ট্রাজেডি
শংকর ব্রহ্ম
প্রেমে পড়লে সবাই যেন কবি হয়ে ওঠে।
কবি কবি ভাব বেড়ে যায় তার মনে।
এই যেমন আমার বন্ধু গৌরাঙ্গ পাল।
সে তার ঠিক পাশের বাড়ির বাসিন্দা অনিমা সেনগুপ্তকে ভালবেসে, একগুচ্ছ কবিতা লিখে ফেলেছে।
সেদিন সন্ধ্যায় ফোন করে আমার বাড়ি এসে আমাকে শোনালো সেই সব লেখাগুলি।
ওর নিজের লেখা কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। কবিতাগুলি এই রকম –
১).
ও পাখি তুই বাজিয়ে শিষ
পাশের বাড়ি গিয়ে বলে দিস
ব্যালকনিতে যার শাড়ি ওড়ে
তার জন্য আমার মন পোড়ে।
২).
সকাল বিকেল বৃষ্টি পড়ে
রাত দুপুরে মন পুকুরে
যেন অনি শব্দ করে
নূপুর পরে হৃদয় জুড়ে।
৩).
তুমি বৃষ্টি ভেজা পায়ে সামনে এলে মনেহয়
আকাশের বুকে কেউ যেন জল ছবি এঁকে যায়
আর তুমি হাসলে আমার মনেহয়,
স্বপ্ন আকাশে প্রাণ-পাখি ডানা মেলে দেয় !
৪).
তুমি আমার রঙিন স্বপ্ন, শিল্পীর হাতে আঁকা ছবি,
তুমিই আমার চাঁদের আলো, সকাল বেলার রবি,
তুমি আমার নদীর মাঝে একটি ধারের কূল,
তুমিই আমার ভালোবাসার শিউলি বকুল ফুল !
৫).
হাজার তারা চাই না আমি, একখানা চাঁদ চাই,
হাজার ফুল চাই না আমি লাল গোলাপটি চাই.
হাজার জনম চাই না আমি একটা জনম চাই,
সেই জনমে যেন আমি তোমায় কাছে পাই !
৬).
দিন যায় দিন আসে, সময়ের স্রোতে ভাসে,
কেউ কাঁদে কেউ হাসে, তাতে কি যায় আসে,
খুঁজে দেখো আসে পাশে,
তোমায় কেউ খুব বেশী ভালোবাসে !
৭).
দুঃখ আছে মনে মনে
বলব আমি কার সনে
শোনার মতো মানুষ নাই,
নিজের কষ্ট নিজেই পাই
যেদিন পাব তোমার দেখা
বলব আমার মনের কথা !
৮).
তুমি আছো শুধু তাই কথা আমি খুঁজে পাই,
দূর হতে আমি তাই, তোমাকেই মনে-প্রাণে চাই
তুমি হাসো বলে তাই, চাঁদের কিরণ দেখতে পাই !
৯).
তোমার জন্য মেঘগুলো ভেসে যাচ্ছে আকাশে,
তোমার জন্য স্বপ্নঘুড়ি উড়ছে ভেসে বাতাসে,
তোমার জন্য আছে বুক ভরা ভালোবাসা,
এই কথা জানে শুধু আমার মনের আশা !
১০).
আজ ছন্দ মহলে মিলছে দুটি মন,
মনে মনে বলবে ওরা কথা যে সারাক্ষণ,
কথার মাঝে থাকবে গভীর ভালোবাসা,
তার মাঝে থাকবে দুটি মনের গোপন আশা।
১১).
ভালবাসি সখী তোমার নয়নের কাজল
তোমারে না দেখিলে আমি হই যে পাগল।
পৃথিবীর যত সুখ আছে তোমার তরে,
দিয়ো সখি সবটুকু আমায় উজাড় করে।
১২).
অজস্র স্বপ্নের ভিড়ে তোমায় বসবাস,
সমস্ত কল্পনা জুড়ে তোমায় পাবার আশ ,
অজস্র কাব্য শুধু তোমায় নিয়ে লেখা,
তোমার অপেক্ষায় আমার বেঁচে থাকা।
১৩).
অনুরোধে নয় অনুরাগে তোমাকে চাই
অভিলাসে নয় অনুভবে তোমাকে চাই,
বাস্তবে না পেলে কল্পনাতে তোমাকে চাই ।
১৪).
অপেক্ষায় আছি অপেক্ষায় থাকবো,
যতদিন বেঁচে থাকি তোমায় মনে রাখবো,
যত কষ্ট হোক সব সহ্য করে নেবো
তবুও চিরদিন তোমাকে ভালবাসবো ।
১৫).
মেঘের হাতে একটি চিঠি পাঠিয়ে দিলাম আজ
আমি আছি অনেক কাছে, তার হাতে অনেক কাজ
বৃষ্টি তুমি একটি বার জানিয়ে দিও তাকে
আমি যে তার পাশেই আছি, হাজার কাজের ফাঁকে।
১৬).
চাঁদকে বলে একটু আলো দিতে পার আমায়
সেই আলোয় দেখব আমি পরাণ ভরে তোমায়
বাতাস হয়ে উড়িয়ে নেবো মেঘেরই উপরে
সন্ধ্যা হলে পৌঁছে দেবো তোমার নিজের ঘরে।
১৭).
ফুলের প্রয়োজন সূর্যের আলো
ভোরের প্রয়োজন শিশির
আর আমার প্রয়োজন তুমি
আর তোমার প্রয়োজনে আমি।
১৮).
তোমায় যদি না পাই আমি এই জীবনের তরে জীবন যাবে তবে আমার আঁধারে আঁধারে
তুমিই আমার নয়ন মণি দুইটি চোখের আলো
কোথায় পাব তোমার মতো এমন মানুষ ভাল?
আমার মনের মানুষ তুমি এই প্রেমের দুনিয়ায়
তোমায় ছাড়া বাঁচবো আমি কেমন করে হায়?তুমিই থাকো মনের মাঝে আমার সকল কাজে
ভালোবাসার ঘর বানাবো তোমার মনের মাঝে।
১৯).
আমার শুধু ইচ্ছে করে সঙ্গে তোমার বসে থাকি
হারিয়ে যাওয়া সময়টাকে মুঠোয় ধরে রাখি
হাওয়ার সাথে সময় সাবার তোমার যাওয়ার সময় হল
মন ছাড়তে চায় না তোমায় আবার কবে আসবে বলো?
২০).
জানি না ভালোবাসার আলাদা আলাদা নিয়ম আছে কিনা
তবে আমি কোন নিয়মে তোমাকে ভালবাসেছি তাও জানি না
শুধু এইটুকু জানি আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি।
এইসব কবিতাগুলি আমায় শুনিয়ে সে বলল, এই কবিতাগুলি দিয়ে একটা বই ছেপে অনিমাকে উপহার দিতে চায়।
তার কথা শুনে, আমি তাকে এক প্রকাশকের ঠিকানা দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে, কথা বলতে বলি। সে উৎসাহিত হয়ে পর দিনই গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে। প্রকাশক তার লেখাগুলি দেখে বলেন, এটা প্রকাশ করতে বারো হাজার টাকা লাগবে।
গৌরাঙ্গ বলে, টাকাটা কি আমায় দিতে হবে?
তবে আর কে দেবে?
আপনারা যে সব বই ছাপেন, সবাই কি টাকা দিয়ে ছাপায়?
প্রকাশক এবার হেসে বললেন, না। আমাদের চাহিদা মতো কেউ বই লিখে দিলে, সেটা আমরা নিজেদের খরচে ছাপি।
যেমন এখন ‘হরর’, ‘থ্রিলার’ লেখা বাজরে খুব চলছে। সে রকম একখানা লিখে এনে দিন। আমরা নিজেরাই ছাপবো, আপনাকে কোন টাকা দিতে হবে না।
কবিতার বই কেউ পড়ে না মশাই।
গৌরাঙ্গের মনে হলো, কেউ তার গালে, ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিল। সে অপমানিত হয়ে বাড়ি ফিরে এলো। কিন্তু সে দমবার পাত্র নয়। আজ হোক কাল হোক, বই সে ছাপবেই। উৎসর্গ করবে – অনিমা সেনগুপ্তকে।
বন্ধুদের কাছে ধার চেয়ে, সে টাকা না পেয়ে মনে মনে ব্যর্থতা অনুভব করলেও সে দমে যায় না।
তারপর এক বন্ধুর পরামর্শে সে সপ্তাহে একটা করে লটারীর টিকিট কাটতে শুরু করে। এইভাবে সপ্তাহের পর সপ্তাহ পেরিয়ে যায়। মাসের পর মাস পেরিয়ে যায়। তবু তার লটারীর টিকিটে কোন প্রাইজ ওঠে না। তবু সে আশা ছাড়ে না। এইভাবে বছরও পেরিয়ে যায়। সপ্তাহের পর সপ্তাহ সে টিকিট কেটে যেতে থাকে।
বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার মতো একবার তার লটারীর টিকিটে দশ হাজার টাকার একটা প্রাইজ লেগে যায়। কিন্তু সে আনন্দে তেমন উৎফুল্লিত হয়ে উঠতে পারে না। কারণ, ততদিনে অণিমার বিয়ে হয়ে গেছে অন্যত্র। এটাই তার জীবনের বড় ট্রাজেডি।
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন