পোড়া বাড়ি
শামসুর রাহমান
(কাজী নজরুল ইসলামকে নিবেদিত)
আজ তুমি চিনবে না এই পথ, এখন সেখানে
বিপুল পিপুল ছায়া অন্তর্হিত, সুর বাহারের,
সারঙের গৎ নেই, স্বপ্নবাগিচায় প্রতিষ্ঠিত
বুলবুলি নেই কোনো। সুন্দরের স্মৃতিতে মড়ক।
আজ এই ঊনিশশো চৌষট্রিতে গ্লানির বৈঠকে
বসে বসে ক্লান্তি এলে নিজস্ব স্বপ্নের স্বেচ্ছাচারে
মেতে উঠি এবং তোমার কথা ভেবে ভেবে শুধু
শোক হই, অবান্তর জেগে থাকি স্বভাবদোষেই।
তোমাকে দেখি নি তবু গুরুজনদের মুখে-মুখে
গল্পপ্রিয় লোভী বালকের মতো কান পেতে সুখে
থরোথরো শুনেছি তোমার কথা। বস্তুত সর্বদা
খুঁজছি আমার স্বত্ব কবিত্বের বিমূর্ত নগরে।
তোমার মাথাটা বুঝি পোড়ো বাড়ি, যেখানে দেয়ালে
জীর্ণ বন্ধ ঘড়ি আর কয়েকটি বিবর্ণ মুখোশ
হেলায় টানানো। ভাঙা দরজার শব্দ প্রেতায়িত
বাতাসের সহযোগী, শূন্যতাই সেখানে সম্রাট।
চতুর্দিকে বাদুড়ের পাখার ঝাপট দুঃস্বপ্নের
রাত্রিকেই ডেকে আনে সর্বক্ষণ। কবরের সব
বিশীর্ণ বাসিন্দা যেন মাটি ফুঁড়ে ভিড় করে আসে,
মগজে হননে মত্ত নষ্ট কোষে ভয়াল মাকড়সা।
কবিতায় রাগ্মিতার রোদ্দুর মিশিয়ে পোড়া দেশে
এনেছিলে তীব্র দাহ; অত্যাচার অনাচার তুমি
সমূলে ভাসিয়ে নিতে চেয়েছিলে কাব্যের জোয়ারে-
নিশ্চিত জেনেছি আমি, চারণ কবির সততায়।
কে বলে কাব্যের ফুঁকে এ পৃথিবী নিরাময় হয়,
হতে পারে? হয় না তা। নইলে ভগ্নস্বাস্থ্য সময়ের
আর্তনাদে কেন এই মানুষের হাট বারবার
ভেঙে যায়? কেন ওড়ে সর্বত্র পতাকা বিনষ্টির?
পণ্ড করে নিয়মের প্রতিবিম্ব, ছকের বাহার
বণিকের রাজ্যপাট করতে লোপাট সমুদ্যত
ছিলে সর্বদাই, অথচ আমরা আজো পরবাসী
নিজ বাসভূমে। প্রতিবিম্ব ভেংচি কাটে নিজেকেই।
তোমার জীবন যেন অন্ধকারে সুতীব্র চীৎকার,
নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটে পুণ্যবানদের। ক্ষণকাল
আড়মোড়া ভেঙে ফের গভীর নিদ্রায় সহজিয়া
তক্তপোশে ঢলে পড়ে অকাতরে বধির সমাজ!
শেকল ছেড়ার গানে রাত্রিদিন সেই ঝোড়ো যুগে
নিজেই হয়েছো অগ্নিবীণা। আমরাও সর্বক্ষণ
সেই গানে মেলাই সত্তার সুর, নির্বাসনে আজো
চৈতন্যের পল্লী জ্বলে, গান গাই শৃঙ্খলিত দাস।
তোমার প্রস্তরমূর্তি রাজপথে পাখির পুরীষে
কলঙ্কিত নয় ভেবে নানা প্রবচনে সমর্থন
সানন্দে জোগায় গৌড়জন, সংস্কৃতির মুখ চেয়ে
সেবকেরা সভাঘরে ঘুর ঘুর করে বিলক্ষণ।
ফুরোলে আতশবাজি যেমন মাটির ঢিবি শুধু
পড়ে থাকে আস্তাকুড়ে, তেমনি তুমি বাঁচো নিরুপায়;
গভীর রাতের শূন্য পার্কের মতোই মানসের
স্তব্ধতায় থাকবে বুঝি, লুণ্ঠিত ভাষার রত্নদ্বীপ।
আজ তুমি চিনবে না এই পথ, এখন সেখানে
বিপুল পিপুল ছায়া অন্তর্হিত, সুর বাহারের,
সারঙের গৎ নেই, স্বপ্নবাগিচায় প্রতিষ্ঠিত
বুলবুলি নেই কোনো। সুন্দরের স্মৃতিতে মড়ক।
আজ এই ঊনিশশো চৌষট্রিতে গ্লানির বৈঠকে
বসে বসে ক্লান্তি এলে নিজস্ব স্বপ্নের স্বেচ্ছাচারে
মেতে উঠি এবং তোমার কথা ভেবে ভেবে শুধু
শোক হই, অবান্তর জেগে থাকি স্বভাবদোষেই।
তোমাকে দেখি নি তবু গুরুজনদের মুখে-মুখে
গল্পপ্রিয় লোভী বালকের মতো কান পেতে সুখে
থরোথরো শুনেছি তোমার কথা। বস্তুত সর্বদা
খুঁজছি আমার স্বত্ব কবিত্বের বিমূর্ত নগরে।
তোমার মাথাটা বুঝি পোড়ো বাড়ি, যেখানে দেয়ালে
জীর্ণ বন্ধ ঘড়ি আর কয়েকটি বিবর্ণ মুখোশ
হেলায় টানানো। ভাঙা দরজার শব্দ প্রেতায়িত
বাতাসের সহযোগী, শূন্যতাই সেখানে সম্রাট।
চতুর্দিকে বাদুড়ের পাখার ঝাপট দুঃস্বপ্নের
রাত্রিকেই ডেকে আনে সর্বক্ষণ। কবরের সব
বিশীর্ণ বাসিন্দা যেন মাটি ফুঁড়ে ভিড় করে আসে,
মগজে হননে মত্ত নষ্ট কোষে ভয়াল মাকড়সা।
কবিতায় রাগ্মিতার রোদ্দুর মিশিয়ে পোড়া দেশে
এনেছিলে তীব্র দাহ; অত্যাচার অনাচার তুমি
সমূলে ভাসিয়ে নিতে চেয়েছিলে কাব্যের জোয়ারে-
নিশ্চিত জেনেছি আমি, চারণ কবির সততায়।
কে বলে কাব্যের ফুঁকে এ পৃথিবী নিরাময় হয়,
হতে পারে? হয় না তা। নইলে ভগ্নস্বাস্থ্য সময়ের
আর্তনাদে কেন এই মানুষের হাট বারবার
ভেঙে যায়? কেন ওড়ে সর্বত্র পতাকা বিনষ্টির?
পণ্ড করে নিয়মের প্রতিবিম্ব, ছকের বাহার
বণিকের রাজ্যপাট করতে লোপাট সমুদ্যত
ছিলে সর্বদাই, অথচ আমরা আজো পরবাসী
নিজ বাসভূমে। প্রতিবিম্ব ভেংচি কাটে নিজেকেই।
তোমার জীবন যেন অন্ধকারে সুতীব্র চীৎকার,
নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটে পুণ্যবানদের। ক্ষণকাল
আড়মোড়া ভেঙে ফের গভীর নিদ্রায় সহজিয়া
তক্তপোশে ঢলে পড়ে অকাতরে বধির সমাজ!
শেকল ছেড়ার গানে রাত্রিদিন সেই ঝোড়ো যুগে
নিজেই হয়েছো অগ্নিবীণা। আমরাও সর্বক্ষণ
সেই গানে মেলাই সত্তার সুর, নির্বাসনে আজো
চৈতন্যের পল্লী জ্বলে, গান গাই শৃঙ্খলিত দাস।
তোমার প্রস্তরমূর্তি রাজপথে পাখির পুরীষে
কলঙ্কিত নয় ভেবে নানা প্রবচনে সমর্থন
সানন্দে জোগায় গৌড়জন, সংস্কৃতির মুখ চেয়ে
সেবকেরা সভাঘরে ঘুর ঘুর করে বিলক্ষণ।
ফুরোলে আতশবাজি যেমন মাটির ঢিবি শুধু
পড়ে থাকে আস্তাকুড়ে, তেমনি তুমি বাঁচো নিরুপায়;
গভীর রাতের শূন্য পার্কের মতোই মানসের
স্তব্ধতায় থাকবে বুঝি, লুণ্ঠিত ভাষার রত্নদ্বীপ।
এখন পর্যন্ত কবিতাটি পড়া হয়েছে ৮২ বার
যদি কবিতাটা সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন