কিচ্ছু বুঝি না, কিচ্ছু বলি না

শামসুর রাহমান শামসুর রাহমান

(সমর সেনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে)


আমাদের খুদে পড়ুয়া খুকুমণিদেরও
মুখস্থ সেই
মুকুটপর! ঘাসের ভেতরকার সাপের নাম ধাম।
সুঠাম শরীর, মুখে চিঁড়ে-ভেজানো মধুর বুলি
এবং প্রায়শই তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন চমৎকার ভঙ্গিতে
তাঁর লেজের ওপর।
দুধদাঁত যাদের পড়েনি তারাও জানে
সর্পমহাশয় কত সহৃদয়; নানা আঙ্গিকে
কী করে ভালোবাসতে হয়
খরগোশ, ব্যাঙ আর তাবৎ সম্মোহিত মানুষকে,
তিনি তা রপ্ত করেছেন অবলীলায়
আর বেজির সঙ্গে লড়াই করতেও বেজায় দড়।


ফুটপাতে, ওভারব্রিজে
ছিঁচকে চোর, পকেটমার, বাটপাড়, চুল-ফাঁপানো
লম্পট, পানরঞ্জিত দাঁতের
বেশ্যার দালাল, ব্যর্থ প্রেমিক, বেকার যুবকের দল,
সদ্য ছাঁটাই-হওয়া কর্মচারী,
নতুন টেকনিক-সন্ধানী গোবেচারী কবি আর পুরানো
টাঙ্গাইল শাড়িপরা যৌবন যায় যায় অনূঢ়া,
তাড়ি-টানা খামোকা উৎফুল্ল প্রৌঢ়, কিস্তি টুপি-পরা,
চাপ দাড়িঅলা মুসল্লি, খাপখোলা তলোয়ারের মতো
কাঁধে ঝোলা বামঘেঁষা, নিষ্ঠাবান
রাজনৈতিক কর্মীর আনাগোনা।
মাঝে-মাঝে ওরা মুকুটপরা সাপের কথা বলাবলি করে।


বেপাড়া-ফেরত বেহেড মাতাল রাত্রির শেষ বাসে
চেপে নেমে পড়ে বিরান সড়কে, আসে
মেঘের মধ্য দিয়ে হেঁটে নিজের বাসায়
বেধড়ক বউকে পেটায়, বমি করে মেঝে, বিছানা ভাসায়।
ঘুমভাঙা শিশুর কান্নায়
ঘুমন্ত মহল্লা ঈষৎ চমকে উঠে পাশ ফিরে শোয়।

বিপর্যস্ত পাড়ার জীর্ণ ঘরবাড়ি, পোস্টার ছাওয়া
পড়ো পড়ো দেয়াল,
খাটাল শৌচাগার আর ঝাঁপবন্ধ দোকানে
ভোর কলপ বুলায়; চালচুলোহীন ঘোর
অস্তিবাদী, বিনিদ্র কবি টানা গদ্যে যুগসংকটে
করেন বিলাপ, পায়রা খুশি ছড়ায় আসমানে।

আমাদের দেশে আছেন একজন,
যিনি নিকারগুয়ার সমোসার মতো কীর্তিমান।
আকাশছোঁয়া তাঁর জ্ঞানগম্যি, ফলত তিনি
জনপথের মহাকল্লোলকে
স্রেফ পোকা মাকড়ের গুঞ্জরন জ্ঞান করেন।
স্বপ্নে অথবা
জাগরণে কোনো বিভীষিকা তাঁকে তাড়িয়ে
বেড়ায় কিনা, এ প্রশ্নের
সদুত্তর কারো জানা নেই। বরং উড়ো খবর পাই
তাঁর খাব্‌-এর রঙ বেহদ সাইকেডেলিক।


আমাদের সেই মেহেবান
ঝড়তুফান এবং বান অগ্রাহ্য করে ছুটে যান
দুর্গতদের অত্যন্ত কাছে,
দরাজ হাতে এদিক ওদিক হৈ হৈ বিলিয়ে বেড়ান
ত্রাণসামগ্রী রাঙা ধানের খৈ।
ওহো খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি;
এলোকেশী কপালকুণ্ডলা এগিয়ে আসে ছিন্ন বেশে
ভিক্ষাপাত্র হাতে। রহমদিল
তাঁর হাঁটুঢাকা গামবুটে চুমু খায় দেশডোবানো পানি।
জানি, টেলিভিশন সাক্ষী, আমরা জানি।


চাল ডাল তেল নুন লাকড়ি আর কাফনের কাপড়ের
দাম যদি আকাশমুখো
লাফাতে থাকে, আল্লার গজব পড়ে,
তিনি কী করতে পারেন? মাশাল্লা, তাঁর ধৈর্য অপরিসীম।
কোনো বেতমিজ যদি হঠাৎ
চেঁচিয়ে ওঠে, কী আনন্দ পাও তুমি শাসনদণ্ড ধারনে, তবে
তিনি নতুন চাল দিয়ে দাবার ছকে
নিজস্ব তখত্‌টি সামলে নেন।
আমরা কিছু বুঝি না, কিচ্ছু বলি না,
শুধু বোবা হয়ে থাকি।


পুতুল খেলার ভারি শখ তাঁর,
পেছন থেকে সুতো নেড়ে, সুতো ছেড়ে
তিনি হরহামেশা নিজের মেজাজটাকে শরীফ রাখেন
পুতুলগণ তাঁর চারপাশ
মুড়ে দিয়েছেন শুভেচ্ছা, অনলস খেদমত আর অন্তবিহীন
তোষামোদে। তাঁর শাসনামল, একজন
পুতুলের জবানিতে, একটি নিখাদ স্বর্ণযুগ।
আরেকজন পুতুল, যিনি মিথ্যার তুবড়ি ফোটানোর
খেলায় গোয়েবলসকেও
তুড়ি মেরে সাকরেদ বানাতে পারেন, এমত সুবচন
ছাড়েন যে, পুতুল খেলার প্রযোজকের
মুখের মতো পবিত্র মুখ ইহজগতে নেই।
আমরা কিচ্ছু বুঝি না, কিচ্ছু বলি না
শুধু বোবা হয়ে থাকি।
এইসব পুতুল পরিবৃত খেলোয়াড়
যে আসনে সমাসীন, তাতে কোনো মুৎসুদ্দি, ভাঁড়, নেকড়ে,
তালুক, উল্লুক, বেবুন, ঘোড়া অথবা
খচ্চর উড়ে এসে জুড়ে বসলেও আমরা টু শব্দটি করবো না।
তাঁর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে,
চিচিঙা, মিষ্টি কুমড়ো আর বেগুনের মতো
মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীগণ বাকায়দা নতুন করে শপথবাক্য উচ্চারণ করবেন,
তাঁর অমোষ নির্দেশে
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিগ্ধিদিক মুড়িমুড়কির মতো
ছিটিয়ে দেরে রাষ্ট্রদূত!
আমরা কিচ্ছু বুঝবো না, কিচ্ছু বলবো না,
শুধু বোবা হয়ে থাকবো।
এখন পর্যন্ত কবিতাটি পড়া হয়েছে ৯০ বার
যদি কবিতাটা সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন