সত্য কুম্ভকার

গল্প - অভিশপ্ত রাজমহল

সত্য কুম্ভকার
বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট ২০২৫ ভৌতিক, রহস্য

​আকাশের চাঁদটা আজ পূর্ণিমার থালার মতো গোল। শিউলি ফুলের গন্ধ ভাসছে বাতাসে। রাত তখন প্রায় বারোটা। এমন এক রাতে গ্রামের নতুন শিক্ষক সৌম্যবাবু ভূতের গল্প শুনতে শুনতে হঠাৎ করেই রাজমহলটা দেখতে চাইলেন।
​সবাই বলল, “ওখানে যেও না! ওটা অভিশপ্ত রাজমহল। দিনের বেলাতেও ওখানে গেলে গা ছমছম করে।”
​কিন্তু সৌম্যবাবুর কৌতূহল ছিল অদম্য। তিনি মশাল হাতে নিয়ে রাজমহলের দিকে রওনা হলেন। পুরোনো, বিশাল রাজমহলটা যেন কোনো রহস্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে। দেয়ালগুলো শ্যাওলা আর লতাপাতায় ঢাকা। প্রধান ফটকের কাছে আসতেই একটা অদ্ভুত ঠাণ্ডা বাতাস তার গা ছুঁয়ে গেল।
​ভেতরে ঢুকেই সৌম্যবাবু অবাক হয়ে গেলেন। বাইরে থেকে যেমনটা জীর্ণ মনে হয়েছিল, ভেতরটা তেমন নয়। বিশাল উঠান, চারদিকে অগণিত কক্ষ। একটা কক্ষের দরজা থেকে ম্লান আলোর আভা আসছিল। সৌম্যবাবু সেই কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলেন।
​দরজাটা ঠেলে ভেতরে যেতেই তিনি যা দেখলেন, তাতে তার রক্ত হিম হয়ে গেল। কক্ষের মাঝে একটা বড় সিংহাসন, আর তাতে বসে আছে এক অদ্ভুত নারীমূর্তি। তার পরনে পুরোনো দিনের রাজকীয় পোশাক, কিন্তু মুখটা সাদা আর চোখ দুটো নিষ্প্রাণ।
​”কে তুমি?” সৌম্যবাবু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করলেন।
​নারীমূর্তিটি কোনো উত্তর দিল না। হঠাৎই রাজমহলের সমস্ত আলো নিভে গেল। চারপাশে কেবল অন্ধকার আর একটি চাপা কান্নার শব্দ। সৌম্যবাবু মশালটা জ্বেলে চারদিক দেখলেন। নারীমূর্তিটি আর সেখানে নেই। তার জায়গায় মেঝেতে পড়ে আছে একটি জীর্ণ ডায়েরি।
​সৌম্যবাবু ডায়েরিটা হাতে নিলেন। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাতে গিয়ে তিনি এক ভয়ংকর সত্য জানতে পারলেন। এটি ছিল রানী সুলেখা দেবীর ডায়েরি। সুলেখা ছিলেন এই রাজমহলের রানী। রাজা বিজয়সিংহের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের কয়েক বছর পর রাজা যুদ্ধ করতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। শোকে কাতর রানী রাজমহলের এক কক্ষে নিজেকে আবদ্ধ করে নেন। এক জ্যোৎস্নারাত, ঠিক আজকের রাতের মতোই, রানী সুলেখা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিন্তু তার মৃত্যুর কারণ ছিল রহস্যজনক। ডায়েরিতে শেষ পৃষ্ঠায় লেখা ছিল, “আমি মারা যাচ্ছি, কিন্তু এর পেছনে এক গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে। আমি শান্তি পাব না, যতদিন না সেই বিশ্বাসঘাতকের মুখোশ খুলে যায়।”
​ডায়েরিটা পড়ে সৌম্যবাবু স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, রানী সুলেখার আত্মা এই রাজমহলে আটকা পড়েছে, কারণ তিনি বিশ্বাসঘাতকের পরিচয় জানেন না। সৌম্যবাবু ফিরে এলেন গ্রামে। সবাই তাকে বলল, “কিছু পেয়েছ?”
​সৌম্যবাবু চুপ করে থাকলেন। তিনি নিশ্চিত, রাজমহলের রহস্য শুধু একটি ডায়েরিতেই সীমাবদ্ধ নয়। এর পেছনে আরও অনেক কিছু লুকিয়ে আছে। সেই রাতের পর থেকে সৌম্যবাবু প্রায়ই রাজমহলে যেতেন এবং পুরোনো দলিলপত্র ঘাঁটতে লাগলেন।
​এক রাতে তিনি গ্রামের সবচেয়ে পুরোনো মন্দিরের নিচে একটা গোপন সুড়ঙ্গের খোঁজ পেলেন। সুড়ঙ্গ ধরে ভেতরে যেতেই তিনি একটি কক্ষের সন্ধান পান, যেখানে রাখা ছিল অনেক প্রাচীন পুঁথি। সেই পুঁথিগুলোতে লেখা ছিল, রাজা বিজয়সিংহ যুদ্ধে মারা যাননি, বরং তার ছোট ভাই রাজেন্দ্রই তাকে হত্যা করেছিল সিংহাসনের লোভে। আর রানী সুলেখা যখন এই সত্য জানতে পারেন, তখন তাকে বিষ দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।
​সৌম্যবাবু দ্রুত এই তথ্যগুলো গ্রামের পঞ্চায়েতকে জানালেন। রাজেন্দ্রের বংশধররা তখনো সেই গ্রামে বাস করত। সত্য উন্মোচিত হওয়ায় তাদের সম্মানহানি হলো।
​সেদিন ছিল পূর্ণিমা। সৌম্যবাবু রাজমহলের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, একটি হালকা আলোর ঝলকানি যেন মহলের কক্ষ থেকে ভেসে উঠল, আর সেই সাথে এক শান্ত কণ্ঠস্বর বলে উঠল, “শান্তি পেলাম।” তারপর সেই আলো মিলিয়ে গেল।
​রাজমহলের রহস্য উন্মোচিত হলো। রানী সুলেখার আত্মা অবশেষে মুক্তি পেল। আর সেই রাজমহলটি আর ভূতুড়ে রইল না। কিন্তু প্রতি পূর্ণিমার রাতে আজও অনেকে বলে, রাজমহলের ভেতর থেকে এক অদ্ভুত সুর ভেসে আসে, যেন রানী সুলেখা তার মুক্তির গান গাইছেন।

৩৪
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন