জলেভাসা খড়কুটো কবিতা গুচ্ছ

শঙ্খ ঘোষ শঙ্খ ঘোষ



ঢালু পাড় ভেঙে নেমে আসবার সময়ে
হারিকেন যেখানে জ্বলছিল
থেমে যায় ধর্ম
শিকড়বাকড়েরা নিশ্বাসে নিশ্বাসে কথা বলে ওঠে
যেন কতদিনের জানা
পায়ের সামনে এসে দাঁড়ায় ছইহারা নৌকো
চুপ করে থাকে বৈঠা
এই মাঝির সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমাদের অনেকদিন আগে
অথচ একদিন বুঝবে কথাটার কোনো মানেই নেই।



মনে করার কথা কিছুই আর বলব না
তোমার গাঁথুনি আমার জানা হয়ে গেছে
এই তো? শুধু এইটুকু?
সবচেয়ে ভালো তবু সুপুরিটানের দোহারা দাঁড়ানো
আর রেখাদোলানো এই ছলছলে জলে
কেঁপে ওঠা অবৈধতা।



কেন আমাকে মানতে হবে তোমার নিয়ম?
দুই পাড় ভেঙে
দেখেছি তার মধ্যে বসতি করে মানুষ
কথাও চলে এপার ওপার
চিৎসাঁতার না ডুবসাঁতার
ভালো করে ভাবার আগেই ঝাঁপ দিয়ে পড়ছি
টইটম্বুর জলে।



মেঘনার মতো তার শরীরে আদুল শুয়ে আছি।



জন্ম জন্ম কথা বলে যাব।
নীরবতার মধ্যে জেগে উঠছে ভাপ
কামড়গুলি সব পথে পথে লুটোয়
তার থেকেই জন্ম নেয়, জন্ম নিতে থাকে, সরু সরু ঘাস
আর তার গায়ে হাত বুলাতে বুলোতে
শেষ হয়ে যায় আমার সর্বস্বহারা অপঘাত।



বৃষ্টির শব্দ জানবে তোমার ঘর।
শহরের হেলাফেলা মুছে নিয়ে কতদূর যে ঘুমিয়ে পড়তে পারি
তার চিহ্ন থাকবে এখানে, এইখানে।
তুমিও জানো
কোনো কাজের মধ্যে নেই আমি, অকাজেও না।




গান গাইবার সময়ে তোমার গলার শঙ্খদাগে
যখন ঢেউ লাগে
আর সুরের কালো হাওয়ায় যখন ঘুমিয়ে পড়ে সবাই
নাম-না-জানা দুটোমাত্র তারা ছাড়া আর সবাইকেই যখন ঢেকে নেয় মেঘ
হিম পড়ে ইতিহাসের পাতায়
খোলা ছাতের সেই অন্তরাতে
বোলো, তুমি বোলো।


জলেভাসা খড়কুটো : দ্বিতীয় গুচ্ছ



ভরাট আঙুরের মতো এক-একটা গাঁয়ের নাম।
আমরা এসে পৌঁছলাম নান্দিনায়।
বলিনি তোমার ভালো লাগবে?
কুড়ি কুড়ি বছরের পাড়ি ভেঙে
নতুন পৈঠা
কতদিনের না-বলা নিয়ে বসে থাকবে এখানে
অজচ্ছল ভেসে যেতে যেতে সবাই একদিন ভুলে যাবে
আমরা ছিলাম।



নিমফুলের আলো এসে পড়ছে তোমার ভোরবেলাকার মুখে
কোথায় যাবে সেই ভিনদেশী মানুষ
চায়ের জন্য খুচরো গুনতে গিয়ে যার হাত থেকে
খসে পড়ে বটচারা
আর ধুলোয় নিচু হয়ে যে দেখতে পায়
তোমার মুখের আদলে ভরে গিয়েছে গোটা দেশ।

১০

যদি আমিই না দেখতে পাই কে আর বলবে তোমার কথা।
ওই বৃন্তের প্রস্ফুরণে
চুমুক দিয়েছিল অন্ধকার
আর তার থেকেই পাকে পাকে ভেঙে যাচ্ছিল বাঁধ
পিচ্ছিলতার দিকে গড়িয়ে যাবার আগে
আমার চোখেমুখে তোমার মসৃণ পাটক্ষেত।

১১

আর তাছাড়া, ওরা বলছিল
ভালোবাসা কথাটার গায়ে ঝুলে আছে মৌচাক।

১২

কথাটা ঠিক তা নয়, বলতে গিয়ে ভুলে গেলাম।
আলে-থেমে-থাকা জল থেকে ছেলেমেয়েরা খুঁটে তুলছিল মাছের কণা
তাদের মুখের প্রতিবিম্বে
একলহমা থমকে গিয়েছিল সর্বনাশ
আর, যদিও তুমি কোথাও ছিলে না
আমার আঙুলে এসে কেঁপে যাচ্ছিল তোমার নক্তক্ষত আঙুল।

১৩

শহরের কামড় আমার ঘাড়ে
চোখের ঢালুতে কালো দাগেরও মানে আছে
পাঁজরগুলি নরম হয়ে আসছিল যেন খসেপড়া পালক।
তাহলে তো তোমার কথাই সত্যি হলো
আর আমিও যে জানি না তা নয়
মটরদানায় ভিজে ঠোঁট রেখে
শুয়ে থাকতে থাকতেই শরীর কুয়াশা হয়ে গেল।

১৪

ওই ভুরু, ক্ষীণ পক্ষ্মপাত
এতদিন পরে এই দ্বাদশীতে এলে
তুমি এলে
শূন্য থেকে শূন্যে ঝরে রুপোলি প্রপাত।

১৫

না-ই যদি হতো? ধরো, যদি না-ই হতো?
পলিমাটি দিয়ে বানিয়ে তুলছিলাম মুখ
কত অপমানের চিহ্ন, কত ভুলবোঝার
বিন্দু বিন্দু করে গেঁথে দিচ্ছিলাম
তবু ওই মুখ কেবলই জেগে উঠছিল, জেগে থাকছিল
উপকথার মতো
বৃত্তান্ত থেকে বৃত্তান্তে গড়িয়ে যাচ্ছিল
আর তার আবছায়ায়
বোকা হয়ে থাকতে বেশ ভালো লাগছিল আমার।

জলেভাসা খড়কুটো : সপ্তম গুচ্ছ

৪৮

তবে কি সম্পূর্ণ হলো দেখা?
এবারে সম্পূর্ণ হলো দান?
ও-দেশের জলধারা এসে
এ-নদীতে করেছে প্রয়াণ–
তুমি কেন আধখানা প্রেমে
যুবাদের মতো ম্রিয়মাণ?

৪৯

যতদূর পিপাসাতে এ-শরীর সাড়া দিতে পারে
আগুন জ্বালিয়ে যাও ততদূর পাতায় পাতায় তুমি সানুমূলে পাইনের বন।

৫০

রাতের পেয়ালা শেষ হলে
দেবতা ভোরের আলো খান
আঙুল এখনও বিজড়িত
পুতুলে লাগেনি আজও টান
নিঃশেষের কাছে এসে গেলে
অপ্রেমিক প্রেমিকসমান।

৫১

কে তোমার কথা শোনে? তুমিই-বা শোনো কার কথা?
তোমার আমার মধ্যে দু-মহাদেশের নীরবতা।
এখন পর্যন্ত কবিতাটি পড়া হয়েছে ১৪৪ বার
যদি কবিতাটা সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন