাচারী রাজা ছিলেন। লোকজনের ঘোড়া-গাধা-ছাগল-মুরগী জোর করে কেড়ে নিতেন। পারিষদদের সঙ্গে নিয়ে রাজা একদিন শিকার বের হলেন। একটা হরিণের পিছনে ছুটতে ছুটতে রাজা একা অনেকদূর চলে গেলেন, খেয়াল নেই তার। তখন সন্ধ্যা হয়েছে। রাজা টের পেলেন বনের মাথায় অন্ধকার নামছে। সঙ্গে কেউ নেই তার । অচেনা জায়গা। কাছাকাছি কোন গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেবেন ভাবলেন। কোন ধনীর বাড়িতে রাত্রিযাপন করবেন বলে মনে ভাবলেন। এদিকে রাত ঘন হচ্ছে। সামনে কোন বাড়ি ঘর না দেখতে পেয়ে। অনেক খোঁজখুঁজি করে শেষে একটা কুঁড়ে ঘর পেয়ে সেখানে আশ্রয় নিলেন। রাতে ঘুমোতে গিয়ে তিনি শুনলেন, একটা গাধা কাতর স্বরে চিৎকার করছে।
ঘুম থেকে উঠে গিয়ে দেখলেন, কুঁড়েঅলা লোকটা নির্বিকার ভাবে তার গাধাটিকে পিটাচ্ছে।
রাজা তাই দেখে লোকটিকে বললেন–
কী হে, অবলা জীবটাকে এভাবে পিটাচ্ছো কেন? গাধার ঠ্যাং ভেঙে তুমি নিজের শক্তি পরীক্ষা দিচ্ছো?
লোকটি উত্তেজিতভাবে জবাব দিল, হ্যাঁ সেটাই করছি। আমার কাজ ভালো কি মন্দ, সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। গায়ে পড়ে কথা বলতে আসবেন না প্লীজ, কোন প্রয়োজন নেই।
তার জবাব শুনে রাজা খুব দুঃখ পেলেন।
তবু জিজ্ঞেস করলেন, এইভাবে এই নিরীহ প্রাণীটিকে মারার কী কারণ থাকতে পারে, দয়া করে কি সেটা আমাকে একটু বুঝিয়ে বলা যায় না ?
– না, তার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।
– আমার মনে হচ্ছে, তুমি যে শুধু নির্বোধ তাই নয় বরং তুমি একটা আস্ত পাগল।
লোকটি এই কথা শুনে হেসে বলল, হ্যাঁ, আমি পাগলই বটে। তবে সবটা শুনলে আপনি বুঝবেন, আমি নির্বোধের মতো গাধাটার পা ভেঙে দিইনি। এর কারণ আছে।
– কি সেই কারণ, বলো?
– আমাদের দেশের রাজা খুব অত্যাচারী। একথা সবাই জানে। আমার সুস্থ সবল গাধাটির খবর পেলে নিশ্চয়ই তিনি জোর করে এটা নিয়ে যাবেন। শুনেছি, আমাদের এই এলাকায় রাজা শিকারে এসেছেন। তাই গাধাটাকে রাজার হাত থেকে রক্ষা করবার জন্যেই খোঁড়া করে দিলাম। রাজা গাধাটিকে কেড়ে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে খোঁড়া অবস্থায় এটা আমার কাছে থাকা অনেক ভালো।
গ্রামবাসী লোকটির মুখে রাজা তার নিন্দা শুনে খুব রেগে গেলেন। কোন জবাব দিলেন না। রাগে, অপমানে, দুঃখে সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারলেন না। ঘুমহীন রাত কাটালেন।
ভোরের আলো ফুটলো পুব আকাশে। মৃদুমন্দ বাতাস বইতে লাগল। পাখির কলকাকলিতে মুখর হলো চারিদিক। এই সুন্দর পরিবেশের গুনেই হয়তো রাজার মনে শুভ বোধের উদয় হলো। তার মনের ভিতরে অনুতাপের জন্ম হলো, তার পূর্বেকার কৃতকর্মের জন্য। তিনি ফিরে গেলেন তার রাজসভায়।
রাজা পরদিন রাজসভায় ফিরে কুঁড়েঅলা লোকটাকে তার রাজ সভায় ডেকে পাঠালেন। সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে রাজ সভায় এসে উপস্থিত হলেন। দেখলেন সিংহাসনে বসে তারই বাড়ির গতকালের অতিথি। তার বুঝতে আর বাকী রইলো না, তার মানে না চিনতে পেরে, তিনি রাজার কাছে তিনি তাঁরই নিন্দা করেছেন।
রাজা তাকে কোন শাস্তি দিলেন না। বরং তার মুখের উপর সত্যি কথা বলে দেবার জন্য, তার গলার থেকে চন্দ্রহারটি খুলে নিয়ে রাজা তাকে গলায় পরিয়ে দিয়ে পুরুস্কৃত করলেন। কুঁড়েঅলা লোকটির আনন্দে চোখে জল এসে গেল। তিনি এতক্ষণ শাস্তির ভয়ে কাঁপছিলেন।
এরপর থেকে রাজাও আর কোনদিন কারও প্রতি কোন রকম অন্যায় আচরণ কিংবা অত্যাচার করেননি।
যেন রত্নাকর বাল্মীকিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছিলেন।
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন