শামসুর রাহমান

কবিতা - স্বপ্ন জাগরণের সীমানায়

লেখক: শামসুর রাহমান


‘ঢের হয়েছে, আর নয়, ছাঁটো, ছাঁটো ক্ষয়া খর্বুটে শব্দাবলি। বাতিল করো
হরিণ, রাজহাঁস আর ঝাড়বাতি; তোমার কবিতায় এসব পড়ে পড়ে হাঁসফাঁস
লাগে। একই উপমা কেন ঘুরে ফিরে আসবে সকল ঋতুতে? এবার চেনা পথ
ছেড়ে ধরো অচেনা রাস্তা, বসিয়ে দাও চেকপোস্ট। জ্যোৎস্নাধোয়া ঝিলে
খিলখিলে হাওয়ায় মুখ ডোবায় হরিণ, কেন এই পুনরুক্তি? কেন তুমি বলবে
না জ্যোৎস্নার চাদর বিছানো প্রান্তরে ক্যাঙারুর পাল লাফিয়ে লাফিয়ে নষ্ট
করছে ফসল? কেনই বা তোমার কণ্ঠে উচ্চারিত হবে না যে, যা’ কিছু মহৎ,
সুন্দর, সহজ আর সরল তার দিকেই তিরিক্ষি মেজাজে তাকায় বন্দুকের নল।
কোনও তন্বী হাসলেই কেন দুলে উঠবে বারবার ঝাড়বাতি। উটের কুঁজোর
মতো বাড়তি চর্বি ঝেড়ে ফ্যালো। তীক্ষ্ণ, ছিপছিপে হোক পঙ্‌ক্তিমালা।
আগ্রাসী মরুভূমিতে তোমার কবিতা হোক এমন মরুদ্যান, যেখানে তুমিই
প্রথম মুসাফির’, বললো এক তরুণী কথায় কথায়। এভাবেই টেলিফোনে
সেদিন আমাকে সে কবিতা লেখার সহজ পাঠ শেখালো।


অসম্ভব তাকে ভালোবাসা, অসম্ভব তাকে ভালো না বেসে জীবনলগ্ন থাকা।
এই রেশনবৎ কথাবার্তা, মাঝে-মাঝে বদখৎ ক্রস কানেকশন, টেলিফোনে
খণ্ডকালীন বসবাস, গৃহকোণে দুঃস্বপ্নের হামলে পড়া, সামলে সুমলে
চলাফেরা, সত্যমিথ্যার জটাজালে বন্দিদশা, কোত্থেকে আচমকা খসে আসা
কিছু পঙ্‌ক্তিকে ঘষা-মাজা টেবিলে, ভাঁড় সাজা কখনও সখনও, খোদাই ষাঁড়ের
গজরান, শক্রর ইতর খিস্তি খেউড়, গতরে জ্বালা-ধরানো, পেছনো, ঢেউয়ের
আনাগোনা-এসব নিয়েই আছি। প্রায়শঃই এরকম থাকি। যেন অপারেশান
টেবিলে শোয়ানো হয়েছে, অ্যানস্‌থেসিয়া একটু একটু করে ঢুকছে নাকে।
কাছাকাছি কেউ নেই; অকস্মাৎ কারো হাঁচিতে চটকা ভাঙে। বহুদূরে গহীন
গাঙে রঙিলা নায়েরমাঝি দাঁড় বায়, খাটায় পাল মসলিনের, কোথাও টিনের
ঘরের চালে চাঁদিমা বিছানো, দুধের পাতলা সর। মাঝে-মাঝে খুচরো কাজের
ঠেলাঠেলিতে বেলাবেলি তার কণ্ঠস্বর শুনে বাঁচি। পিটপিটে নক্ষত্র চোখ মারে;
আরে, শোনোই না, ভর সন্ধ্যেবেলা কোথায় যাচ্ছো? কোনও কথা কেউ শোনে
না, আলতো তাকায় ফিরে, বোনে যে যার স্বপ্নের শৌখিন শাড়ি অন্তহীন, কত
টানাপোড়েন। সসপ্যানে বাস্তবতার ঈষদুষ্ণ অমলেট, ঘরে ঘরে ছেলেমেয়ে
মানুষ করার হৈ-হুল্লোড়। পাড়ায় পাড়ায় চোর ছ্যাঁচোড়ের উৎপাত, ডাকাতের
দল নানা ছলছুতোয় উপর তলায় সমাসীন। কবিতার জন্মদ্বারে কালো
বেড়ালের ছোঁক ছোঁক। কবিপুরুষ ঢোঁক গিলে তড়িঘড়ি কবিতার ভ্রুণ সামলে
দ্যাখেন, নগ্ন পায়ে ফিরে যাচ্ছে ভালোবাসা।


দীপ জ্বালাতে গিয়ে আঙুল ঝলসে যায়। দেশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠি নতুন
কুলোয়, ছিপছিপে শরীর অর্ধেক ময়ূর হাতে এগোয় স্বপ্নের সীমানায়, রূপ
আমাকে গিলে খাবে। যাব কোন্‌ চুলোয়? হাসি, কাচের বাসন চূর্ণ মোজেইক
করা মেঝেতে। চুপচাপ থাকি, কাছের শেলফ থেকে বই টানি; পড়তে পড়তে
রাত বাড়ে। কে অমন আড়ালে দাঁড়িয়ে ঘুম কাড়ে? অতীতের ঘানি টেনে ক্লান্ত,
আপাততঃ থাক ধারাদেনার ভাবনা। রাগ সাপের মতো ফোঁসে, মাথার ভেতর
লকলকে আগুন। বেনামি আক্রোশে কুকুর মাটি খুঁড়তে থাকে গুম করা লাশ
বের করবে বলে। দুপুর রাতে শূন্য হাতে উড়ে এসে বসে ডুমুর; তার সরুঙ্গে
নোখে মেরুন পালিশ ছিল কি বিকেলে? ওর কাছে গেলে ভ্রূকুটি-অলা মেঘ
কেটে যাবে, রঙ-বেরুঙের পাখি কুড়াবে রুটি-বিস্কুটের টুকরো বারান্দায়,
ঝরাবে সুর চেতনায় নিমগ্ন স্তরে। কোন্‌ পথ ধরে যাব নিবাসে তার? পথগুলি
শয়তানের নাড়িভুঁড়ি; অলিতে গলিতে ঘুরি, উড়ি ময়ূর-নীল মেঘে। সে আছে
অজ্ঞাতবাসে। যা-কোনও রাস্তা ভাবি। স্বর্ণতালার দাবি, ‘খোলো,
দ্বার খোলো। কোথায় কবে হারিয়ে ফেলেছি চাবি। কী করে বইব বিচ্ছেদের
ভার? পূর্ব-পুরুষদের কেউ বিরহকাতর প্রহরে আমার মতোই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে
কেঁদেছেন রহস্যের গুহায়? নাকি বনবাদাড়ে পিছল আঁধারে কুপিয়ে কেটেছেন
হিজল গাছ ভুলতে অন্তর্জালা? বন্যবরাহ তেড়ে আসে যখন তখন অকারণ।
হেঁড়ে গলায় দশকওয়ারী ফিচেল ফতোয়া ঝাড়ে নানাবয়েসী মস্তান। কেন
টেলিফোন বেজে ওঠে না এখনও? যখন অতিশয় ব্যাকুল হয়ে সে ঘোরাবে
ডিজিট, তখন থাকব তো?


সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা খোঁয়াড়, লম্বাচওড়া, তারকাঁটার বেড়া দিয়ে
ঘেরা। শুয়োর, শুয়োর,শুয়োর। মদ্দা শুয়োর, মাদি শুয়োর। ডানে শুয়োর,
বামে শুয়োর। প্রচণ্ড গাদাগাদি, গুঁতোগুঁতি। উত্তরে শুয়োর, দক্ষিণে শুয়োর,
পূর্বে শুয়োর, পশ্চিমে শুয়োর। চারদিকে ছুটোছুটি, কাদায় লুটোপুটি। ঘোঁৎ,
ঘোঁৎ, ঘোঁৎ, কী শীত কী গ্রীষ্মে শুয়োরের গীত। কত মাদি শুয়োরের মাথায়
ঘোমটা, গলায় লাল কিংবা নীল রিবন শুয়োরেরা ফার্সি পড়ে হদ্দ হয়, আরশি
নগরে ক্লান্ত হয় সব্জির আঁটির মতো গুচ্ছের পদ্য পড়ে। কোনও কোনও শুয়োর
শোলার টোপর পরে ঘুরে বেড়ায় চরকি হয়ে। শুয়োর, শুয়োর, শুয়োর।
দিনরাত্রি নামে শুয়োরের ঢল। ফূর্তিমাতাল দাঁতাল শুয়োরের কেতাদুরস্ত
বুর্জোয়া চালে মাথা নাড়ে, মাদি শুয়োরের নজর কাড়ে, নিয়ে যায় নাচের
ফ্লোরে, যখন সূর্য অস্তাচলে। মোহকবলিত শুয়োর, যন্ত্রচালিত শুয়োর, শবলিত
শুয়োর। শুয়োরকে শূকর নামে ডাকলে অনেক শুয়োর যারপরনাই আহ্লাদিত
হয়। অতএব শূকর-শূকরী, শূকর-শূকরী, শূকর-শূকরী। শূকর-শূকরীর
রোদালো, ঝাঁঝালো, জ্যোৎস্না চমকিত জীবন বাঁশের বল্লম আর অজানা
জোয়ারের অপেক্ষায়। ভরাট খোঁয়াড়। শূকর, শূকর, শূকর। শূকরের
কামড়াকামড়ি, লালসা, শাঠ্যে আমরি নাট্যে রুমালে ঘন ঘন মুখের চামড়া
মোছে সূত্রধর।


স্বপ্নের ভর্তুকি নিয়ে কতকাল চলবে আর? একটি স্বপ্নাদ্য কবিতার
বিতিকিচ্ছি রূপ দেখে এজন কবি নিজেকেই প্রশ্ন করেন। একজন তোবড়ানো-
গাল কেরানি বাসে ঝুলতে ঝুলতে ভাবেন, আহা, সারা জীবন যদি গল্‌ফ খেলে
কাটিয়ে দেয়া যেত। গলা ফাটিয়ে এ-কথা দশ দিকে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে
তার। ভদ্রলোক যদি দয়া করে দশ পয়সার বদলে, খোদার ফজলে, একটি দশ
টাকার কড়কড়ে নোট দিতেন, একজন নুলো ভিখিরির ভাবনা। একজন
রিক্‌শা-অলা প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে মনে মনে আওড়ায়, হায়, এমন কি
হয় না যে, প্রতিটি রাস্তা খুব ছোট, অথচ ভাড়া দিব্যি চড়া। কবির মৃত্যু হলো
অনিয়মের অঙ্কুশাঘাতে, কেরানি অকূলে ভাসিয়ে সংসার গেল অন্তরীক্ষে
অচিকিৎস্য রোগের হাড়িকাঠে মাথা রেখে, রিকশা চালক ওর চঞ্চল পা দুটো
হারিয়ে হয়ে গেল আরও বেশি সর্বহারা, আর নুলো ভিখির আজও খুঁড়িয়ে
খুঁড়িয়ে দশ টাকার কড়কড়ে নোটের আশায় ভিক্ষা করে বেড়ায় সাত ঘাটে।


বেখাপ্পা লোকটা বারবার দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালায় আর নেভায়, বিড়ি
সিগারেট ধরায় না। সাধ ছিল তার ঐন্দ্রজালিক গালিচায় বসে পা দোলাতে
দোলাতে বিশ্ব ভ্রমণে উঠবে মেতে। দু’চারটি শালিক চড়ুই, কাকাতুয়া মুনিয়া
সঙ্গী হবে ওর আর থাকবে একজন, তামাম দুনিয়ায় যার নেই জুড়ি। প্রসন্ন
ছায়াবীথিতে সেই বিবাহিতা তরুণীর সিঁথিতে হঠাৎ পরিয়ে দেবে সিঁদুর, ইচ্ছে
নাচতো পুষ্ট লোকটার অন্তরে। ফুসমন্তরে ভোলায়নি, হৃৎমন্ত্র শুনিয়ে
সকালসন্ধ্যা প্রণয়ের বন্ধ্যাকালে দিয়েছে ডাক। জানাজানি হলে পাড়ায় ঢিঢি
পড়ে যাবে’ দুজনকেই গিলে খাবে সামাজিক রাক্ষুসে বোয়াল। সংস্কারের
কাঁকড়ার ভয়ে সিঁটিয়ে তরুণী কামনার মায়াবৃক্ষে চড়েনি, সিঁথিতে পরেনি
গোধূলিবেলায় বিয়ে-বিয়ে খেলার সিঁদুর। লোকটার কিছু হলে বিধবার
অপবাদ কী করে সইবে? দুর্বিষহ বিষাদকে পোষ্য নিয়ে পথ চেয়ে থাকে সেই
বিবাহিত-অবিবাহিতা তরুণী, চিরুনি কোলে আলস্য পোহায় এবং সারা শহর
জুড়ে খাপছাড়া লোকটার শুধু টো টো। কোনও বিলাপ নেই, নেই প্রলাপ;
উজাড় বাগানে ফুল ফোটানোর ব্রত ওর, অথচ ওকে কেবলি ঘিরে ধরে কিছু
ভীমরুল। ডাকাবুকো, বিটকেল লোকজন পিছু নেয়, লাগায় চড় চাপড়, দ্যায়
রুক্ষ মাটিতে ঘষটে তার স্বপ্নের মুখ।


বাতি নিভিয়ে শুয়ে যায় সে; কী তাজ্জব, রাতারাতি দু’হাতে গজায় ভৌতিক
ফণিমনসা। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে বিছানায়, নিজের ঘর ক্যাপ্টেন আহারের
কেবিন, মৃত্যুর পদহীন পদচারণায় অতিশয় নিস্তব্ধ। দেয়ালে মরা কুকুরের
নাড়িভূঁড়ি লেপ্টে আছে, একাকীত্বের একাঘ্নি ওর দিকে ধাবমান। হাত নিয়ে
নাজেহাল। মাথার একরাশ চুল শিশু নাগ, ওষুধের বাক্স তোলপাড় করে খায়
ঘুমের বড়ি। বারবার পাশ ফিরে শোয়, দুচোখে তপ্ত শলাকা ঢোকায় কে?
ঘুণপোকায় ধরেছে সত্তা; মূত্রাশয়ে বেরহম জ্বালা, বৃক্ক আক্রান্ত হলো বুঝি।
গলায় নরমুণ্ডের মালা পরে আসে কেউ বসে তার পাশে। ব্লাটিং পেপারে গড়া
মুখ চোখে রক্ত কিডনী ফেলে দিতে হবে মূর্গির বাতিল মাংসের মতো? ফের
কাটাছেঁড়া? বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস। ভোরেও রাত্রির জের, চেতনায় অমানিশার
ঘোর, ভবিষ্য ধুধু মরীচিকা। চোদিক থেকে আগুনের শিখা ধেয়ে আসে,
ছায়াচ্ছন্ন দিশা, তলপেটে হাজার হাজার সুঁচের হামলা, বৃশ্চিকের কামড়; প্রাণ
সামলানো দায়। মাটির তলায় পোকা মাকড়ের অধীর অপেক্ষা। বাঁচার বাসনা
অত্যধিক তৃষ্ণাকাতর মরুচারীর পাথরঘেঁরা পান্থপাদপ। খুনের নেশায়
তলোয়ার মাছ তার সমস্ত শরীর ছিঁড়ে ফেড়ে এঁকে বেঁকে চলে অতলে আর
আহত কত প্রার্থনা করে জীবনের রস। অসুখ এবং ওষুধের কলহান্তে আরেক
সকালে সে বসন্ত বাহার।

এখন পর্যন্ত লেখাটি পড়া হয়েছে ৬১ বার
যদি লেখাটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন